ধারাবাহিক - স্বপন দেব
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
আমার বারুদ-বেলা—১৫
স্বপন দেব
আমার বর্তমান ঠিকানা এখন পি জি হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডএর ২৩ নং বেড। বাইরে যখন সি পি এম, নকশাল আর কংগ্রেসের লড়াই চলছে, এখানে কিন্তু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আমার পাশের বেডেই আছেন এক সি পি এম কর্মী। এক নকশাল কর্মীর ছোরা তার তলপেট চিরে দিয়েছে। এই ওয়ার্ডটা মূলত রাজনৈতিক এবং সমস্ত আহতদের চিকিৎসার জায়গা। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা যে এখানে কিন্তু রোগীদের মধ্যে কোন রাজনৈতিক দলাদলি নেই। আমার হুইল চেয়ার টেনে নিয়ে যাচ্ছেন এক সি পি এম কর্মী বোমা বাঁধতে গিয়ে যার হাত উড়ে গেছে। মাস খানেক এখানে থাকার পরে কত যে অভিজ্ঞতা হল! আমার তো নিত্যি নতুন পরীক্ষা আর ওষুধ পালটানো চলছে। লাম্বার পাংচার থেকে শুরু করে একদিন ওটিতে নিয়ে গিয়ে অজ্ঞান করে কি করল কে জানে! ইতিমধ্যেই আমার আরো দুটো উপসর্গ যোগ হয়েছে। কথায় কথায় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে হাতের কাছে যা পাই তাই ছুঁড়ে ফেলা আর ঘন ঘন মৃগী রোগ। আর এইরকম হলেই আমাকে সঙ্গে সঙ্গে লিকুইড প্যারালডিহাইড বলে একটা ইনজেকশন দেওয়া হত। ডিসটিলড ওয়াটারের মত একটা অ্যাম্পুলে ভরা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত এই ইনজেকশনটা দিলেই আমি ৫ মিনিটে ঘুমিয়ে পড়তাম। হাসপাতালে সাধারণত ভিজিটিং আওয়ার এর পরে রোগীদের ওষুধ ও ইনজেকশন দেওয়া হয়। ভিজিটিং আওয়ার সবে শেষ হয়েছে আমার নাকে এল সেই তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধটা। আমি তো এখন ভালোই আছি। তাহলে আমাকে কেন প্যারালডিহাইড দেওয়া হবে? একটু এদিক ওদিক ঘুরতেই আসল রহস্যটা বোঝা গেল! প্রথম বর্ষের এক ট্রেনী নার্স ওই প্যারালডিহাইড দিয়ে সকলের ইনজেকশন ডিজলভ করছিলেন! বোঝো কাণ্ড! আমার ঠিক বাঁদিকের বেডে ছিলেন এক অরাজনৈতিক ব্যক্তি। ফুড করপোরেশনের গুদামে কাজ করতেন। ঘাড়ের ওপর বস্তা পড়ে গিয়ে পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। কথা বলতে পারেন, তবে জড়িয়ে জড়িয়ে। আমি সিগারেট ধরালেই উনি সকরুণ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বলতেন, শেষটা দেবেন একটু? আমি উনার মুখে সিগারেটটা ধরলে উনি টানতে পারতেন। একদিন রাতে উঠেছি টয়লেটে যাবো বলে। সেদিন সকালে ওঁর অপারেশন হয়েছে। আচ্ছন্ন ছিলেন। কিন্তু আমি সিগারেট ধরাতেই চোখ মেলে তাকালেন। এসে দিচ্ছি -বলে আমি টয়লেটে গেলাম। ফিরে এসে ওঁর মুখে সিগারেটটা গুঁজে দিলাম, কিন্তু উনি ধোঁয়া ছাড়লেন না। আবার আচ্ছন্ন হয়ে গেছেন ভেবে আমি ওঁকে জাগাবার জন্যে গায়ে ধাক্কা দিলাম। কোন সাড়া নেই। সিস্টারকে ডেকে বলাতে উনি প্রাথমিক পরীক্ষা করে বললেন, উনি মারা গেছেন। এই হসপিটালে আমাকে প্রায় সাত মাস থাকতে হয়েছিল। তাই এই অভিজ্ঞতাগুলি বলে নিলাম।
প্রেসিডেন্সি জেল থেকে একদিন দুপুরে পি জি হসপিটালের এই উডবার্ন ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হল অজিত কর্মকারকে। ইনি সেই অজিত কর্মকার যিনি ছিলেন R.C.C.I. এর কর্মী প্রেসিডেন্সি জেল থেকে পালানোর অন্যতম প্রতিযোগী। কিন্তু সেদিন একমাত্র এই অজিত কর্মকার ই পালাতে পারেননি। তাই অমানুষিক অত্যাচারে তাঁর চোখ দুটি উপড়ে নেওয়া হয়। এবং শরীরের অন্যান্য অর্গানগুলিও বিকল হয়ে যায়। আজকের দিনটা ওঁকে বিশ্রাম নিতে দিন। কাল থেকে ওঁর মুখেই শুনবো জেল পালানোর ছক এর কথা।
তোমরা জেলের মধ্যে বোমা নিয়ে এলে কি করে? আমার প্রশ্নের উত্তরে অজিত বলল, আনিনি তো! জেলের মধ্যেই বানিয়েছি! কিন্তু কি করে? বোমার মসলা পেলে কিভাবে? আমরা কিন্তু যাকে পেটো বলে সেই সুতলি বাঁধা বোমা বানাইনি। কারণ পেটোতে থাকে স্প্লিন্টার। যেটা মানুষকে আঘাত করে, মেরেও ফেলে। আমরা বানিয়েছিলাম স্মোক বোমা। যা খালি আওয়াজ আর ধোঁয়া তৈরী করে। আর এটা সুতলি দিয়ে বাঁধা হলেও এর পলতে বা সলতে থাকে। চৌকায় যে আলুর বস্তা আসতো তার থেকেই এই সুতলি বানানো। পলতেতে আগুন দিয়ে সঠিক জায়গায় ছুঁড়ে দিলেই পুরো এলাকাটা ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যায়। এগুলি অনেকটা বড়ো চকোলেট বোমার মত। ধরো একটা বড়ো কমলালেবুর আকারের। কিন্তু, তার জন্যেও তো বারুদ লাগে। নুন আর চিনি দিয়ে তো বোমা বানানো যায়না! আসলে এই বোমা বানাতে যা যা লাগে তার সবই আমাদের চৌকায় বা কিচেনে পাওয়া যায়। বাড়তি যেটা লাগে সেটা হয় সাদা ( Kclo3) বা পটাসিয়াম ক্লোরেট। পটাসিয়াম ক্লোরেট দিয়ে বোমা বাঁধা কিন্তু খুব রিস্কি। যে কোনও সময়ে একটু চাপের হেরফেরেই ফেটে যেতে পারে আর তাহলেই তো আমাদের পালানোর স্বপ্ন শেষ। এর থেকে অনেক নিরাপদ হোল Kno3 বা পটাসিয়াম নাইট্রেট যেটা তুবড়ি বানাতে লাগে। ডাক নাম সোরা। তো, এই সোরা, চিনি আর বেকিং সোডা দিয়েই বানিয়ে ফেলা যায় একটা ধোঁয়া বোমা! সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু তোমার ঐ সোরা জেলে ঢুকল কি করে? মুচকি হেসে অজিত বলল, বুদ্ধি দিয়ে! তবে সময় লেগেছে অনেক দিন। অনন্ত সিংহ ছাড়া ওরা ছিল সাত জন। প্রত্যেকে বাড়ি থেকে সপ্তাহে একদিন ইন্টারভিউ, মানে বাড়ির লোক আসতো দেখা করতে। জেলের কিছু অদ্ভূত নিয়ম-কানুন আছে যার বেশিরভাগই ব্রিটিশ আমলের। কোন এক স্বাধীনতা সংগ্রামী কাঁঠালের মধ্যে করে জেলে পিস্তল এনেছিলেন। তারপর থেকে জেলে কোন গোটা ফল দেওয়া যায়না। আম কিংবা লিচু দিতে গেলেও কেটে দিতে হবে। জেলের ভেতর বাইরে থেকে রান্না করে আনা খাবার দেওয়া যায়না। ইন্টার ভিউএর দিন মূলত জামাপাপড়, চিঁড়ে, মুড়ি, গুড়, বাতাসা, চিনি, এই সবই দেওয়া হতো। আর দেওয়া হতো বিঁড়ি বা সিগারেট, সাবান ইত্যাদি। জেলে কিন্তু টাকাপয়সা দিয়ে কোন লেনদেন হয়না। সবই হয় বাটার সিস্টেমে বা বিনিময় প্রথায়। মানে ধর, দুটো সাবানের বিনিময়ে তুমি এক কেজি চিনি পেতে পারো কারো কাছে। সেই কারণেই কোন জিনিষই প্রভূত মাত্রায় দেওয়া চলতনা। পাঁচ বাণ্ডিলের বেশি বিঁড়ি তুমি দিতে পারবেনা। জামাকাপড়, সিগারেটের প্যাকেট, সাবানের মোড়ক খুলে চেক করা হলেও বিঁড়ির বাণ্ডিল খুলে পরীক্ষা করতে আমরা কোনদিন দেখিনি। আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিলাম আমরা। কি ভাবে? নিরীহ প্রশ্ন আমার। প্রতি সপ্তাহে আমরা সাতজন পাঁচটি করে মোট পঁয়ত্রিশটি বিঁড়ির বাণ্ডিল পেতাম। ওই পাঁচ বাণ্ডিলের মধ্যে মাত্র একটি বাণ্ডিলে অর্ধেক সোরা আর ওপরে তামাক থাকতো। আর ঐ নির্দিষ্ট বিড়িটি বাণ্ডিলের মাঝখানে একটা অন্য রঙের সুতো সিয়ে বাঁধা থাকতো! তাহলেই বোঝো, ৩৫ বাণ্ডিল বিড়িতে মাত্র সাতটি বিড়ির তামাকের তলায় থাকতো ঐ যৎকিঞ্চিৎ সোরা। একটা ধোঁয়া বোম বানাতে আমাদের দরকার ১০০ গ্রাম সোরা। চারটে তে ৪০০ গ্রাম। তাহলেই বোঝো, কতদিন ধরে আমাদের সংগ্রহ করতে হয়েছিল এটা। আর ২০০ গ্রাম চিনি একটা কড়াইতে ক্যারেমেল করে নিয়ে তাতে এই সোরা আর দু চামচ বেকিং সোডা মেশালেই তৈরি হয়ে গেল ধোঁয়া বোমার মসলা। আর দড়ি ? সেটা এল কি করে জেলের ভেতরে ? সেটা বাইরে থেকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল চৌকার ছাদে। অবিশ্যি তার মানে এই নয় যে আমরা দড়ি বানানোর চেষ্টা করিনি। আমাদের চৌকায় রোজ এক বস্তা আলু আসতো চটের বস্তায়। সেখান থেকে চটের সুতো বার করে দড়ি পাকানোর উদ্যোগ আমরা শুরু করেছিলাম। কিন্তু সেল এ তল্লাসীর সময়ে সেটা ধরা পড়ে যায়। এরপরে আমরা আর কোন রিস্ক নেইনি। এতো পরিকল্পনা করে পালানোর পরেও তোমার সঙ্গীরা তিন দিনের মধ্যে আবার পুলিশের জালে পড়লো কি করে? সেটাই আমাদের মারাত্মক ভুল ছিল। এই পরিকল্পনার নেতা হিসেবে জেল পালানোর পরে আমরা কে কোথায় থাকবো, কিভাবে যোগাযোগ রাখবো এই সমস্ত তথ্যই সাংকেতিক কোডে আমাকে জানানো হয়েছিল। কারণ, সর্বপ্রথম আমারই দড়ি বেয়ে পাঁচিল টপকানোর কথা ছিল। পালানোর সময়ে আমার বুক পকেটেই সেটা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনার বদল হয় এবং আমাকে সবশেষে পালানোর আদেশ দেওয়া হয়। তাই দড়ি ছিঁড়ে আমি যখন মাটিতে পড়ে গেলাম তখন চরম অত্যাচারের সঙ্গে সঙ্গে সেই সাংকেতিক কাগজটিও তাদের হস্তগত হয়। ওটাকে ডিকোড করতে পুলিশের ২ দিন সময় লেগেছিল। তারপরে আর ধরে আনতে বাধা কোথায়? কিন্তু চৌকা থেকে তোমরা ছাদে উঠলে কি করে? চৌকায় চুল্লির ওপরে ধোঁয়া বেরনোর জন্যে একটা চিমনি থাকে। চিমনির চার পাশে লোহার তিনটি রড লাগানো থাকে। তাদের মধ্যে দুটি রড আমরা আগেই কেটে ফেলেছিলাম!
প্রেসিডেন্সি জেল পালানোর গল্প শুনলেন। পরের কিস্তিতে আসবো অন্য প্রসঙ্গে। (চলবে)
দুর্ধর্ষ ! উদগ্রীব অপেক্ষায় থাকলাম পরের পর্বের জন্যে।
ReplyDeleteEkebare Live Telecast... Tobu protikxa na kore upay nei ! Kobe boi hoye berube?
ReplyDeleteরোমহহর্ষক !! পরের কিস্তির অপেক্ষায়...
ReplyDeleteঅসাধারণ ! এটির মুদ্রিত সংস্করণের আশায় রইলাম।
ReplyDeleteআপনার লেখায় যাদু আছে ! কেবলমাত্র এটি পড়ার অপেক্ষায় থাকি সারাটা মাস !
ReplyDeleteচাবুকের মত লেখা !
ReplyDeleteশিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়...ভয় করে, আবার ভালো ও লাগে !
ReplyDeleteতারপর?
ReplyDeleteআমার নিজের লোকের কথা ও কাহিনী উপভোগ করছি !
ReplyDeleteএক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম !!
ReplyDelete