ছোটগল্প - দময়ন্তী দাশগুপ্ত
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
উত্তরাধিকার
দময়ন্তী দাশগুপ্ত
দ্বিতীয় সন্তানও কোনও পিতৃপরিচয় পাবেনা জেনে শবনম ব্যথাতুর হয়। স্তনভাসানো দুধের মতোই নিরুপায় সে। যে নিরুপায়তা তাকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় দাঁড় করায় শেয়ালদা জগৎ সিনেমার সামনে। আর দশমাসের আয়েষা মায়ের বুকের দুধবিহনে বড় হয় তার দাদিমার কাছে লখনৌয়ে। বাজারে শবনমের নাম গৌরী। রূপযৌবনেও সে আক্ষরিক অর্থেই গৌরী। তার গায়ের রঙ, ত্বকের ঔজ্জ্বল্য কোনও বড় ঘরের মেয়ে-বউকেও হার মানায়।
দেশভাগ-দাঙ্গায় সর্বস্বান্ত হয়েছিল গৌরীর মা রুকসানা। দাঙ্গায় জ্বলে গিয়েছিল তার মরদ, ছেলে আর ঘরদুয়োর। তবু গ্রামের অন্যসব মুসলিম পরিবারের মতো সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যায়নি সে। সেখানে ওর কোনও স্বজন নেই যে দুখের দিনে আশ্রয় দেবে। সাতপুরুষের ভিটে এইখানেই। আর অন্য দেশে গিয়ে পথে নামার থেকে চেনা জায়গায় তা করা ভালো। এক-দুবার আসমান তাকে কলকাতা শহরে নিয়ে এসেছে বেড়াতে। কলকাতা তার একেবারে অচেনা শহর নয়, কিন্তু এই শহরে সে একেবারে অচেনা। একদিন এদেশে শান্তি ফিরে আসবে এই আশায় বোরখা খুলে কোলের মেয়ে শবনমকে নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে আসে সে। দাঙ্গার শহরেও দালালের হাতে পড়ে ঠিক জায়গাতেই পৌঁছে যায়। নাহ্, অন্য কোনকিছু ভাবার মতো অবস্থাই ছিলনা তার। কার্ফিউয়ের শহরে কে তাকে ভিক্ষা দেবে? কে তাকে বিশ্বাস করে ঘরে কাজ দেবে? নিরক্ষর রুকসানার সামনে দুটো পেট চালানোর একটাই উপায় ছিল। রুকসানা নাম বদলে হল রূপবতী। শবনম হল গৌরী। রুকসানা লেখাপড়া না জানলেও তার গানের গলা ছিল ভালো। ছোটবেলায় মা নিজের কাছে বসিয়ে গান শেখাত। মাসীকে সেসব গল্প বলতে বলতে চোখের কোন চিকচিক করে উঠেছিল তার। বর্ষীয়সী মাসি মুখঝামটা দিয়ে বলে উঠেছিল, ‘আদিখ্যেতা’। অথচ দিনে দিনে এই মাসীরই পছন্দের হয়ে ওঠায় বাকীদের ঈর্ষা বাড়ছিল। রূপবতীর ঘরে খদ্দেরের লম্বা লাইন লেগেই থাকত সেইসময়ে।
এইসব অনেক আগের কথা। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গৌরী ভাবে। এই কলকাতা শহরেই তার বেড়ে ওঠা। মা নিজে লেখাপড়া না জানলেও এর ওর পায়ে ধরে মেয়ের কিছুটা লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছিল। বই পড়তে ভালোবাসত গৌরী। ওর দশ বছর বয়সে মায়ের এক বাবুর সঙ্গে লখনৌতে এসে উঠেছিল ওরা। সেখানে খারাপ পাড়ায় না, আলাদা বাড়িতেই রেখেছিল তাদের মা-মেয়েকে। লখনৌতে এসে রূপবতী আবার রুকসানা হয়েছিল, গৌরী শবনম।
বছর পনেরো হলেই নিজের ব্যবসায়ে মেয়েকে নামিয়ে দেয় রুকসানা। অল্প লেখাপড়া জানা, ভালো গাইতে পারে, আর সোমত্ত বয়স – আর দেরী করেনি। সৌখিন বাবুদের নজর কেড়েছিল শবনম। পনেরো বছরের মেয়ে, জীবনের প্রথম পুরুষকে শুধু শরীর নয়, মনও দিয়ে বসেছিল। মায়ের দেওয়া বড়ি খায়নি সে ইচ্ছে করেই। আয়েষা পেটে এসেছিল। সম্পর্কের সেখানেই শেষ।
আয়েষা কয়েক মাসের হলেই আবার তাকে কাজে নামতে বলে রুকসানা। মাকে না বলেই তাই পালিয়ে চলে এসেছিল কলকাতায়, তার নিজের শহরে। আয়েষাকে রেখে আসতে কষ্ট হয়েছিল খুব। কলকাতা অনেক বড় শহর, তার কি একটা কাজ জুটবে না ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য? তখন আয়েষাকে চেয়ে আনবে মায়ের কাছ থেকে। আয়েষাকে আর শরীর বেচতে দেবেনা গৌরী।
পথেই আলাপ হয়েছিল রাকেশের সঙ্গে। বড়লোকের একমাত্র ছেলে রাকেশ। কলকাতায় তাদের মস্ত ব্যবসা। অল্প আলাপেই রাকেশ বুঝে যায় মেয়েটি একা। আর রাকেশের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গৌরী বলে ফেলে কলকাতা শহরে তার একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই আর কাজের খুব দরকার। রাকেশের কাছে নিজের নাম গৌরী বলেই পরিচয় দেয় শবনম। কলকাতায় পৌঁছে ট্যাক্সি করে গৌরীকে নিয়ে একটা ছোট হোটেলে তোলে রাকেশ। গৌরী তার পেশার কথা রাকেশকে বলেনি। বলেছে বাড়িতে বিয়ে দিয়ে দেবে বলায় পালিয়ে এসেছে, বিয়ে করতে চায় না সে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। হোটেলের ঘরে তাকে পৌঁছে দিয়ে রাকেশ বলে, ‘আপাতত কিছুদিন এখানে থাক। তোমার জন্য ঘর আর কাজ দেখছি। এত ছোট মেয়ে, কি কাজ করবে তুমি?’ ক্লাস এইট পাসের সার্টিফিকেট ছোট ট্রাঙ্ক থেকে বার করে রাকেশের হাতে দেয় –‘দেখুন, এই দিয়ে যা জোটে’। গৌরী রায়ের সার্টিফিকেটটা উল্টেপাল্টে দেখে নিজের কাছেই রেখে দেয় রাকেশ। রাকেশ বেরিয়ে গেলে হোটেলের বয় এসে ওর খাবার দিয়ে যায় ডেকে। সবদিকে রাকেশের খেয়াল আছে দেখে পনেরো বছরের গৌরী সেদিন আরোই মুগ্ধ হয়েছিল।
এইসবও বেশ কিছুদিন আগের কথা। হোটেল ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে এনে রেখেছিল তাকে রাকেশ। কাজ জুটিয়ে দিতে পারেনি, কিন্তু ফেরত দেয়নি সার্টিফিকেটটাও। অনেকদিন তাগাদা দিয়েও গৌরী এর কোনওটাই পায়নি। রাকেশ ওকে নাকি ভালোবেসেছিল। রাকেশের প্রথম ভালোবাসা! রাকেশ ওর শরীরে প্রথম হাত রাখলে ও কেঁপে উঠেছিল। তবে কি ও আবার প্রেমে পড়েছিল? রাকেশ ওকে বিয়ে করবে বলেছিল। আর তাই রাকেশের শরীরে শরীর মেশাতে মেশাতে ও বলে ফেলেছিল ওর পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা। পূর্ব অভিজ্ঞতা না পূর্ব জন্ম? সেই মুহূর্তে তো ওর সবই পূর্ব জন্ম বলে মনে হয়েছিল। গৌরী তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চেয়েছিল। রাকেশের কোনও তাড়া ছিলনা। বিয়ের অথবা গৌরীর চাকরির। অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল রাকেশ, অনেক। রাকেশের দৌলতেই ওর গলায় রূপোর হার, হাতে চারগাছা রূপোর চুড়ি। বাপের ব্যবসায় ঢুকলে সোনার গয়না গড়িয়ে দেবে বলেছিল। রাকেশকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমাকে বিয়ে করলে আপনার বাবা-মা মানবেন তো? রাকেশ আশ্বাস দিয়েছিল, না মানলে আলাদা থাকব। একটাই তো ছেলে, না মেনে কতদিন থাকবে? রাকেশের সঙ্গে কাটানো কয়েকমাসকে কেমন স্বপ্নের মতো লাগে তার। এক-দু রাতের জন্য বেড়াতে যাওয়া, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাড়াকাড়ি করে ফুচকা খাওয়া, সবই। কিন্তু সেইসবও বোধহয় আর জন্মের কথা। অথবা অন্য জন্মের। কতবার জন্ম হয়েছে তার? আর কতবার হবে কে জানে!
অতএব অনিবার্যভাবে গর্ভবতী রাকেশকে তার পিতৃত্বের সংবাদ দিলে সে আর এ বাড়িতে আসে না। গৌরীর সার্টিফিকেটখানা রাকেশের কাছেই রয়ে যায়। গৌরী ভাবে, সত্যিই তো তাকে চাকরিই দিয়েছিল রাকেশ। তার আর ওই সার্টিফিকেটের কোনও প্রয়োজন নেই। সার্টিফিকেট ছাড়াই সে কাজ জুটে যাবে তার। বাড়িওলার তাগাদায় শেষপর্যন্ত আবার তৃতীয় পুরুষের হাত ধরে ভেসে পড়ে গৌরী। সেও মাস চারেক হল। এবারে আর প্রেমে নয়, প্রেমহীনতায় নিজের একমাত্র মূলধন শরীর নিয়ে মায়ের মতোই পথে নামে সে। হাতবদল হতে হতে শেয়ালদা প্ল্যাটফর্মের কাছে এক ঝুপড়ি তার ঠিকানা এখন। ভরভরন্ত শরীর নিয়েও রোজ শেয়ালদা জগত সিনেমার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর বাবুদের সঙ্গে ট্যাক্সিতে অথবা রেস্টুরেন্টে। যে দু-একজনের সঙ্গে হোটেলের ঘরে গিয়ে ওঠে, তাদের বলে, ‘বাবু একটু সাবধানে করবেন’। শেষ রাত্তিরে নিজের পেটের ভেতর নড়াচড়া বুঝতে বুঝতে তলপেটে হাত বুলিয়ে বলে, তোকে আর আয়েষাকে আমি আর এপথে আসতে দেবনা। তোদের আমি লেখাপড়া শেখাব। মানুষ করব।
প্রথম দুমাস ওই বাড়িতেই পড়ে ছিল সে। ভেবেছিল রাকেশ যদি ফিরে আসে। একবার তার পা ধরে বলবে পেটেরটার জন্য থেকে যেতে। তার সন্তানের একটা পরিচয়, বাপের নাম। কালীঘাটে গিয়ে মাথায় সিঁদুর দিয়ে আসবে সে। অথচ এই দুমাসে সে উপলব্ধি করেছিল রাকেশ তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মানুষ। যাকে সে নিজের সব কথা বিশ্বাস করে বলেছে, এমন কী আয়েষার কথাও, যাকে সে সবথেকে বেশি ভালোবেসেছে, তার নামটুকু ছাড়া আর কিছুই জানেনা। রাকেশের ঠিকানা, বাবার নাম, ফোন নম্বর, কিচ্ছু না। কিছুই সে চায়নি রাকেশের কাছে এক বিশ্বাস আর ভালোবাসা ছাড়া। অথবা রাকেশ ওকে কিছুই দেয়নি, কিচ্ছু না। পুরোনো একটা স্টুডিওতে তোলা তার আর রাকেশের ছবি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় সে। কেউ চিনতে পারেনা, কেউ না। খিদেতে ওর মাথা ঘুরে ওঠে, গা গোলায়।
এভাবে আর চলেনা, শরীর দেয়না। বস্তির পাট চুকিয়ে ছোটবেলার পুরোনো পাড়ায় ফিরে আসে গৌরী। মাসীর আরও বয়স বেড়ে গেছে। কিন্তু ওকে দেখে খুশি হয়। বলে, ‘তোর মায়ের থেকে তোর চেহারা তো আরও ঢঙের রে ছুঁড়ি, এর মধ্যেই পেট বাঁধিয়েও বসেছিস?’ এখানে তার আশ্রয় জুটেছে, আবার মাথার ওপর ছাদ, পায়ের তলার মাটি। মাসীই ওর গার্জিয়েন। ঘরে লোক ঢুকিয়ে তাকে শাসিয়েও রাখে, ‘সাবধানে কোরো বাপু, ও তো আর পালিয়ে যাচ্ছেনি, বিইয়ে নিক আগে’। ওর কাছেও মায়ের মতোই লাইন পড়ে। মাসীর শাসনে তারা অন্য ঘরে ঢুকে যায়। এই পাড়াটাও কিছুটা বদলে গেছে। কারো কারো ঘরে সাদা-কালো টিভি চলে। অমিতাভের হিন্দি সিনেমা হলে এলে ওরা দলবেঁধে দেখতে যায়। গৌরী ভাবে, আর কয়েক বছর যাক, একটু টাকা জমিয়ে নিই, আয়েষাকে এনে ভর্তি করে দেব সুধা দিদি-বেলা দিদিদের ইস্কুলে। তিনটে পেট চলে যাবে ঠিক। ছোটবেলায় সন্ধ্যের সময় যখন মায়ের ঘরে বাবুরা আসত তখন ও কোথায় যাবে ভেবে পেতনা। ওর মতো অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মাসীর ঘরে গিয়ে বসে থাকত। কী কষ্টের সময় ছিল। ওখানেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। শেষরাতে মা যে কখন এসে কোলে করে নিয়ে গিয়ে খাটে শুইয়ে দিত বুঝতেও পারতনা। একটু বেলায় ঘুম ভাঙলে পাশে ঘুমন্ত মায়ের মুখটা দেখে ভারী ভালোলাগত ওর, মায়ের জন্য কেমন একটা মায়া হত যেন। কবেই যেন ওর ছেলেবেলার সেই গ্রামের বাড়ির মা হারিয়ে গিয়েছিল ওর স্মৃতি থেকে। ঘুমন্ত মায়ের মুখে সেই মাকে খুঁজে বেড়াত সে।
এখন রোজ সন্ধেয় মাসীর ঘরের পাশের ঘরে সুধা দিদি-বেলা দিদিদের ইস্কুল বসে। বাচ্চারা দুলে দুলে নামতা পড়ে, যোগ-বিয়োগ, ইংরেজি-বাংলা শেখে। আর দিনের বেলায় ওখানেই ওদের মতো মেয়েদেরও লেখাপড়া শেখায়। আরও কত কথা বলে, বাবুদের কন্ডোম ব্যবহার করতে বাধ্য করতে হবে, নাহলে শুধু যে বাচ্চা হবে তাইনা, শক্ত অসুখও হতে পারে। পোস্টাফিসে টাকা জমানোর কথা বলে, তাহলে নাকি টাকা বাড়বে! একটা কথা গৌরীর খুব ভালোলেগেছে। সুধা দিদি বলেছে ওরা নাকি খানকি নয়, ওরা শ্রমিক, নিজেদের শ্রম বেচে খায়। শ্রমিক শব্দটার গায়ে একটা ঘামের গন্ধ আছে যেটা বাবু শব্দের সুগন্ধীর চেয়ে ভালো। বই পড়তে ও ছোট থেকেই ভালোবাসত। লেখাপড়া করা জীবনটা ওকে টানে। রাকেশের হাত ধরে সেই জীবনেরই স্বপ্ন দেখেছিল সে। এখন আবার দেখে সুধা দিদি-বেলা দিদিদের চোখ দিয়ে। ওদের ফরসা কাপড়জামায় কোথাও সুগন্ধ লেগে থাকেনা, ঘামের গন্ধ, শ্রমের গন্ধ লেগে থাকে যেন। আর কেউ পায় কি? কে জানে! ও তো সবসময় নানারকম মানুষের মধ্যে নানারকম গন্ধ পায়। কেবল বিশ্বাসের গন্ধটা কেমন হয় তা ওর জানা হয়ে ওঠেনি।
এভাবে রাকেশের সঙ্গে কোনদিন দেখা হয়ে যাবে ঠিক ভাবেনি গৌরী। পুজোর আর বেশি দেরী নেই। কেনাকাটা করতে হাটে গিয়েছিল সে। মায়ের জন্য, নিজের জন্য, আয়েষার জন্য। মাসীকেও একটা শাড়ি দেবে, হোক ব্যবসা, বিপদের দিনে সেই তো মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই দিয়েছিল। মাকে চিঠি লিখে সব জানিয়েছে, আর গোপন করার কিছুই নেই তার। তবে রাকেশের কথা জানায়নি। আবার পেটে ধরেছে শুনে খুব রেগে গেছে মা। বলেছে মাসীর কথা শুনে চলতে। আয়েষা ভালো আছে, তার আয়েষা, কথা ফুটেছে নাকি তার। খান্নার হাট থেকে কেনাকাটা করে হাতিবাগানের ভীড় ঠেলে ফেরার সময় কিনে ফেলে বেলোয়াড়ি চুড়ি, রঙিন ফিতে, মালা। এই ভিড়ের মধ্যেই তার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল মেয়েটির। ফর্সা করে লাল শাড়ি পরা অল্পবয়সী অনভ্যস্ত হাতে ঘোমটা টানা মেয়েটা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আহা লাগল দিদি?’ দেখে মনে হয়েছিল সদ্য বিবাহিত। সারা গায়ে গয়না, চোখে ধ্যাবড়া করে কাজল টানা, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ, সিঁথির সিঁদুর কিছুটা নেমে এসে কপালের ঘামে মিশেছে। মেয়েটাকে কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই চেনা গলায় ডাকটা শুনতে পেল, ‘অপর্ণা, এদিকে এস, ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে’। মুখ তুলে মানুষটাকেও দেখতে পেল সে। খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে রাকেশ, অথবা অনেক দূরে। কারণ তাকে দেখতে অথবা চিনতে পারছে না। এইসবই সত্যি হতে পারে এমন যে সে কখনও ভাবেনি তা নয়। তবু যেন এক মুহূর্তের জন্য জগতটা শূন্য হয়ে গেল তার কাছে। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। ভীড়ের ধাক্কায় চমক ফিরল তার। চোখে জল এল। অসহায় লাগল। সে কি করতে পারে? দৌড়ে গিয়ে রাকেশকে বলবে? কী বলবে? সে তো সবকিছুই জানে। কে শুনবে তার কথা? বাজারের মেয়েছেলের কথা? এমন তো তাদের হয়, হয়েই থাকে। সে রাকেশের সন্তানের মা। অথচ তার কোনও অধিকার নেই রাকেশের ওপর দাবী জানাবার। পুরুষের সঙ্গে সহবাসই তার জীবিকা। অথচ রাকেশের সঙ্গে সে জীবিকা নির্বাহ করেনি। জীবন চেয়েছিল। যাপনে চেয়েছিল তাকে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি পেয়েই রাকেশের সন্তানকে সে গর্ভে ধারণ করেছিল। পেটের ভেতর বাচ্চাটা আবার নড়ে ওঠে। রাস্তাতেই বসে পড়ে সে। ওয়াক ওঠে। দুপুরের ভাত-তরকারি ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মহিলারা নাক কোঁচকায়। সামনের দোকানের দুটো ছেলে নেমে এসে ওর মুখে-মাথায় জল দিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসিয়ে দেয়। ঢকঢক করে বেশ কিছুটা জল খায় ও। একটি ছেলে বলে ওঠে, ‘এমন অবস্থায় একা বেরিয়েছেন বৌদি, বাড়িতে একটা খবর দেব? কোথায় বাড়ি বলুন, নাহয় রিকশায় তুলে দিচ্ছি।’ ও হাত তুলে আশ্বস্ত করে, না যেতে পারবে সে, ফিরে যেতে।
গৌরী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। প্রথমে কিছুটা এলোমেলো, তারপরে আস্তে আস্তে ধীর সহজ পদক্ষেপে সোজা হয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। তাকে যে এখনও অনেকটা রাস্তা হাঁটতে হবে। নিজের জন্য, আয়েষার জন্য, অনাগত সন্তানের জন্য। অনেকটা পথ একা একাই...।
0 comments: