ধারাবাহিক - অমিতাভ প্রামাণিক
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে
অমিতাভ প্রামাণিক
চার
রামলোচন ঠাকুরের ঘরে এসেছেন কুলাচার্য নীলকান্ত ভট্ট, তিনি এক প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। বৈঠকখানায় বসে তার সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে তিন ভাই রামলোচন, রামমণি, রামবল্লভের। হঠাৎ সেখানে প্রবেশ মেজোভাই রামমণির পুত্র রাধানাথের। তার বয়স মাত্রই চার বছর, অতিশয় চঞ্চল বালক, সে এসেই বায়না জুড়ে দিলো, পোনমশাই, সেদিন যে বলছিলেন, সেই কারিকাটা একবার শোনান।
রামলোচনের বাড়ি কলকাতার মেছুয়াবাজারে, হালে কেউ কেউ একে জোড়াসাঁকো নামেও ডাকছে। তার পিতা নীলমণি ঠাকুরকে এখানকার বিঘেখানেক জমি দান করেছিলেন এখানকার আদি বাসিন্দা বিখ্যাত ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠ। শেঠজির গঙ্গাজলের ব্যবসা। বিয়ে-শ্রাদ্ধ-পুজো-আচ্চায় গঙ্গাজল তো লাগেই, শেঠজি তা সরবরাহ করেন কলকাতায় শুধু নয়, দূর দূরান্তরেও, মাটির হাঁড়িতে ভর্তি করে মুখবন্ধ অবস্থায়। অনেকেই পুকুরের জলকে গঙ্গাজল বলে চালায়, বৈষ্ণবচরণের সিলমোহর মারা হাঁড়িতে সেটি হবার জো নেই, তাই সবাই তার গঙ্গাজলকে বিশ্বাস করে। সুদূর দাক্ষিণাত্য থেকেও গঙ্গাজলের অর্ডার আসে তার অফিসে। ব্যবসা যে ফুলে ফেঁপে উঠবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সততাই একমাত্র মূলধন।
কিন্তু দান করতে চাইলেই তো হলো না। শূদ্রের দান, নীলমণি ঠাকুর ব্রাহ্মণসন্তান, গ্রহণ করেন কী করে? বৈষ্ণবচরণ বললেন, ঠিক আছে ঠাকুরমশাই, আপনি না নেন, আপনার লক্ষ্মীজনার্দন শিলা, তিনি তো করুণাময় ঈশ্বর, আমি এ জমি তাকেই দিলাম। নীলমণি আর কী করেন, ঈশ্বরকে দান যে কেউ করতে পারে, তাতে অস্বীকার করার অধিকার তার নেই, তিনি এই জমিতে এক আটচালা বেঁধে পরিবার নিয়ে সেখানেই স্থাপন করলেন তার লক্ষ্মীজনার্দন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বছর পনেরো পরের সময় এটা, গ্রাম বাংলা ছারখার হয়ে গেছে। লোকজন কাজের খোঁজে শহরমুখো, অন্নসংস্থান হওয়াই দায়। নীলমণির অবস্থা অবশ্য তত খারাপ নয়। কিছুদিনের মধ্যেই সেই জমিতে উঠে গেল পাকা বাড়ি।
নীলমণির তিন ছেলে, এক মেয়ে। জোড়াসাঁকোয় বসবাসের বছরখানেকের মধ্যেই মেয়ে কমলমণির বিয়ে হয়েছে বেহালায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের হরিশচন্দ্র হালদারের সঙ্গে। বড়োছেলে রামলোচন আর মেজো রামমণির শ্বশুর একই ব্যক্তি, যশোরের দক্ষিণডিহির রামচন্দ্র রায়। রামচন্দ্রের দুই মেয়ে অলকা আর মেনকার বিয়ে হয়েছে এই পরিবারে। রামলোচন-অলকার একটাই সন্তান হয়েছিল, মেয়ে শিবসুন্দরী। সে বেশিদিন বাঁচেনি, তারপর অলকার আর সন্তানাদি হয় নি। সেই নিয়ে দুজনেরই মনস্তাপ। মেজো রামমণির বৌ মেনকার রাধানাথ ছাড়াও আরো দুটো মেয়ে আছে, জাহ্নবী আর রাসবিলাসী। রাধানাথের জন্মের এক বছর পরে পরিবারের প্রধান তার ঠাকুর্দা নীলমণি মারা যান। মেনকা এখন আবার সন্তানসম্ভবা, অন্দরমহলে তার তদারকির জন্যে ধাত্রী নিয়োগ হয়েছে। বালক রাধানাথের তাই এখন সব সময় দেখভাল করার তেমন কেউ নেই, সে ছুটে ছুটে বেড়ায়।
রাধানাথের মুখে কারিকার কথা শুনে নীলকান্ত ভট্ট মজা পেলেন। তিনি বললেন, তুমি শুনেছ সেই কারিকা?
রাধানাথ বললো, শুনিচি বইকি। আপনি যে সেদিন এসে পড়ছিলেন, কী যেন ভোজনদোষকারিকা।
নীলকান্ত বললেন, অথ ঘ্রাণার্ধভোজনদোষকারিকা। সেইটে?
রাধানাথ বললো, হ্যাঁ। ঐ যে পীর আলির পদ্য, ঐটা শোনান।
নীলকান্ত আগের দিন এসে শুনিয়ে গেছিলেন। বালকের অনুরোধে আবার বলতে লাগলেন –
খান জাহান মহামান বাদশা নফর।
যশোরে সনন্দ লয়ে করিল সফর।।
তার মুখ্য মহাপাত্র মামুদ তাহির।
মারিতে বামুন ব্যাটা হইল জাহির।।
পূর্বেতে আছিল সেও কুলীনের নাতি।
মুসলমানী রূপে মজে হারাইল জাতি।।
পীর আলি নাম ধরে পীরল্যা গ্রামে বাস।
যে গাঁয়েতে নবদ্বীপের হল সর্বনাশ।।
রাধানাথ মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো, কেন কেন, নবদ্বীপের সব্বোনাশ হলো কেন?
নীলকান্ত বললেন, শুনলেই বুঝবে কেন সর্বনাশ হলো। এই মামুদ তাহির বা পীর আলি তো আসলে মুসলমান ছিল না, সে ছিল এক কুলীন ব্রাহ্মণের নাতি। কিন্তু এক সুন্দরী মুসলমান মেয়েকে তার পছন্দ হয়, তাকে সে বিয়ে করে ফেলে। ব্যাস, আর যাবে কোথায়, তার জাত চলে গেল। কুলীন ব্রাহ্মণ থেকে সটান মুসলমান। আর জানোই তো, হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের বিরোধ, তারা মুসলমানদের নীচু ভাবে। মুসলমানরা তা সহ্য করবে কেন? তারা সুযোগ পেলেই হিন্দুদের হেনস্থা করতে চায়। সেই জন্যেই পীরল্যা গ্রামের পীর আলি হিন্দুদের পবিত্র স্থান নবদ্বীপের সর্বনাশ করতে উদ্যত হলো।
রাধানাথ বললো, ও। এই পিরল্যা গ্রামটা কোথায় পোনমশাই? সেখানে আমাকে নিয়ে যাবেন? আমি পীর আলিকে দেখতে চাই।
নীলকান্ত বললেন, সে কি আজকের কথা বাছা? দাঁড়াও হিসাব করি। আজ থেকে সাড়ে তিনশো বছরেরও আগের কাহিনি এটা। চৈতন্য মহাপ্রভুর নাম শুনেছ তো? তিনি জন্মেছিলেন আজ থেকে তিনশো বছর আগে। এটা তারও পঞ্চাশ বছর আগের কথা। চৈতন্যের জীবনী লিখেছিলেন জয়ানন্দ গোস্বামী, তার নাম চৈতন্যমঙ্গল। সেখানেও তিনি লিখেছিলেন –
পিরল্যা গ্রামেতে বৈসে যতেক যবন।
উচ্ছন্ন করিল নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণে যবনে বাদ যুগে যুগে আছে।
বিষম পিরল্যা গ্রাম নবদ্বীপের কাছে।।
মানে নবদ্বীপের কাছেই ছিল সেই পিরল্যা গ্রাম। এখন বোধ হয় আর নেই।
এমন অদ্ভূত গ্রাম যেখানে একজন ব্রাহ্মণের নাতি মুসলমান হয়ে বাকি ব্রাহ্মণদের সর্বনাশ করে দিলো, সেটা আর নেই শুনে রাধানাথের মন খারাপ হয়ে গেল। সে মনে মনে ভাবছিল, দেখা হলে সে এর শোধ তুলবে, পীর আলিকে ভীমের মত গদা দিয়ে উরুভঙ্গ করে। গ্রামই যখন নেই, পীর আলি কি আর আছে? সে বলল, তারপর কী হলো পোনমশাই? নীলকান্ত বললেন, শোনো, কী হয়েছিল, সেই কাহিনি –
আঙিনায় বসে আছে উজীর তাহির।
কত প্রজা লয়ে ভেট করিছে বাহির।।
রোজার সেদিন পীর উপবাসী ছিল।
হেনকালে একজন নেবু এনে দিল।।
গন্ধামোদে চারিদিক ভরপুর হৈল।
বাহবা বাহবা বলি নাকেতে ধরিল।।
কামদেব জয়দেব পাত্র দুইজন।
বসে ছিল সেইখানে বুদ্ধে বিচক্ষণ।।
কী করেন কী করেন বলিলা তাহারে।
ঘ্রাণেতে অর্ধেক ভোজ শাস্ত্রের বিচারে।।
পাঠে আবার বাধা পড়ল। রাধানাথ বলে উঠলো, পোনমশাই, কে এই কামদেব-জয়দেব? তারা সেখানে বসে ছিল কেন?
নীলকণ্ঠ ভট্ট বললেন, সে তো বাছা অনেক দিনের গল্প। ছোট করে বলি শোনো। সেন বংশেরবিখ্যাত রাজা ছিলেন বল্লালসেন, তার পুত্র লক্ষ্মণসেন। বল্লালসেন যখন রাজা, একসময় রাজপুত্র লক্ষ্মণসেন বেশ অনেকদিন রাজপুরীতে ছিলেন না, বন্ধুবান্ধব নিয়ে কোথাও শিকারে টিকারে গেছিলেন। তার বৌ বেচারি স্বামী বাড়ি নেই বলে দুঃখে কাতর, কিন্তু কাউকে বলতেও পারছে না। তো একদিন করেছে কী, নদীতে স্নান করে দেবমন্দিরে গিয়ে মন্দিরের গায়ে কাঠকয়লা দিয়ে লিখে রেখে এসেছে এক সংস্কৃত শ্লোক –
পতত্যবিরতং বারি নৃত্যন্তি শিখিনো মুদা।
অদ্য কান্তঃ কৃতান্তো বা দুঃখস্যান্তং করিষ্যতি।।
কিন্তু দুঃখের অন্ত কে করবে? রাজা বল্লালসেন মন্দিরে গিয়ে দেখতে পেলেন সেই লেখা। অমনি খোঁজ খোঁজ, কে লিখেছে এটা। জানতে পারলেন, এটা তার পুত্রবধূর কাজ। অমনি তিনি তার চর অনুচরদের ডেকে বলে দিলেন কাল সকালের আগেই যে লক্ষ্মণকে রাজপ্রাসাদে এনে দিতে পারবে, তাকে তিনি উপযুক্ত বকশিশ দেবেন। এদিকে কুমার লক্ষ্মণ তখন নদীতে মাছ ধরছিলেন। সূর্য নামে এক মাঝি খবর পেয়ে তাকে নিয়ে গেল রাজার কাছে। ফলে সেই মাঝি রাজার কাছে পুরস্কারস্বরূপ পেলো কতগুলো গ্রাম, তার নাম হয়ে গেল সূর্যদ্বীপ বা সূজদীয়া পরগণা। সে সেখানকার জমিদার হয়ে গেল, তার কাছাকাছি অঞ্চলের জমিদার ছিল শরণি গুড়। এই সূর্যমাঝির পৌত্রের প্রপৌত্র, মানে অধস্তন পঞ্চম পুরুষকে আবার মুসলমান বানিয়ে দিলো শরণি গুড়ের পৌত্রের প্রপৌত্র রমাপতি গুড়।
এই গুড় কিন্তু খাবার জিনিস না, এটা একটা জায়গার নাম। গৌড়ের কাছেই এক গ্রাম, তার নাম গুড়। রাজা আদিশূর কনৌজ থেকে পাঁচ ব্রাহ্মণ আনিয়ে যজ্ঞ করেছিলেন, তার মধ্যে একজন ছিলেন কাশ্যপগোত্রীয় দক্ষ। দক্ষের চোদ্দটা ছেলে, একজনের নাম ধীর। ধীর আদিশূরের ছেলে ভূশুরের কাছ থেকে সেই গুড় গ্রামটা পেয়েছিল থাকার জন্যে। ধীরের অধস্তন সপ্তম পুরুষ রঘুপতি আচার্য ছিল পণ্ডিত মানুষ। তিনি কাশী গিয়ে সেখানকার দন্ডিসমাজে অনেক পাণ্ডিত্য দেখানোয় তারা তাকে সোনার এক দণ্ড উপহার দিয়েছিল বলে তার উপাধি হয়ে গেল কনকদণ্ডী গুড়।
এই রঘুপতির পুত্র হচ্ছে সেই রমাপতি গুড় আর রমাপতির পৌত্র হচ্ছে জয়কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী, তার দুই পুত্র নাগররায় আর দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরী। এরা হচ্ছে যশোরের চেঙ্গুটিয়া পরগণার ভূস্বামী।এই যে রায় বা রায়চৌধুরী, এগুলো হচ্ছে মুসলমান রাজাদের দেওয়া উপাধি, মানে এরা নিজেদের পাণ্ডিত্য দেখিয়ে রাজদ্বারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। এরা কোন মুসলমান রাজার আনুগত্য পেয়েছিলেন জানো? ঐ কারিকায় বললাম, খান জাহান মহামান বাদশা নফর, তার। সে আসল বাদশা নয়, বাদশা হচ্ছে গৌড়ের পাঠান সুলতান, সে সময় নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ। তার কাছ থেকে সনন্দ নিয়ে বাদশার নফর খানজাহান আলী সুন্দরবনে আবাদ করতে যশোরে আসেন, সঙ্গে আনেন ঐ কুলীন ব্রাহ্মণের নাতি মহম্মদ তাহিরকে।
সুন্দরবনে আবাদ করতে হলে তো বনজঙ্গল কেটে চাষের উপযুক্ত জমি তৈরী করতে হবে, তার জন্যে প্রচুর লোকজন চাই, খানজাহান তা কোত্থেকে পাবে? মুসলমান রাজত্বে নিয়ম ছিল যে সম্রাটের আদেশ নিয়ে কেউ কোথাও গেলে সেখানকার জমিদার তাকে সাহায্য করবে লোকজন ইত্যাদি দিয়ে। একে বলা হত মদত দেওয়া। খানজাহান মদত এনেছিলেন চেঙ্গুটিয়ার জমিদার রায়চৌধুরীদের নামে, সেখানে এসে সেই পরোয়ানা দাখিল করলে তারা বললেন, ঠিক আছে, লোকজন যা লাগবে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, তুমি বনজঙ্গল কেটে চাষ আবাদ করো, কিন্তু যে জমি আবাদ হবে তার রাজস্ব আদায়ের ভার কিন্তু আমার। খানজাহানের রাজি না হয়ে কোনো উপায় নেই, সে তাতে রাজি হয়ে গেল।
বন কাটার শুরুতেই খানজাহান বুঝে ফেললেন, রাস্তা আর পানীয় জলের ব্যবস্থা না করে দিলে লোকজনের রসদ সরবরাহ করা যাবে না, তাতে তারা খাদ্যাভাবে ও জলকষ্টে মরবে। তিরিশ ফুট পাকা রাস্তার পত্তন হলো আর তার ধারে প্রতি ক্রোশ অন্তর একটা করে দিঘি। ৩৬০০ জন কুলিমজুর এক বছর কাজ করে এক বিরাট জায়গা জঙ্গলশূন্য করে দিল, সেখানে পাকা রাস্তা ও বড় বড় দিঘি থাকায় বসবাসের পক্ষে অতি লোভনীয় জায়গা হয়ে উঠলো। গৌড় থেকে সেখানকার জমিদারি স্বত্ত্বও পেয়ে গেলেন খানজাহান আর পূর্বপ্রতিশ্রুতিমত রায়চৌধুরীদের পত্তনিও দিয়ে দিলেন তিনি। দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর তো পোয়াবারো, বিশেষ কিছু না করেই তিনি বিশাল ভূখণ্ডের জমিদারি পেয়ে গেলেন আর তাতে গ্রাম নগর পত্তন করতে লাগলেন। রাজধানীও স্থাপন হল সেই ভূভাগের মধ্যে, ভৈরব নদীর ধারে। দুশো বিঘা জমির ওপরে নির্মিত হল রাজপ্রাসাদ, তার তিন মাইল দূরে বিশাল দিঘি খোঁড়া হল, তার নাম হয়ে গেল খাঞ্জে আলির দিঘি। ষাট-গম্বুজ নামে বিরাট এক মসজিদ স্থাপন হলো রাজপ্রাসাদের কাছে। এছাড়া ৩০ ফুট চওড়া প্রধান সড়কের পাশে যে দিঘিগুলো খোঁড়া হয়েছিল, সব মিলিয়ে ৩৬০ খানা, তার প্রতিটির কাছে এক একটা করে মসজিদ বানানো হলো।
খান জাহান আলী প্রসিদ্ধ হয়ে উঠলেন, মামুদ তাহির হলেন তার উজির। রাজস্ব আদায় করতেন দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরী। তার চার ছেলে এক মেয়ে। বড় দুই ছেলের নাম কামদেব আর জয়দেব। তারা পিতার সহকারী এবং জমিদার ও উজিরের বিশেষ প্রিয়পাত্র। এবার বুঝলে, রাধুবাবু, কেন তারা সেখানে বসেছিল?
এই বিরাট আখ্যান শুনতে শুনতে ধৈর্য হারানো তো দূরের কথা, রাধানাথের আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। সে বলে উঠলো, হ্যাঁ বুঝলাম। তার পর কী হলো পোনমশাই? কামদেব জয়দেব ‘কী করেন, কী করেন’ বললো তো তখন মামুদ তাহির কী করলেন?
নীলকণ্ঠ বললেন, মুসলমান উজির রোজা পালন করছিলেন। সেদিন ছিল শবেবরাত, রোজার শেষ দিন। আর একটু সময় গেলেই উপবাস ভঙ্গ, এ সময় কোনো মানে হয় এই রকম ঠাট্টা করার? একজন রোজার উপবাস পালন করছে, তাকে বলা হল তুমি লেবু শুঁকেছ আর তার ঘ্রাণে অর্ধভোজন, মানে তোমার অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেছে, সুতরাং উপবাস বৈধ নয়! তার মানে রোজা ভঙ্গ হয়ে গেছে। এই অহেতুক ঠাট্টা একজন ধর্মভীরু মুসলমান উজিরের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব? সুতরাং –
দিন পরে মজলিস করিল তাহির।
জয়দেব কামদেব হৈল হাজির।।
দরবারের চারিদিকে ভোজের আয়োজন।
শত শত বকরি আর গোমাংস রন্ধন।।
পোলাও লসুন গন্ধে সভা ভরপুর।
সেই সভায় ছিল আরো ব্রাহ্মণ প্রচুর।।
নাকে বস্ত্র দিয়া সবে প্রমাদ গণিল।
ফাঁকি দিয়া ছলে কলে কত পলাইল।।
কামদেবে জয়দেবে করি সম্বোধন।
হাসিয়া কহিল ধূর্ত তাহির তখন।।
জারিজুরি চৌধুরী আর নাহি খাটে।
ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন শাস্ত্রে আছে বটে।।
নাকে হাত দিলে আর ফাঁকি তো চলে না।।
এখন ছেড়ে ঢং আমার সাথে কর খানাপিনা।।
রাধানাথ বলে উঠলো, খানাপিনা করলো তারা উজিরের সঙ্গে?
নীলকণ্ঠ বললেন, ঢিল ছুঁড়লে পাটকেল তো খেতে হবেই। পড়েছ যবনের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে! সুতরাং, বুঝতেই পারছ–
দুইজনে ধরি পীর খাওয়াইল গোস্ত।
পিরালী হইল তারা হৈল জাতিভ্রষ্ট।।
কামাল জামাল নাম হইল দোঁহার।
ব্রাহ্মণসমাজে পড়ে গেল হাহাকার।।
শুধু রাধানাথ নয়, তার বাবারা তিন ভাইও এই আলোচনা শুনছিলেন। রামলোচন জানেন এ তাদের নিজের পারিবারিক ইতিহাস। শুনেছেন নিজের পিতা নীলমণির কাছে। ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রাঙ্গনেই হয়েছিল সেই মজলিস। তাতে উপস্থিত আশেপাশের অনেক সম্ভ্রান্ত মানুষেরা। যথেচ্ছ পেঁয়াজ রসুন সহযোগে গোমাংস রন্ধন হচ্ছিল কাছেই, তার গন্ধে চতুর্দিক আমোদিত। কামদেব জয়দেব সহ অন্যান্য হিন্দুরা গন্ধ পেয়ে নাকে কাপড় চাপা দিলেন। উজির বললেন, আপনারা কি গন্ধ পাচ্ছেন বলে নাকে কাপড় দিয়েছেন? ওরা বললেন, হ্যাঁ। ব্যাস, আর যাও কোথায়! উজির বললেন, তবে তো আপনাদের অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেছে, আপনাদের শাস্ত্রেই তো আছে ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম্। অন্য হিন্দু রাহ্মণরা শুনে এদিক ওদিক দিয়ে পালিয়ে গেলেন, কিন্তু উজির আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, এদের ছাড়লেন না, বললেন, অর্ধেক খাওয়া যখন হয়েই গেছে, পুরো খেতে দোষ কী? জোর করে ওদের মুখে গোমাংস ঢুকিয়ে দিলেন তারা। বললেন, হিন্দুত্ব যখন গেছেই, তখন পবিত্র মুসলমান ধর্মই গ্রহণ করা উচিত তবে তোমাদের। সে রাত্রেই কলমা পড়িয়ে মুসলমান বানিয়ে নতুন নাম দেওয়া হলো তাদের। কামদেব হলেন কামালুদ্দিন খান আর জয়দেব হলেন জামালুদ্দিন খান। খানজাহান তাদের নিকটবর্তী শিঙ্গিয়া গ্রাম দান করলেন। তার কাছে মাগুরা নামে এক গ্রাম ছিল, দুভাই গিয়ে উঠলো সেইখানে।
দক্ষিণানাথের আরো দুই পুত্র আর এক কন্যা ছিল। তাদের নাম রতিদেব, শুকদেব আর রত্নমালা। তারা তখন দক্ষিণডিহিতে থাকতো। এই খবর পেয়ে তারা মর্মাহত হয়ে গেলেন, কিন্তু নিজের ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা তো সম্ভব না। যতদিন মাগুরায় বাড়ি বানানো না হলো, ততদিন দক্ষিণডিহিতেই থাকতে লাগলো বড় দু ভাই-এর স্ত্রী-পুত্র-পরিজন। তারাও নিজেদের পৈতৃক বাড়িতে যাতায়াত করতে লাগলেন সম্পত্তি ও পরিজনদের কারণে। হিন্দুসমাজ একে একেবারেই ভাল চোখে দেখলো না। ফলে শুধু বড় দুভাই নয়, বাকিরাও সমাজের চোখে জাতিভ্রষ্ট বলে পরিগণিত হলো। তা সহ্য করতে না পেরে রতিদেব গৃহত্যাগী হলেন, তার কোনো সন্তানসন্ততি ছিল না। ভাই শুকদেবেরও অবস্থা সঙ্গিন। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত বিবাহযোগ্যা ভগিনী রত্নমালাকে পাত্রস্থ করতে দম বের হবার উপায় হলো শুকদেবের। বিশাল সম্পত্তির মালিক গুড় রায়চৌধুরীদের সম্বন্ধে সকলেই ওয়াকিবহাল, তাদের সম্বন্ধে মুখরোচক গল্প ছুটেছে বাতাসেরও আগে। ফলে আশেপাশের সবাই জেনে গেছে। মোটা অঙ্কের বকশিস ধার্য করে একগাদা ঘটক লাগিয়েও সুবিধে হলো না। নিজেদের পরিবারের কাছে পতিত হবার ভয়ে কেউ রত্নমালাকে বিয়ে করতে চায় না। তার বয়স বেড়ে যেতে লাগলো। শুকদেবের চোখে ঘুম নেই। তার এক মেয়েও আছে, সেও বড় হচ্ছে।
মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্রাহ্মণযুবক দক্ষিণডিহির কাছে ভুগীলহাটে বিদ্যাশিক্ষার জন্যে যাচ্ছিলেন – সেখানে অনেক টোল-ফোল ছিল পণ্ডিতদের– পথে সন্ধ্যা নেমে যাওয়ায় জমিদার-বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কৌশলে তাকে প্রায় আটকে রেখে প্রচুর জমিজমা ও উপঢৌকন দানের লোভ দেখিয়ে ও এই বুঝিয়ে যে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছে তার বড় ভাইরা, সে নয়, তার পরিবার ব্রাহ্মণই আছে এখনও, তার সঙ্গে রত্নমালার রাতারাতি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।
শুকদেবের কন্যাকে পাত্রস্থ করতেও ভাগ্য সহায় হয়েছিল। শান্ডিল্য ভট্টনারায়ণ দীন কুশারীর বংশধর খুলনার পিঠাভোগের শ্রোত্রিয় জমিদার জগন্নাথ কুশারী একদিন ভৈরব নদী দিয়ে বজরায় কার্যোপলক্ষে যাচ্ছিলেন। ভৈরবতীরে দক্ষিণডিহির কেয়াতলায় এক কালীমন্দির ছিল, স্থাপন করেছিলেন শুকদেবের পিতা দক্ষিণানাথ। সন্ধ্যায় ভীষণ ঝড়জল শুরু হলে বজরা পাড়ে লাগিয়ে সেই কালীমন্দিরে উঠলেন তারা, মন্দিরের কর্মচারীরা খবর পাঠালে শুকদেব নিজে ঘোড়ায় চড়ে সেই ঝড়জলের রাত্রে হাজির হলেন কালীমন্দিরে, আদরযত্ন করে জগন্নাথকে নিয়ে গেলেন নিজের প্রাসাদে।
কুশারীরা ভট্টনারায়ণের পুত্র দীন কুশারীর বংশজাত। রায়চৌধুরীদের পূর্বপুরুষ যেমন গৌড়ের কাছে গুড় গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন, এরা করেছিলেন বর্ধমানের কাছে কুশ গ্রামে, পেয়েছিলেন মহারাজ ক্ষিতিশূরের কাছ থেকে। কালে এরা সচ্ছোত্রিয় বা কুলীন শ্রোত্রিয় আখ্যা পান। কুশ গ্রাম থেকে তাদের বিস্তার ঘটে অন্যান্য জায়গাতেও। জগন্নাথের পরিবার যেমন পিঠাভোগের। দীন কুশারীর কয়েক পুরুষ পরে তাদের বংশের একজনের নাম কুমার, তার দুইপুত্রের একজনের নাম বিষ্ণু। বিষ্ণুর তিনপুত্রের একজনের নাম হরি বা হাড়। হরির চারপুত্রের কনিষ্ঠটির নাম গোবর্ধন, তার পাঁচপুত্রের বড়টি মহাদেব। মহাদেবের পাঁচপুত্রের একজন রামগোপাল, তার পুত্র এই জগন্নাথ।
রাত্রে আহারাদির সময় জানা গেল জগন্নাথ অকৃতদার। অমনি তার কাছে প্রস্তাব গেল শুকদেবের কন্যার জন্যে। জগন্নাথ দেখলেন, কন্যাটি অতীব সুন্দরী। জগন্নাথ উদারমনা যুবক, তিনি এই বিয়েতে রাজি হলেন। কয়েকদিনের মধ্যে সেই বিয়ে হয়ে গেল। বৌনিয়ে জগন্নাথ দেশে যেতেই শুরু হয়ে গেল জ্ঞাতিগুষ্টির কাছে গঞ্জনা। পতিত ব্রাহ্মণকন্যাকে বিবাহের অপবাদে তার সকল আত্মীয়রা তাকে পরিত্যাগ করলেন। উপায় না পেয়ে জগন্নাথ বৌ নিয়ে চলে এলেন শ্বশুরালয়ে। শুকদেব নরেন্দ্রপুরের কাছে উত্তরপাড়া নামে এক গ্রামসংলগ্ন বারোপাড়া গ্রাম তাদের দান করলেন।
বারোপাড়ায় জগন্নাথ বৌ নিয়ে গুছিয়ে বসলেন। একে একে তার প্রিয়ঙ্কর, পুরুষোত্তম, হৃষীকেশ ও মনোহর নামে চার পুত্র জন্মায়। পুরুষোত্তম কুশারীর পুত্র বলরাম, তার পুত্র হরিহর, তার পুত্র রামানন্দ, তার দুই পুত্র – মহেশ্বর ও শুকদেব।
মহেশ্বর-শুকদেব দু’ভাই আর মহেশ্বরের ছেলে পঞ্চাননআবার কোনো এক কারণে জ্ঞাতিকলহ শুরু হলে বারোপাড়ার ভিটে ছেড়ে আদিগঙ্গার ধারে গোবিন্দপুরে বসতি স্থাপন করেন। তখন এর নাম গোবিন্দপুরের খাঁড়ি, পরে এর নাম হয় টালির নালা। সেখানকার অধিবাসীরা মাছধরার জেলে, মালো, কৈবর্ত। তারা ব্রাহ্মণসন্তান পেয়ে এদের পুজো-আচ্চার কাজে ডাকাডাকি শুরু করলে এদের এতদিনের কুশারী পদবি বিলীন হয়ে ঠাকুর পদবি শুরু হয়ে যায়। পঞ্চানন ও কাকা শুকদেব পুজোপাঠের সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে লাগা বিদেশী জাহাজের মুৎসুদ্দির কাজ শুরু করেন। ঘাটে জাহাজ লাগলেই এরা তাতে চড়ে যেতেন, জাহাজের ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে খোশগল্প করতেন ও তাদের কী কী দরকার তা জেনে নিয়ে তা সরবরাহ করতেন। প্রথম প্রথম শুরু করেছিলেন ফলমূলাদি দিয়ে, পরে তারা যা চাইত, তাই সরবরাহের বরাত নিতে লাগলেন। এই দালালির সুবিধে ছিল যে, ক্যাপ্টেনরা এখানে এক একটা জিনিসের কেমন দাম হওয়া উচিত, তা কিছুই জানত না। ফলে তাদের কাছে যা খুশি দাম চাওয়া যেত। ফলে প্রবল লাভ। অবশ্য ক্রমে অর্থনীতির নিয়মে এর মধ্যেও রেষারেষি বেড়ে উঠলো, স্থানীয় লোকে ক্যাপ্টেন ধরতে জেলেডিঙি নিয়ে চলে যেত আরো এগিয়ে কলাবেড়ে-জয়নগর অবধিও, মারামারি করত নিজেদের মধ্যে। তবে ঠাকুরদের একটা অতিরিক্ত সুবিধে ছিল যে, তারা লেখাপড়া জানত বলে বিদেশীদের সঙ্গে কথাবার্তা ভাল বলতে পারত।
বেশ দু-পয়সা জমিয়ে তারা বাড়ি তুলে ফেললো গোবিন্দপুরে।
এই সময় তৈরী হচ্ছিল ইংরেজদের কেল্লা, ফোর্ট উইলিয়াম। কাকা-ভাইপো নিজের উদ্যোগে গিয়ে আলাপ করলেন ইংরেজ গভর্ণর, ক্যাপ্টেন, কুঠিয়ালদের সঙ্গে। তার ফলে গঙ্গায় মারামারি করে জাহাজ ধরার বদলে তারা সরাসরি ফোর্টে মাল সরবরাহ করার বরাত পেয়ে গেলেন, ব্যবসা হিসাবে সে অনেক বড়সড় ব্যাপার। গ্রামের লোক তাদের ঠাকুর বলে ডাকে, ইংরেজরা ঠাকুর বলতে পারে না, বলে টেগোর। ইংরেজরা মাল সাপ্লাই পেয়ে বিল কাটতে লাগলেন টেগোর নামেই।
কাকা শুকদেবের কৃষ্ণচন্দ্র আর ভাইপো পঞ্চাননের জয়রাম ও রামসন্তোষ নামে দুই পুত্র হয়। কৃষ্ণচন্দ্র, জয়রাম, রামসন্তোষ তিনজনেই ফার্সীভাষা ভাল জানতেন, কিছু কিছু ইংরাজিও শিখে নিয়েছিলেন ইংরেজদের সঙ্গে ওঠাবসার ফলে, বিশেষ করে জয়রাম। পঞ্চানন অতি করিৎকর্মা পুরুষ, যেই জানলেন কম্পানির সরকারে বেতন বিভাগের অধ্যক্ষের অধীনে প্রধান কর্মচারির একটা পদ খালি হয়েছে, ইংরেজ মুরুব্বিদের ধরে নিজের ছেলে জয়রামকে দিলেন সেই পদে ঢুকিয়ে। ইংরেজ গভর্ণরের অধীনে চারখানা অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল, তারমধ্যে একজন হচ্ছেন রেভিনিউ অফিসার। পরে এর নাম হয় কালেক্টর। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছ থেকে কলকাতা সুতানুটি গোবিন্দপুর হস্তগত হবার পর ইংরেজ রাজপুরুষ সেলডন সাহেব প্রথম কলকাতার কালেক্টর হিসাবে নিযুক্ত হন। সেলডন বলেন, তার কাজের সুবিধার জন্যে এখানকার জমি জরিপ করা প্রয়োজন, তার জন্যে চাই সার্ভেয়ার বা আমিন। পঞ্চানন ঠাকুর আবার একে তাকে ধরে নিজের দুই ছেলে জয়রাম ও রামসন্তোষকে সেই আমিনের চাকরিতেও ঢুকিয়ে দেন। ফলে ইংরেজদের অধীনে জয়রামের ডবল চাকরি চলতে থাকে একই সঙ্গে, উপার্জনও চলে রমরমিয়ে। তিন গ্রামের যাবতীয় জমি জরিপ হয় এই দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে। উপার্জিত অর্থেজয়রাম নতুন প্রাসাদ, বৈঠকখানা ও বাগানবাড়ি বানিয়ে ফেলেন ধনসায়রে, পরে যার নাম হয় ধর্মতলা।
পঞ্চানন ঠাকুরের মৃত্যুর পর জয়রামের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের বিবাদ বাধলে কৃষ্ণচন্দ্র ধনসায়রের বাস উঠিয়ে সুতানুটিতে চোরবাগানে বাস স্থাপন করেন। ইংরেজদের মাল সরবরাহ করার বদলে তিনি ইংরেজ কুঠির সঙ্গে অন্যান্য বাণিজ্য শুরু করেন, তাতে তার বিস্তর উপার্জন হতে থাকে। মানিকতলার কাছে কৃষ্ণবাগান নামে এক বিশাল বাগান, দীঘি ও প্রাসাদ নির্মাণ করেন। কলকাতায় বিখ্যাত শ্রেষ্ঠী উমিচাঁদের নন্দনবাগান ছাড়া আর এ রকম প্রমোদকানন আর কারো ছিল না সে সময়। বস্তুত এই দুজনই শহরের উপকণ্ঠে বাগানবাড়ি নামক প্রমোদজনক বস্তুটির উদ্ভাবক।
ততদিনে ইংরেজদের প্রভাব বাড়তে শুরু করেছে, আর সেই সূত্রে কলকাতার দক্ষিণে আরও দশ মাইল পর্যন্ত জায়গায় আটত্রিশখানা গ্রাম তারা কিনে নেয়। এর জমি জরিপ করার ভারও ন্যস্ত হয় জয়রাম-রামসন্তোষ ঠাকুর ভাইদের ওপরেই। তাদের উপার্জন বাড়তেই থাকে। এই আটত্রিশখানা গ্রামের পার্শ্ববর্তী সমস্ত ভূখন্ডের জমিদার নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের। তার সঙ্গেও জয়রামের ঘনিষ্টতা জন্মে। তিনি বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন রাধাকান্তজীউ বিগ্রহ। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রাধাকৃষ্ণের ভক্ত, সেই বিগ্রহের সেবায় তিনি ৩৩১ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন জয়রামকে।
সে সময়বাংলায় প্রতিবছরই মারাঠা দস্যুদেরপ্রচণ্ড হামলা হত, তাদের বলা হতো বর্গী। ঘোড়ার পিঠে চড়ে আকস্মিকভাবে হানা দিয়ে সব লুটেপুটে নিয়ে কেটে পড়ত তারা। নবাবের সেপাইরা তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত না। সাধারণ মানুষের জন্য সেটা ছিল এক দুর্বিষহ অবস্থা। মায়েরা বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে ছড়া কাটত –
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে।
ধান ফুরালো পান ফুরালো এখন উপায় কী?
আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি।
কলকাতায় ঢুকতে হলে ভাগীরথী নদী পেরিয়ে আসতে হতো, সেটা বড় সহজ ব্যাপার নয়। বর্গীদের স্থলপথের আক্রমণ ঠেকাতে কলকাতার উত্তর-পূর্ব দিকে নালা কাটার পরিকল্পনা করা হয়।তখন নবাব খুব প্রতাপশালী আর ইংরেজরা তাদের ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণে ব্যস্ত। বর্গীদের হাত থেকে কলকাতাকে রক্ষা করার জন্য চারিদিকে মারাঠা ডিচ বা নালা খনন করার পরিকল্পনা করে ইংরেজরা। মূলত তাদের বাণিজ্যের সম্পদ রক্ষা করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। সে কাজে কলকাতাবাসীও চাঁদা দিয়েছিল। মারাঠা ডিচ খননের সময় জয়রাম ঠাকুর তার প্রধান আমিন ছিলেন। সেটা অবশ্য পুরোটা খোঁড়ার দরকার হয়নি শেষমেষ। ১৭৫১ সালে নবাবের সঙ্গে মারাঠাদের সন্ধির ফলে বর্গীদের আক্রমণ আশঙ্কা থেমে গেল। নালাটি সাত মাইল লম্বা করার পরিকল্পনা ছিল। ছ’মাসে অবশ্য কাটা হয়েছিল তিন মাইল। পরে তা বুঁজিয়ে দিয়ে সার্কুলার রোড বানানো হয়।
জয়রামের দুই স্ত্রী, দুজনেই যশোরের, গঙ্গাদেবী ও রামধনি। এদের মোট চার পুত্র ও এক কন্যা – আনন্দীরাম, নীলমণি, দর্পনারায়ণ ও গোবিন্দরাম এবং কন্যা সিদ্ধেশ্বরী। আনন্দীরাম খুব ভাল ইংরাজি শিখেছিলেন, কিন্তু পিতার অপ্রিয় কোনো কাজ করায় তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। জয়রাম বেঁচে থাকতেই তার মৃত্যু হয়। আনন্দীরামের রামনিধি আর রামতনু নামে দুই পুত্র ছিল।
জয়রামের মেজোছেলে নীলমণিই হচ্ছে রামলোচন-রামমণি-রামবল্লভের পিতা।
জয়রামকে রামলোচনের বিশেষ মনে পড়ে না। ১৭৫৬ সালে ইংরেজরা তাদের ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ মেরামত করছিল। সেই মেরামতির কালেই জয়রামের মৃত্যু হয়, তখন রামলোচন একেবারেই শিশু। মৃত্যুকালে জয়রামের পরিবারবর্গ ছিল ধনসায়রের বাড়িতে। এর কিছুকাল পরেই দুর্গ মেরামতির অজুহাতে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করেন ও ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ওপর গোলাবর্ষণ করেন। নবাবের সেনাবাহিনী শহর লুঠ করে। দুর্গ ধূলিসাৎ তো হয়ই,এতে শহরবাসীরও প্রচুর ক্ষতি হয়। তার অন্যতম ছিল জয়রামের বসতবাটি, যেটা ছিল ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের পাশেই। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয় হলে ইংরেজরা নবাবের রাজকোষ লুঠ করে। পরের নবাব মীরজাফর ইংরেজদের ও কলকাতা শহরবাসীদের ক্ষতিপূরণ দেন। নীলমণি ও দর্পনারায়ণ পান তেরো হাজার টাকা। গড়ের মাঠ বাড়ানোর জন্যে ইংরেজরা ঠাকুরদের ধানসায়রের সম্পত্তি কেনার প্রস্তাব দিলে তারা তা বিক্রি করে দিয়ে চলে যান সুতানুটি গ্রামের পাথুরিয়াঘাটায়। ১৭৬৪ সালে রামচন্দ্র কলু নামে এক স্থানীয় বাসিন্দার কাছ থেকে ৫২৫ টাকায় ঘরবাড়ি সমেত সাড়ে দশকাঠা জমি কিনে শুরু হয় ঠাকুরদের কলকাতার বসতবাড়ি। নীলমণি এর আগে ও পরে আরো দু তিন জায়গায় জমি কিনে নিজের সম্পত্তি বাড়িয়ে নেন। ১৭৫৭ সালেক্লাইভ নতুন ফোর্ট উইলিয়ম বানানো শুরু করলে গোবিন্দরাম তাতে ইন্সপেক্টর ছিলেন, তা থেকে তার প্রভূত উপার্জন হয়।
আনন্দীরাম আগেই মারা গেছেন। বাকি তিন ভাই ও তাদের পরিবারবর্গ নিয়ে শুরু হয় পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার। তার প্রধান নীলমণি। সম্পত্তি তিনি তার নিজের নামেই কেনেন। তিন ভাইই বিয়ে করেন যশোরের দক্ষিণডিহিতে। নীলমণির স্ত্রীর নাম ললিতা, দর্পনারায়ণের দুই স্ত্রী, তারাসুন্দরী ও বদনমণি, আর গোবিন্দরামের স্ত্রী রামপ্রিয়া। রামপ্রিয়ার সন্তানাদি ছিল না। দর্পনারায়ণের প্রথমা স্ত্রীর পাঁচ পুত্র, দ্বিতীয়ার দুই পুত্র এক কন্যা।
নীলমণি পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতে রাধাকান্ত বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া গোবিন্দপুরে পঞ্চানন ঠাকুরের আদি বাড়িতে যে শিব প্রতিষ্ঠা করা ছিল, সেটাকেও উঠিয়ে এনে গঙ্গাতীরে স্থাপন করে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, তার নাম হয়ে যায় শিবতলা। শিবমন্দিরের নীচে নীলমণি গঙ্গাতীরে একটা ঘাট বাঁধিয়ে দেন, তাকে বলা হতে থাকে শিবতলার ঘাট। এই শিবতলার ঘাটের কাছেই এক বাড়িতে নিজগৃহ-বহিষ্কৃত আনন্দীরাম ঠাকুর থাকতেন মৃত্যুর আগে অবধি।
পিতা জয়রামের মৃত্যুর কিছু আগে থেকেই নীলমণি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনের চাকরি করছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর শেয়ারও কিনেছিলেন গৃহদেবতা রাধাকান্ত জীউয়ের নামে। ১৭৬৫ সালে কম্পানী বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। ক্লাইভ নতুন দেওয়ান হয়ে রাজস্ব আদায়ের নতুন ব্যবস্থা শুরু করেন, নীলমণি ঠাকুরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় উড়িষ্যার কালেক্টরের সেরেস্তাদার হিসাবে। সে সময় তমলুক প্রদেশ উড়িষ্যার অন্তর্গত। চাকরিতে নীলমণির বিশাল উপার্জন হয়, সে সমস্ত তিনি পাথুরিয়াঘাটায় ভাই দর্পনারায়ণকে পাঠিয়ে দিতেন। পাথুরিয়াঘাটার বাড়ির অভিভাবক তখন দর্পনারায়ণই। তিনিও নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে নেই। দর্পনারায়ণ হুইলার কম্পানীর দেওয়ানি লাভ করেন। এ ছাড়াও জমিদারির পত্তনিদারি ও অন্যান্য ব্যবসা থেকে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদের মালিক হন।
শাসনব্যবস্থার পালাবদলের সেই অশুভ লগ্নে বর্বর ইংরেজদের লোভ ও হিংস্রতা বাংলায় নিয়ে আসে ঘোর অভিশাপের মত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। না খেতে পেয়ে, রোগে ভুগে বাংলার তিনভাগের একভাগ মানুষ, প্রায় এক কোটি লোক, মারা যায়। একভাগ লোক পালিয়ে বনে জঙ্গলে চলে যায় খাদ্যান্বেষে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এই সময় বেশি জোরজুলুম করে বাংলায় রেকর্ড পরিমাণ খাজনা আদায় করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী।আর এই ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে তাদের সহযোগী ছিল স্থানীয় জমিদার তালুকদারপত্তনিদাররা, তারাই খাজনা আদায়েমূল ভূমিকা পালন করে। পুরনো জমিদারদের চেয়ে ব্যবসায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নূতন জমিদাররা খাজনা আদায়ে বেশী দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হন। ফলে কোম্পানীর কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও বেড়ে যায়। পুরনো অলস দুর্বল জমিদারদের অনেকেই খাজনার আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়ে জমিদারী হারায়। নতুন ব্যবসায়ী ও জমিদাররা সেই জমি কোম্পানীর কাছ থেকে ইজারা নেন, আর তা করে তারা বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন। এরা সবাই নায়েব গোমস্তাদের মাধ্যমেই জমিদারী পরিচালনা করতেন।
১৭৭৭ সালে নিঃসন্তান গোবিন্দরামের মৃত্যু হলে তার পত্নী রামপ্রিয়া ভাসুরদের অধীনেই পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতে ছিলেন। এদিকে বিতাড়িত বড়ভাই আনন্দীরাম পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তার ছেলে রামতনু পাথুরিয়াঘাটার দিকে নজর দিতেন না। কিন্তু যেই দেখলেন মেজো আর সেজো কাকা মিলে প্রচুর আয় করছেন, অমনি বিধবা ছোটকাকিমার ওপর তার দরদ উথলে উঠলো। হিন্দু-বিধবার শ্বশুরের সম্পত্তিতে অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি কাকিমাকে ভাসুরদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে লাগলেন। গোবিন্দরামের দুই কর্মচারী – গোমস্তা দর্পনারায়ণ ঘোষ আর অপি গাঙ্গুলী – তাদের এই প্ররোচনায় ইন্ধন জুগিয়ে ১৭৮২ সালে কলকাতা সুপ্রীমকোর্টে সম্পত্তি ভাগের জন্যে নালিশ জানায়। এই সুপ্রীমকোর্ট তৈরিই হয়েছে মাত্র বছর ন’য়েক আগে। মকদ্দমায় রামপ্রিয়া রাধাবাজার আর জ্যাকসন ঘাটের দুটো বাড়ির অধিকার পেলে পাথুরিয়াঘাট ছেড়ে চলে যান।
মামলা করেছিলেন রামপ্রিয়া একত্রে দু-ভায়ের বিরুদ্ধে, যারা ছিলেন হরিহর আত্মা। কিন্তু মামলা চলাকালে শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় কে কতটাকা উপার্জন করেছেন তার হিসেব কষতে গিয়ে দু ভায়ের মনান্তর শুরু হয়। দুজনেরই উপার্জন যথেষ্ট, কিন্তু এই অশান্তি সহ্য করতে না পেরে দুজনের মধ্যে বড়ো নীলমণি নিজের উপার্জিত সম্পত্তি ও পৈতৃক সম্পত্তি থেকে মাত্র একলক্ষ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি ও অন্যান্য সমস্ত সম্পত্তির ভাগ পেলেন ভাই দর্পনারায়ণ। পৈতৃক বিগ্রহ রাধাকান্ত জীউয়ের ভারও পড়লো তার ওপরেই। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রদত্ত বিশাল ভূখন্ডের নিষ্কর জমি, দেবসেবার জন্য পিতা জয়রাম প্রদত্ত নগদ, ধনসায়রের সম্পত্তি বিক্রির টাকা ও ইংরেজ প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের সমস্ত টাকা রাধাকান্ত জীউএর সেবায় অর্পণ করে ভাইকে তার দায়িত্ব দিয়ে কেবলমাত্র লক্ষ্মীজনার্দন শিলা ও পরিবার নিয়ে তিনি বেরিয়ে এলেন ছেলেমেয়ের হাত ধরে।
সে মাত্রই দশ বছর আগের ঘটনা। রামলোচনের এসব পরিষ্কার মনে আছে। তখন তার বয়স প্রায় তিরিশ বছর, তার ভাই রামমণির পঁচিশ, রামবল্লভের কুড়ি আর বোন কমলমণির এগারো। পরের বছরেই কমলমণির বিয়ে হয়। বাবা নীলমণিও তো মারা গেলেন এই মাত্র তিন বছর আগে।
বাবার মতই রামলোচনের বিষয়বুদ্ধি অতি প্রখর। বাবার সম্মতি নিয়েই তিনি সম্পত্তি বাড়ানোর দিকে মন দিয়েছেন। নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ায় বিরাহিমপুর পরগণা কিনে জোড়াসাঁকো পরিবারের আনুষ্ঠানিক জমিদারগিরির সূচনা করেছেন তিনিই। বিরাহিমপুর পরগণার সদর কাছারি শিলাইদহে। এর পরএকের পর এক বিষয়সম্পত্তি কিনে রামলোচন ঠাকুরপরিবারকে কলকাতায় অভিজাত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এর আগে ঠাকুর পরিবারের পরিচয় ছিল শুধুই পিরালী ব্রাহ্মণ এবং ব্যবসাদার বা ইংরেজদের বেতনভুক বাবু হিসেবে। সমাজে বিশেষ পাত্তা পাওয়ার মতো তেমন কেউ না। রামলোচন তাকে নিয়ে গেছেন পাদপ্রদীপের আলোয়।
জমিদারি শুরু করার পাশাপাশি পারিবারিক কিছু শৌখিন আভিজাত্যও শুরু হয় তার সময়। বিকেলে তিনি হাওয়া খেতে বের হন। লম্বা কুর্তা দোপাট্টা ও তাজ পরিধান করে তাঞ্জামে চড়ে বাড়ি থেকে বেরোন, চলে যান গড়ের মাঠে গঙ্গাতীরে, তারপর একে একে চোরবাগানে কৃষ্ণচন্দ্র ঠাকুরের বাড়ি, পাথুরিয়াঘাটায় কাকার বাড়ি ও নানা মন্দির দর্শন করে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরেন। মেছুয়াবাজারে বেশ কয়েকঘর বাঈজির বাস। ইংরেজ বণিক, উমিচাঁদ, রাজা হাজারিমল ও শেঠ-বসাকদের মজলিসে আমোদের জন্যে মুর্শিদাবাদের বাঈজিরা কলকাতায় আসতো। রামলোচন তাদের ছাড়াও খেয়াল, কালোয়াতি গান ও কবিয়াল-হাফ আখড়াইয়ের আসর বসান নিজের বাড়িতে। সেসব অনুষ্ঠানে ইয়ারবন্ধুদের আমন্ত্রণ করেন, সেখানে বিস্তর খাওয়াদাওয়া হয়। বিভিন্ন জেলায় তিনি জমিদারি কিনেছেন। কলকাতা শহরেই তার দশ দশটি বাড়ি।
অথচ তার একটাও পুত্র নেই। চল্লিশ বছর বয়স হলো, পুত্র উৎপাদনের ক্ষমতা এখনও অন্তর্হিত হয়নি, কুলাচার্য সে প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্ন করলেন, ঘটক ডাকার প্রয়োজন আছে কিনা। তিনি নিজেও এখানে ওখানে যান, অনেক সুলক্ষণা কন্যার খবর আছে তার কাছে, রামলোচনকে পাত্র পেলে তারা তো বর্তে যাবে।
রামলোচন আর একটি বিয়েতে মোটেও উৎসাহী নন। তিনি জানেন ব্রাহ্মণ হলেও তারা পতিত ব্রাহ্মণ, পিরালী ব্রাহ্মণ। তাদের স্থান ব্রাহ্মণকুলে নীচের দিকে। টাকা পয়সার জোরে তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেও বিয়ে-শাদির ব্যাপারে সে সুবিধে নেই। তাদের পরিবারে বিয়ে হলেই অন্যপক্ষ পতিত হবে – কেউ তাতে রাজি হয় না – তাই নিজেদের আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যেই বিয়ে করতে হয়। রামলোচন রামমণি যে দক্ষিণডিহির একই পরিবারের দুই কন্যাকে বিয়ে করেছেন, সে তো এই কারণেই। অতীতকাল থেকেই তাদের পরিবারের সবার জন্যে যশোরেই তাদের বিয়ের কনে খুঁজতে যেতে হয়। জাতপাতের ব্যাপারটা এখনও ভয়াবহ ব্যাধির মত সমাজে লেপ্টে আছে। জাত খোয়ানোর ভয় এখনও সর্বগ্রাসী। ইয়ারবন্ধুদের মারফত রামলোচনের কানে এসেছে, এক ইংরেজ যাজক, তার নাম উইলিয়ম কেরি, মাত্র কিছুদিন আগে কলকাতার কাছেই এক গ্রামে তার অকালমৃত পুত্র পিটারের মৃত্যুর পর তার শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেয়ে গেছে, দেশী ডোমও বিদেশী মড়া ছুঁতে রাজি নয়, যদি জাত যায়! হায় জাত!
বাইরের ঘরে কথা চলাকালীনই অন্দরমহল থেকে শোরগোল ভেসে এলো। তিন ভাই একসঙ্গে ভেতরে ছুটে গেলেন। শোনা গেল এক নবোজাত শিশুর কান্না। মেনকার তবে প্রসব হলো!
ধাত্রী নবোজাত শিশুকে পরিষ্কার কাপড়ে মুড়ে বেরিয়ে এসে তিন ভাইকে বললো, দেখুন কর্তামশাইরা, কেমন সুন্দর ছেলে হয়েছে। এ যেন আমাদের রমণীরঞ্জন কেষ্টঠাকুর, মথুরা-বৃন্দাবনের গোপিনীদের অকূলে ভাসিয়ে হাজির হয়েছে দ্বারকায়।
শিশুটির নাম রাখা হলো দ্বারকানাথ।
(চলবে)
বিশাল গবেষণা বটে। রিলেশনশিপের খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। প্রাক রবীন্দ্রনাথ পর্বে যে এত ইতিহাস...অনেক অনেক ধন্যবাদ অমিতাভকে।
ReplyDeleteবেলাল হোসেন।
পড়তে পড়তে, সুনীল গাঙ্গুলির 'সেই সময়ে'র কথা মনে পড়ছে।
ReplyDeleteখুব ভাল হছে আমিতাভদা। একটু ধীরগতি হলে ভাল হয়।
ReplyDeleteতপপ্রিয়
বেশ। মনে রাখলাম। মন্তব্যের জন্যে অশেষ ধন্যবাদ।
Deleteবহু অজানা তথ্য জানা গেল। মূল ইতিহাসটা জানা থাকলেও এত গভীরে গিয়ে কে গবেষণা করেছেন বলে আমার জানা নেই।
ReplyDeleteধন্যবাদ আপনাকে, বেলালদা। কোনো সাজেশন থাকলে জানাবেন।
ReplyDeleteসত্যি এতটা বিস্তারিতভাবে কোনও ইতিহাসই জানা ছিল না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এধরণের রচনার ধারাটি তৈরী করে গেছেন, সেটা যোগ্য উত্তরাধিকারীর হাতেই পড়েছে। সব কটা মেলালে প্রাচীন বাঙ্গলা তথা ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে যা জানা যাবে, হাজার ইতিহাস বই খুঁড়ে ফেললেও তার থেকে সরেস হবে না।
ReplyDeleteআমি কোথাও পড়েছিলাম ওনাদের আদি পদবী বন্দোপাধ্যায় ছিল,এটা কি ঠিক নয়?
ReplyDeleteঅমিতাভ বাবু, আপনার লেখার আমি ভক্ত মানুষ। তবে এই লেখাটি র লয় একটু দ্রুত। খুব ভাল লাগছে।
ReplyDelete