ধারাবাহিক - অমিতাভ প্রামাণিক
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে
অমিতাভ প্রামাণিক
। ৫ ।
১৭৬৫ সাল। বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে ভারত মহাসাগরে পড়লো যাত্রী বোঝাই জাহাজটা। গন্তব্য ইংল্যান্ড। এতক্ষণের যাত্রাপথ ছিল নির্বিঘ্ন, ঘটনাবিহীন। অকস্মাৎ বিনামেঘে বজ্রপাতের মতই যেন একটা ঝড় উঠলো।
জাহাজের ক্যাপ্টেন মিস্টারসুইনটন যাত্রীদের দেখভালের ব্যাপারেও বেশ উৎসাহী। এই জাহাজে রয়েছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর বিভিন্ন পদে থাকা বেশ কিছু ইংরেজ কর্মচারী। তাদের কেউ কেউ বলতে গেলে পাকাপাকিভাবেই ভারত ছেড়ে চলে যাচ্ছেন স্বদেশে। যথেষ্ট আয় করা হয়ে গেছে তাদের, এ দিয়ে কয়েক পুরুষ হেসেখেলে চলে যাবে। কেউ কেউ ফেরত যাচ্ছেন দল ভারি করে ফের ফেরৎ আসার জন্যে। তারা স্বর্ণখনির সন্ধান পেয়েছেন, কিন্তু এখনও সে খনিতে পা ফেলার সুযোগ হয়নি তেমন। আরও কেউ কেউ রয়েছেন যারা এদের থেকে আলাদা, তারা ঈশ্বরপুত্রের বাণী সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চান, দেখেছেন এই দেশটা কেমন অশিক্ষায়, অনাচারে দগ্ধ হচ্ছে, তারা একে মহান বাইবেলের নির্দেশ দিয়ে সঠিক রাস্তা বাতলাবেন।
শুধু ইংরেজ রাজপুরুষ বা ধর্মপ্রচারক নয়, জাহাজে রয়েছে গাদাখানেক দেশী মানুষজনও। ঢাকা-চাটগাঁ অঞ্চল থেকে তাদের সংগ্রহ করা। তারা মোটামুটি ক্রীতদাস, ইংলন্ডে গিয়ে তারা বাবুদের ফাইফরমাস খাটবে, কলকারখানায় কাজ করবে, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করবে। এরা সব লুঙি পরা, অনাবৃত উর্ধাঙ্গে কারও কারও গামছা জড়ানো। নিজেদের মধ্যে যে ভাষায় কথা বলাবলি করে, তা ইংরেজরা বিন্দুমাত্র বোঝে না।
দেশী মানুষদের মধ্যে একজন আবার এর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তার পোশাক সবার চেয়ে আলাদা, জাহাজের অন্যান্য ইংরেজদের তো বটেই, ক্যাপ্টেনের চেয়েও জমকালো। ক্যাপ্টেন সুইনটনের সঙ্গেই তার আদানপ্রদান বেশি, অন্যান্য ইংরেজরাও তাকে সমীহের চোখে দেখছে। তার নাম মির্জা এহতেসামুদ্দীন, বাড়ি নদীয়া জেলার পাঁচপুর গ্রামে। এতক্ষণ পর্যন্ত সুইনটনের সঙ্গে তার বেশ সৌহার্দ্য দেখা যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা ছোট্ট ঘটনায় মির্জা খুবই রেগে গেলেন। দেশি বাংলায় এমন গালাগালি দিলেন সুইনটনকে, যে কাছাকাছি থাকা লুঙি পরা কাঁচুমাচু মুখের মানুষগুলোও অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। এমনিতে তারা জানে এ হচ্ছে নবাব মীরজাফরের ভাই।
সমুদ্র পেরিয়ে বিদেশযাত্রা মানে কালাপানি পার হওয়া। মানে জাত যাওয়া। যদিও হিন্দুদের মধ্যেই জাতপাতের ব্যাপারটা প্রকট, বাঙালি মুসলমানরাও কালাপানি পেরোতে অনাগ্রহী। ইতিহাসের কী বিচিত্র বিধান! বাঙালিরাই জাহাজপথে সমুদ্রযাত্রা করে সিংহল বিজয় করে তৈরী করেছে তাদের নতুন ইতিহাস। ছোট নৌকা থেকে বিশাল সাইজের জাহাজ তারা নিজেরাই বানাতো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন দ্বীপে তাদের সমুদ্রযাত্রা সুপ্রাচীনকালের। আরবদের সঙ্গে সমুদ্রপথে তাদের ব্যবসার আদানপ্রদানও বহুকালের। অথচ পর্তুগীজ ভাস্কো-দা-গামা ইওরোপ থেকে ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কারের পর পরই বঙ্গোপসাগর আরবসাগর হয়ে পড়ল পর্তুগীজ জলদস্যুদের বিচরণক্ষেত্র। বাড়ির ছেলেরা জাহাজে গিয়ে আর ফিরে আসতে লাগল না যখন, তখন থেকেই সমুদ্র হয়ে গেল কালাপানি। অধর্মীয়।
এখন যে সমস্ত বাঙালীরা বিদেশে যায়, তারা সবাই ঐ লুঙি-পরা ক্রীতদাস শ্রেণীর। শিক্ষিত সুজনরা নয়। যারা যায়, তারা নিজের ইচ্ছায় যায় না। তবু যে মির্জা এহতেসামুদ্দীন এই জাহাজে চড়ে বসেছেন, তার কারণ অতিশয় চমকপ্রদ। মীরজাফরের সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক নেই মোটেও, যদিও পোশাক দেখে তা ঠাহর হওয়ার উপায় নেই। সে যাচ্ছে ইংলন্ডেশ্বর জর্জ দ্য থার্ডের সঙ্গে দেখা করতে, মোগলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের দূত হয়ে, তার একটা চিঠি নিয়ে। চিঠিটা জিম্মা আছে ক্যাপ্টেনের কাছে। সেই রকমই তাকে বলা আছে।
ভারত মহাসাগরে জাহাজটা পড়ার পর ক্যাপ্টেন সুইনটন মির্জা এহতেসামুদ্দীনকে জানালেন, চিঠিটা তার কাছে নেই!
