2

প্রবন্ধ - অমিত ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ



যমের ছেলেবেলা, যমের বড়বেলা
অমিত ভট্টাচার্য *



বাজশ্রবস স্বর্গকামনায় যজ্ঞ করছেন। ঘর ভর্তি আমন্ত্রিত অভ্যাগতরা এসেছেন। যজ্ঞের নাম সর্বস্বদক্ষিণ বিশ্বজিৎ যজ্ঞ। সব দেবার আয়োজন চলছে। কিন্তু নামে তালপুকুর ঘটি ডোবে না। যজ্ঞানুষ্ঠানে দানধ্যানের বহর মোটেই আশাপ্রদ নয়। যারা প্রায় শেষবারের মতো খেয়েছে, পান করেছে এবং যাদের ইন্দ্রিয়গুলো শিথিল হয়েছে, যাদের আর বাছুর হবে না – এমন সব গরুগুলোকে অকাতরে বিলোনো হচ্ছে। যজ্ঞের ফল জন্মান্তরে নথিভুক্ত করে দেওয়া হবে – এই বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ বাজশ্রবস। কেবল মানুষের আনাগোনা, ধন্যি ধন্যি রব। কথকঠাকুর ঋষির বলার ভঙ্গিমায় পাঠক উৎকর্ণ। কেউ কেউ বলেন বাজশ্রবস পূর্বেই সব দান করে রিক্ত হওয়ায় কতিপয় নিরিন্দ্রিয় গরুই অবশিষ্ঠ ছিল এবং হাতের কাছে সেই পড়ে থাকা গরুই বিতরণ করা হচ্ছিল। সুতরাং বাজশ্রবসের মর্যাদা খাটো করার প্রশ্নটি মোটেই সঙ্গত নয়। 

এই পর্যন্ত ভালোই চলছিল। বাদ সাধলেন বাজশ্রবসের পুত্র নচিকেতা। বয়সে কুমার নচিকেতার অন্তরে বিবিদিষা চাড়া মেরে উঠল। দাতার দানসামগ্রী যদি গ্রহীতার ভোগে না লাগে, ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয় তবে দাতা এবং গ্রহীতা উভয়েরই অকল্যাণ। বস্তুত প্রজননসামর্থ্যহীন শীর্ণদেহ গরু কেনই বা স্বর্গকামী পিতা দান করছেন তা ভেবে ভেবে নচিকেতা নিজের অন্তরের থেকে কোন সদুত্তর পেল না। স্বর্গবাসনা-পূরণ যজ্ঞের আনন্দানুষ্ঠানের মধ্যেও নচিকেতার মন বিষণ্ণ, ভারাক্রান্ত। স্বর্গকামী মানুষ কিনা শেষমেশ নিরানন্দময় লোকে গমন করে দুঃখ পাবেন। বয়সটা নিতান্তই কম হলেও নিজের উপলব্ধ সত্যকে পিতার সামনে খোলামনে প্রকাশ করতে নচিকেতা কৃতসঙ্কল্প হল। যজমান বাজশ্রবসের অধোগতি অবধারিত অনুভব করে নচিকেতার নিষ্পাপ কিশোরচিত্ত উদ্বেলিত হল—‘এবম্ভুতাঃ গাঃ ঋত্বিগ্‌ভ্যো দক্ষিণাবুদ্ধ্যা দদৎ প্রযচ্ছন্‌, অনন্দা অনানন্দাঃ অসুখা নাম ইত্যেতদ্‌ যে তে লোকাঃ, তান্‌ স যজমানো গচ্ছতি’ (শা.ভা.ক.উ. ১।১।৩) 

নচিকেতা একবগ্গা । আড়াল থেকে পিতার অনুষ্ঠান-কর্ম সে সবই খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে। পিতার মুখোমুখি হয়ে নিজের অন্তরের জিজ্ঞাসা নিয়ে সে হাজির। ‘কস্মৈ মাং দাস্যতীতি’ আমাকে কাকে দিচ্ছেন? আমি তো আপনার মূল্যবান সম্পত্তি। আমি সবুজ, বয়সে নবীন। আমাকে কোন্‌ ঋত্বিকের উদ্দেশ্যে দক্ষিণারূপে প্রত্যর্পণ করছেন। বিবিদিষু নচিকেতার প্রশ্নে যজ্ঞশালা জুড়ে শোরগোল পড়ে গেল। অনেকের মনে হল, একরত্তি ছেলে কি ডেঁপোরে বাবা ! পংক্তিভোজনের সময় ভরা পেট খেয়ে ফাঁকের দিকে বন্ধুরা মিলে কোথায় ছুটোছুটি করবে, তা না—একঘর আমন্ত্রিতদের মধ্যে পিতাকে পাকা প্রশ্ন—আমাকে কাকে দিচ্ছেন ?

সব বাড়িতে যেমন হয় এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। নিজের স্বর্গকামনা অভিলাষী বাজশ্রবস মুখ তুলেও চাইবার প্রয়োজন অনুভব করলেন না। নচিকেতা নাছোড়বান্দা। যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেঁতুল। প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হল। আজ্ঞে, শুনছেন, আমাকে কাকে দিচ্ছেন? পিতা নিরুত্তর। দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার এই একই কথা ‘দ্বিতীয়ং তৃতীয়ম’। বাজশ্রবস শুনলেন। আহতহৃদয় পিতার ক্রোধাগ্নির সামনেও নচিকেতা অবিচল। বাজশ্রবসের উন্নত কপালে স্বেদবিন্দু। আরক্তনয়ন পিতার মুখমণ্ডলের সামনেও পলায়নহীন পুত্র শান্ত, সরল ও সত্যবদ্ধ।

