ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
॥২॥
কাল সে দারুণ নখে ছিঁড়ে ফেলবে গলার বকলস /উল্টোদিকে পার হবে যন্ত্রনার অগ্নিবলয়
পাহাড়ে উঠতে নামতে মোটেই কষ্ট হয়না। পাথরের খাঁজে খাঁজে যেন শিমুল আর অর্জুনের হৃদয় শিরাগুলি বেরিয়ে এসে খুব কোমল ফাঁদ হয়ে পা ধরে নেয়। ওই গোপন খাঁজগুলো মুখস্ত হয়ে গেছে গোরাচাঁদের। অন্ধকারে অবলীলায় তরতর করে নামতে লাগলেন তিনি। সড়সড় শব্দে পিছন ফিরে তাকালেন। ভাবলেন বুঝি পেরো আসছে পিছন পিছন। দেখলেন একটা বড় সড় মেঠো ইঁদুর লাফিয়ে লাফিয়ে তার সাথে সাথে নামছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে হাসলেন গোরাচাঁদ। পেরো এদিকে কেন আসবে? ওতো নিশাচর জীব। লোকালয় বিমুখ ছায়াগামী। পাহাড়ের পিছন দিকে এক গভীর খাই। সেই নিম্নগামী গর্ত দিয়ে ওর গোরাচাঁদের কাছে যাওয়া আসা। উনি বলেন পেরোর অভিসার। হা হা করে হেসে উঠলেন তিনি। ইঁদুরটা এত কাছে যে হাত বাড়িয়ে ছোয়া যায়। উনি আকাশের দিকে মুখ তুলে উদাত্ত গলায় আবৃতি করে উঠলেন ‘দেখা যায় কয়েকটা তারা/হিম আকাশের গায়ে,-ইঁদুর পেঁচারা /ঘুরে ঘুরে যায় মাঠে, ক্ষুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজও মেটে, পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে...’। পঁচিশ বছর! সেই দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য উদ্দেশ্যেহীন পাঁচ বছরের সমুকে কোলে করে দৌড়ানো -কোথায় আশ্রয় -কোথায় নিশ্চিন্ত মাটি! অহরহ পুলিশের বুটের আওয়াজে চকিত ত্রস্ত। রাজনৈতিক ভ্যান। সম্বল শুধু একটা ধুতি একটা গামছা সমুর দুটো কাপড়, মার্ক্স ও জীবনানন্দ। পঁচিশ তবু গেছে কবে কেটে। সেই পঁচিশ বছর আগের পুলিশি বুটের চামড়া ও মেদিনী কাঁপানো আঘাত এখন ঝাপসা ছবি। সেই স্মৃতি ফিরেছে বিপথে। এখন সদর্ভ মিলিটারি বুটে তারই রক্তের ভাষা কথা কয়। কেন হিংসার মহড়া, কেন ভাবী বিষক্রিয়া মেনে এখনি নির্মল সবুজে বিষ ঢেলে তেজ পরখ করা। হিসাব মেলে না।
সূর্য ডুবতে না ডুবতেই ফুটফুটে জ্যোত্স্না আদিগন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। গোরাচাঁদ নেমে পড়লেন পাদদেশে। গলা ঝেড়ে এবার চাঁদের আলোর গান ধরলেন। রচনাকার সুরকার গায়ক শ্রোতা সব তিনিই। চারপাশ শুধু নিস্তব্ধতা। গাছপালা বেশি না থাকার কারণে ঝিঁঝি পোকা জোনাকি নেই। পাদদেশ থেকে সমতল ভূমি অব্দি অনেকটাই ঢালু। মসৃণ ঢালু জমি গড়িয়ে গড়িয়ে বেঁকে পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে পিছনে এক অগভীর নালাতে মিশেছে। বারোমাস তাতে ঝির ঝির জল বইতে থাকে। পাড়ে টুকরো টুকরো জমি নিয়ে গ্রামের প্রায় সবাই চাষ করে সব্জি ফলায়। জমিগুলোর ওপারে আদিগন্ত ঘন জঙ্গল ও নির্জনতা। গোরাচাঁদ এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, এখান থেকে বস্তির ঘরগুলো খুব ছোট ছোট দেখা যায়। কোনও কোনও ঘরের ফাঁক দিয়ে একটুকরো লাল আগুন। ওরা তোলা উনুনে রান্না করে। উনুনে কয়লা দিয়ে বাইরে আঙনে আঁচ আসতে দেয়। ফিট সাদা ধুয়োর মেঘ ভেদ করে লাল আগুন। পিছনে ছায়া ছায়া সবুজ প্রান্তর। অসম্ভব ঢালু পিছল মাটি বেয়ে গোরাচাঁদ নামছিলেন আবার পিছনে খসখস শব্দ। এবার সত্যিই পেরো তাঁর পিছনে। তার সাথে আরও দুজন। গোরাচাঁদ পিছন ফিরতেই পেরোর সাথীটা একেবারে তার গা ঘেঁষে মুখোমুখি। উত্তেজিত মুখ হাঁ করে হিন্দি বাংলা নাগপুরিয়া ভাষা মিশিয়ে একনাগাড়ে বলতে লাগলো। দাঁতের ফাঁকে বাসী মাংসের টুকরো, দুর্গন্ধ ভকভক করে বেরচ্ছে। ও যা বলল তাতে বোঝা গেল জেরকার লাশ ওই খাঁড়ির জলে পাওয়া গেছে। গোরাচাঁদ ওকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে দিয়ে পেরোর সামনা সামনি হলেন। চোয়াল শক্ত করে পেরো একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো গোরাচাঁদের দিকে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে এলো। মুখ নিচু করে বলল –চলিয়ে সাবজী।
গোরাচাঁদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন পেরোর মুখের দিকে। জেরকা ওর মা কিন্তু আজ অব্দি কোনওদিন পেরো মায়ের কথা ওঠায়নি। এক আধবার জেরকার প্রসঙ্গ উঠতেই পেরো সেখান থেকে উঠে চলে যেত। জেরকার একটিই সন্তান কিন্তু পেরো তার মার কাছ থেকে আলাদাই থাকে। শুধু তাই নয় মার প্রতি এক প্রচ্ছন্ন ঘৃণা বোধ আছে গোরাচাঁদ বুঝতে পারেন। তার জন্যে যে তিনিই দায়ী সেটাও তিনি ভালই বোঝেন। কিন্তু পেরোর চোখ বেয়ে অশ্রু আর তার এই ভেঙ্গে পড়া অসহায় বেমানান রূপ এই প্রথম দেখলেন তিনি। উনি হাত বাড়িয়ে পেরোকে ছুঁতেই পেরো হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল গোরাচাঁদকে। কিছুক্ষণ এভাবেই থেকে পেরো একরকম ধাক্কা দিয়ে ওনাকে সরিয়ে দিল। মুখ ঘুরিয়ে ওর সঙ্গীটাকে বলল- চলো রে অব জঙ্গ শুরু হো গয়া। বলেই তরতর করে নেমে পাহাড়ের ডান দিকে ঘুরে গেল।
পেরো হাওয়ার বেগে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওর দুই সঙ্গীও নেই। গোরাচাঁদ একা হাফাতে হাফাতে ঢালু পথে চলতে লাগলেন। এদিকে ছোটো ছোটো ঝোপ ঝাড়। বনতুলসী আর ঘৃতকুমারী প্রচুর। পাখা ঝাপটানোর শব্দে পিছন ফিরে দেখেন একটা শেয়াল বনমুরগী শিকার করে তারই পিছন পিছন আসছে। হয়তো রাস্তা পাচ্ছেনা। গোরাচাঁদ ঝোপের দিকে সরে গেলেন। শেয়ালটা লাফ দিয়ে সবেগে বেরিয়ে গেল। পৃথিবীতে সবারই যেন খাদ্য খাদকের সম্পর্ক। শারিরীক বা মানসিক যে কোনও ভাবেই প্রত্যেকে চায় তার চেয়ে কমজোরকে গ্রাস করতে। সেসময় সে মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশু হয়ে যায়। গোরাচাঁদ ভাবেন সাম্যতা আনতে কত যুগে কতবার যে মহানেরা এসেছেন কতবার কতরকম ভাবে চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু মানুষের সেই প্রিমিটিভ সেই আদিম রিপু এতটুকু টসকায়নি বরং আরও উজ্জ্বল ও সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন হয়েছে।
গোরাচাঁদ যখন পৌঁছালেন সেখানে তখন ওরা তিনজন ধরাধরি করে জেরকার দেহ উপরে তুলেছে। আধো আঁধারে ঠিক মতো দেখা যাচ্ছেনা। কিন্তু বোঝা গেল ওরা ঝুঁকে পড়ে কিছু করছে। একটা আবেগ হঠাত্ই গলা ঠেলে উঠল গোরাচাঁদের। সামলাতে পারলেননা তিনি। মুখ ঢেকে বসে পড়লেন আর ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আর কেউ জানুক বা না জানুক পেরো জানে জেরকার সাথে গোরাচাঁদের কী সম্পর্ক। চার বছর জেলে থেকে দেখে ফেরত এই তিনদিন হল জেরকা এখানে এসেছে। এসে কোথায় উঠেছিলো সে, বিধ্বংস ভিটে বাড়ি দেখে তার মনের কি যে অবস্থা হয়েছিল, সেটা এখন গোরাচাঁদ মনে মনে অনুভব করছেন আর ফুলে ফুলে উঠছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় আফসোস আর নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে এই ভেবে যে, এই তিনদিন কেন সমুর উপস্থিতি উপেক্ষা করে তিনি জেরকার সাথে দেখা করলেননা? সমু এমনিতেই তাঁকে ঘৃণা করে। জেরকার ব্যপারে জেনে না হয় আর একটু বেশিই হতো? আর একটু বেশি থুতু ছুড়তো? জেরকাই বা কি ভেবেছে? এজীবনে আর তো দেখা হবেনা ওর সাথে। জেরকা বিদুষী ও বুদ্ধিমতি। ও কি ক্ষমা করেছে? গোরাচাঁদ আরেক প্রস্থ হু হু করে কেঁদে উঠলেন। সে সময় কার যেন স্পর্শ তার কাঁধে। মুখ তুলে থাকতেই দেখলেন পেরো। উত্তেজিত হয়ে বলল –সাবজী উও জিন্দা হ্যায় ! আভি ভি শ্বাস চল রহা হ্যায়। উঠিয়ে, কুছ কিজিয়ে।
0 comments: