3

অণুগল্প - সুবর্ণা রায়

Posted in


অণুগল্প


একলাবেলা
সুবর্ণা রায়



- বড় হয়ে কি হবি রে টিপু?

- চশমা।

গেমটিচার অত হাসছিল কেন টিপু বুঝতে পারল না! ঠাম্মা মাঝেমাঝেই চশমা খুলে চোখ মোছে। তার মানে তো ভালো দেখতে পাচ্ছে না। চশমা হলে সবার কত সুবিধা হবে। ঠাম্মার। বাবার। এসব আর কাকে বোঝাবে টিপু! মাঝেমাঝে তো মা'র শাড়ির আঁচল হতে ইচ্ছে করে, যে আঁচলটা বারবার চোখ মুছলেও শুকনো থাকবে। লুকিয়ে লুকিয়ে মা যতই কাঁদুক, টিপু ঠিক বুঝতে পারে, কাউকে বুঝতে দেয় না।

স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলেই একছুটে বাগানে। এক বিকেল আলো নিয়ে ঝাঁকড়া পেয়ারা গাছটা তখন গর্বভরে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। সবাই লোভীচোখে তাকাত কি না! 

একটা ঢিল নিয়ে উপরের একটা জোড়া পেয়ারায় সবে তাক করেছিল টিপু, সড়সড় করে গাছ বেয়ে নেমে এলো বাদামী কাঠবিড়ালিটা। গোড়ার কাছে এসে একটু থমকে টিপুকে দেখল, তারপর ফোলা লেজটা দুবার নাড়িয়ে একটা ডিগবাজি খেয়ে লালঅশোকের ঝোপে ঢুকে গেল। 

ঢিলটা হাতে নিয়ে স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিল টিপু কয়েক মুহূর্তের জন্য। দুদিন আগে স্কুল থেকে ফেরার সময়, মিত্রজেঠুদের বাড়ির সামনে এই কাঠবিড়ালিটাই ঝিম মেরে আধশোয়া হয়ে পড়েছিল। রাস্তায় লোক ছিল না বিশেষ। গরমে জেরবার হয়ে সবাই ছায়ায় ছিল হয়ত। টিপু এদিক ওদিক দেখে ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বার করল। একটু জল দিলে হয়ত চাঙ্গা হয়ে যাবে। কিন্তু বোতল তো খালি! কি করে এখন? দু'পা গেলেই মোড়ের মাথায় মিষ্টির দোকান। টিপু দৌড়ল সেইদিকে। 

বোতলে অল্প জল, ঢাকনাটা বাঁহাতে, টিপু কাছে এগোতেই, কাঠবিড়ালিটা তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে লেজ ফুলিয়ে দে দৌড়! মিত্রজেঠুদের কাঁঠালগাছে উঠে টিপুর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ঘন পাতার ভিতরে হারিয়ে গেল।

ঠিক চিনেছে টিপু, মাথার পিছনে সেই আড়াআড়ি লম্বা দাগ! যেন গভীর ক্ষত সেলাই করা। 

গুনগুন করে একটা মৌমাছি চলে গেল কানের পাশ দিয়ে। হালকা হাওয়ায় একটা পাঁচমিশালি গন্ধ। ঘাসফুল দু-চারটে উঁকি মারছিল এপাশ ওপাশ থেকে। মৌমাছিটা সাদা-হলুদ লক্ষ্য করে উড়ে গেল ওইদিকেই। পেয়ারাগাছের একটা শুকনো ডাল পড়েছিল লেবুগাছের পাশটায়। কুড়িয়ে নিয়ে ডাল ভেঙে লম্বা লাঠির মতো বানাল টিপু। মা এখনও বই পড়ছে নির্ঘাৎ! উঠলে ডাকাডাকি শুরু করে দিত।

লাল অশোকের ঝোপটার সামনে সন্তর্পণে বসল টিপু। একটুও আওয়াজ করা চলবে না। ঝোপটার ভিতর অন্ধকার। ঘন সবুজ পাতা আর মাকড়সার জালে কিচ্ছুটি দেখা যায় না। হাতের লাঠিমতন ডালটা শক্ত করে ধরে গুটি গুটি দু'পা বসে বসেই এগোল টিপু। 

মা'র সাধের ক্রিসেনথেমামের টবগুলোর মাটি, এক সকালে, লণ্ডভণ্ড হয়েছিল ছাদে। মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল মা অনেকক্ষণ। তারপর, বাবার অফিসের ব্যাগটা! সামনের পকেটটা কেটে কুটিকুটি করে ফেলেছিল। সবাই ভাবল ইঁদুরের কাজ। কিন্তু টিপু এখন বুঝতে পারছে, এটা কার কাজ। অত পছন্দের ডোরেমনের বিছানার চাদরটা মেলতে গিয়ে দেখা গেল অনেক জায়গায় ছেঁড়া। মা বলেছিল, পুরনো হয়ে গেছে। কিন্তু টিপু এখন জানে ওটা কার কাজ ছিল। বাবার কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে। দুবছর আগে যেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল, ঠাণ্ডায় গায়ে চাদর দিতে হয়েছিল, বাবা অনেক রাতে বাড়ি এসে জুতো রাখার জায়গাতেই বসে পড়েছিল। মাথা চাপড়ে বলেছিল, শেষ অবধি জ্বালিয়ে গেল! বাবার চোখে বৃষ্টির জল ছিল। কিন্তু মা আর ঠাম্মা অনেক কেঁদেছিল। পরের দিন সবাই হাসপাতালে গিয়েছিল, টিপুকে বাড়িতে রেখে। মা বলেছিল পরে, হারিয়ে গেছে! সব্বাইকে জ্বালিয়ে হারিয়ে যাওয়া! টিপু লাঠিটা দিয়ে খুঁচিয়ে আজ মজা দেখাবে। দরকার হলে মারবেও।

কাঠবিড়ালিটাই যে দীপু, টিপুর তাতে কোনও সন্দেহ নেই।


3 comments:

  1. টিপুকে আমি চিনি

    ReplyDelete
  2. টিপুকে আমি চিনি

    ReplyDelete
  3. লেখার গুণে মনটা ভারী হয়ে গেল.....

    ReplyDelete