রম্যরচনা - সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়
Posted in রম্যরচনা
রম্যরচনা
বেণীমাধবের হয়রানি
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়
বেণীমাধব সাতজম্মে পেস্ট মুখে তোলেনি। রোজ সকালে ঝাড়া তিরিশ মিনিট একখানা নিম দাঁতন মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বাগানের পাকা পাতা, পোকাধরা পাতা বেছে ঝেড়ে তারপর নিজের চান জলখাবার সেরে দোকানে গিয়ে বসে। সারাদিনের কারবার সামলানোর আগে ওইটুকুই তার বিলাস বল বিলাস, আয়েস বল তো আয়েস। কিন্তু আজ আর সে সময় নেই। বাথরুমে ঢুকে বউয়ের সায়েবি কেতার পেস্ট থেকে খানিকটা নিমডালে লাগিয়ে ঘসঘস করে দাঁত মেজে গায়ে জল ঢালতে হল।
খোঁজ পাওয়া গেছে শেষ অব্দি! রানাঘাট যেতে হবে আজই। মীরা স্টোর্সের বিধান গড়াই বলে দিয়েছে রানাঘাটেই বাড়ি তাঁর। ঠিকানা বলতে পারেনি। তবে কিনা তিনি নামী মানুষ। স্টেশনে নেমে গোঁসাইবাড়ি বললে কোন্ না একজন রিক্সাওলা নিঘঘাৎ চিনিয়ে নিয়ে যাবে 'খন। বেণী পাঞ্জাবীটা গলিয়ে বুকপকেটের চিরকুটে লেখা নাম দেখে নেয়। জয় গোস্বামী। কাল বিধানদার কাছে একটা বইয়ের পিছনে তার ফটোও দেখেছে। দিব্যি কেমন সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী চেহারা, খাপচা দাড়ি গোঁফের জংলা মুখে একখান ছিপছিপে হাসি! এ মানুষটার জন্যেই বেণীর এত আতান্তর!
ট্রেন মোটামুটি ফাঁকাই। ভুলক্রমেঃ ভেন্ডার কামরার পরের কামরাতেই উঠেছে তাই একটা টক টক ছানার জলের গন্ধ মাথায় ধাক্কা দিচ্ছে মাঝে সাঝে। দুটো স্টেশন পেরিয়েই বসার জায়গায় জুটে যায় একটা। ফিতে চুলের কাঁটা শিশুপাঠ্য চিরুনি ন্যাপথলিন নিয়ে একজন হকার ওঠে। খানিক হইচই লাগিয়ে নিজের জিনিসের গুণাগুণ শোনায়। ছবির কি কিছু লাগবে? মনে মনে ভাবার চেষ্টা করতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বেণীমাধব। একটানা দুলুনিতে ঘুম এসে যায় একটু।
- দাদা, কদ্দুর যাবেন! পাশের লোক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেণীমাধবের মাথাটা ঝেড়ে ফ্যালার ভঙ্গি করে জাগিয়ে দেয়।
- একদম শেষ মাথা। রাণাঘাট...
- ওঃ, আমি তার আগে নামব। রাতে ঘুমোন না নাকি?
আর রাতে! বেণীর চোখে জল এসে যায়। কত রাত যে ভাল করে ঘুমোয়নি! সেইইই যে পঞ্চমীতে পাড়ায় পুজো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো, পাশের টাউনের এক মেয়ে বিদ্যা না সন্ধ্যা গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে পাড়া ফাটিয়ে- বেণীমাধোওওওব বেণীমধোওওওব তোমার বাড়ি যাবোওও- বলে কবিতা শোনালো, ব্যাসসস... সেই থেকে সংসার জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। ছবি ওই কবিতা শুনেই বাড়ি গিয়ে খিল দিল ঘরে। যত বোঝায় আরে আমি ওকে চিনি না! তো সে সমানে বলে, চেন না তো তোমাকে নিয়েই এত চেল্লানি কিসের! ক্যানও আর কোন ভাল কবিতা ছিলনা! তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে কিংবা মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে, মা কে' নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে... এসব কি বইতে নেই!
ছবি নিজের গাঁয়ে ক্লাস ফাইভ পাস। কবিতা কি সে পড়ে নি! না জানেনা! ওইরকম বুক ফেটে কেঁদে কেঁদে বেণীমাধওওওব ডাক কোন বইতে কোনদিন দ্যাখে নি তো! পাঁচ বছরের বিয়ে। প্রতি বছর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে ছবি নতুন পাটভাঙ্গা শাড়ি পরে বরের সঙ্গে রিকশো করে ওদের গাঁয়ে আর লাগোয়া সদরটাউনে ঠাকুর দেখেছে। এবার ওই এক বিচিত্রানুষ্ঠানের জ্বালায় গোটা পুজোটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল। ছবি এই ক'দিন ভাল মুখে কথা বলেনি। ভাতের থালা, মুড়ির বাটি এমন ভাবে সামনে ধরে দিচ্ছে যে ভাত মুড়ি কোলে ছিটকে উঠছে। এসব তবু যা হোক সইছিল, কিন্তু কাল দুপুরে দোকান থেকে ফিরে দেখে বউ তপতপে মুখে সুটকেশ গোছাচ্ছে। কিসের গোছগাছ জিজ্ঞেস করায় উত্তর এল এমন পরঢলানে পুরুষমানুষের ঘর করার থেকে বাপের ভিটেয় গিয়ে নাকি গলায় দড়ি দেওয়াও সম্মানের। রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখল সকালে মধুকে দিয়ে পাঠানো পাকা জ্যান্ত রুইটা মরা কাঠ হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। রান্নাবান্না কিছুই হয় নি।
পর পর তিনটে প্রশ্ন একসঙ্গে বেণীর মাথায় ভীড় করে এল ... মাছটা এখনও বেড়ালে নেয় নি কি করে? দুপুরে খাওয়া দাওয়া কি আদৌ জুটবে না? আর সবচেয়ে মোক্ষম প্রশ্নটা হল গলায় দড়ি দিতে হলে বাপের বাড়ি গিয়ে কেন? ওদের গাঁয়ে কি বড় গাছ নেই! শেষ প্রশ্নটা ভেবেই বেণীমাধব নিজেকে দু গালে চড়াল। এসব কথাও মাথায় আসে এই আপৎকালে! ভেবে ভেবে অশান্তি সামলে সামলে মাথাটাই আউলে গেছে এক্কেবারে। এই সংসারে আবার ঘুম!
তা এসব কথা তো অচেনা মানুষকে বলার না। বরং একবারে যাকে বলার তাকেই বলবে খন। বেণী নড়েচড়ে উল্টোবাগে ঘাড় হেলিয়ে ঝিমোতে ঝিমোতে স্বপ্নের মধ্যেও ছবির তপতপে মুখ আর কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে সুটকেস গোছানোই দেখতে পায়।
স্টেশনে নেমে এক্কেবারে ব্যোমকে গেল বেণীমাধব! বাপরে বাপ! কী লোকজন! বাইরে বেরুবার সময় চেকার হাত পাতার সময় পাচ্ছে না টিকিট নিতে। হুড়হুড় করে লোক বেরোচ্ছে। ধাক্কায় ধাক্কায় বেণীও বেরিয়ে আসে। একটু আফসোস হয়। অ্যাঃ, আগে জানলে টিকিট কাটতোই না। কেউ চেক করল না, এদিকে ফালতুতে খানিক পয়সা বেরিয়ে গেল! বেলা এগারোটার রোদ্দুর মাথায় চড়ে নাচছে। এদিকে কোন রিক্সাওলাই গোঁসাইবাড়ি চেনে না। একজন ভ্যানওলা অবশ্য এক গোঁসাইবাড়ির হদিস দিল। সে বাড়িতে নাকি এক বুড়ি থাকে তার নাতনী নিয়ে। বাড়ির সামনের দালানে গৃহদেবতার ভাঙা দেউল আছে। বছরে তিনটে পূন্নিমায় সিন্নি হয় তাদের। পুজোর জিনিস সামজ্ঞিরি সেই বুড়ি ওই ভ্যানওয়ালাকে দিয়েই আনায়। ওই একটাই গোঁসাইবাড়ি নামকরা। তবে জয়বাবু গোঁসাই বলে যে কেউ সে বাড়িতে নেই, তাও সে হলফ কেটে বলে দিল।
বেলা গড়াচ্ছে ওদিকে এদিকে পেটে যেন পালোয়ানের মুগুর পড়তে শুরু করেছে! সকালের দুটি মুড়ি কোথায় তলিয়ে গেছে কে জানে! স্টেশনের রাস্তা ধরে ক'টা কচুরি জিলিপির দোকান। তার মধ্যেই একটু পরিষ্কার দেখে একটা দোকান বাছল বেণীমাধব। পেটে খিদে নিয়ে খোঁজার মানে নেই। গরম গরম পাঁচটা কচুরি কুড়ি টাকা। দুপ্লেট কচুরি খেয়ে মনটা একটু শান্ত হল বটে। দোকানদার লোকটা বেশ ভদ্রমত। দ্বিতীয়বার অর্ডার করার পর মাথার ওপরের পাখাটার একটু স্পিড বাড়িয়ে দিল। ক্যাশে পয়সা দিতে গিয়ে বেণীমাধব নিজেই একবার কথাটা পাড়ল...
- মশাই এখানে গোঁসাই বাড়ি কোথায় চেনেন?
- কি গোঁসাই? পুরো নাম জানেন?
- জয় গোঁসাই
মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক ... নাম তো শুনিনি। কিসের ব্যবসা?
- ওই লেখালেখি ...
- বইয়ের দোকান? দোকানের নাম জানেন?
- আরে না, ভদ্রলোক কবিতা লেখেন...
দোকানদারবাবু একবার ওপর থেকে নিচ জরিপ করে নিয়ে হাত বাড়ালেন "চল্লিশ হয়েছে ... না মশাই ... ওর'ম কারুর বাড়ি চিনিনা"
তবে! কেউই চেনে না! বড় আশা নিয়ে এসেছিল যে জয়বাবুকবিকে বলবে ওই কবিতাটায় বেণীমাধব কেটে আর যা খুশি নাম বসিয়ে দিতে। দরকার হলে নিজের পয়সায় পাল্টানো নামের কবিতাটা নতুন করে ছাপিয়েই দেবে হাজার কপি। শুধু যেন বেণীমাধব নামটা লোকে ভুলে যায়, ব্যাস...
পকেটে মোবাইলটা কেঁপে ওঠে। বাড়ি থেকে হয়ত! শেষ অব্দি ছবিই কি...
নাঃ , বিধানদা...
- বেণী, তোর যে আজ রানাঘাট যাওয়ার কথা ছিল
- হ্যাঁ, আমি রানাঘাটেই কিন্তু এখানে কেউ ওই গোঁসাইবাড়ি দেখাতে পারছে না। এ জায়গাও বিশাল। কেউ কারো খোঁজ জানেনা...
- আরে শোন, উনি বোধহয় এখন আর রানাঘাটে থাকেনও না। আমার দোকানে একটা ছেলে আসে। এই সব কবিতার বই টই নেয় মাঝে মাঝে। ওর কাছে জানলাম উনি নাকি রানাঘাট ছেড়ে চলে গেছেন... হয়ত কলকাতায় থাকেন। বিখ্যাত মানুষরা তো কলকাতাতেই থাকে সবাই...
- অ্যাঁ! চমকে হাত থেকে ফেরত দশ টাকাটা পড়ে যায়। কলকাতায়! হা ভগবান! তবে খুঁজব কেমন করে!
- সে দেখা যাবে, তুই ফিরে আয়। আর রানাঘাটে ঘুরে কি হবে!
ফেরার পথে ট্রেনে বেশ ভীড়। কোনওরকমে একটা কোণ খুঁজে নিজেকে সেট করে নেয় বেণীমাধব। লোকটার আক্কেল দেখ! কী এক কবিতা লিখে বেণীর জীবন অতিষ্ঠ করে নিজে কলকাতায় গিয়ে বসে আছে! এদিকে বেণীর সংসার ভেঙ্গে খানখান হতে বসেছে তা কে বোঝে!
বাড়ি ফিরতেও ভয় লাগে। ট্রেন থেকে নেমে আগে বিধানের দোকানেই যায়
- কি রে? ফিরলি? শোন, ওই ছেলেটা বলল বটে কলকাতায় থাকে ভদ্রলোক কিন্তু ঠিকানা টিকানা তো জানে না... তাছাড়া তুই তার সঙ্গে দেখা করেই বা কি করবি? কি বলবি! শুনলাম ওনার ওই কবিতা নাকি খুব বিখ্যাত। ক্যাসেট রেকর্ডে অনেক বিখ্যাত মহিলারা নাকি ওই কবিতা গান গেয়েছে আবৃত্তি করেছে!
ওরে বাবা! আরও মেয়ে? বেণীমাধবের আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে! শ্বশুরবাড়ির খিড়কির পাশের নিমগাছে ডুরে শাড়ি পরা চোখ ঠিকরনো ঝুলন্ত ছবিকে দেখতে পায় পষ্ট।
- কি হল রে! চুপ মেরে গেলি কেন? তুই তো বিখ্যাত রে বেণী!
কোন কথা না বলে ধুলো পায়ে নীতিন উকিলের বাড়ির দিকে দৌড় দেয় বেণীমাধব। আর ভাবার সময় নেই। এখন একমাত্র উপায় হল বাপ মায়ের দেওয়া নাম পালটে ফেলা। গোঁসাইকবিকে খোঁজার আগেই ছবি যদি ওসব ক্যাসেট রেকর্ডের কথা জানতে পারে তো কুরুক্ষেত্র করবে। তার চেয়ে একটা যাহোক কিছু নাম পছন্দ করে নিজেকে বাঁচাতে হবে... যত তাড়াতাড়ি সম্ভব...
আইডিয়া টাই দারুন। যথারীতি আনন্দ পেলাম পড়ে
ReplyDeleteধন্যবাদ ধন্যবাদ :)
Deleteঈঈর একটা ল্যাজ্জ বিচার চাই ... সকাল সন্দি ভদ্দরঘব্রে সবাই এই ভালো মানসটারে নাম ধরে বুলবে ক্যানে !!
ReplyDelete:) সেই তো ...বটেই তো
Deleteসব পড়ে-টড়ে.. আম্মো চেঁচিয়ে বলতে চাই..."গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে পাড়া ফাটিয়ে- বেণীমাধোওওওব বেণীমধোওওওব তোমার বাড়ি যাবোওও"
ReplyDeleteবেশ নতুন ভাবনা যা হোক!:O
:) একরাশ ধন্যবাদ । ভালো থাকবেন :)
DeleteE shudhu Sangitai pare 😀
ReplyDeleteDil khush lekha!!
:) thankuuu
Delete