0

ছোটগল্প - জয়ন্ত প্রসাদ গুপ্ত

Posted in


ছোটগল্প



অনুবর্তন
জয়ন্ত প্রসাদ গুপ্ত



আদিনাথ ঘুমোচ্ছিলেন। শরীরটা ভাল নেই। হাঁপের রুগী, তারপর হার্টের অসুখ। সে-ও তো আজ বছর পঁচিশেক। হার্ট নিয়ে তিনি অবশ্য রসিকতা করতে ছাড়েন না। বন্ধুমহলে বলেন, দ্যাখ্‌ হার্টের ডিজিজ যখন হয়েছে তখন নিশ্চিত একটা প্রমাণ পাওয়া গেল যে আমার একটা হার্ট আছে। I am not at all a heartless creature। আড়াই দিনের নবদ্বীপ-মায়াপুর সফর করে বুকে সর্দি বসিয়ে ফেলেছে, গাটাতেও কেমন একটা জ্বর-জ্বর ভাব। তা হঠাৎ ঝংকার দিয়ে উঠতে মোবাইলটাকে কানের কাছে ধরে শুনতে পেলেন : তেরি সামনে মে। বিরক্ত হয়ে মোবাইলের গলাটাকে অর্থাৎ গালটাকে টিপে দিয়ে স্বগতোক্তিতে তিনিও একটা অস্ফুট ঝংকার দিলেন– কর ব্যাটা, তেরি সামনে মে কি তেরি পিছন মে – তো আমার কি এসে গেল, দিলি তো কাঁচা ঘুমটা ভেঙে। এই হয়েছে এক জ্বালা – সময় নেই, অসময় নেই, যখন তখন এই বিজ্ঞাপনওয়ালারা তোমাকে disturb করবেই।

আর ঘুম আসবে না। খাওয়ার পর বেশ খানিকটা সময় বাদে শোবার advice দিয়েছেন ডাক্তার। আর অফিস-কাছারি নেই বলে খেতে বসতেও নিয়মিতভাবেই দেরি করা হয়। দাদুভাইর স্কুল থেকে ফিরতে আর কতটা দেরি ! বড় ঘড়িটা ড্রইংরুমে, মোবাইলে টাইম দেখা খালি চোখে তাঁর অসাধ্য। চুপচাপ চোখ বুঁজে পড়ে থাকেন। একটুখানি চোখ খুলে দেখতে পান রোদের ঝলকও বেশ আছে। বৃষ্টি পড়লেই মুস্‌কিল। দাদুসোনাকে আনতে তার মাকে আবার ছাতা নিয়ে ছুটতে হবে। কোনও সুনির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা মাথায় খলছে না। খেলাবার জন্য কোনও তাগিদও অনুভব করেন না আদিনাথ।

এই এলোমেলো চিন্তাই বর্তমান জীবনে আদিনাথের একান্ত সঙ্গী। তিনি বিপত্নীক হয়েছেন দু বছর পার হয়ে গেল। লোকে অনেক সময়ই একটা ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করে। বলে, আহা share করার আর সেরকম লোক রইল না। কথাটা সর্বৈব সত্যি। কিন্তু share শব্দটাকে এমন mechanical ভাবে বলে যে ওটা যেন একটা “ক্লীশে” (cliché) হয়ে গেছে। চুপ করে থাকেন। কাউকে কিছু বলেন না। কিন্তু কীরকম একটা বিরক্তিতে মনটা ভরে যায়, তার পেছনে কি যে কারণ বা যুক্তি তা তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না। বোধ হয় তাঁর চেতনায় কোনও কোনও শব্দ অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক, অত্যন্ত মাহাত্মপূর্ণ। তাই তাদের casual উল্লেখ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে আঘাত করে। যেমন ‘প্রেম’ শব্দটি। বর্তমান সমাজে এর অবমূল্যায়ন তাঁকে একাধারে গভীরভাবে ব্যথিত করে ও প্রচণ্ডভাবে ক্ষিপ্ত করে। 

ভালবাসার বিয়ে তাঁদের। দুই পরিবারের প্রচণ্ড অমতে ও প্রতিকূলতায়, ভয়ংকর ঝড় তুফানের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে তাঁদের জীবনের পথ। জীবন-সংগ্রাম যত তীব্র হয়েছে, তত তাঁরা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছেন পরম প্রেমে, পরম বিশ্বাসে। বেশ কিছু বছর কেটে যাবার পর ওঁর স্ত্রী ওঁকে একদিন বলেছিলেন, বিশ্বাস কর, ভালবাসতাম আমি তোমাকে ঠিকই, কিন্তু তোমার মধ্যে বরাবরই প্রেমের যে তীব্রতা ছিল, তা আমার ছিল না। কিন্তু এখন তোমাকে ছাড়া আমার জীবন আমি কল্পনাও করতে পারি না। প্রাকৃতিক নিয়মে দিনের পর দিন গড়িয়ে গেছে, সংসার হয়েছে জমজমাট পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনীতে। একটা উপলব্ধি ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল উভয়ের অন্তরে সে ওদের দেহ দু’টি, কিন্তু আত্মা একটিই। একজনের দেহে আঘাত লাগলে অন্যজনও যেন তাঁর নিজের দেহে সে বেদনাকে অনুভব করতে পারতেন। তাই বোধহয় যান্ত্রিকভাবেই ঐ share শব্দটার উচ্চারণ আদিনাথের মধ্যে কীরকম একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার যন্ত্রণা জাগায়। 

নাতি এসে গেল। পর্জন্যদেব শত্রুতা করেন নি। আদিনাথের সময়কাল পাল্টে গেলেও তাঁদের পুত্রদের আমলেও একটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় রুটিন ছিল এরপর, সেটা হল খেলাধূলা। কিন্তু এই generation এ সেটা গুণার্হ। বিদ্যাদিগ্‌গজেরা মাষ্টারমশাইদের বেশী করে খাটিয়ে নিতে গিয়ে ছেলেপেলেদের সেই খেলার সময়টুকুতেও টান ধরালেন । অবশ্য মাষ্টারমশাইরাও কম যান না। আগে পরে যাই হোক্‌, স্কুল ছুটির পরই তাঁদের টিউশনের আদর্শ সময়। আদিনাথ জানেন এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে তিনি কিছু করতে পারবেন না, তাই যথাসাধ্য চেষ্টা করেন মনকে ও থেকে নিবৃত্ত রাখতে।

রোদ পড়ে গেলে ছাদে গেলেন আদিনাথ। আজকাল প্রায়ই যান এই সময়টাতে। বৈকালিক ভ্রমণ সারেন। ভাল লাগে। কারণ নিজেকে নিজের পাওয়া হয়। রাস্তায় বেরোলে, কি গার্ডেনে বা পার্কে গেলেই, পাঁচজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ, পাঁচরকম কথাবার্তা, সামাজিক ফর্মালিটির বাধ্য-বাধকতা। অনেক সময়ই ভাল লাগে না। তার থেকে এ-ই ভাল। সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে আসতে থাকে, পাখীরা দল বেঁধে তাদের বাসায় ফিরবার জন্য আকাশের এক প্রান্ত থেকে এসে আর এক প্রান্তে মিলিয়ে যায়, একটা রক্ত গোলার মতো সূর্যটা ডুবে যায় পশ্চিমদিগন্তে ঐ গাছগাছালির ফাঁকে, একটি দুটি করে তারা ফুটে উঠতে থাকে আকাশে, একটা প্রশান্ত স্তব্ধতা মনটাকে কীরকম একটা নীরব স্নিগ্ধ শান্তির মধ্যে সমাহিত করে দেয়। ... “আয় আয় চাঁদমামা টি দিয়ে যা” এই ছড়াতে মুগ্ধ হবার মতো শিশুটি আর নন্‌ তিনি। বিজ্ঞানের ছাত্র না হলেও সাধারণ শিক্ষিত মানুষের যে বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা তা তো তাঁর অবশ্যই আছে। তবু কোনদিন সন্ধ্যারাতেই চাঁদ উঠলে সেদিকে তাকিয়ে কেমন বিমনা হয়ে যান। বিজ্ঞান, যুক্তি, তর্ক কোন্‌ মায়াজালে মনের কোন একটা প্রকোষ্ঠে যেন বন্দী হয়ে থাকে, মোহাচ্ছন্ন মন অসম্ভবের কল্পনায় যেন বুঁদ হয়ে যেতে চায়। জ্বলজ্বলে শুকতারার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনের মধ্যে ডুক্‌রে ওঠে একটা গানের কলি বেদনায় সিক্ত : “ভাবি কোন তারাটির মাঝেই তুমি আছ নয়ন মেলে।”

শীত হোক্‌, গ্রীষ্ম হোক, রাত এগারোটা বাজলে তবেই খাবার ডাক পড়বে। শরৎচন্দ্রের মেজদার (কি মেজদির) এ যুগেও অভাব নেই। খাবার পর ডাক্তারের নির্দেশে আবার সেই অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকা। ড্রইং রুমে বসে রিমোটে চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এটা সেটা একটু দেখা। কোনওটিতেই বিশেষ মনোনিবেশ করতে পারেন না। অধিকাংশই মনে হয় trash। সংবাদ শুনবেন কি! বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কাঁটা বেছে মাছ বার করা একটা শক্ত কাজ। বঙ্কিমচন্দ্রের সেই বটতলার সাক্ষীর কথা ভেবে এক্ষেত্রেও অধিকাংশ সময় কোনও বিতর্কের মধ্যে যান না। কেবল ডাক্তারের পরামর্শই নয়, বিছানায় দেরী করে যাবার একটা গূঢ় কারণ আদিনাথের মনের কোণেই থাকে – ও তো কাউকে বলবার নয়। শয্যার অলংকার, শয্যার অহংকার ছিলেন তাঁর পত্নী। যতক্ষণ না ঘুমে চোখ ঢুলে আসে ততক্ষণ আদিনাথ ও দিকে পা বাড়ান না।

প্রতিদিন শোবার সময় পরম যত্নে পরিপাটি ক’রে দু’টি বালিসই পাতেন আদিনাথ। মনে তাঁর কি প্রত্যাশা। সে কথা অন্য কাউকে কেন, যেন নিজেকেও প্রকাশ করে বলা যায় না। আচ্ছা সত্যিই কি এটা কখনও সম্ভব যে, তাঁর বিগতা পত্নীর অশরীরী আত্মা এসে এলিয়ে পড়বে বিছানায় তাঁর পাশে। হয়তো পাগলেরই প্রলাপ। তবু, তবু যদি এমনটা হতে পারে এবং তাঁর পাশে তাঁর পত্নীর অস্তিত্বের কথা তিনি উপলব্ধি করতে পারেন, তবে কি তিনি পরম পুলকে আপ্লুত হয়ে যাবেন? নাকি ভয়ে চীৎকার করে উঠবেন? আদিনাথ ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না।

রাত একটা বেজে গেছে। শয্যায় যাবার সময় হ’ল আদিনাথের। বিছানা ঠিক করে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। ফিনিক দিয়ে জোৎস্না ফুটেছে। হ্যাঁ, আজ তো পূর্ণিমা। অবারিত জানলা দিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে জ্যোছনার বন্যা, আদিনাথ চোখ বুজলেন। কতক্ষণ কেটে গেছে তিনি জানেন না। একটা অপূর্ব সৌরভে সমস্ত ঘরটা ভরে গেছে। মাথার ভেতরটা কেমন যেন ঝিম্‌ঝিম্‌ করে, যেন একটা নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে যাবার অবস্থা। ধীরে ধীরে চোখ খোলেন তিনি। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যান। কোন্‌ অলক্ষ্য অনন্ত আকাশ থেকে ছায়াপথে নেমে এসেছে তাঁরই জানালায়। জানালার গরাদ কোথায় গেল ! ছায়াপথ বিসর্পিত তাঁর বিছানায়। সেই ছায়াপথ ধরে যেন উড়তে উড়তে ভাসতে ভাসতে তাঁর কাছে এসে উপস্থিত তাঁরই হারিয়ে যাওয়া প্রিয়া। এমন সৌন্দর্য তাঁর স্ত্রীর তিনি এর আগে কখনও দেখেন নি। তাঁর সুতনুটি যেন জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া। মায়াপুরীর কোন পরী যেন এসে উপস্থিত হয়েছে, নাকি স্বর্গের কোন দেবী !

অভিমান জড়ানো কন্ঠে তিনি বললেন, “কেন তুমি এতদিন আসনি, এই তোমার ভালবাসা! আমাকে আর কতদিন এ সংসারে ফেলে রাখবে! আজ এসেছো যখন আমায় নিয়ে চলো।”

কোন উত্তর না দিয়ে মুখের স্বর্গীয় হাসিটি নিয়ে দয়িতা পরম আদরে তাঁর দয়িতের মাথাটি নিজের কোলে তুলে নিলেন। ধীরে ধীরে মাথার চুলে পদ্মপাপড়ির মতন কোমল অঙ্গুলি দিয়ে বিলি কাটতে লাগলেন। পদ্মকোমল অন্য হাতটি বোলাতে লাগলেন পিঠে। তারপর শিশুকে আদর করার মতন ভঙ্গিমায় বিশ্বসংসারের সমস্ত স্নিগ্ধ সুরের নির্যাসের লাবণ্য ও মাধুরী কন্ঠে ঢেলে তিনি অস্ফুটে বললেন, “আর একটু কাল অপেক্ষা করো সোনা, সময় হোক্‌, আমি নিজে এসে নিয়ে যাব তোমায়।”

“দাদু, দাদু, ও দাদু ওঠো, কত বেলা হয়ে গেছে দেখো।” নাতির ডাকে চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন আদিনাথ। খানিক পরে চোখ ঘুরিয়ে দেখেন জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে এক ফালি রোদ এসে পড়েছে বিছানায়।

0 comments: