মুক্তগদ্যঃ রিয়া চক্রবর্তী
Posted in মুক্তগদ্য
আমি ও আমার পৃথিবী
রিয়া চক্রবর্তী
আমার পৃথিবীর সাথে আমার পথ চলে যে কবে, কিভাবে মনে পড়ে না। হয়তো বাড়ীর অন্য সবার সঙ্গে শুরু হয়েছিল পথ চেনা বা হাঁটা। সে পথ চলতে চলতে সমান্তরাল আর একটা রেখা টেনে আরেকটা পৃথিবী গড়ে নিয়েছিলাম আমি সেই সময় টাও আজ মনে নেই।
এ যেন অন্য এক পৃথিবী, লাল-নীল-সবুজ-হলুদ নানান রঙের সমারোহ। যেখানে আমি নিশ্চিন্তে আমার কল্পনাগুলোকে আমার তুলির ছোঁয়ায় আমার পৃথিবীতে নিয়ে আসতাম। আমার আরেকটা পৃথিবী, যার রং- এর ছোঁয়ায় মুহূর্তে গড়ে ওঠে নতুন বিশ্ব, বরফের গন্ধ মাখা দুধ সাদা সে বিশ্ব জুড়ে শুধু আমি শান্তির ঘুম খুঁজি। খাদ্যের প্রয়োজন এ স্বপ্নের বিশ্বের নেই। রামধনুর রঙে সাজানো আমার পৃথিবীতে হেরে যাওয়া জীবনেরা নির্দ্বিধায় চলে আসে আমার কাছে। এমনকি পলেস্তারা খসে পড়া ছাত, ঘুন ধরা আসবাব, নোনা ধরা ইঁট, হারানো গুপ্তধন, হেরে যাওয়া রাজা, নোনা জলে ভরা রাজ্য, প্রদীপের আলোয় জাগা ঘুম ঘুম চোখের রূপকথা, মেঠোপথ, মুছে যাওয়া জঙ্গল, ধুয়ে যাওয়া ইতিহাস, রাখালের বাঁশী সুর, হেরে যাওয়া ধুলো হয়ে ভুলে যাওয়া সক্কলের অনায়াস আবাস আমার সে পৃথিবীতে। গরাদের আড়ালের বনের রাজা পায় অনন্ত মুক্তির আস্বাদ।
পৃথিবী শব্দটা তাই বড় বেশি জটিল আমার কাছে। আজ এই এখন, বড় বেশি ক্লান্ত আমি এ নীল সবুজ গ্রহতে। আর কথা বলাও কমাতে কমাতে তলানিতে এসেছি। আজকের পৃথিবী একদম অচেনা। এ অচেনা ছবি আমাকে, নাহ, অবাক করে না আর, আজ আমি শুধুই বেঁচে আছি, এ মুখের দেহে প্রাণ নেই, যন্ত্র চলে, যন্ত্র বলে, মন ভোলে, স্বাধীনতা কাড়ে, খুন করে জীবন, ছাই করে স্বপ্ন।
আমি তাই নিজেকে আলাদা করে সরিয়ে নিচ্ছি একটু একটু করে আমার পৃথিবীতে। যে পৃথিবী সাজানো রামধনু রঙে, শরতের শিউলি, বুকে নীল সুমুদ্রের ডাক আর হাতে সোনালি ঈগলের স্বপ্ন। আমার পৃথিবীতে তাই নতুন জঙ্গল গড়ে তুলি, এক নৌকো হারানো জীবন নিয়ে। হারানো সে গ্রাম গড়ি, খড়ের চাল দিয়ে, মাটির নাটমন্দির ঘিরে, বটের ঝুড়ি বুনে, লাল ডুরে শাড়ি-নাকে টালুক টুলুক নোলক পরা এক রত্তি মেয়ের সাথে শ্যাওলা ধরা পুকুরে পায়ের পাতা ডুবিয়ে, শীতল পাটি বিছিয়ে নিয়ে জোনাক জ্বলা সন্ধ্যে হয়ে শাঁখের ডাক শুনি।
এই কল্প বিশ্বের স্বচ্ছ আকাশ জুড়ে প্রতি পদের একা চাঁদ স্বাক্ষী হয় এক পক্ষকাল ধরে। এ তবু অনেক সুন্দর, নির্বিরোধী নির্বিকার নিরুত্তাপ, তাতে না আছে কোন অহংকার, না আছে কোন আস্ফালন, না আছে কোন আকাঙ্খা, না আছে কারো পদানত হয়ে থাকা, অদ্ভুত এক চিরশান্তি ধু ধু করে তুষার শীতল হাওয়াতে। জানি আজও সেই কল্পনার রামধনু রঙে রাঙ্গানো পৃথিবী আমার গড়ে তোলা হয়নি, আমার পৃথিবীতে কোন সীমানা নেই, তাই ঘর গড়ি না। কল্প বিশ্ব জুড়ে অনন্ত আকাশ। তাই এ পরিব্রাজকের গ্রহ থেকে পৃথিবী হয়ে বিশ্ব জুড়ে অবাধ অনায়াস যাতায়াত। সেই বিশ্ব আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বুকের পাঁজরের আনাচ কানাচ ধরে ফুসফুসের হাওয়া কুঠুরিতে; নির্ভেজাল অক্সিজেন।
যে আকাশে আলো জ্বলে প্রতি কৃষ্ণপক্ষে সেই খানে লুকিয়ে রেখেছি আমি আমার স্বপ্নকে- আর রাখা আছে আমার পৃথিবীকে; " আমার আমিকে "।
এই মুক্তগদ্য ভালই লাগল।
ReplyDelete