বাজশ্রবস পুত্রের কানে হাত দিলেন না, গালে সপাটে চড় কষালেন না, পুত্রকে সকলের মধ্যে হাঁটু মুড়ে বসতে বললেন না, বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করার জন্য ধমক দিলেন না, জুলপি ধরেও টানলেন না। এই সবই লঘু অপরাধের শাস্তি বলে তিনি মনে করলেন। বাজশ্রবসের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। তিনি স্ত্রীকে ডাকতে পারতেন, রাগারাগি করতে পারতেন, বখাটে ছেলেটাকে গর্ভে ধারণের জন্য স্ত্রীর নিন্দামন্দ করতে পারতেন। আরও কিছু করতে পারতেন। যেমন ছেলেটাকে পাঁচশ বার ওঠাবসা করাতে পারতেন, উত্তম-মধ্যম দিয়ে ধুলোয় লুটিয়ে দিতে পারতেন। প্রতিবেশীদের সামনে নিজের কপালে বারংবার চপেটাঘাত করে পরিবারের মানমর্যাদা মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারতেন। গৃহস্বামী হিসেবে বাজশ্রবসের পক্ষে এসব মোটেই বেমানান হত না।

কিন্তু সকলে শুনলেন ক্রুদ্ধ বাজশ্রবস অবাধ্য পুত্রকে যমের বাড়ি পাঠালেন। ‘মৃত্যবে ত্বা দদামি’। বাজশ্রবসের মনে হল পুত্রের অপরাধ অমার্জনীয়। কিশোর বয়সেই পিতার স্বর্গস্বপ্ন চুরমার করে দিতে উদ্যত। নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠান সমাপ্তপ্রায় যজ্ঞে দক্ষিণার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন। অসহ্য। যমের বাড়িই এই উদ্ধত কিশোরের একমাত্র উপযুক্ত স্থান। এরকম পুত্রের মুখদর্শনও পাপ। বয়সে ছোট হলেও এর মধ্যে ছেলেমির বিন্দুবিসর্গ নেই। ‘নায়ং কুমারস্বভাবঃ’ (শা. ভা. ক. উ. ১। ১। ৪)

‘নচিকেতা পরিদেবয়াঞ্চকার’ ভাবতে থাকে। কোন্‌ পরিস্থিতিতে স্বয়ং পিতা পুত্রকে অন্তর থেকে যমালয়ে পাঠাতে চান। নচিকেতা নিজের পারফরম্যান্সের চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করে। সে তো নিম্নমানের মোটেই নয়। অধম, নীচ পুত্রের মৃত্যুকামনা অমূলক নয়। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। কিন্তু বহুজনের মধ্যে উত্তম অথবা মধ্যম হবার দাবিদার যে, তাকে এই ধরনের ভর্ৎসনা! নচিকেতার সিদ্ধান্ত হল, প্রথম জিজ্ঞাসাতেই পিতা নেহাৎ অবহেলার ছলেই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বারংবার একই প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে তিনি ধৈর্যচ্যুত হন এবং শেষে নিতান্ত বিরক্তিবশতই এই কঠোর বাক্য প্রয়োগ করেন ‘নূনং ক্রোধবশাদুক্তবান্‌ পিতা’ (শা. ভা. ক. উ. ১। ১। ৫)

মুখ থমথমে। মুখ ফসকে যা বলে ফেললেন তা বাস্তবে ঘটলে নিজের পায়ে লোকে কুড়ুল মারার অভিযোগে লোকে বাজশ্রবসের দিকে আঙুল তুলবে বৈ কি ! যে আত্মজ পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবে বলে মনে করা হয়, সেই আত্মজকে ইহজগৎ থেকে বিদায়ের আদেশ দিয়ে একরাশ আতঙ্ক নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন বাজশ্রবস। সত্যনিষ্ঠ নচিকেতা পিতার কথা পালনে যত্নবান হল। কথা দিয়ে যায় চেনা। ‘ন চলতি খলু বাক্যং সজ্জনানাং কদাচিৎ’ সুতরাং যেভাবেই হোক উচ্চারিত বাক্যের মর্যাদা রক্ষায় বাজশ্রবস যেন বিন্দুমাত্র বিচলিত না হন। ‘পালয়াত্মনঃ সত্যম্‌’। উচ্চারিত সত্য পালন করাই বিধেয়। কথামতো এবার আমায় যমের বাড়ি চলে যাবার অনুমতি দিন—‘প্রেষয় মাং যমায়’। বিষাদবিধুর বাজশ্রবস পুত্রের কাছে হারলেন। কালের অনুসরণ করে চলেছেন নিজের অজ্ঞাতসারে।

ইহলোক বাসের মেয়াদ উত্তীর্ণ হল। নচিকেতা চললেন যমালয়ে। ঋষি পথের কোন বর্ণনা দেননি। বর্ণিত পথের বিবরণ শুনে আরও অনেকে যে সেই পথে ভীড় করবেন না, তা তো সহজেই অনুমেয়। আপামর জনতা জানেন, যমের সদন মানেই অপারেশন সাইলেন্স। নামোচ্চারণেই পাবলিক শিহরিত হয়, চোখ বন্ধ করে। নচিকেতা ব্যতিক্রমী। বন্ধনমুক্তির অনুমতি নিয়ে কম বয়সেই নতুন ভুবনে যাবার আনন্দে মশগুল। পিতার কাছে অপ্রিয় সত্য বলবার দায়ে নচিকেতা অভিযুক্ত। এই অভিযোগেই যমদর্শনের সুযোগ।

যমের জন্ম ইতিহাসটা ভারি মজার। বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞার সাথে সূর্যের বিবাহ হয়। মার্তণ্ড সূর্যের দোর্দণ্ড তাপ তো বলবার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত সূর্যের দিকে তাকানোই দুষ্কর। সূর্য সংজ্ঞার দিকে তাকালেই সংজ্ঞা নেত্রযুগল বন্ধ করতেন। এদিকে সূর্য গেলেন বেজায় চটে। মুদ্রিতচক্ষু নায়িকার সঙ্গে তো প্রেম চলে না। সূর্যের মনের কন্দরে নায়কোচিত ভাবটি জেগে ওঠে। ‘লোচনৈঃ পীয়মানঃ’ না হলে তো দাম্পত্য প্রেমের কবর খনন হয়। স্বামীকে দেখলেই সংজ্ঞার দু-চোখ জুড়ে আসত। ‘সংজ্ঞা চ রবিনা দৃষ্টা নিমীলয়তি লোচনে’ (মা. পু. ৭৭। ৩)। সূর্য যে কার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করবেন ভেবে পান না। অসন্তুষ্ট সূর্য সংজ্ঞাকে দিলেন অভিশাপ। সূর্য বললেন, যেমন আমায় দেখে নিমীলিত নেত্রে রয়েছো তেমন তোমার গর্ভস্থ সন্তানের নাম শ্রবণেও মর্ত্যের মানুষ মুদ্রিতচক্ষু হবে—

ময়ি দৃষ্টে সদা যস্মাৎ কুরুষে নেত্রসংযমম্‌
তস্মাজ্জনিয্যসে মূঢ়ে প্রজাসংযমনং যমম্‌।। (মা. পু. ৭৭। ৪)

পরিণামে সমগ্র প্রাণিকুলের সংযমনকারী যমের জন্ম হয়েছিল। সূর্যের অভিলাষ ছিল আর পাঁচটা স্ত্রীর মতোই তার স্ত্রীও যেন ‘আঁখো মে আঁখি’ ডালতে জানেন। কিন্তু যমের মা নয়নকোণে পুষ্পধনু বাঁকানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সূর্যের অভিশাপে অভিমান স্পষ্ট। এদিকে সংজ্ঞাও যে দৃষ্টিদানের চেষ্টা করতেন না, তা নয়। তবে তার দীর্ঘশ্বাস ফেলা দেখে অভিযোগের কিছু চলতে পারে না।

দুই পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে সূর্য-সংজ্ঞার সংসার। জ্যেষ্ঠ পুত্র মনু শাস্ত্রানুশীলনে বেশি সময় ব্যয় করে। মনুর অনুজ যম এবং কন্যা যমুনা। যমুনার জন্মকাহিনীও অভিশাপ জর্জরিত। সংজ্ঞা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেন সূর্যকে দু’চোখ ভরে দেখবেন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। স্বামীর উজ্জ্বল তেজে নিজেকে সইয়ে নিতে নিতেও শঙ্কিত সংজ্ঞার চোখ পিটপিট করে ওঠে। সারাদিন ধরে জগৎকে তাপ বিকিরণ করে দিনান্তে একটুকু বিশ্রামের বেলায় যদি পিটপিটমুখী স্ত্রী হাজির হন তবে কারই বা ধৈর্য থাকে। স্ত্রীর চঞ্চল দৃষ্টিতে পুনরায় সূর্য ধৈর্যচ্যুত হন এবং বলেন—তোমার এই চঞ্চল দৃষ্টির জন্যই গর্ভস্থ সন্তান বিলোলা নদীরূপিনী হবে—

যস্মাদ্বিলোলিতা দৃষ্টির্ময়ি দৃষ্টে ত্বয়াধুনা
তস্মাদ্বিলোলাং তনয়াং নদীং ত্বং প্রসবিষ্যসি।। (মা.পু. ৭৭। ৬)

স্বামী, পুত্র, কন্যার ভরা সংসারেও সংজ্ঞা কিন্তু মোটেই ভালো নেই। নিজের ভালো না থাকার জন্য তার সন্তানেরা দায়ী নয়। এর জন্য দায়ী সংজ্ঞা নিজে, না তার স্বামী স্বয়ং সূর্য—তা সংজ্ঞা বুঝে উঠতে পারেননি। তবে সংজ্ঞা এটুকু বুঝেছেন যে, দাম্পত্যসুখের মূল যে অদ্বৈতবোধ, তা সে যতই ক্ষণিকের হোক্‌, সেটিই বড় অভাব তার জীবনে। অত্যন্ত সহজভাবে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেও সংজ্ঞা সূর্যের দিকে স্বাভাবিকভাবে দৃষ্টি দিতে পারেন নি। দৃষ্টিদানের টেনশনেই সংজ্ঞা মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। পুত্রকন্যার কথা ভেবে সংজ্ঞা এতকাল অসহ্য হলেও গৃহত্যাগ করেন নি। বিবাহের পর থেকেই সংজ্ঞার একটিই সমস্যা। সূর্যের সঙ্গে সহাবস্থানই তার অসহ্য লাগে—

সাপি সংজ্ঞা রবেস্তেজঃ সেহে দুঃখেন ভাবিনী।
অসহস্তী চ সা তেজশ্চিন্তয়ামাস বৈ তদা।। (মা.পু. ৭৭। ৮)

অভিশাপ মাথায় নিয়ে সন্তানধারণ কারই বা ভাল লাগে! সংজ্ঞা ভাবতে বসেন, সন্তানদের ছেড়ে তিনি কোথায় যাবেন, ওদের কে দেখভাল করবে, খিদে পেলে ওরা কার কাছেই বা খাবার চাইবে। সংজ্ঞার মন নানা দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত। সকাল থেকেই সূর্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাকেও সন্তানদের দেখভালের জন্য সময় দিতে বলা ব্যর্থ। মনু, যম, যমুনা—কেউ বুঝবে না সংজ্ঞার অন্তরের বেদনাকে। আর তাদের সে বোঝার বয়সও হয়নি। সংজ্ঞার প্রায়ই মনে হয় সূর্যের কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে। সংজ্ঞা মনমরা।

সংজ্ঞা স্বামীকে চটাতেও চান না। উজ্জ্বল পিতৃপরিচয়ের অধিকারিণী সংজ্ঞা অপযশের ভাগী হতে মোটেই ইচ্ছুক নন। এতেই সমস্যা জটিল আকার নিয়েছে। সূর্যকে চটাবোও না অথচ তার থেকে দূরে কোথাও নিজেকে রাখব - তা কিভাবেইবা সম্ভব ! কি করি, কোথায় যাই, কোথায় গেলে সমস্যা দূর হবে, অথচ উনিও রাগবেন না—এই সব কিছুই সংজ্ঞার অন্তরটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে—

কিং করোমি ক্ক গচ্ছামি ক্ক গতায়াশ্চ নির্বৃতিঃ।
ভবেন্মম কথং ভর্তা কোপমর্কশ্চ নেষ্যতি।। (মা.পু. ৭৭। ৯)

চিন্তায় চিন্তায় সংজ্ঞার দুচোখের পাতা যখন আর এক হয় না, তখন তিনি স্থির করেই ফেললেন পিত্রালয়ে যাবেন। পিতাকে গিয়ে নিজের অসুবিধার কথা বলার চেষ্টা করবেন।

এদিকে যাবো বললেই তো যাওয়া যায় না। সংসারের একটা দায়িত্ব আছে বৈ কি? ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্ব, সূর্যের চাহিদা পূরণের দায়িত্ব। বুদ্ধিমতী সংজ্ঞার মাথায় চটজলদি একটা প্ল্যান এসে গেল এবং সেটিকে তিনি অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় বাস্তবায়িতও করলেন। প্রবল আবেগ-তাড়িত সংজ্ঞা নিজেরই দেহ থেকে অবিকল একই রকম সূর্যের প্রিয়তমা ছায়াময় তনু নির্মাণ করলেন। বিশ্বকর্মার কন্যা হওয়ার সুবাদে সংজ্ঞাও নির্মাণকার্যে কম যান না। সৃষ্টি হল ছায়াসংজ্ঞা। একরকম নাক, একরকম চোখ, হাঁটাচলা, ওঠাবসা সবই এক (নকল সংজ্ঞা, Dummy !) ছায়াসংজ্ঞার সাথে কথা হল।

সংজ্ঞা ছায়াকে জানালেন তার অন্তরের অভিপ্রায়। ছায়াকে সংসারের ভার দিয়ে তিনি চলে যেতে চান পিত্রালয়ে। ছায়াকে সংজ্ঞা দীর্ঘক্ষণ ধরে দায়দায়িত্ব বোঝাতে থাকলেন। মনু, যম, যমুনাকে মায়ের মতনই যত্ন করতে হবে, বাড়ির সব প্রয়োজনের দিকে অতন্দ্র দৃষ্টি রাখতে হবে এবং সর্বোপরি সূর্য যেন ঘুণাক্ষরেও তার এই প্ল্যানের বিষয়ে কিচ্ছুটি জানতে না পারেন। সূর্য বাড়িতে ফিরে যখন যেটি বলতে চাইবেন তখন সেটি তৎক্ষণাৎ নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে ছায়া যেন সম্পন্ন করেন। কেবল সূর্যই নয়, ছেলেমেয়েরাও যেন সংজ্ঞার বিষয়ে কিছুই না জানতে পারে। ছায়াসংজ্ঞা উপলব্ধি করেন তার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব মোটেই সোজা নয়। বেশ কঠিন।

দায়িত্বের বোঝা নিয়ে ছায়ার মনে যে শঙ্কা আছে তা আগাম অনুমান করলেন সংজ্ঞা। তিনি ছায়াকে প্রলুব্ধ করলেন। সংজ্ঞা বললেন, আজ থেকে সম্পূর্ণ বাড়িটাই তোমার। আমি যেমন এই বাড়িতে থেকেছি, মর্যাদা পেয়েছি, তুমিও তেমনভাবেই থাকবে, মর্যাদা পাবে। শুধুমাত্র একটাই জিনিস মনে রেখো, আমার সঙ্গে আচরণে তারতম্য আনবে না। সূর্য যেন আমার অভাব না বুঝতে পারেন—

তাঞ্চোবাচ ত্বয়া বেশ্মন্যত্র ভানোর্যথা ময়া।
তথা সম্যগপত্যেষু বর্তিতব্যং তথা রবৌ।।
পৃষ্টয়াপি ন বাচ্যং তে তথৈতদ্‌গমনং মম।
সৈবাস্মি নাম সংজ্ঞেতি বাচ্যমেতৎ সদা বচঃ।। (মা.পু. ৭৭। ১২-১৩)

ছায়া অনুভব করলেন তার কাজটা হুবহু সম্পন্ন করতে বেশ বেগ পেতে হবে। প্রতিমুহূর্তেই সূর্যের কাছে ধরা যাবার ভয় তো আছেই। প্লাস শিশু-পুত্রকন্যার নজরদারি।

ছায়াসংজ্ঞা অবস্থা পর্যালোচনা করে শর্তাধীনে রাজি হলেন। আসলে প্রকৃত ঘটনা জানাজানি হলে যে চড়থাপ্পড় খেতে হতে পারে বা অভিশম্পাত বর্ষিত হতে পারে, ছায়ার সেটি বোঝার মত বুদ্ধি ছিল। এজন্য ছায়া সংজ্ঞাকে জানান যে—শাপ ও কেশাকর্ষণ যতদিন না হয় ততদিন সে প্রদত্ত আদেশ যথাযথভাবে পালন করবে। ঐ দুটিকে ছায়ার বড্ড ভয়—

আ কেশগ্রহণাদ্দেবি আ শাপাচ্চ বচস্তব।
করিষ্যে কথয়িষ্যাম বৃত্তন্তু শাপকর্ষণাৎ।। (মা.পু. ৭৭। ১৪)

ছায়া জালালেন পুরুষ কর্তৃক মেয়েদের প্রহারের কুদৃশ্য এবং শাপ-শাপান্ত মোটেই সহ্য করা যায় না। এই দুটির কোনওটি ঘটলে ছায়া যে সব প্রকৃত ঘটনা ফাঁস করে দেবেন, তা জানিয়ে দিলেন। সংজ্ঞা জানতে চাইলেন, ছায়ার আর কোন শর্ত রয়েছে কি-না। থাকলে সে যে তা প্রাণ খুলে নির্ভয়ে বলতে পারে, তাও জানিয়ে দেওয়া হল। সংজ্ঞার আন্তরিকতায় ছায়া সূর্যের সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন।

সংজ্ঞার আনন্দ আর ধরে না। সূর্যের অসহ্য তেজের মুখোমুখি হতে হবে না ভেবেই তিনি আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন। এতো চটপট ছায়াকে রাজি করানো যাবে তিনি ভাবতেই পারেন নি। সংজ্ঞার মনে হয়েছিল ছায়া কৌতুহলী হবেন, নানান প্রশ্নাবলীতে তাকে জর্জরিত করবেন বা উপদেশের ছলে বলে বসবেন—এই ধরণের চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে তিনি যেন পুনর্বিবেচনা করেন ইত্যাদি, ইত্যাদি। অথবা নিজে না হলেও লোক মারফৎ প্রকৃত ঘটনা সংজ্ঞা বিশ্বকর্মাকে জানিয়েছেন কি-না, প্রভৃতি। কিন্তু ছায়া পরিপ্রশ্ন না করায় সংজ্ঞা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সংজ্ঞার অন্তরাত্মা খুশিতে ডগমগ। নিজের বৈবাহিক জীবনে চোখে চোখে যে এতো যন্ত্রণা পেতে হবে তা কে জানত। জানা থাকলে সংজ্ঞা কখনও বিবাহে সম্মতিই দিতেন না।

দীর্ঘকাল বাদে কন্যাকে পিত্রালয়ে পেয়ে বিশ্বকর্মা আহ্লাদে আটখানা। সংজ্ঞা চাপা-প্রকৃতির। পিতাকে কিছুই জানালেন না, জানাতে পারলেন না। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কুশল বিনিময় করে সানন্দে বেশ কিছুদিন পিত্রালয়ে কাটিয়ে দিলেন। দিন যায়। একদিন সাগ্রহে কন্যাকে ডেকে বিশ্বকর্মা বললেন—সংজ্ঞা যতদিন তার নিবাসে থাকবে তিনি খুশী হবেন। কন্যার দীর্ঘকাল অবস্থানও পিতার কাছে ক্ষণিকের মনে হয়। সব পিতাই কন্যার আগমনে উদ্বেলিত হয়ে থাকেন। কিন্তু বিবাহের পর স্বামী, সন্তানকে ছেড়ে পিত্রালয়ে কন্যার দীর্ঘকাল অবস্থান মোটেই সুখকর নয়। বিশ্বকর্মা কথায় কথায় জামাতার কুশল সংবাদ নিয়েছেন। আদরের মনু, যম, যমুনার নিষ্পাপ কচি মুখগুলোর কথা মনে করেছেন। কোন্‌ পিতা না চায়, মেয়ের সঙ্গে নাতি, নাতনিরাও আসবে, হৈ-হল্লা করবে। ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে দৌড়ে এসে আবদার করবে, একের বিরুদ্ধে অপরে নালিশ জানাবে। অভিজ্ঞ বিশ্বকর্মা সংজ্ঞার মনে কোন আঘাত না দিয়ে শাস্ত্র, সাহিত্য থেকে পর্যাপ্ত উদাহরণ দিলেন। অবশেষে প্রতিবেশীদের কানাকানির প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। বিশ্বকর্মার মতে বেশির ভাগ প্রতিবেশীদের পরচর্চা হল প্রমোদ উপকরণ। সংজ্ঞার এতোদিন পিত্রালয়ে উপস্থিতিতে তারা নিশ্চয়ই খারাপ গন্ধ পাচ্ছেন। তাদের মুখ তো বন্ধ করবার কোন রাস্তা নেই। সুতরাং কন্যার আগমনে তিনি খুশী হলেও বর্তমানে সংজ্ঞা যেন স্বামী, সন্তানের কাছে প্রত্যাবর্তন করে। সংজ্ঞার পুনরাগমনের আশা নিয়ে তিনি বসে থাকবেন।

পিতৃগেহে চিরং কালং বস্তুং নার্হসি পুত্রিকে।
সা ত্বং ভর্তৃগৃহং গচ্ছ তুষ্টোহহং পূজিতাসি মে।
পুনারাগমনং কার্যং দর্শনায় শুভে মম।। (মা.পু. ৭৭। ২০-২১)

সংজ্ঞা পিত্রালয় থেকে বাইরে এলেন। নিজের সংসারে প্রত্যাবর্তনের কথা ভাবতেই পারছে না। পুনরায় ‘কিং করোমি ক্ক গচ্ছামি’ অবস্থা। স্থির করলেন সংসার থেকে, পিত্রালয় থেকে দূরে ভিন্ন প্রদেশে তপস্যায় বসবেন। লক্ষ্য হল, পতির উগ্র তেজ নিবারণ।

এদিকে ছায়াসংজ্ঞা সূর্যের সংসার ভালোই সামলাচ্ছেন। সংজ্ঞাকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। সূর্য ডামিসংজ্ঞাকে নিয়েই ঘর করেন, মানুষটিকে বোঝারই উপায় নেই। এই ছায়াসংজ্ঞার গর্ভেও দুই পুত্র ও এক কন্যার জন্ম হল—‘জনয়ামাস তনয়ৌ কন্যাঞ্চৈকাং মনোরমাম্‌ (মা.পু. ৭৭। ২৪)। এই পর্যন্ত ভালোই চলছিল। কিন্তু অনিষ্ট এল আত্ম-পর বোধ থেকে নিজের সন্তানদের বড় হওয়ার সাথে সাথেই সংজ্ঞার গর্ভজাত মনু, যম, যমুনা উপেক্ষিত হতে লাগল।

টিফিনের সময় টিফিন নেই, একসাথে খেতে বসা নেই। সামান্য ছোটখাট জিনিসের বেলায়ও তারতম্য। শেষ অবধি ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতন হয়। সংজ্ঞার তিন সন্তানের মধ্যে মনু সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। বাড়ির কোনও ব্যাপারেই তার মাথাব্যথা কোনকালেই নেই। কেবল নিজের অধ্যায়ন নিয়েই সে থাকে। কি খাওয়া হল, কোথায় বেড়াতে যাওয়া হবে, একই পঙ্‌ক্তিতে কেন সবাই বসে খাবার খায় না, একই বাড়িতে কেউ কেউ বেশি পাচ্ছে কেন, ভালো খাবার বন্টনে বৈষম্য কেন-এসব প্রশ্ন তার চিন্তাতেই আসে না। যমুনাও যেন সর্বংসহা পৃথিবী। কোনও প্রতিবাদ নেই। দধির ওপরটা, ঘোলের শেষটা না পেয়েও অসন্তোষ প্রকাশ তার প্রকৃতিবিরুদ্ধ। ফলে মনু এবং যমুনাকে নিয়ে ছায়াসংজ্ঞার কোনও রকম অসুবিধে হচ্ছিল না। একদল বুকের, একদল পিঠের করে ছায়াসংজ্ঞা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

ছায়াসংজ্ঞা ত্বপত্যেষু যথা স্বেষ্বতিবৎসলা।
তথা ন সংজ্ঞাকন্যায়াং পুত্রয়োশ্চন্ববর্তত।। (মা.পু. ৭৭। ২৫)

বাদ সাধে যম। ছেলেবেলা থেকেই যম পক্ষপাত-বিরোধী। বৈষম্য তার চক্ষুশূল। বহু বই পড়া বড় ভাইকে সে একেক জনের একেক রকম বিশেষ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজের মতামত সুযোগ পেলেই জানিয়ে দেয়। যমের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খা পিতার মত বড় হলে সে অবশ্য সকলের জন্য সমান ব্যবস্থার প্রবর্তন করবে। পিতা সূর্যের পক্ষপাতহীন আচরণটি তার সবচেয়ে ভালো লাগে। মায়ের আচরণের পরিবর্তন যম কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করে চলেছে। বাড়িতে পিতার দীর্ঘক্ষণ অনুপস্থিতির সুযোগে ভাই-বোনেদের মধ্যে স্বতন্ত্র ব্যবস্থার মাত্রা একেক সময় বড্ড বেশি প্রকট হচ্ছে। পিতার কাছে এখনও পর্যন্ত নালিশ না জানালেও বড় ভাই মনুকে নিজের অভযোগ বহুবার যম জানিয়েছে। ধীরে ধীরে কিশোর যম নিজের স্বভাবকে অনুসরণ করতে থাকে। অবহেলিত যম নিজের স্বাধীন মতপ্রকাশে ইতস্তত করে না । বরং বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজের কর্তব্য নিয়ে অগ্রসর হবার জন্য দৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ করে। শৈশব থেকেই বঞ্চনার শিকার যম প্রতিবাদী হয়ে উঠতে থাকে।

অবশেষে প্রতিবাদ একদিন চরম আকার নেয়। অভিমানী যম নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। লেখাপড়া জানা মানুষ কেন যে অন্যায়কে, বঞ্চনাকে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেও চুপ করে থাকে, যম তার উত্তর খুঁজে পায় না। বড় ভাইয়ের ওপর একারণে তার ক্ষোভও কম নয়। মায়ের বৈষম্যমূলক আচরণের নমুনা মনুর সামনে সে অনেকবার রেখেছে। মনু শুনেছে, অথচ কোন সদর্থক ব্যবস্থা নিজে নেয়নি এবং নেবার পরামর্শও দেয়নি। ‘মনুস্তৎক্ষান্তবানস্যা যমস্তস্যা না চক্ষমে’ (মা.পু. ৭৭। ২-৬)।

ধৈর্যচ্যুত যম মাকে পদাঘাতে উদ্যত হল। ‘তাড়নায় চ বৈ কোপাৎ পাদস্তেন সমুদ্যতঃ(মা.পু. ৭৭। ২৭)। আর যায় কোথা! গর্জনে হুঙ্কারে ছায়াসংজ্ঞা সারা বাড়ি কাঁপিয়ে তুললেন। উত্তেজিত ছায়াসংজ্ঞা আঙুল তুলে তারস্বরে যমকে ধমক দিতে লাগলেন। ক্রোধে আরক্ত নয়না ছায়াসংজ্ঞা বললেন, পিতার পত্নীকে অমর্যাদা! যে পদ আমার ওপর ব্যবহার করতে তৎপর হয়েছিলে আজই তোমার সেই পদটি পৃথিবীতে পতিত হোক। পাণিপল্লবের আন্দোলন, শাপপ্রদান, তিরস্কার সবই অলাতচক্রন্যায়ে এতো দ্রুত ঘটে যাবে যম কল্পনাও করতে পারে নি। ভয়াতুর যমের ‘সীদন্তি গাত্রাণি, মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি’।

ত্রস্ত যম পিতা সূর্যের পাশে গিয়ে করজোড়ে দাঁড়িয়ে রইল। সমস্ত ঘটনার অনুপুঙ্ক্ষ বিবরণ দেবার জন্য যম যেন দীর্ঘকাল প্রস্তুতি নিয়েছিল। পিতার সামনে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে যম আজ হাল্কা হতে চায়। যমের বক্তব্যের সার কথা হল, বড় ভায়ের কাছে, মায়েদের সম্বন্ধে সে অনেক মহৎ কথা শুনেছে। যেমন কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনও নয়, ইত্যাদি। কিন্তু মনু-কথিত বাণীর সঙ্গে তার মায়ের সে কোন মিল খুঁজে পায় না—

যথা মনুর্মামাচষ্টে নেয়ং মাতা তথা মম।
বিগুনেষ্বপি পুত্রেষু ন মাথা বিগুণা ভবেৎ।। (মা.পু. ৭৭। ৩২)

যম বলে চলে—কোন মা তার স্বভাবসুন্দর বাৎসল্যকে বিসর্জন দিয়ে পুত্রকে শাপ দেন—এমন আশ্চর্য কথা কখনও শোনা যায়নি। পুত্র, কন্যার হাজারো অপরাধ মা মার্জনা করে দেন। তিনি কখনও সন্তানের প্রতি বিরূপা হন না। সত্য উন্মোচনে বদ্ধপরিকর যম কেবল যথাযথ বিবিরণটুকুই দেয়নি, সে পিতার সহানুভূতি আদায়ে নিজের বক্তব্যটিও সুন্দরভাবে গুছিয়ে উপস্থাপন করেছে।

তাতৈতন্মহদাশ্চর্যং ন দৃষ্টমতি কেনচিৎ।
মাতা বাৎসল্যমুৎসৃজ্য শাপং পুত্রে প্রযচ্ছতি। (মা.পু. ৭৭। ৩১)

সূর্য রুচিহীন একটি শব্দও প্রয়োগ করলেন না। ছায়াসংজ্ঞার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে কেবল জানতে চাইলেন—সংজ্ঞা কোথায় ‘ক্কগতেতি সা’। সংজ্ঞাকে দেওয়া পূর্ব প্রতিশ্রুতি স্মরণ করে ছায়াসংজ্ঞা আত্মগোপন করেই রইবেন স্থির করলেন। বারংবার জিজ্ঞাসিত হয়েও তিনি বললেন, সূর্যের আজ কি মতিভ্রম হল। নিজের পত্নীকে তিনি চিনতে পারছেন না। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই হাসি। একি বিপদ! সূর্যকে ছায়াসংজ্ঞা বোঝাতে চাইলেন, তিনিই বিশ্বকর্মার কন্যা। সূর্যের সন্তান তিনিই গর্ভে ধারণ করেছেন। 

সা চাহ তনয়া ত্বষ্টুরহং সংজ্ঞা বিভাবসো।
পত্নী তব ত্বয়াপত্যানেতানি জনিতানি মে।। (মা.পু. ৭৭। ৩৪)

কিন্তু না, ছায়াসংজ্ঞা শেষরক্ষা করতে পারলেন না। ক্রোধী সূর্য সত্যসন্ধানী হতে চাইলেন। যেভাবে সুর সপ্তমে চড়িয়ে যমকে অভিশাপ দিতে চেয়েছেন ছায়াসংজ্ঞা, সেটি সূর্যের মোটেই ভাল লাগেনি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা যে কিছু একটা গোপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সূর্য সেটি উপলব্ধি করলেন এবং তৎক্ষণাৎ কালবিলম্ব না করে শাপদানে উদ্যত হলেন। সূর্যের সংসার আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি ততকালই ছিল যতকাল ছায়াসংজ্ঞার ওপর শাপ বর্ষিত না হয় ‘কথ্যয়িষ্যামি বৃত্তন্তু শাপকর্ষণাৎ’। সত্য অনাবৃত হল। সূর্য ছায়াসংজ্ঞার মুখে প্রকৃত ঘটনা জেনে স্তম্ভিত। তার অমিততেজের জন্য নিজের ওপর ধিক্কার এল। যমকে সূর্য জড়িয়ে ধরলেন।

সূর্য শ্বশুরালয়ে সংজ্ঞাকে ফিরিয়ে আনবার জন্য ছুটলেন। সংজ্ঞা তার অসহনীয় তেজে কতই না কষ্ট পেয়েছেন। সংজ্ঞার কষ্টের প্রকৃত কারণ আগে থেকে জানা থাকলে স্বামী হিসেবে সূর্য নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা নিতেন। কোনও অভিমানিনী তার আদরের সন্তানদেরও ছেড়ে যখন পিত্রালয়ে চলে যান তখন কষ্টের পরিমাণ যে মাত্রাতীত—তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সূর্য ব্যথিত। স্ত্রীর এই কষ্টভোগের জন্য সম্পূর্ণ তিনি নিজেই দায়ী। দেখামাত্রই সূর্য সংজ্ঞার কাছে এজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, স্থির করলেন। শ্বশুরের ওপরেও সূর্যের কিঞ্চিৎ অভিমান হল। স্বয়ং বিশ্বকর্মা তো নিজের কন্যার সুবিধার্থে জামাতার তেজ কিছুটা কমিয়ে দিতে পারতেন। তবেই তো বিশ্বকর্মা নামটিও সার্থক হত এবং সূর্যের দাম্পত্যজীবনের এই মর্মান্তিক পরিণতি হত না। এইভাবে একরাশ ভাবনা নিয়ে সূর্য হাজির হলেন শ্বশুরালয়ে।

শিষ্টাচারসম্মত প্রণামাদির কাজ সেরে সূর্য জানতে চাইলেন, সংজ্ঞা কোথায়? সংজ্ঞা কি সত্যই এতদিন এখানেই আছে? বিশ্বকর্মা বুঝলেন, কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। তিনি সূর্যকে জানালেন যে, সংজ্ঞা তার কাছে এসেছিল বটে। কিন্তু কিছুকাল থাকবার পর তিনিই তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে সংজ্ঞা কোথায় তিনি সেই সংবাদ জানেন না। পিতা বিশ্বকর্মা কন্যার ব্যাপারে বিচলিত হলেন। সূর্যের অবস্থাও তথৈবচ।

সংজ্ঞার গৃহত্যাগের কঠোর সিদ্ধান্তে সূর্য আঘাত পেয়েছেন। ধ্যাননেত্রে সূর্য দেখলেন সংজ্ঞা সূর্যেরই তেজ মন্দিকরণের জন্য তপস্যায় রত আছেন। সংজ্ঞার ভালোবাসার গভীরতা আন্দাজ করে সূর্য মর্মাহত। কাছে আসার বেদনায়, অপলক নেত্রে না তাকাতে পারার বেদনায় একজন সংসার ত্যাগ করে কষ্ট স্বীকার করছেন, সূর্যের ভাবতেও খারাপ লাগল। খারাপ লাগবে নাই বা কেন ? সূর্য-সংজ্ঞার তো সাংসারিক কোন বিষয়কে নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, মনোমালিন্য ছিল না। সন্তানদের নিয়েও আক্ষেপ কোনকালে ছিল না। একারণে সমস্ত দায় নিজের কাঁধে নিয়ে সূর্য নিজেকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন। তপোভূমিতে সূর্য-সংজ্ঞার মিলন হল। বিশ্বকর্মা জামাতা সূর্যের অনুরোধে তার তেজ নিয়ন্ত্রিত করলেন। দিনান্তে সূর্যের তেজ হল মন্দীভূত। সংবৎসরেও একই রকম তেজ আর রইল না।

সূর্য-সংজ্ঞার প্রত্যাগমনে সমগ্র বাড়িতে আনন্দের পরিমণ্ডল লক্ষ্য করা গেল। মনু, যম ও যমুনা তিনজনেই আনন্দে অধীর হলেও পিতামাতার মিলনের মূল কৃতিত্ব ছিল যমের। যম যথাকালে প্রতিবাদ করাতেই সত্য প্রকাশ পেল। যম যদি প্রতিবাদ না করত, বঞ্চনার বিরুদ্ধে একা রুখে না দাঁড়াত, তবে তো প্রকৃত ঘটনা কোনদিন কেউ জানতে পারত না। এমনকি তার পিতৃদেবও না। যমও তো পারত কেবল দাদা মনুর মতন গ্রন্থকীট হয়ে থাকতে। কিন্তু যমের তা স্বভাববিরুদ্ধ ‘প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি’। যম জানত, যার হয় না নয়তে, তার হয় না নব্বইতে। প্রতিবাদী যমকে পিতা-মাতা দুজনেই স্নিগ্ধ চুম্বনে ভরিয়ে দিলেন। এহো বাহ্য। পিতা সূর্যের আশীর্বাদে সমদর্শী যম যমত্বে উন্নীত হলেন—‘ততো নিয়োগং তং যাম্যে চকার তিমিরাপহঃ’।

পিতা সূর্যের আশীর্বাদধন্য যম পদাভিষিক্ত হয়েই তার নিজের বহুদিনের লালিত স্বপ্নপূরণে যত্নবান হলেন। কোনও বৈষম্য নয়। শপথ নিলেন সকলের কাছে পৌঁছতে হবে। কোটিপতি, বস্তিবাসী একাকার। যমের ভুবনে জমিদার-জমাদার পার্থক্য নেই। দৃঢ়চিত্ত যম জানতেন, বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গৃহীত হলে সব প্রচারের আলো তার ওপর আসবেই আসবে। হয়েছেও তাই। যমের প্রতিষ্ঠা অবিসংবাদিত। ‘সমো মিত্রে তথাহিতে’।

একদিন এই প্রতিষ্ঠিত যমের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন মর্ত্যের অপর এক প্রতিবাদী নচিকেতা। বয়সে কিশোর। সাক্ষাৎ জ্যোতির্বলয় যেন যমসদনে হাজির। জ্বলন্ত দুটি চোখ। সেই চোখ দুটিতে অনন্ত কৌতূহল। এবং জিজ্ঞাসা। এদিকে যম তখন বাড়িতে নেই। বিনা বিজ্ঞপ্তিতে ব্যস্ততম একজনের সঙ্গে কি দেখা মেলে ! সমগ্র জগতের নিয়ন্ত্রণে যিনি, তাকে আগাম না জানিয়ে আসা চরম বোকামি। যমালয়ে নিযুক্ত রক্ষীকুল শশব্যস্ত হয়ে মনিবের অনুপস্থিতির কথা নচিকেতাকে জানাল এবং যথোচিত মর্যাদায় আতিথেয়তা গ্রহণের প্রস্তাব দিল। নচিকেতা আতিথেয়তা গ্রহণে সম্মত হল না। এতো কষ্ট স্বীকার করে যার কাছে পৌঁছেছেন তারই সঙ্গে দেখা না করে কিভাবে আতিথেয়তা গ্রহণ করা যায়। যত কষ্টই জোক যম-দর্শনের আগে কোনমতেই বিশ্রাম নয়।



।। শব্দসঙ্কেত ।।

ক. উ. কঠোপনিষদ 
মা.পু. মার্কণ্ডেয়পুরাণ
শা.ভা. শাঙ্করভাষ্য


* অধ্যাপক, তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। 







2 comments:

  1. যমের বড়বেলা পেলাম কই।

    ReplyDelete
  2. যমের বড়বেলা কোথায় লেখা পেলাম না

    ReplyDelete