হতভম্ব হয়ে গেলেন মির্জা। আকস্মিক ভাবটা কাটিয়ে নেওয়ার পরেই তার ভিতরে জমা হ’ল ভীষণ ক্রোধ। রাগে মুখে যা এল, বলে দিলেন ক্যাপ্টেনকে। বলা হয়ে গেলে বুঝতে পারলেন, এখন তার আর কিছু করার নেই, তিনি এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের শিকার। ক্রোধ থেকে জন্ম হ’ল হতাশার। অবিলম্বে জাহাজ ঘুরিয়ে বাংলায় নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি।
ব্যাপারটা এই রকম। পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা হেরে গেলে বাংলায় শুরু হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রমরমা। সিরাজের আসনে বসানো হ’ল ষড়যন্ত্রের নায়ক মীরজাফরকে। তার পরে মীরকাশিমকে। দিল্লীতে মোগল সম্রাটের প্রতিপত্তি অস্তমিত প্রায়, আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে যে অবনতি শুরু হয়েছে, তা ঠেকানো যায় নি। পলাশির পর আবার যুদ্ধ হ’ল বক্সারে, অযোধ্যায় নবাব সুজাউদ্দৌল্লা, মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম আর বঙ্গাধিপতি মীরকাশিমের মিলিত শক্তির সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনাদের। সে যুদ্ধেও, কী আশ্চর্য, জিতে গেল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী।
শান্তি চুক্তির জন্যে সমস্ত পক্ষকে আহ্বান করা হ’ল এলাহাবাদে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে সেনাধ্যক্ষ রবার্ট ক্লাইভ এলেন দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে দেখা করতে। পলাশির যুদ্ধের কিছুকাল পর তিনি দেশে ফিরে গেছিলেন, আবার ফিরে এসেছেন। শাহ আলমের অবস্থা অতিশয় করুণ। মোগলদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, দাক্ষিণাত্যে ও পশ্চিমে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। তিনি ভাবলেন, এই বিপদে ইংরেজরাই হয়ত তাকে শক্তি জোগাতে পারবে, তিনি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন দিল্লীর মসনদ। অনেক আশা নিয়ে তিনি ক্লাইভের হাত চেপে ধরলেন।
সুচতুর ক্লাইভ প্রাথমিক মজাটা ভালভাবেই উপভোগ করলেন। এ দেশে ব্যবসা কায়েম করার উদ্দেশ্যে সম্রাটকে দিয়ে লিখিয়ে নিলেন বাংলার দেওয়ানি স্বত্ত্ব। তারপর বললেন, তিনি তো মাত্রই ইংলন্ডের রাজার দূত, এক ব্যবসায়ী সেনাধ্যক্ষ মাত্র। শাহ আলমকে সাহায্যের জন্য যে পরিমাণ সেনার প্রয়োজন, তা তো তার কাছে নেই। আর তাছাড়া সেসব করতে গেলে খোদ রাজার আর তার কোম্পানীর উর্ধতন অফিসের অনুমতি চাই, তা ছাড়া তিনি এসব আইনত করতে পারেন না। ইংলন্ডের রাজাকে ভেট পাঠিয়ে যদি কিছু সাহায্য প্রার্থনা করে চিঠি লেখা যায়, তবে তা হয়ত তিনি মঞ্জুর করবেন। বাদশাহ তাতেই রাজি।
সেই চিঠি নকল করা হ’ল সেখানেই। ক্লাইভ বললেন চিঠিটার সাথে লাখখানেক টাকা মূল্যের উপঢৌকন পাঠানোর বন্দোবস্ত করতে। তিনি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছেন, সেখানে উপঢৌকন পৌঁছে গেলেই তিনি বাদশাহের সিলমোহর করা চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। কলকাতায় সেই খসড়া চিঠির ভাষা বদলে ক্লাইভের নিজের মত করে তার ভাষা চূড়ান্ত করা হ’ল, নিরুপায় বাদশাহ তাতেই স্বাক্ষর করে সিলমোহর লাগিয়ে দিলেন। বললেন, কয়েকদিনের মধ্যেই বারাণসী থেকে তার ভেট পৌঁছে যাবে কলকাতায়।
চিঠিটা লেখা ফার্সী ভাষায়। নিয়ম অনুযায়ী ফার্সী ভাষায় দক্ষ একজনকে প্রয়োজন যে চিঠিটা ইংলন্ডের রাজার কাছে পড়ে দিতে পারবে বাদশাহের দূত হয়ে -সেই রকম লোকের খোঁজ চলতে লাগল। তাতেই নিয়োগপত্র পেলেন নদীয়াবাসী মির্জা এহতেসামুদ্দীন।
কিছুকাল আগেও এহতেসামুদ্দীনকে আর পাঁচজন হেঁজিপেঁজিই বলা যেত। মীরজাফর যখন বাংলার নবাব হলেন, তখন সে সময়ের তার সভার দুই বিচক্ষণ শিক্ষিত ব্যক্তি মুন্সি সলিমুল্লাহ ও মুন্সি মির্জাকাসিমের তত্ত্বাবধানে তার পড়াশুনায় দক্ষতা অর্জন হয় ফার্সীতে। ইংরেজরা দেশীয় ভাষা না জানায় তাদের ও দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে কথাবার্তা চালানোর জন্যে মাধ্যমের কাজ পেতে লাগলেন তিনি। মীরকাশিমের আমলে তাকে নিয়োগ করল ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর মেজর পার্ক। বক্সার আর পলাশির যুদ্ধের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি যুদ্ধে হারিয়েছিল বীরভূমের রাজা আসাদুজ্জামানকেও, সেখানে মেজর পার্কের প্রতিনিধি ছিলেন মির্জা এহতেসামুদ্দীন। পরে মেজর পার্কের সাথেই আজিমাবাদে গিয়ে দিল্লী থেকে বিতাড়িত মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাক্ষাৎ হয় তার।
ইংলন্ডে গিয়ে সে দেশের রাজাকে উপঢৌকনসহ মোগল সম্রাটের চিঠি পেশ করে আসার সুযোগ আসতেই তরুণ মির্জা সে প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের কালাপানির বিপর্যয় ও জাত খোয়ানোর সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিলেন তিনি। ক্যাপ্টেন আর্চিবন্ড সুইনটনের জাহাজ ইংলন্ডে যাচ্ছে, এই সংবাদ ক্লাইভের কাছ থেকে আসতেই তিনি সেই জাহাজে চড়ে বসলেন। তাকে জানানো হ’ল, সুরক্ষিত চিঠিটা ক্যাপ্টেনের কাছে গচ্ছিত আছে।
আর এখন কিনা তাকে বলা হচ্ছে, চিঠিই নেই! কী নিয়ে তবে ইংলন্ডে যাচ্ছেন তিনি? কী করতে? সেখানে তো তার জানাশুনা কেউ নেই। ফালতু ইংলন্ডে গিয়ে কী করবেন তিনি? ফেরার সংস্থানই বা কী করে হবে? অবিলম্বে তাই জাহাজ ঘোরানো হোক, তার প্রস্তাব এল।
বললেই আর শুনছে কে! সুইনটন অবশ্য সম্পূর্ণ উপেক্ষা না করে তাকে বোঝালেন, আসলে চিঠিটা তার কাছেই ছিল। কিন্তু বারাণসী থেকে বাদশাহের উপঢৌকন সময়মত কলকাতায় এসে পৌঁছায়নি বলে ক্লাইভ তার সঙ্গে দেখা করে চিঠিটা ফেরৎ নিয়ে নেন। খালিহাতে তো রাজার সাথে দেখা করা যায় না, ভেট দেওয়াই নিয়ম। জাহাজের সময়সারণী ঠিক হয়ে গেলে আর অপেক্ষা করা যায় না, তাই তাকে জাহাজ ছাড়তেই হয়েছে। ক্লাইভ তাকে বলে দিয়েছেন, পরেরবার যখন জাহাজ যাবে আবার ইংলন্ডে, তখন তিনি সম্রাটের উপহার আর চিঠিটা নিজে সঙ্গে নিয়ে আসবেন, সেই সময় মির্জা উপস্থিত হতে পারে ইংলন্ড রাজদরবারে। বেশি তো না, মাত্রই বছর খানেকের ব্যাপার। এ ক’দিন সে সুইনটনের অতিথি হিসাবেই থাকবে ইংলন্ডে। চাইলে ওখানেই বিয়েশাদি করে সংসারও করতে পারে।
হতচকিত নিরুপায় মির্জা এহতেসামুদ্দীন বুঝতে পারলেন, তার বিশেষ কিছু করার নেই আর। জোরাজুরি করতে গেলে তারা একে রাত্রিবেলা সমুদ্রে ফেলে দিলেও কেউ জানতে পারবে না। তার চোখের আলো নিভে গেল। জাহাজের প্রতিটি মিনিট দুঃস্বপ্নের মত মনে হতে লাগল। কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলা বন্ধ হয়ে গেল। ভগ্নহৃদয় মির্জা এসে ইংলন্ডে পৌঁছালেন ছ’মাস বাদে।
ষড়যন্ত্রের নায়ক রবার্ট ক্লাইভ এক সুচতুর, ধূর্ত, অসমসাহসী মানুষ। তার বাল্য-কৈশোর ও প্রথম যৌবনের ঘটনার মধ্যেই তা প্রতিভাত।
* * *
লন্ডনের মার্চেন্ট টেলর্স স্কুল। তার সবচেয়ে মারকুটে ছেলেটার নাম বব। ঘন্টা পড়লেই হলো, যেই টিচার ক্লাশ ছেড়ে বাইরে যাবেন, অমনি আগের বেঞ্চের ছেলেটার চুল ধরে টানবে সে। সে যদি রুখে দাঁড়ায়, তবে সঙ্গে সঙ্গে মুখে মারবে এক ঘুষি। স্কুল ছুটি হলে তো কথাই নেই, গেটের বাইরে বেরিয়েই তার প্রথম কাজই হচ্ছে কারো ব্যাগ কেড়ে নিয়ে ড্রেনের মধ্যে ছুঁড়ে দেওয়া। সবাই তার জ্বালায় তটস্থ।
ববের বাড়ি ইংল্যান্ডের শ্রপশায়ারের ড্রেটন বাজারের কাছে। তেরো ভাইবোনের মধ্যে সেই সবচেয়ে বড়, যদিও তাদের ছ’জন বেশিদিন বাঁচেনি। বাবা লন্ডনে উকিলগিরি করে। এতগুলো বাচ্চা কে দেখাশুনা করবে, ববকে ম্যাঞ্চেস্টারে তার মাসির বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে মাসির আদরে বব এক পরিপূর্ণ বাঁদরে পরিণত হলো। তবে তার অত্যাচার মাসিকে তেমন সহ্য করতে হয়নি, কেননা ববের যখন ন’বছর বয়স, তখন তিনি ববের মায়ায় আচ্ছন্ন হলেও পৃথিবীর মায়া কাটান। বব তারপর কিছুদিন বাবার লন্ডনের খুপরিতে কাটিয়ে ফিরে আসে ড্রেটনে।
তার দৌরাত্ম দিন দিন বাড়তেই থাকে। গোটা তিনেক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয় তাকে একের পর এক। সব জায়গা থেকেই রিপোর্ট আসে, এ ছেলেকে ম্যানেজ করা আমাদের কম্মো নয়, নিয়ে যাও এখান থেকে। আর শুধু ইস্কুল তো না, তার জ্বালাতনে পাড়াপ্রতিবেশীও তটস্থ। মারামারি করতে পেলে সে আর কিছু চায় না। ভয়ডরের কোন ব্যাপারই নেই তার মধ্যে। এক সকালে তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, দেখা গেল ড্রেটন বাজারে সেন্ট মেরী’জ চার্চের একেবারে মাথায় চড়ে বসে আছে সে। কী করে উঠল কে জানে। সেখানে দাঁড়িয়ে এক হাতে গীর্জার চূড়াটা পাকড়ে ক্যার্দানি দেখাচ্ছে। হাত ফস্কে গেলেই নীচে পড়ে যাবে, সাক্ষাৎ মৃত্যু। নীচে লোকজন তো ভয়েই অস্থির। নেমে আয়, নেমে আয় করতে লাগলো তারা। কে শোনে কার কথা!
পড়াশুনো হলো না ববের। তবে মুখের বুলিতে তাকে হারাবে, এমন মানুষও কম। আর কী আশ্চর্য, ঠিক সেই ভাষাতেই সে লিখে ফেলতে পারত পরিস্কার, তা দেখে কেউ বুঝতে পারত না অশিক্ষিতের লেখা।
ববের বাবা ডিক বুঝে গেলেন এ ছেলে নিয়ে কপালে বহুৎ কষ্ট আছে। খোঁজ নিয়ে জানলেন, ইন্ডিয়াতে ইংল্যান্ডের যেসব ব্যবসায়িক ঘাঁটিগুলো আছে, তাতে ফ্যাক্টর বা কেরাণী নিয়োগ করা হচ্ছে। লেখালিখিরই তো কাজ, তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে ববকে ঐ কাজে ঢুকিয়ে দিলেন। ঊনিশ বছর বয়সী বব চেপে বসল ভারতগামী জাহাজে। তবে তার এমনই কপাল, ব্রাজিল উপকূল ঘুরে আসতে গিয়ে সেই জাহাজ গেল বিগড়ে। সারাই হতে হতে চলে গেল দীর্ঘ ন’টা মাস। তাতে অবশ্য অসুবিধের বদলে লাভই হলো ববের। ব্রাজিলে থেকে ভাঙা ভাঙা পর্তুগীজ ভাষাটা শিখে গেল সে। ইন্ডিয়াতে পর্তুগীজদেরও বেশ কিছু কুঠি আছে, দরকারে কাজে লেগে যেতে পারে।
ইন্ডিয়াতে তখন ইংরেজদের চারটে প্রধান ঘাঁটি। মাদ্রাজে সেন্ট জর্জ ফোর্ট, কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম ছাড়াও বোম্বাই আর কাডালুরে তাদের প্রতিপত্তি। বোম্বাই আগে ছিল পর্তুগীজদের, রাজা সেকেন্ড চার্লসের বিয়েতে এই দ্বীপ যৌতুক পায় রাজা, সেটা তিনি দিয়ে দেন কম্পানীকে। বব হাজির হলো সেন্ট জর্জে, সেখানে আর্মি-ক্যান্টিন টাইপের একটা দোকানের খাতাপত্তর দেখার কাজ করতে লাগল পরবর্তী দু বছর ধরে। তার সঙ্গে অবশ্য জারি ছিল তার ঝগড়াঝাঁটি মারামারিও, সেই দোকানে যারা মালপত্তর সাপ্লাই করত, তাদের সাথে। অবসর সময়ে রাজ্যপালের লাইব্রেরিতে গিয়ে বইটই পড়ত সে।
ভারতে তখন মোগল শাসন টিমটিম করে চলছে। ঔরঙ্গজেব মারা গেছেন বছর চল্লিশ হলো। তারপর দিল্লীর গদি নড়বড়ে। বিভিন্ন প্রদেশে সুবেদারদেরই আস্তে আস্তে রমরমা বাড়ছে। দাক্ষিণাত্যে ছড়ি ঘোরাচ্ছে হায়দ্রাবাদের নিজাম আসফ জা আর মহীশূরের নবাব আনোয়ারুদ্দিন মহম্মদ শা। ইংরেজদের ফোর্ট সেন্ট জর্জ আর ফরাসী ঘাঁটি পন্ডিচেরী দুটোই মহীশূরের নবাবের এলাকায়। ইওরোপে ইংরেজ, ফরাসী, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ আর দিনেমারেরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করতে ঘাঁটি গাড়ছে। ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা অন্য জায়গার চেয়ে অনেক ভাল, ব্যবসা এখানেই বেশি, ফলে ভারতের ওপর সবারই নজর। এদের স্বভাবই হলো নিজেদের মধ্যে অনবরত মারামারি করা। ইওরোপের সেই হাঙ্গামার জের এসে পড়ে ভারতের ঘাঁটিগুলোতেও। যুদ্ধবিগ্রহ করতেও অনেক খরচ। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো ভাল ব্যবসা না করতে পারলে মারামারির খরচ চালানোও দায়, তাই তাদের ঘাঁটিগুলো সুরক্ষিত করা খুবই দরকার। সেজন্য সৈন্যসামন্ত জোগাড় করা, দূর্গ বানানো, ইত্যাদিও শুরু হয়েছে। ভারতে এসব করতে গেলে আঞ্চলিক শাসকদের তুষ্ট করতে হয়। ইংরেজরা দেখেছে ঘুষটুষ খেতে ভারতীয়রা ভালবাসে, সুবেদারদের অধীনস্থ দেওয়ান বা ঐ জাতীয় কাউকে মোটা ঘুষ দিলে ব্যবসার অধিকার সহজে মিলে যায়, জমির ইজারা পাওয়া যায়, অনেক বে-আইনী সুবিধে হাসিল করা যায়।
মারামারির সূত্রপাত হলো ইংরেজ রণতরী ফরাসীদের এক নৌবহরে গোলাগুলি বর্ষণের মধ্যে দিয়ে। ফেঞ্চ গভর্ণর-জেনারেল দ্যুপ্লে অতিরিক্ত সেনা চেয়ে পাঠালেন। সেই সেনা নিয়ে ফরাসী সেনাধ্যক্ষ লাবর্দনে মাদ্রাজ আক্রমণ করলেন। দুপক্ষে প্রবল গোলাগুলি বর্ষণ আর প্রচুর হতাহতের পর মাদ্রাজ দখল করে নিল ফরাসীরা। সব ইংরেজ সৈন্যদের ধরে নিয়ে গিয়ে ভরা হলো পন্ডিচেরির গারদে। ঠিক হচ্ছিল উপযুক্ত টাকা পয়সা আদায় করে মাদ্রাজ ফিরিয়ে দেওয়া হবে ইংরেজদের, কিন্তু দ্যুপ্লে বেঁকে বসলেন। বললেন, ইংরেজদের পুরো হটিয়ে দিয়ে মাদ্রাজকে পন্ডিচেরির সঙ্গে জুড়ে বড়সড় ফরাসী ঘাঁটি বানানো হোক। মাদ্রাজের সেন্ট জর্জ ফোর্টে বাকি যেসব ইংরেজ ছিল, যাদের মধ্যে বব একজন, তাদের বলা হলো যীশুর নামে শপথ নিতে যে তারা কোনদিন ফরাসীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে না। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনের সঙ্গে বব সেই শপথ নিতে অস্বীকার করল।
শপথে অনেকের অ্যালার্জি থাকে, আর মাত্র এ কজন আর কী করবে, এই ভেবে এদের কয়েকজন সেনার পাহারায় রেখে ফরাসী সৈন্যরা সেন্ট জর্জ ফোর্ট নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কাজে লেগে গেল। ততদিনে বব দু-বছরের বেশি ভারতে কাটিয়েছে, দেশীয় লোকেদের হাবভাব জানে। দেশী লোকের পোশাক পরে আর তাদের ভাষায় কথা বলে বব তিনজন ইংরেজ সঙ্গীকে নিয়ে ফরাসী পাহারাওলাদের চোখে ধুলো দিয়ে ফোর্ট থেকে বেরিয়ে গেল। পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে কাডালুরের ইংরেজ ঘাঁটি সেন্ট ডেভিড দূর্গে হাজির হয়ে বলল, আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাই।
কেরাণীর চাকরি করছিল এতদিন বব। যুদ্ধ করার ট্রেনিং নেই তার। সেনাবাহিনীর নীচু পদ মর্যাদায় ফ্যাক্টর বা কেরাণীর চেয়েও নীচু, মাইনেও কম। তা হোক, মারকুটে বব কলম পেষার চেয়ে বরং বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়বে।
ছ’মাসের মধ্যে সে সুযোগও মিলে গেল। ফরাসীরা কাডালুরের সেন্ট ডেভিড ফোর্ট দখল করতে এলে সে প্রবল বিক্রমে তাদের নিরস্ত করল। অবশ্য এ কাজে প্রভূত সহযোগিতা করেছিল নবাব আনোয়ারুদ্দিনের সেনারাও। বব তার কথার মায়াজালে মহীশূরের নবাবকে ততদিনে বশ করে ফেলেছ।
ভারতের মাটিতে ফরাসীদের সঙ্গে ইংরেজদের হানাহানি লেগেই থাকল। সে বছর সেপ্টেম্বরে ফের আর এক রাউন্ড লড়াইতে বব যুদ্ধ করল বুক চিতিয়ে। প্রত্যক্ষদর্শী একজন বলল, এ লোকটার মৃত্যুভয় নেই। বিপক্ষ ভয়ঙ্কর গোলাগুলি চালালেও এ অকুতোভয়ে এগিয়ে যায় নিজের জীবনের পরোয়া না করে, আর বিপক্ষের ওপর তুমুল গোলাবর্ষণ করে। যার ভয় নেই, তাকে ঠেকানো সহজ নয়। সে কথা কানে গেল ইংল্যান্ড থেকে সেন্ট ডেভিডে সদ্য আসা মেজর স্ট্রিঙ্গার লরেন্সের।
পূর্বঘাট পাহাড়ের পূবদিকে বর্ষা আসে ফিরতি পথে। অক্টোবরে বৃষ্টি শুরু হতেই যুদ্ধ থেমে গেল। দুপক্ষে সন্ধির চুক্তি হলো, ইংরেজরা ফিরে পেল মাদ্রাজ।
মেজর লরেন্স ববকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ছোকরা, তোমার দম আছে তো! বব এসে স্যালুট করে দাঁড়াল।
- থ্যাঙ্কিউ স্যার।
- আই ক্যান সী, ইউ লাভ ফাইটিং!
- আই হেট এনিমিজ।
- ইউ সীম টু বী অ্যা বর্ণ ফাইটার। ক্যান ইউ লীড অ্যা গ্রুপ?
- আই থিঙ্ক সো।
- ইউ আর প্রোমোটেড টু লেফটেন্যান্ট।
- থ্যাঙ্কিউ স্যার।
এই ববই হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পরবর্তীর সেনাধ্যক্ষ রবার্ট ক্লাইভ।
* * *
বিলাতে ক্যাপ্টেন সুইনটন থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন মির্জা এহতেসামুদ্দীনের। ভাঙা ভাঙা কিছু বাক্য ছাড়া মির্জা ইংরাজি জানেন না, অথচ দেখলেন ইংলন্ডের মানুষের তার প্রতি অপার উৎসাহ। তার গায়ের রঙ ওদের থেকে আলাদা, সেটাই তার কারণ, নাকি তার জমকালো পোশাক, তা তিনি বুঝতে পারলেন না চট করে। ইংরেজরা আগে তাদের দেশে যে ভারতীয়দের দেখেছে, তারা সব চাটগাঁ বা ঢাকার খালাসি, জাহাজে তুলে যাদের আনা হয়েছিল সেদেশে ভৃত্য হিসাবে। তাদের চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ তাদের চোখে বর্বরদের মত, সেখানে এই ব্যক্তিটির পরণে ভীষণ জমকালো পোশাক। নির্ঘাৎ ভারতীয় কোনও কেউকেটা ইনি। তার বাড়ির আশেপাশে দূরদূরান্ত থেকে ইংলন্ডের লোক এসে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। কত সহস্র মাইল দূরে বাংলাদেশ, সেখানকার নবাবের ভাই তাদের দেশে এসেছে! সুইনটন তাকে ইংরাজি তামাশা দেখানোর জন্যে সঙ্গে নিয়ে বেরোলে উলটে মির্জাকে নিয়েই রাস্তায় তামাশা শুরু হয়ে যেত। তাদের জুড়িগাড়ির পেছন পেছন লম্বা লাইন দিয়ে ছুটত ছেলেছোকরার দল। রাস্তার পাশের বাড়ির গবাক্ষ খুলে যেত ফটাফট, সেখানে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ইংরেজ গৃহবধূর দল। বালক-বালিকারা তাকে রাস্তায় দেখলেই ছুটে গিয়ে খবর দেয় বাড়ির বড়দের, দেখবে চলো, দেয়ার ইজ আ ব্ল্যাক ম্যান ইন দ্য স্ট্রিট। সেই ডাক শুনে বাড়ির কর্তা কর্ত্রী ভিড় জমায় রাস্তার দিকের জানালায়। ছোটদের বলে, ডোন্ট গেট নিয়ার হিম, বেবি, হি মে বি আ ব্ল্যাক ডেভিল। ভয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা তার কাছে ঘেঁষতে সাহস করে না।
দু’তিন মাস চলে গেলে অবশ্য এসব ভয় দূর হয়ে গেল। মির্জা দেখলেন, পৃথিবীর এ প্রান্তের মানুষও বাংলাদেশের মতই সাদামাটা ও মিশুকে। তারা তার ভাষা না বুঝলেও তার সাথে অন্তরঙ্গভাবেই রসিকতা করে। ভদ্রবাড়ির মেয়েরা ঠাট্টাচ্ছলে তাকে বলে, হাই ডার্লিং, উড ইউ গিভ মি আ কিস!
মির্জা এহতেসামুদ্দীনের অপেক্ষা শুরু হয় বাদশাহের চিঠি নিয়ে আসা সেই জাহাজটার জন্যে। বছর দেড়েক বাদে হ্যারি ভেরেলস্টকে দায়িত্বভার দিয়ে ক্লাইভ সত্যিসত্যিই হাজির হলে ইংলন্ডে। সে খবর অবশ্য পেলেন না মির্জা এহতেসামুদ্দীন। তার আর প্রয়োজন নেই। ক্লাইভ পুরোপুরি চেপে গেলেন মোগল সম্রাটের চিঠির কথা। তার প্রেরিত লক্ষাধিক টাকা মূল্যের উপঢৌকন রাজার সামনে হাজির করলেন এমনভাবে যেন তিনি নিজেই রাজাকে উপহার দিলেন। রাজদরবারে ক্লাইভের সম্মান বেড়ে আকাশছোঁয়া হয়ে গেল। অশিক্ষিত, গোঁয়ার বব ক্লাইভ হয়ে গেলেন লর্ড ক্লাইভ।
সুইনটন অবশ্য প্রকৃত বন্ধুর মতই এহতেসামুদ্দীনকে ইংলন্ডে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। মির্জার উপস্থিতিতে তার নিজেরও প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েছে ইংরেজ সমাজে। ইংরেজরা ক্যাপ্টেনকে অতিরিক্ত সমীহ করে সঙ্গে মির্জা এহতেসামুদ্দীন থাকলে। বাংলার নবাবের ভাই যার বিশ্বস্ত বন্ধু, সে তো আর অন্য চারটে জাহাজের নাবিকের মত সাদামাটা ক্যাপ্টেন হতে পারে না। তাছাড়া প্রচুর লোকজন ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীতে চাকরি নিয়ে বাংলায় যেতে উৎসাহী। তারা কেউ ফার্সী ভাষা জানে না। তাদের ভাষা শেখানোর জন্য মির্জার মত এমন কাউকে হাতের কাছে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার।
সুইনটনের সঙ্গে ইংরেজ সমাজে ঘোরাফেরা করে মির্জা বাংলাদেশের মানুষদের সাথে এদের পার্থক্যও বেশ বুঝতে পারলেন। বাঙালি যেখানে অযথা বাগাড়ম্বর করে বেড়ায়, ইংরেজরা সেখানে মিতস্বভাব। ওদের মধ্যে খোসামোদ করার ব্যাপারটা খুবই কম। হিন্দুস্তানে কোথাও রাস্তায় একটা জানোয়ার দেখা গেলে সেপাইরা দল বেঁধে সড়কি লাও, বন্দুক লাও করতে থাকে, ভয়ে এগোয় না কেউ তার দিকে। অনেক ধ্বস্তাধ্বস্তি করে হয়ত পরে দেখা গেল সেটা একটা শিয়াল, তাকে বল্লম-টল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে সেপাইটা তার বন্ধুদের কাছে গোঁফে তা দিয়ে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে গল্প করবে – বুঝলি, আজ যা একখানা রয়েল বেঙ্গল টাইগার মারলাম! তাও পুরো খালি হাতে। সকালে গাড়ু নিয়ে বাহ্যে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি একটা বাঘ আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। আমি গাড়ুটা দিয়ে তার মাথায় মারলাম এক বাড়ি, তারপর এক চড়ে তার তিনটে দাঁত ফেলে দিলাম। এদের হাবভাবই এমন যেন পৃথিবীর তাবৎ বীরেরাও তার কাছে শিশু। সেদিকে বিলাতের লোকজন নিজেদের ব্যাপারে বাড়িয়ে বলা একেবারে পছন্দ করে না। এদের মধ্যে এত যে বড় বড় যোদ্ধা, তারা নিজেদের শৌর্যবীর্য দেখিয়ে কোনও বড়সড় যুদ্ধে জিতে ফিরলেও লোকের সামনে সেসব বলে না। অন্যেরা তার নামে প্রশংসা করলে তারা লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়, বারবার থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ বলতে থাকে। এমনকি যে সেই যুদ্ধের সেনাধ্যক্ষ, তার সামনে কেউ তার কৃতিত্বের কথা বললে সে খুবই সঙ্কোচের সঙ্গে তা শোনে, তার চোখ থাকে মাটির দিকে, যত বেশি প্রশংসা করা হয়, তত সে ঘেমে যায়, সামনাসামনি প্রশংসা শোনা তাদের কাছে লজ্জাকর। কেননা একমাত্র কাপুরুষরাই তাদের মতে অন্যের প্রশংসা শুনতে ভালবাসে।
শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারেও এহতেসামুদ্দীন লক্ষ করলেন দু দেশের পার্থক্য। বাংলাদেশের বাপ-মা’রা বাচ্চাদের পুতুল মনে করে, তারা অপত্যস্নেহে অন্ধ। তার ফলে শিক্ষার জন্যে বাচ্চাদের দূরে পাঠাতে চায় না কেউ। শিক্ষক বা ওস্তাদ ভাড়া করে বাড়িতে এনে যদি লেখাপড়া করানো যায়, তবেই শিক্ষাদীক্ষা হয় তাদের। বাড়ির বাইরে গেলেই নাকি তাদের ওপর লোকের কু-নজর লাগবে, ভূত-প্রেতের দৃষ্টি পড়বে, তারা মায়ের হাতের রান্না না খেতে পারার জন্যে অসুখে পড়বে। ফলে বাঙালিরা অশিক্ষিতই থেকে যায় প্রায়। সেখানে ইংলন্ডের এমনকি অভিজাত ঘরেও পুত্রকন্যাদের দূরে পাঠানো হয় শিক্ষালাভের জন্যে। তারা বিশ্বাস করে স্বনির্ভর হওয়ার মত গুণ আর দ্বিতীয়টি নেই। সব কাজ নিজে করে নেওয়া তখনই সম্ভব, যদি বাচ্চারা বাপ-মায়ের নাগালের মধ্যে সবসময় না থাকে। পিতামাতার স্নেহমমতা গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই, কিন্তু সারাজীবন বিদ্যাশিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে আতুপুতু বানিয়ে রাখা মানে ঘরে ঘরে অমানুষ তৈরী করা। মির্জা দেখলেন, বিলাতের লোকজনরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সামগ্রিক উন্নতির জন্যে হাজার হাজার পুস্তক রচনা করেছেন। একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার প্রতি স্তরে তাদের রচিত পুস্তকের সংখ্যার এত প্রাচুর্য দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। এক একটা দোকানেই বিভিন্ন ভাষার ওপর কতশত বই। বাংলা ভাষায় তো বই-ই নেই বলতে গেলে!
সুইনটনও মির্জার বেশ কিছু আচার-ব্যবহারে অবাক হয়েছিলেন। তিনি অভিজ্ঞ নাবিক, অন্তত বিশ বছর বাংলায় এসেছেন, থেকেছেন, মিশেছেন সেখানকার মানুষদের, এমনকি নবাব-উজিরদের সঙ্গে। দেখেছেন, মুসলমান আমির-উমরাহদের প্রকাশ্যে মদ পরিবেশন করলেই তারা ছি ছি করে ওঠে, বলে, আমরা মদ খাই না, শাস্ত্রে মানা। কিন্তু বাঈজির মজলিসে তাদের রূপ একেবারে আলাদা। সেখানে তারা রূপোপজীবিনীর হাত থেকে পানপাত্র নিয়ে বেশ ঢুকুঢুকু চালায়। ধরে পড়লে বলে, মদ খুব ভাল জিনিস, এর মত নেয়ামত আর কী আছে! নেহাৎ শরিয়তে মানা, তাই সবার সামনে খাওয়া চলে না, কিন্তু আড়ালে আবডালে একটু আধটু পানে কোনও দোষ নেই। তারা হালাল ছাড়া মাংস খাবেই না। সেখানে মির্জা এহতেসামুদ্দীনের হালালের ব্যাপারে গোঁড়ামি নেই। মদ স্পর্শ করেন না কখনওই।
তিনি শ্বেতাঙ্গিনী বিয়ে করে থিতু হবার প্রস্তাব দিতে মৃদুভাষী মির্জা জবাব দিলেন, দেখুন, আমার যাকে ইচ্ছে হবে, সে আমাকে পছন্দ করবে না, আর যে আমাকে পছন্দ করবে, আমি তাকে বিয়ে করবো না। আমি উচ্চবংশের মানুষ, আমার পক্ষে নীচু বংশে বিয়ে করা সম্ভব নয়। যদিও ইংলন্ডের অনেক কিছুই তার ভাল লেগে গেল, দেশের কথা ভেবে খুব মন খারাপ করতে লাগল। জিজ্ঞেস করতে বললেন, সুলেমানের সিংহাসনের চেয়ে জন্মভূমির মমতা বড়। জন্মভূমির কাঁটাও বিদেশি সুবাসিত ফুলের চেয়ে মধুর।
প্রায় তিন বছর বিলাতে কাটিয়ে ১৭৬৮ সালের এক অক্টোবরে তিনি দেশে ফিরে এলেন। দেশে ফেরার পর তার মর্যাদা আরও বেড়ে গেল। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির কূটনীতিক হিসাবেই তিনি পুনর্বহাল হলেন। মরাঠাদের সাথে ইংরেজদের দীর্ঘ যুদ্ধে তার প্রভূত ভূমিকা ছিল। যুদ্ধশেষে জন হ্যামিল্টনের সাথে তিনি পুনায় গেলেন মরাঠা নেতা নারদ শাখারাম ও নানা ফড়নাবিশের সঙ্গে আলোচনার জন্যে।
মির্জা এহতেসামুদ্দীনকে বলা যেতে পারে প্রথম বিলেতফেরৎ শিক্ষিত বাঙালী। ফিরে এসে তিনি শিগার্ফনামা-এ-বিলায়েৎ বা বিলায়েতনামা নামে ফার্সীতে একটা বইও লিখেছিলেন বন্ধুদের অনুরোধে। বিলেতভ্রমণকারী কোনও ভারতীয়র এটাই প্রথম ভ্রমণকাহিনি।
তবে তা অনেক পরে। মাত্র তিন বছর দেশ থেকে দূরে থেকে, ফেরার পর তিনি যে বাংলা দেখলেন, তার রূপ একেবারে আলাদা।
** *
এর মধ্যে নবাবের গদি বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়েছে। পলাশির যুদ্ধের পর মীরজাফর যে গদিতে বসেছিলেন, তার কার্যকাল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৭৬০ সালে ক্লাইভ দেশে ফিরে গেলেন, এদিকে মীরকাশিম পেলেন মুর্শিদাবাদের গদি। তাকে যুদ্ধে হারিয়ে ইংরেজরা মীরজাফরকে আবার মসনদে বসালেন। ১৭৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে মীরজাফরের মৃত্যু হলে তার এক পুত্র নাজমুদ্দৌল্লাকে দুধভাত করে গদি দেওয়া হ’ল বিশে ফেব্রুয়ারি, পরোক্ষে কর্তৃত্ব চালাতে লাগল ইংরেজরাই। প্রতিবার শাসক বদলানোর পুরস্কার হিসাবে ইংরেজরা রাজ্যের সিন্দুক ফাঁক করে ধনরত্ন জাহাজে বোঝাই করে পাঠাতে লাগল তাদের দেশে। তার কিছু ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির খাতায় জমা হ’ল, অধিকাংশটাই গেল ইংরেজ কর্মচারীদের নিজেদের পকেটে।
এর পরেই ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সেই ঐতিহাসিক দেওয়ানি লাভ। ক্লাইভ দ্বিতীয়বার ফিরে এলেন বাংলায় সে বছরের মে মাসে, ইচ্ছা করলেই বাংলার শাসনভার দখল করতে পারতেন, বাধা দেওয়ার মত কেউ নেই আর। কিন্তু চতুর ক্লাইভ বুঝেছিলেন এসব করতে গেলে ফরাসী, ওলন্দাজ আর দিনেমাররা একত্র হয়ে দেশি রাজন্যবর্গের সাথে একযোগে তাদের আক্রমণ করবে, সেসব প্রতিহত করতে অনেক ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হবে। তাছাড়া ইংলন্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি একটা বাণিজ্য সংস্থাই, বিদেশে শাসনব্যবস্থা চালানো তাদের কর্মকাণ্ডেরর আওতায় পড়ে না, তাদের জবাবদিহি করতে প্রাণান্ত হবে। বাংলায় নবাবের কাজ তো দুটো, নিজামতি অর্থাৎ শাসন করা বা আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা আর দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায় করে দিল্লী পাঠানো। নিজামতির ভার পুতুল নবাবের ওপর রেখে ক্লাইভ দেওয়ানি নিজের হাতে নেওয়াই উচিত সাব্যস্ত করলেন। দিল্লীর ক্ষমতা ক্রমশই কমে আসছে। দ্বিতীয় শাহ আলম ঠুঁটো জগন্নাথ। অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌল্লাকে যুদ্ধে হারিয়ে যুদ্ধের খেসারত হিসাবে পনের লক্ষ টাকা হাতিয়ে তার সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে নিলেন ক্লাইভ। অযোধ্যার কিছু অংশ – কোরা, এলাহাবাদ, চুনার আর বারাণসী – দান করে দিলেন মোগলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে। যদিও মোগলদের ক্ষমতা চলে গেছে, কাগজে কলমে তারাই তখনও ভারতেশ্বর, তাই কাগজে তাদের সই-এর দাম আছে। বার্ষিক ছাব্বিশ লাখ টাকার পরিবর্তে বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি মানে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির প্রভূত লাভ, কেননা যা রাজস্ব আদায় হবে, তা থেকে ছাব্বিশ লাখ টাকা দিল্লী পাঠালেই বাকিটা পকেটে। অযোধ্যার ওপর লোভ করলেন না ক্লাইভ, আপাতত এটাই যথেষ্ট।
১৭৬৫ সালের বারোই অগাস্ট সেই দেওয়ানি চুক্তিতে সই করলেন মোগলসম্রাট।
বাংলার শাসনব্যবস্থা দেখার জন্যে তো একজন কর্মঠ লোক চাই। নবাব নাজমুদ্দৌল্লা অনুরোধ করলেন নন্দকুমারকে সেই পদে বসাতে। কিন্তু নন্দকুমারের সঙ্গে ইংরেজদের আগেই কিছু বিবাদ হয়েছে, তাই তারা নন্দকুমারের বদলে এই কাজ সঁপে দিল আলিবর্দীর আত্মীয় মহম্মদ রেজা খাঁকে। দু বছর পর সিতাব রায়কে এই একই দায়িত্ব দেওয়া হলো বিহারের রাজস্ব আদায়ের জন্যে।
শর্বরী পোহাতে বণিকের মানদণ্ড বাংলার রাজদণ্ড হয়ে গেল। বাংলার মানুষ কিছু বুঝলো না। তারা জানলো তারা রাজস্ব দিচ্ছে বাংলার নবাবের মাধ্যমে দিল্লীর সম্রাটকে। অথচ তার সিংহভাগ চলে যেতে লাগলো শুধু বাংলার বাইরে নয়, দেশের বাইরে। কম্পানির কাজ নিজেদের লাভের অঙ্ক বাড়িয়ে চলা, তার জন্যে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো বেশি বেশি করে রাজস্ব সংগ্রহ, তার জন্যে দরকার হলে জোরজুলুম করাও দস্তুর। ফলে, বাংলায় একযোগে ঠুঁটো নবাবের আর কম্পানির শাসন চলতে লাগল যুগ্মভাবে। তার ঠেলায় নাভিশ্বাস উঠল জনগণের। কার কাছে কার বিরুদ্ধে তারা নালিশ জানাবে? তাদের কাছে তখন এই দুই পক্ষ যেন জলে কুমির ডাঙার বাঘ।
প্রথম কোপটা পড়ল রাজস্বের অঙ্কেই। ভূমিরাজস্ব যেখানে এতদিন ছিল উৎপাদিত শস্যের ১০-১২ শতাংশ, সেটা একলাফে করে দেওয়া হলো পঞ্চাশ-ষাট শতাংশ। ১৭৬৪ সালে সারা বাংলার রাজস্ব ছিল ৮১ লক্ষ টাকা, পরের বছর তা বেড়ে হ’ল ১ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা।
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ইংরেজ কর্মচারিরা গ্রামেগঞ্জে ঢুকে চাষিদের ধানচাষ ফেলে জমিতে নীল আর আফিমের চাষ করতে বাধ্য করতে লাগল। নীল আর আফিমে ব্যাপক লাভ। ইওরোপে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছে, ম্যাঞ্চেষ্টার-লিভারপুলে স্থাপিত হয়েছে প্রচুর কলকারখানা। তাদের অগ্রগণ্য হচ্ছে সুতিবস্ত্র। ভারত থেকে জাহাজ ভরে তুলো পাঠানো হতে লাগল সেই মিলগুলোতে। আর তাদের রঙ করার জন্যে নীল। কৃত্রিম রঙ তখনও আবিষ্কারই হয়নি।
১৭৬৮ সালে, মির্জা এহতেসামুদ্দীন যে বছর দেশে ফিরে এলেন, সেবার বৃষ্টি কম হ’ল। ধান হ’ল না ভাল। অন্যান্যবার এ রকম হ’লে নবাবের কাছে জানালে নবাব খাজনা মকুব করে দেন। খাদ্যশস্য আনার ব্যবস্থা হয় অন্য জায়গা থেকে। এবার তা তো হলোই না, উলটে খাজনা চেপে বসলো পাঁচগুণ। বিপন্ন মানুষ আধপেটা খেয়ে সরকারের বাপান্ত করতে লাগল। পরের বছরও যখন খরা আর অনাবৃষ্টি হ’ল, লোকের দুঃখের অন্ত রইল না। খাজনার সাঁড়াশি গলায় চেপে বসেই আছে, মাঠে ধান নেই, হাতে পয়সা নেই, চাষীরা বাধ্য হয়ে হাল-বলদ বিক্রি করে দুমুঠো গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা দেখতে লাগল। মাঠ পুড়ে যাচ্ছে, নিষ্করুণ সূর্যদেব মাথার ওপরে, থেকে থেকে খবর আসে অমুক গ্রামে আগুন লেখে পুড়ে গেছে খড়ের ছাউনির বসতবাড়ি। উপায় না পেয়ে চাষীর শেষ সম্বল বীজধান খেয়ে ফেলল তারা। খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। সামান্য পয়সার বিনিময়ে মা বিক্রি করে দিতে লাগলো তার শিশুসন্তানকে।তাতেও সুরাহা না পেয়ে খাদ্যের খোঁজে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে লাগল লোকে অন্যত্র।
দিনের পর দিন চলে সেই হেঁটে চলা। সকলেই নগ্নপদ। পুরুষদের দেহ অনাবৃত, মহিলারা একটিমাত্র সুতির কাপড়ে। মানুষই বটে, তবে দেখে তা বোঝা কঠিন। সকলের হাড়-পাঁজরা বেরিয়ে গেছে। শরীরে শক্তি আছে বলে মনে হয় না। বেশ কয়েকদিন ধরে চলে এই পথ চলা। কোথায় যাচ্ছে এরা কেউ তা জানে না। মাথায় যখন গনগনে সূর্য, এরা তখন বসে কোনও গাছের তলায়। গাছের পাতা ছিঁড়ে কেউ কেউ মুখে দেয়, চিবায়, থু থু করে ফেলে দেয় খেতে না পেরে। পুকুর দেখলে নেমে জল খায় এক আঁজলা। নোংরা ঘোলাজল খেয়ে বমি করে। আবার উঠে চলতে শুরু করে। কেউ কেউ চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে, উঠতে পারে না। আগে এরা তাকে ধরে ধরে তুলে দিচ্ছিল, এখন আর করে না। যারা বসে থাকে, তারা বসেই থাকে, এক সময় শুয়ে পড়ে, আর ওঠে না।
বিহারের পূর্ণিয়া, বাংলায় বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, নদীয়ায় অবস্থা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করল। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেল গুটিবসন্তের মড়ক। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেতে লাগল। রাস্তায় মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকে, কুকুরে শেয়ালে খায়, কারো গ্রাহ্য করার উপায় নেই। খবর আসতে লাগল, মানুষ বুনো গাছের পাতা, মূল খেয়ে সহ্য করতে না পেরে মরা মানুষের মাংস খেতে শুরু করেছে।
এক ইংরেজ যুবা একদিন তার বাড়ির গবাক্ষ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বসেছিলেন। মানুষের মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে থাকার দৃশ্য দেখা ততদিনে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। সেদিনও আগের মতই দেখছিলেন একদল মানুষ – নামেই মানুষ, গায়ে তাদের শুধুই হাড়, মাংস আছে বলে মনে হয় না – হাঁটতে হাঁটতে চলেছে। তাদের দলে একজন মহিলা পিছিয়ে পড়ছিল ক্রমাগত। অবশেষে তাকে ফেলেই বাকিরা এগিয়ে গেল। ভাল করে লক্ষ করে সে দেখল, মহিলাটি গর্ভবতী, আসন্নপ্রসবা। তার হাঁটার ক্ষমতা নেই আর। সে বসে পড়েছে এক গাছের নীচে। সেখানে তখন কিছু পুড়ছে, আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে, ধোঁয়া উঠছে।
গাছের নীচে আর্তনাদ করতে করতে এক মনুষ্যসন্তানের জন্ম দিল সেই মহিলাটি। নিশ্চয় মৃত সন্তানের। ভাগ্যিস মৃত, কেননা জীবিত হলে তাকে তখনই মরতে হ’ত, তার খাবার দুধ কোত্থেকে আসবে? কিন্তু যুবাটির অবাক হওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল। সদ্যোজাত মৃত সন্তানটির শরীরটা উঁচু করে দুহাতে ধরে তার ধড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে ফেলল জন্মদাত্রী মা। তারপর সেই ধড়টা গুঁজে দিল গাছের নীচের সেই আগুনের কুণ্ডে। প্রথমে সে ভাবছিল বুঝি মৃতদেহ দাহ করা হচ্ছে, কেননা হিন্দুদের তাই প্রথা। কিন্তু তার চোখের সামনে অদ্ভুতভাবে নিজের সন্তানের ঝলসানো মাংস খেতে লাগল ক্ষুধাকাতর সেই মা। এ দৃশ্য সহ্য করতে পারল না যুবাটি। গবাক্ষ বন্ধ করে দিল সে।
পরদিন সকালে গাছতলাতেই মা-টির মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল।
যুবকটির নাম টেইনমাউথ। কবি। বহু বছর পরে তার লেখা কবিতায় ফুটে উঠল বাংলার হাহাকারের ছায়াছবি -
Still fresh in Memory’s eye, the scene I view,
The shrivell’d limbs, sunk eyes, and lifeless hue;
Still hear the mother’s shrieks and infant’s moans,
Cries of despair, and agonizing groans.
In wild confession, dead and dying lie; -
Hark to the jackal’s yell, and vulture’s cry,
The dog’s fell howl, as, midst the glare of day,
The riot, unmolested, on their prey!
Dire scenes of horror! Which no pen can trace,
Nor rolling years from Memory’s page efface.
অবস্থা চূড়ান্ত হ’ল ইংরাজি ১৭৭০, বাংলা ১১৭৬ সালে। লোকে বলল, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। তিন কোটি মানুষের অন্তত এক কোটি মারা গেল সেই মন্বন্তরে। সারা বাংলা শ্মশানের চেহারা নিল।
* * *
১৭৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্লাইভ পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে যান দ্বিতীয় শাহ আলম প্রেরিত সেই উপঢৌকনাদি নিয়ে। দেশে পৌঁছাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কম্পানির উচ্চপদস্থ অফিসারেরা তার নামে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আনে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল যে তিনি শাসনের নামে অপর্যাপ্ত শোষণ চালিয়ে বিদেশে ইংরেজ পার্লামেন্টের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছেন এবং নিজের সম্পত্তি বাড়িয়েছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে পার্লামেন্টের সদস্যদের অনেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির শেয়ারের মালিক। ঘুষ দিয়ে তাদের সপক্ষে টানা এমন কিছু কঠিন হয়নি ক্লাইভের পক্ষে। তারা নিজেরাও চাইতেন না ক্লাইভের শাস্তি হয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির শেয়ারের দাম পড়ে যাক, তাতে তাদের নিজেদেরই ক্ষতি। তাছাড়া রাজাকে দেওয়া মোগলসম্রাটের বহুমূল্য উপহার সব নিজের বলেই চালালেন ক্লাইভ। ফলে সমস্ত অভিযোগ থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়ে গেলেন। উলটে রাজকার্যে তার অসামান্য অবদানের জন্যে পুরস্কার ও লর্ড শিরোপা দেওয়া হলো।
কিন্তু নিজের বিবেকের কাছ থেকে মুক্তি পেলেন না রবার্ট ক্লাইভ। গলস্টোনের ব্যথা কমাতে আফিম ধরেছিলেন, সেটাও চূড়ান্ত নেশায় পরিণত হয়। এত বৈভবের মধ্যেও মাঝে মাঝেই চূড়ান্ত অবসাদে ভুগতেন তিনি। লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টারে বার্কলে স্কয়ারের প্রাসাদে ১৭৭৪ সালের ২২শে নভেম্বর সামান্য এক কাগজ কাটা ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে।
মাটির ওপর এত অনাচার, এত অধর্ম মাটি সহ্য করে না। জন্ম দেয় একে একে সুপুত্রদের, যারা এই অনাচার প্রতিহত করতে পারে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সর্বনাশা রেশ চলতে চলতেই ১৭৭২ সালের ২২শে মে হুগলী জেলার আরামবাগ মহকুমার রাধানগর গ্রামে রাঢ়ি বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ রামকান্ত রায়ের পত্নী শৈব ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা তারিণীদেবীর গর্ভে জন্ম হলো তেমনই এক সুপুত্রের। তার নাম রামমোহন রায়।
************************
সংযোজন – ব্যারাকপুরের বিশাল প্রাসাদে ক্লাইভ রেখে গিয়ে ছিলেন পোষা এক কচ্ছপ, তার নাম অদ্বৈত। সেশেল্স্ দ্বীপপুঞ্জের আলডাবরা উপকূল থেকে এই কচ্ছপটাকে ভারতে নিয়ে এসেছিলেন ব্রিটিশ সেনাদের একজন। ক্লাইভ তখন তরতর করে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর সেনাবিভাগের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছেন, তিনি উপহার হিসাবে পেলেন অদ্বৈতকে, তার স্থান হলো ক্লাইভের প্রাসাদে। ক্লাইভ দেশে ফিরে যাওয়ার একশো বছরেরও বেশি পরে ১৮৭৫ সালে কলকাতার আলিপুরে কার্ল লুইশেন্ডলার যখন চিড়িয়াখানা বানালেন, অদ্বৈতকে সেখানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। গমেরভুষি, গাজর, লেটুসপাতা, ছোলা ভিজে খেয়ে খেয়ে সে দেখে গেল বাংলার নবজাগরণের সমগ্র ইতিহাস।
২০০৬ সালের ২২শে মার্চ পিঠের খোলা ফেটে তার নীচের মাংসে জীবাণুর আক্রমণে যখন সে মারা যায়, সেইসময় বেঁচে থাকা পৃথিবীর সম্ভবত বৃদ্ধতম প্রাণী হিসাবে সে ততদিনে আনুমানিক ২৫৫টা বসন্ত পার করে ফেলেছে।
Just Fantastic,,ক্লাইভ লয়েডের বেপরোয়া বাল্য জীবন নিয়ে আগেও পড়েছি। আবারও সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDeleteভালো লাগলো লেখাটা, পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম
ReplyDeleteচমৎকার প্রাঞ্জল ইতিহাস বর্ণনা। বেশকিছু বিষয় নতুন করে জানলাম। অব্যাহত থাকুক আপনার এই লেখা
ReplyDeleteAsadharon..Robert clive o nobabi amole murshidabaad niye agroho boraborer...rridho hocchi
ReplyDeleteদারুণ তথ্যবহুল লেখা, পড়ে সমৃদ্ধ হলাম ।☺
ReplyDeleteদারুণ তথ্যবহুল লেখা, পড়ে সমৃদ্ধ হলাম ।☺
ReplyDeleteএসবের কিছু কিছু ছড়ান-ছেটানো ভাবে পড়েছি। একত্রে পড়তে পেরে খুব ভাল লাগল। বাংলার ও বাঙ্গালীর ইতিহাসের এ এক গুরুত্ত্বপূর্ণ ও সুসংবদ্ধ দলিল হয়ে থাকবে।
ReplyDelete