বিশেষ রচনা - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
Posted in বিশেষ রচনা
বিশেষ রচনা
কুসংস্কার বিরোধিতা: ছোটোদের গল্পে
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
কলেজ স্ট্রীট পাড়ার এক প্রকাশক ২০০১-এ একটি বই বার করেন: বিশ শতকের কুসংস্কার-বিরোধী গল্প। সেই প্রকাশকই ২০০৩–এ বার করলেন ছোটদের কুসংস্কার-বিরোধী গল্প। ভাবতে ভালো লাগে, দু-খণ্ডে প্রকাশিত এই বইটি দু বছর অন্তর পুনর্মুদ্রণ হয়েছে, ২০১০-এ একটি পরিমার্জিত সংস্করণও বেরিয়েছে। চমৎকার কাজ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে একেবারে হালের শ্রেয়া রক্ষিত অবধি অনেকের গল্প এতে আছে।
সম্পাদকের পছন্দমতো গল্প বাছা হয়েছে, কিন্তু তার বাইরেও কিছু গল্প থাকে যেগুলি এই বইতে জায়গা পাওয়ার যোগ্য। তেমন একটি গল্প ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য-র ‘তাবিজ-মহিমা’। অমিয়কুমার চক্রবর্তী-সম্পাদিত একটি বইতে এটি আছে।
যেসব বিষয় নিয়ে বড়দের গল্প লেখা হয় তার প্রায় সবই ছোটোদের গল্পর বিষয় হতে পারে। তাই কুসংস্কার-বিরোধী গল্প বড়-ছোটো সবার জন্যেই লেখা হয়েছে। কিন্তু গল্পর চরিত্র ও ঘটনা ঠিক করার সময়ে একটু তফাতও হয়। ছোটোদের গল্পে চরিত্ররা, বা তাদের অন্তত কেউ কেউ, বয়সে ছোটো হলে কমবয়সী পাঠক-পাঠিকার সঙ্গে ভাবের সংযোগ আরও সহজে ঘটে। আর গল্পর ঘটনা যদি তাদের অভিজ্ঞতার জগতের হয়, তবে মূল কথাটি কিশোর পাঠকদের কাছে সহজেই পৌঁছয়। সব পাঠকের অভিজ্ঞতার জগৎ এক নয়। তবে স্কুল আর পরীক্ষা—এই দুটি ব্যাপার কিশোর পাঠকের অভিজ্ঞতায় থাকে। এইরকমই একটি বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছিল ‘তাবিজ-মহিমা’।
গল্পটা সংক্ষেপে এই: সামনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা কিন্তু সোমেশের কিছুই পড়া হয় নি। তার বন্ধু সিদ্ধেশ্বর খবর দিল: শিবপুরের হরিপদ জ্যোতিষালঙ্কার মন্ত্রপূত তাবিজ দিয়ে পরীক্ষা পাশের ব্যবস্থা করে দেন। সেই মতো দু জনেই জ্যোতিষালঙ্কারের কাছে গেল। জ্যোতিষী ঘরে ছিলেন না; ছিল তার খুকি বোনঝি। তাকে এক পয়সা ঘুষ দিয়ে জ্যোতিষীর দেখা মিলল। দু টাকা ফি আর পাঁচসিকে দাম দিয়ে তারা তাবিজ নিয়ে এল। জ্যোতিষালঙ্কার বলে দিলেন: ‘যি দিন পাশের সংবাদ বাইর হইবো সি দিনই এই তাবিজ খুইলা গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করবেন—ভুল হয় না যিনি!’ শুধু ওই দুজনই নয়, সোমেশের আরো দশ-বারোজন বন্ধুও শিবপুরে গিয়ে সেই ‘তেজস্কর তাবিজ’ নিয়ে এল।
পরীক্ষার ফল বেরতে দেখা গেল: সিদ্ধেশ্বর, রমেশ আর হরেন ভালোভাবে পাশ করেছে, কিন্তু সোমেশ, ভুঁদো, ভোঁতা—একেবারে ফেল। সবাই মিলে তখন ছুটল শিবপুরে। সব শুনে জ্যোতিষীমশায় বললেন: ‘আমার তাবিজ ঠিকই আছে, কিন্তু মহামায়ার উপর তো আর মানুষের আত নাই, তেনি যদি পছন্দ করেন ফ্যালের আত কেডা বাচাইবো? তাবিজের ভিতর ঢুইকা তেনি হগ্গল বদলাইয়া দিবেন। কই, কেডা ফ্যাল্ হইছেন? আপনে? দেহি আপনের তাবিজ, খোলেন তো?’
সোমেশের তাবিজ খুলে ভেঙে ফেলা হলো। ভেতর থেকে ফুলের সঙ্গে বেরল পাকানো এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখা: তুমি ফ্যাল হইবা। জ্যোতিষী সগর্বে বললেন: ‘আর কেডা কেডা ফ্যাল হইছেন? খোলেন তাবিজ।’ ভুঁদো আর ভোঁতার তাবিজ খুলে দেখা গেল: কাগজে একই কথা লেখা আছে।
এই অবধি গল্পর প্রথম পর্ব। ঘটনার গতি একমুখে চলেছে। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব:
"সোমেশের দলের মুখ চূন হইয়া গেল। জ্যোতিষালঙ্কার মহাশয় ঠোঁট দুটি শুয়োরের মত সরু করিয়া টিপিয়া টিপিয়া হাসি চাপিতে লাগিলেন; ভাবখানা–এবার কেমন জব্দ!
"হঠাৎ সিদ্ধেশ্বরের মাথায় কী খেয়াল চাপিল, সে কহিল—দেখি আমারটায় কী লেখা! আমি তো পাশ হয়েছি! জ্যোতিষালঙ্কার হাঁ হাঁ করিয়া উঠিলেন—কন্ কিঈ, পাশ করছেন তবু গঙ্গাজলে বিসর্জন দেন নাই! মহাপাতক করছেন—অখনই ছুইটা যান, মা গঙ্গার কাছে ক্ষমা চাইয়া তাবিজ ফেইলা দিয়া আসেন। ছি ছিছি! কিন্তু সিদ্দেশ্বর ততক্ষণে তাবিজ খুলিয়া ফেলিয়াছে। সকলে অবাক হইয়া দেখিল তার ভিতরেও পাকানো কাগজ এবং তাতেও গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—তুমি ফ্যাল হইবা।
"যারা পাশ করেছিল তাদেরও তাবিজ খুলে দেখা গেল: প্রত্যেকটির মধ্যেই লেখা—তুমি ফ্যাল হইবা, তুমি ফ্যাল হইবা, তুমি ফ্যাল হইবা।"
গল্পটি এইখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু পাঠকের মন তাতে ভরত না। জ্যোতিষীকে কোনও শিক্ষা দেওয়া গেল কিনা সেটা জানার কৌতূহল তো থাকবেই। এই ব্যাপারটিতে ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য একটু যেন হতাশই করেন। সোমেশ ও তার বন্ধুরা যখন জ্যোতিষীর অন্য এক মক্কেলকে নিয়ে পড়েছে, সেই ফাঁকে জ্যোতিষীমশাই পা টিপে টিপে বাড়ির ভেতরে চলে গেছেন। ঝাড়া দুই ঘন্টা চিৎকার, চেঁচামেচি, ইত্যাদির পর ‘বোধহয় বাড়ির লোকদের মায়া হইল। উপরের বারান্দা হইতে সেদিনকার সেই খুকি দেখা দিল, কহিল—বাবুরা প্যাচাল পাড়বেন না! মাউসার প্যাটে ভঙ্কর ব্যাদনা হইছে, আইজ আর তেনি লামায় যাইবো না।‘
ক্ষিতীনবাবু কিন্তু জ্যোতিষের ছলনাকে শুধু পরীক্ষার্থীদের মধ্যেই আটকে রাখেন নি। জ্যোতিষীর লক্ষ্য ছিল আরও এক ধরণের লোক। তারা হলেন: বেকার। বাড়ির সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল: উমেদারগণের মহা সুসময়
চাকুরির বাজারে নিষ্ফলভাবে ঘুরিয়া না বেড়াইয়া
এইখানে আসুন, জ্যোতিষালঙ্কারের
মন্ত্রপূত তাবিজে আপনার অবশ্য
চাকুরি লাভ ঘটিবে।
দ্বিতীয়দিন যখন সোমেশরা ঐ জ্যোতিষীর বাড়ি গেল, তখন তিনি বৈঠকখানাতেই ছিলেন, ‘তাঁর সামনে ছিল একটি অত্যন্ত গোবেচারা গোছের লোক। তারই হাতে তাবিজ বাঁধিতে বাঁধিতে তিনি বলিতেছেন—এই তাবিজে আপনের চাকরি না হইয়া পারে না, কিন্তু চাকরি পাইয়াই কইলাম তাবিজ গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করতে ভুলবেন না। বোচ্ছেন নি!’ জ্যোতিষীর জোচ্চুরি ফাঁস হওয়ার পর সোমেশরা সেই গোবেচারা লোকটিকে কোনও কথা বলার ফুরসত না দিয়ে তার তাবিজটাও খুলে ফেলল। দেখা গেল, তার মধ্যে লেখা—তোমার চাকরি কস্মিনকালেও হইব না। সোমেশ বলল, ‘ওঃ, এই জন্যে আপনাকেও চাকরি পাওয়া মাত্র গঙ্গাজলে তাবিজ নিক্ষেপ করবার আদেশ দেওয়া হয়েছে।’
পরীক্ষার্থীর পাশাপাশি কর্মপ্রার্থীকে এনে ক্ষিতীনবাবু একটি দারুণ কাজ করেছেন; জ্যোতিষীর কাজ শুধু ছাত্রদের ঠকানো—এই বার্তাটিও একই গল্পর ভেতর দিয়ে চমৎকার পৌঁছে দেওয়া হয়। জ্যোতিষীর কায়দাটি এক—চাকরি হলে ভালো, না-হলেও ক্ষতি নেই। মহামায়ার মায়া কে বুঝবে? তিনি যদি কাউকে চাকরি দিতে বা পরীক্ষায় পাশ করাতে না চান, তার ওপর তো আর জ্যোতিষীর ‘আত নাই’।
গল্পটা ঠিক কোন্ সালে লেখা তা জানা নেই! তবে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার কথা যখন আছে তখন নিশ্চয়ই ১৯৫২-র আগের কথা। নববিন্দু বৃত্ত-র বদলে নাইন-পয়েন্টস্ সার্কল্ থেকে অনুমান হয়: গল্পর ঘটনাকাল ১৯৩০ বা ’৪০ এর দশকও হতে পারে। তখনও পরীক্ষায় পাশ ফেল আর চাকরি পাওয়া না-পাওয়ার দুর্ভাবনা ও অনিশ্চয়তা ভালোমতোই ছিল—এখনকার মতোই। আর এই অনিশ্চয়তার সুযোগে ছোটো-বড়ো-মাঝারি নানা মাপের জ্যোতিষী দিব্যি করে খেত—এখনো যেমন করে খায়। ক্ষিতীনবাবু নিশ্চয়ই জ্যোতিষীদের মুখোশ খোলার উদ্দেশ্য নিয়েই গল্পটি ফেঁদেছিলেন। কিন্তু শুধু উদ্দেশ্য দিয়েই তো গল্পর ভালোমন্দ বিচার হয় না। গল্পটিকেও তো ভালো গল্প হতে হবে।
এ ব্যাপারে ক্ষিতীনবাবু শতকরা একশ পাঁচ ভাগ সফল। প্রথম হলো চরিত্রসৃষ্টি। খড়ম পরে ‘এক ঝলক বিশুদ্ধ নস্যের গন্ধ’র ‘পিছুপিছু জ্যোতিষালঙ্কার মহাশয়ও ঢুকিলেন।’ তার পরের অংশটিও অ-সাধারণ:
"জ্যোতিষীমহাশয় যে নেহাত হাতুড়ে জ্যোতিষী নন, তা তাঁর প্রথম কথা হইতেই বুঝা গেল—বাবুরা বুঝি এবার মেট্রিক দিবেন? সোমেশ ও সিদ্ধেশ্বর মুগ্ধ হইয়া গেল; লোকটি পণ্ডিত, আবার কেমন ভদ্র। এখনও তো তারা কলেজে উঠে নাই, তবু কেমন ‘বাবু’ ‘আপনি’ বলিয়া কথা বলিতেছেন। বাঃ, বেশ তো!"
সাধুভাষায় বিবরণের সঙ্গে পূর্ববঙ্গীয় ভাষার সংলাপ মেশানো—শুধু সংলাপে নয়, তাবিজের ভিতরকার ভবিষ্যদ্বাণীতেও—গল্পটিকে আরও সুখপাঠ্য করে তুলেছে। সবচেয়ে ওস্তাদি মার জ্যোতিষীর বোনঝি। তাকে এক পয়সা ঘুষ দিয়ে সোমেশ আর সিদ্ধেশ্বর প্রথম দিন জ্যোতিষীর দেখা পেয়েছিল। সে-ই আবার দেখা দেয় গল্পর শেষে। বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়ে, মেশোমশায়ের জবানিতে শেষ সংলাপ দিয়ে গল্পটি সে-ই শেষ করে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
পার্থসারথি মিত্র, শ্যামল চট্টোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ দত্ত, সৌম্যেন পাল
তথ্যসূত্র:
অমিয়কুমার চক্রবর্তী সম্পা। হালকা হাসির গল্প। অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির, ১৯৫৬
সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পা। ছোটোদের-কুসংস্কার-বিরোধী গল্প। খণ্ড ১ ও ২। র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, ২০১০।
সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পা। বিশ শতকের কুসংস্কার-বিরোধী গল্প। র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, ২০১২।
0 comments: