0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জল রেখা ৯ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 



মেঘগুলো নেমে আসছে ওর দিকে। ঘিরে ফেলতে চাইছে ওকে। না, কোনও রাস্তা দেখা যাচ্ছেনা। খুব সাবধানে নামতে হবে পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে। পায়ে মাঝেমধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে বুনো লতা। খুব সাবধানে আগলে রেখেছে বুকের কাছে দু হাতের বোঝা। কাঁটাঝোপ এড়িয়ে সে নামে। 

‘নিরূপ- নির-ঊ-উ-প...’ কে যেন ডাকছে দূর থেকে। না, পিছনে ফিরলে চলবে না। এগিয়ে যেতে হবে। পাহাড় থেকে নামলেই জিপ অপেক্ষা করে আছে। ব্যস... কোনওমতে একবার পৌঁছে যেতে পারলেই, মুক্তি। 

কি বলে ডাকছে ওরা? ‘নিরূপ’? না না। ওরা ডাকছে ‘লির, লি-ই-ই-র...’ সব্বোনাশ... ওরা লিরকে ডাকছে। ওরা কি বুঝতে পেরে গেছে যে নিরূপ পালাচ্ছে? পালিয়ে যাচ্ছে সে। একা নয়, তার কোলে শিশু লির রয়েছে। পালিয়ে যাচ্ছে অরণ্যের আদিমতা থেকে অভ্যস্ত নাগরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাত্রার দিকে। ভেতরে বেজে উঠছে হাজার দামামা। বলছে ‘পালাও, তোমাকে পালাতেই হবে। শুধু নিজের জন্য নয়, লিরের ভবিষ্যতের জন্য। শিশুকে নিজের মনোমত গড়ে তুলতে হলে তোমাকে ফিরতে হবে নিজের শিকড়ে, যা এখানে নয়, তোমার নাগরিক জীবনেই পেতে পারো তুমি। পালাও, নিরূপ, পালাও!’ নিরূপ দৌড়াতে থাকে। বুকের ওমের মধ্যে শিশুটিকে আগলে নিয়ে দৌড়ায়। এত ঠাণ্ডাতেও ঘামতে থাকে সে। ওই যে দূরে জিপের হেডলাইট জ্বলছে। আধো অন্ধকারে দেখতে পায় সে। স্টার্ট চালু করাই আছে। দৌড়ে গিয়ে এলিয়ে পড়ে সীটের উপরে। কে যেন কপালে হাত রাখে... বলে ‘নিরূপ, নির-ঊ-উ-প...’। 

চমকে ওঠে সে। ঘুমটা ভেঙে যায়। তাহলে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল! কিন্তু সে এখানে কি ভাবে এল? বুঝতে পারে এটা ক্যাম্প নয়, সরমার বাড়ির বসার ঘরের ডিভান। উঠে বসতে যায়। সরমা ধমকে ওঠে, ‘একদম না। চুপ করে শুয়ে থাকো। যা বাঁধিয়েছ, হেলথ সেন্টারেও রাখার যো নেই। ক্যাম্পে সবাই বাড়ি গেছে গরমে। এখন অন্তত সাত দিনের রেস্ট কম করে। তার পরে সব শুকিয়ে গেলে ক্যাম্পে ফিরে যেও’। 

নিজের মুখে হাত বোলায় নিরূপ। ‘কি হয়েছে আমার সরমাদি?’ প্রশ্ন করে নিরূপ। ‘সেরকম কিছু নয়। অতি নির্দোষ জিনিস’। মুখ টিপে হাসে সরমা। ‘জঙ্গলে বসন্ত শেষ হয়ে গিয়ে গ্রীষ্ম এল। আর তোমার জীবনে কি এদ্দিনে বসন্ত এল?’ নিরূপ অপ্রস্তুত বোধ করে কিছুটা। বলে, ‘পক্স? পক্স হয়েছে আমার? কিন্তু এটা... আচ্ছা এখানে থাকলে, যদি তোমার হয়? আমি ফিরেই যাই নাহয়... কত রাত হয়েছে? চলে যাই দিদি।’ দ্বিধাগ্রস্ত মুখ করে উঠে বসার উপক্রম করে নিরূপ। 

‘না, উঠো না’ ফের ধমকে ওঠে সরমা। 

‘হ্যাঁ, আসলে তুমি আজ সকালে মাথা ঘোরার কথা বলাতে আমি একবারও ভাবিনি যে এটা পক্স থেকেও হতে পারে। কারণ সাধারণত বড় বয়সে মানুষের পক্স হয়না, যদি শিশুবেলায় একবার হয়ে গিয়ে থাকে। বিকেলে তুমি অফিসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলে জ্বরে, গিরিধারী এসে আমাকে খবর দিলো। তোমাকে জ্বর কমাবার ওষুধ দিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছে দিতে গিয়ে দেখি, ওই এক মাতাল রাঁধুনি ছাড়া কেউ নেই। তার জিম্মায় তোমাকে রেখে আসার ভরসা হলো না। তাই, একদম কিডন্যাপ করে নিয়ে এলাম আমার বাসায়। আজ রাতে আর কিছু করার নেই। বেজায় নিন্দে হবে তোমার। আমারও। অনাত্মীয়া মহিলার গৃহে রাত্রিবাস করা ছাড়া আপাতত আর কোন রাস্তা তোমার কাছে খোলা নেই। তবে শনিচারীকে আজ রাতে থাকতে বলে দিয়েছি’। ... গম্ভীর মুখে বলে সরমা। 

নিরূপ ভেবে পায়না এই আক্রমণের সামনে কি বলবে; হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায়না সে। ক্লান্ত অসুস্থ শরীরে শুধু একবার বলার চেষ্টা করে, ‘আমার জামা-কাপড় কিছু তো এখানে নেই’। সরমা হাসে, আওয়াজ করে হেসে উঠে বলে, ‘উফফফ, নিয়ে এসেছি আমি দুটো সেট। ক্যাম্পে গেছিলাম, শুধু জামাকাপড় নয়, স্লিপার, টুথব্রাশ, তোয়ালে সব নিয়ে এসেছি। আচ্ছা, আমার ভাইটার জন্য কি আমি এটুকু করতে পারিনা? দিদি বলেছ যখন, ব্যস। এত ভাবনা করার কি আছে শুনি?’

নিরূপ একটু আশ্বস্ত বোধ করে। কিন্তু অনেক চিন্তা যেন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তার যাওয়া দরকার ছিল মায়ের কাছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। বাবা অসুস্থ, আজ ফোনে জেনেছে সে। নীরদার সঙ্গে কথা হয়েছে ফোনে। কিন্তু শরীরের এই অবস্থায় সে এতটা দুরত্ব ট্রেনে যাবে কীভাবে? সরমাদিকে বলবে? বাপরে, যা মেজাজ, বাড়িতে যাওয়ার কথা বলতেই ভয় লাগছে। তার উপর, শরীরটা এত দুর্বল লাগছে যে সে কিছু ভাবতেই পারছেনা। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। হাত পা নাড়তেও কি কষ্ট! কি করবে নিরূপ, ভেবে পায়না। 

সরমাদি ডিনারে গরম রুটি আর চিকেন স্যুপ নিয়ে আসে। নিরূপ বুঝতে পারে, সে খাবার গিলতে পারছেনা। অসহ্য কষ্ট হচ্ছে তার গিলতে। বোধহয় গলার ভেতরে পক্সের গোটা বেরিয়েছে। খেতে পারেনা সে ঠিকঠাক। স্যুপে ভিজিয়ে ভিজিয়ে কোনওমতে গলাধঃকরণ করে। খাবার পরে কিছুটা ভালো বোধ করে সে। ঘুম পাচ্ছে নিরূপের। আধো-ঘুমের মধ্যেও বাড়ির চিন্তা মন থেকে তাড়াতে পারেনা সে। একটা ফোন করে খোঁজ নিলে হতো। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে যদি মা বুঝতে পারে তার অসুস্থতা। থাক, পরে করবে নাহয়। মা তো জানেই যে সে দায়িত্বজ্ঞানহীন। আর নতুন কি ভাববে? কিন্তু ঘুমের মধ্যে যদি ফের সেই পালিয়ে যাওয়ার দুঃস্বপ্নটা ফিরে আসে, যেটা সে জ্বরের ঘোরে দেখছিল সন্ধেবেলায়? সেটা যে শুধুই স্বপ্ন নয়, একথা নিরূপের থেকে ভালো আর কেইই বা জানে? ভেবেই তার ঘুম ছুটে যেতে থাকে। সব চিন্তা মন থেকে বের করে দিতে চায় সে। পারে না। অনেকগুলো মুখ- বাবা, মা, নীরদা এবং বিশেষ একজনের মুখ ভেসে উঠতে থাকে মনের মধ্যে। যার কাছে সে বড় বেশী অপরাধী। সুখে, দুঃখে, সেবায় হয়ত সে বড় বেশী জড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল নিরূপকে, সেই ভয়ে সে পালিয়েছিল সেই মানুষটির কাছ থেকে। সেই নারীটির কাছ থেকে। ছিন্ন করতে চেয়েছিল ভালবাসার বন্ধন। পেরেছে কি? 

0 comments: