0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক



প্রতিস্রোত 
 সুবল দত্ত 



॥১॥

অস্বচ্ছ ভীড়ের স্রোত অন্ধকারে বয়ে চলেছে
আমার বোধ নেই
আমি নিজেকেও চিনতে পারিনা 

অগুন্তি পিছল সাদা গ্রানাইট পাথর আর নিকষ কালো নুড়ি পাথরের ঢিবি। পুব পশ্চিম ঈশান নৈঋত যেদিকেই মুখ করে দাঁড়াও বা বসো বাতাসের সেই বিরক্তিকর আওঁ আওঁ ধ্বনি। দিগন্ত বিস্তৃত চকরা বকরা কালো সাদা পাথরের ডিজাইন। মাঝে মাঝে আমেরিকান ঘাসের মত ছোট ঘাসের টুকরো টুকরো মখমল কার্পেট আর লাল মাটির স্তূপ। কেবল পাথর আর পাথর। এর মাঝে হঠাত্‍ করে একটা উপুড়করা হেলমেটের মত কালো সাদা পাহাড়। দূর থেকে তুমি তুমি ডাকলে সেই তুমি ডাক ফেরত। আমিতেও তাই। পাহাড় প্রায় দুশো ফুটের। সরু মাথায় একটা শিমুল গাছ। চারপাশে কোথাও কোনও বড় গাছ নেই। এমনকি পুটুসও দুর্লভ। গ্রীষ্মের শুরু, পাহাড়ের উপরটা রক্তময় হয়ে উঠেছে। দূর থেকে দেখায় যেন সাদা কালো নক্সাকাটা ফুলদানীতে একটা লাল ফুলের স্টিক। কাছ থেকে দেখা যায় পাহাড়ের গা বেয়ে সাদাকালো পাথরের চাইঁয়ের ভিতরে ঢুকে বেরিয়ে অত উঁচু উপর থেকে এঁকেবেঁকে মাটি খুঁজেছে দু রকমের শিকড়। একটা হালকা বাদামি আর একটা কালচে খয়েরি। দূর থেকে অসামান্য দৃশ্যপট, কাছ থেকে প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের বিস্ময়। পাহাড়ের নিচে কয়েকটি ঘর নিয়ে শিমুলিয়া গ্রাম। এই গ্রামটি তিনপ্রদেশের সীমান্তে। দেশের সীমারেখাও খুব কাছে। প্রতিবেশী দেশটি শত্রুতা ছাড়া কিছুই বোঝেনা। বেশীরভাগ জায়গা নির্জন, কেবল কাঁকর পাথর, বৃষ্টি হয়না বললেই চলে। যেকটি ঘর আছে তাদের অনেকেরই ক্ষয়রোগ ও কুষ্ঠ, পুরো গ্রামটি খরচের খাতায়।তাই বুঝি তিনপ্রদেশের কোনও রাজনেতাই শিমুলিয়াকে নিজের অন্তর্ভূক্ত বলে স্বীকার করেনা। তাই বুঝি এই জায়গাটিকে কেন্দ্রীয়সরকার দেশের সুরক্ষাবিভাগের হাতে তুলে দিয়েছে।মাঝেমাঝেই মিলিটারিদের কনভয় এসে গ্রামে হানা দেয়। বেশ কয়েকদিন গুলিগোলার কান ফাটানো আওয়াজ। চিত্‍কার চেঁচামেচি হিংস্রতার মহড়া চলে। তারপর ট্যাংক, মিলিটারি গাড়ি, ক্ষেপণাস্ত্র, ইত্যাদি যাবার পর গ্রামবাসীরা দেখে পাহাড়ের গায়ে শিকড় ছিন্নভিন্ন। গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তলাল রস। আসলে পাহাড়ের উপরে শিমুল গাছটির সাথে অঙ্গাঙ্গি লেপ্টে রয়েছে এক অর্জুন গাছ। খুব কাছে না গেলে এই অর্জুন গাছটি দেখা যায় না। এই দুই বৃক্ষের শিকড় জড়াজড়ি করে প্রায় দুশো ফুট নিচে মাটি খুঁজে নিয়েছে! ভাবা যায়না। এখন এই আলো আঁধারে গ্রামের রাস্তা সুনসান। আশ্চর্য এই, গ্রামে একটিও কুকুর নেই। তার অবশ্য কারণ আছে। প্রতিবারেই সৈন্যবাহিনীতে কয়েকটি গোর্খা সৈন্য থাকেই। তারা আবার কুকুর মাংসের ভক্ত। পাখীও নেই। শুধু মাত্র বাতাসের ফাঁকা হা হা ধ্বনি। গতকাল গভীর রাত অব্দি পাহাড়ের ওপরে মশাল জ্বলছিল। নাচ গান মাদল আর ঢাক। কিন্তু বড় ফাঁকা ফাঁকা। গ্রামের মানুষদের রীতি রেওয়াজ সৃষ্টিছাড়া, অদ্ভুদ। ওদের কেউ মারা গেলে ওরা শিমুল গাছের নিচে জমা হয়, নাচ গান করে, মাদল বাজায়, রাতভর মশাল জ্বালিয়ে রাখে। কারও ঘরে বাচ্চা জন্মালে ওরা কাঁদতে বসে ওই শিমুল গাছটার তলায় গিয়ে। অন্ধকারে গাছের নিচে চুপচাপ বসে থাকে ওরা।যেন কোনও পাপ কাজ করেছে।  তারই প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে ওদের। 

সন্ধে হবহব। পাহাড়ের মাথায় পরিষ্কার নিকোন সমতলে দুটি প্রাণী।একজন ফর্সা, শাদা দাড়ি চুল শাদা ধুতি ফতুয়া, বৃদ্ধ। অন্যজন মিশকালো খালি গা ময়লা জিন্স, মাঝবয়েসি। ওরা দুজনে শুয়ে।গায়ে গা ঠেসে, কালোর বুকে গোরার হাত, গোরার একটা পা কালোর গায়ে চাপানো। পাশ দিয়ে শিমুল ও অর্জুন গাছের মোটা ভারী শিকড়গুলো পরস্পরে পাকিয়ে পাকিয়ে নিচে নেমেছে।যেখানে ওরা শুয়ে, সেখানটা উঠোনের মত চিক্কণ আর ফিটফিটে শাদা। হঠাত্‍ করে শোয়া দুটি মানুষকে দেখলে মনে হয় বুঝি শিকড়ের অংশ। ওপর থেকে দেখা যায়, সপাট সমতল মালভূমিতে ছেঁড়া ছেঁড়া সবুজ ও কালো সাদা পাথুরে নকশার মাঝে হঠাত্‍ বড় গোল ধবধবে সাদা ঢিবি। ওই সাদা মাটির ঢিবি খুঁড়ে খড়ি মাটি এনে গ্রামের লোকেরা পাহাড়ের ওপরে শিমুল তলায় একটা আঙ্গন তৈরি করেছে। ওই খড়িমাটি দিয়ে বানানো অদ্ভুদ সব ঘোড়া হাতি পুতুল যোদ্ধা শিমুল অর্জুনের গোড়ায় ছড়ানো আর চারদিকে প্রচুর বড় বড় শিমুল ফুল গোধুলির পড়ন্ত লাল আভা পরিবেশে বিষাদ লালিমা। গোরাচাঁদ উঠে বসলেন আবার শুয়ে পড়লেন। ঘুম তার চোখ থেকে কয়েক দশক হল বড় একটা নেই। এক আধদিন এখানে পেরোর সাথে নিশ্চিন্তে এক আধ ঘণ্টা ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ কী যে হচ্ছে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেননা তিনি। একটা শিমুল ফুল ঢুপ করে পেরোর পেটের উপর পড়ল। পেরো কিন্তু নড়লো না। ঘুমিয়ে কাদা। গোরাচাঁদ ফুলটা সরিয়ে দিলেন। ঈর্ষা হল পেরো কেমন গভীর ঘুমে নিজের কাছ থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে! পেরো একটা খুনে উগ্র অমানুষ কোনও পাহাড় জঙ্গলই তার কাছে দুর্গম নয়।আদিবাসীরা কেউই তাকে পছন্দ করে না। এই পাহাড়ের কোটরে প্রচুর ইঁদুর। অনেকেই জানে, গোরাচাঁদ নিজেও দেখেছেন, পেরোকে ইঁদুর মেরে মাংস পুড়িয়ে খেতে। অশিক্ষিত, মাথা মোটা, তার শরীর কোনদিনই বুঝি জল স্পর্শ করেনি, গায়ে দুর্গন্ধ কিন্তু... তবু... গোরাচাঁদ কেন যে ওকে এত ভালোবাসেন, তিনি নিজেই জানেন না। ওকে একটু দেখতে না পেলে মন বড় আনচান করতে থাকে, অভিমান হয়। একটু ছুঁতে পেলেই মনে বড় শান্তি আসে।গোরাচাঁদের মেজর লেফ্টনেণ্ট ছেলে সমুর ঘৃণা তাঁর বুকে অষ্টপ্রহর দাউদাউ করে জ্বলছে। গ্রামের আদিবাসীদের নির্বোধ ভোঁতা চাউনিতেও একটা বিজাতীয় কৌতুক দেখে নিজের উপরে ঘেন্না আসে বইকি কিন্তু মন মানেনা। একবার তো সমু সরাসারি তাকে সমকামী বলেই বসলো। কিন্তু তাই কি? তিনি নিজেই জানেন পেরো তাঁর কাছে কি। যেমন এই নো ম্যানস ল্যাণ্ডে কেউ জীবনানন্দ বোঝে না, তেমনি তাঁর সাথে পেরোর সম্পর্ক কেউ বোঝে না।

ওপরে তাকান গোরাচাঁদ। আকাশটা আজ যেন বেশি লাল। শিমুল ফুল এত বেশি ফুটেছে যেন মনে হয় আকাশের লাল গর্ভ থেকে সিঁদুর প্রসব হচ্ছে। পেরোর মতন অসম্ভব কট্টর মাতৃভূমি ভক্তেরা দেখবে পাহাড়ের উপরে কেউ যেন লাল নিশানা ওড়াচ্ছে। এস ও এস দিচ্ছে। আবার শুরু হতে চলেছে বিধ্বংসের রণনীতি। তখন ছিল অসম্পূর্ণ, এমেচার। এখনকারটা হবে সম্পুর্ণ প্রফেশনাল। একজন খুন কর তুমি খুনী, হাজার খুন কর তুমি জয়ী, মানবজাতিকে খুন কর তুমি ঈশ্বর। গেলবার বছর সাতেক আগে মিলিটারি সাহেবরা মাইন্স পুঁতে প্র্যাকটিস করছিল পেরোর ঝোপড়ির খুব কাছে। একটা ক্ষেপনাস্ত্র উড়ে এসেমাইন্স সমেত পরিবারের পাঁচজনকে উড়িয়ে দিল। ছিন্ন ভিন্ন রক্তাক্ত লাশ। পরিবারের প্রত্যেক মৃত্যুর জন্যে সরকার এক লাখ টাকা মুআবজা রেখে ছিল। গ্রামের মানুষজনের সামনে থেকে পেরো সেই যে গায়েব হল। এখনোও গাঁয়ের লোকের কাছে সে বেপাত্তা। কে নেবে সরকারি টাকা? যাকে সরকার হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে? গোরাচাঁদ উঠে বসলেন। পেরো ঘুমিয়ে কাদা। চোখের মণি নড়ছে। বোঝাই যায় এখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে সে। ওর কোনো বোধ নেই। পৃথিবীর কালের প্রকৃতির কি হচ্ছে কি যাচ্ছে ওর কিছুই যায় আসে না। বিচক্ষণ বুদ্ধিমান অথচ একেবারে নৈষ্কর্ম স্থিতিতে হরদম। গোরাচাঁদ ওর রুক্ষ কালো দড়ি পাকানো হাতের দিকে তাকালেন। গোরাচাঁদের ফর্সা হাতের ওপর রাখা ওর অনড় হাত। ওই হাত দিয়ে গতকালও নির্মম হত্যাকাণ্ড করে এসেছে। এখন গোরাচাঁদের হাতের ওপর সেই হাত। ওর স্বপ্নময় ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। জেগে থাকলে ওই হাসি কখনোই দেখা যায়না। এখন ও অবচেতন আনন্দময় হয়ে আছে। অন্য এক সুন্দর জগতে সুন্দর হয়ে আছে। জেগে উঠলেই সে সৃষ্টি করবে এক অসুন্দর জগত। আর সংহারে তত্‍পর হয়ে উঠবে। কি করে হয়? গোরাচাঁদ তন্ময় হয়ে রহস্যের সমাধান খুঁজতে লাগলেন। সত্যিই কি পেরোর সুন্দর অসুন্দরের বোধ আছে? হয়তো আছে কিংবা নেই। যদি সুন্দরের বোধ থাকতো তবে এতদিনে নিশ্চয়ই তার প্রকাশ ঘটত। ফুল ফল আকাশ বাতাস জল মাটি শৈত্য উষ্ণতা আজ অব্দি ওর মনে কোনও ছাপ ফেলেছে বলে গোরাচাঁদের মনে পড়ে না। আজ অব্দি কোনও নারী ওর জীবনে আসেনি একথা গোরাচাঁদ জোর গলায় বলতে পারেন। অনেককটিই খুন করেছে সে কিন্তু নারী ঘটিত কোনও কর্ম? কেউ সে কথা বলে না। জেগে থাকলে একেবারে নর রাক্ষস। প্রাগঐতিহাসিক গুহামানব। হয়তো হত্যাকারীর চরিত্রই এমনি হয়। কিন্তু সবাই কি? আর একজন তো তারই ঔরসজাত। সৌম তার সৈনিক পুত্র। সে তো ঠাণ্ডা মাথায় প্ল্যান করে পেরোর চার ভাইবোনকে ওদের ঝোপড়ি ঘর সমেত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে উড়িয়ে দিলো। মিলিটারি কোর্টে কেস উঠল। অপোনেণ্ট ছিলো না। কেস এখনো ওপেন। ওদের পক্ষে এক জোরালো যুক্তি। হিউম্যান এরর। 

এবারে সমু এসেছিলো ঝটিকা সফরে। প্রোমোশন হয়েছে। চলনে বলনে আগ্রাসী পাওয়ার হাঙ্গার। বংশে তো আর কেউ নেই একা তার বাপ ছাড়া । ঘণ্টা দুয়েক ছিল নিজের শক্তি প্রদর্শন করতে। এটাচি খুলে এই গ্রামটির উন্মূলনের অনুমোদন কাগজগুলি বার করে গোরাচাঁদের হাতে ধরিয়েছিল। চোখে ছিল নৃশংসতা ঘৃণা তাচ্ছিল্য আর দম্ভ। মুখের সবকটি মাংসপেশীতেই কিলবিল করছিল চরম অসুন্দরের প্রকাশ।পেরোর মুখে তো চরম নিরাসক্তি। নিস্পৃহতা ভেদ করে পেরোর অন্তরে পৌঁছানো যায়না আর সমুর মুখে তাকালেই সম্মোহিত হয়ে যেতে হয়। ওর মুখের ভাব যে কোনও মানুষের মনকে টেনে কুত্সিৎ মনোবৃত্তির গভীর পাঁকে নামিয়ে দেয়। অবশ্য ও বলে এটা তার পারসোনালিটির ক্রেডিট ।

গোরাচাঁদ আবার শুয়ে পড়েন। তার চেয়ে এই ভাল। এই জোড়া বৃক্ষের নিচে সুরক্ষিত কটা দিন কেটে যাক পেরোর সাথে। খুব দেখা গেল এতদিন সামাজিক জীবের সাথে কাল কাটিয়ে। এবার অসামাজিকই সই। কঠিন নির্মম হোক তবু তো সেখানে একটা ফাটল আছে, তার ভিতরে এক ফোঁটাও তো কেবল তারই জন্যে অমৃত প্রেম রসের ক্ষরণ হয়! পেরো তাকে ভালোবাসে, যেমন ট্রেনারকে বাঘ ভালোবাসে। এমনকি কখনও কখনও বিনা ছড়িতেই শুধু আঙ্গুল তুলে আদেশ করতেই বাঘ মাথা নুইয়ে নিজের গুহার ভিতরে প্রতিবাদহীন ঢুকে যায়। সেটাকে কি বলা যায়?





0 comments: