2

ছোটগল্প - সোমস্নিগ্ধ মুখোপাধ্যায়

Posted in


ছোটগল্প


দাহ
সোমস্নিগ্ধ মুখোপাধ্যায়



উবু হয়ে বসে আছে পাঁচুঠাকুর।
এই সবেমাত্র মুখে আগুন জ্বেলেছে সে। দামোদরের চরে।

খানিক দূরে সবখাওকি আগুন, ঝলসাতে থাকা জোয়ান শরীরটা থেকে যত রসদ পাচ্ছে, তত যেন লাফিয়ে লাফিয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে।

কি দুঃসহ তেজ ঐ কমলা শিখার, কি চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য! যেন বলছে পাঁচুঠাকুরকে, আজ আমি তোর সব শেষ করে দিচ্ছি, পারবি আটকাতে?

কিছুটা তফাতে, কালু ডোম, হরেন ম্যাস্টর বা বছর বাইশের ঐ টগবগে জোয়ান বিলে, যে অন্যদিন মালের ঘোরে এতক্ষণ বাপের বয়সী পাঁচুঠাকুরের সাথেও অশ্লীল ফাজলামো শুরু করে, সবাই কেমন থম মেরে গেছে।

কেনই বা থম মারবে না। চলে যাবার কি বয়েস হয়েছিল ছেলেটার। তাও আবার শক খেয়ে। কাজে ঢোকার মাত্র এক বছরের মাথায়। ঐ বিলের থেকে আর কত বড়ই হবে? মাস পাঁচেকের। বিলে হলো আশ্বিনে, আর ছেলেটা বোশেখে। সত্যি, কি আঁচ ছিল ছেলেটার। বোশেখের গণগণে রোদ্দুরের মতই। পাঁচুর সব মনে পড়তে থাকে।

যে বছর হলো, হাসপাতালের ডাক্তার, বৌকে হাসতে হাসতে বলেছিল, 'তোমার ছেলে এই চোদ্দশ সালে তোমার কোলে এল। দেখো, এ ছেলে একশ বছর বাঁচবে।'

আজ দামোদরের চরে বসে সে সমস্ত উপহাস মনে হয় পাঁচুর।
আসলে, রাধুখুড়োই বোধহয় ঠিক বলত। 

'সবই কপালং, বুঝলি পাঁচু, সবই কপালং। না হলে, যার বাবা সাক্ষাৎ দেবাদিদেব মহাদেব আর যার মা স্বয়ং জগজ্জননী অন্নপূর্ণা, তার মাথা কোনওদিন হাতির হয়!!'

আর কপালই যদি না হবে তবে বামুনের ছেলে হয়েও পাঁচুঠাকুর কি আর এ অঞ্চলের মড়া পোড়ানোর দলের মাথা হয়!

না সে নিজেই কোনওদিন ভেবেছিল, যে কত কত মড়া পুড়িয়ে শেষে কিনা এই দামোদরের চরে আজ নিজের হাতে আগুন দিতে হবে তার একমাত্র আত্মজকে!

পাঁচু ভাবতে থাকে.....।

কতই বা বয়েস হবে তখন ছেলেটার , তিন কি চার। সে কি জ্বর! ধুম জ্বর। এক দিন গেল, দু..দিন। যখন তিনদিনেও জ্বর কমার বদলে বাড়ছে, নিয়ে যেয়ে ভরতি করাতে হলো সদরের হাসপাতালে। তার পর টানা পনের দিন যমে মানুষে টানাটানি। সারারাত মেঝেতে বসে পাঁচু পাখা করছে আর বৌ জলপটি দিচ্ছে। তারপর ভগবান মুখ তুলে চাইলেন। আস্তে আস্তে সেরে উঠল ছেলেটা। অবশ্য সুস্থ হবার পরেও ছেলেটার গায়ে বল আনতে কম জায়গাতে যায়নি পাঁচু। কবচ, মাদুলি। একদিন রাধু খুড়ো বললে, নতুনগাঁয়ে, দত্তদের পুকুরে প্রচুর ল্যাটা, চ্যাং হয়েছে। ঈশ্বর জানে, শুধু ঐ একরত্তি ছেলেটার জন্য দু চারটে ধরতে গিয়েছিল পাঁচু, ছিপ হাতে। দত্তদের মেজবাবু দেখতে পেয়ে সে কি অপমান, কি অপমান!

এত অপমান যে মরেই যেতে মন যাচ্ছিল। কিন্তু সে সবই তো মুখ বুজে সহ্য করা শুধু তোর জন্য! আর সেই তুইই কিনা একলা আর উদোম করে চলে গেলি।

আর ল্যাঠা, চ্যাং -ও কি সেভাবে মুখে রুচত ছেলের? একদিন তো বাগদীবৌ অসটায় বলেই ফেলল -
"বড়লোকের লড়কার
টাটকা ইলিশ দরকার
মাছেরঝাল আর পান্ত
পেলেই বাবু শান্ত"

পাঁচু ভাবতে থাকে.....।

গেলবার, বারণ করা সত্বেও যখন বাপে খ্যাদানো পার্টির ছোকরাগুলোর পাল্লায় পড়ে বিরগেড গেলি, আর পুলিশের লাঠি খেলি, তখন এই বাপই তো পিঠে তেল মালিশ করে তোর ব্যথা কমিয়েছিল। আর তুই কিনা.......

হাঁটুয় মুখ গুঁজে পাঁচু দেখতে পাচ্ছিল কেমনবকরে তার সৃজন আস্তে আস্তে ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল বিমুক্ত চরাচরে, সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে।

- ও ঠাকুর... ঠাকুর, শ' তো শেষ হতে চলল। কি আর করবে বল। এইবার তো চিতায় জল দিতে হবে, চলো', কালু ডাক পাড়ে।

কালুর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পাঁচুর। 

- তোরাই ঢেলে দে, আমাকে আর বলিস না কালু, আমি পারব না।
- তা কি করে হয় ঠাকুর, মন্তর টন্তরের তো আমরা কিছুই জানি না। এই কাজটা তো তুমিই করো। এজন্যই তো তুমি আজ এত বছর আমাদের সাথে আসছ।

-না রে, আমাকে আজ তোরা ছেড়ে দে, জবাব দেয় পাঁচু ঠাকুর।
কথা না বাড়িয়ে হরেন ম্যাস্টর, বিলেকে নদী থেকে জল এনে ঢালতে বলে চিতাতে।

মাটির কলসির জল ঢালার শব্দের সাথে, দূর থেকে পাঁচু শুনতে পায়, হরেন ম্যাস্টর উচ্চারণ করে চলেছে,
"বাসাংসী জীর্ণাণী যথা বিহায়, নবানী গৃহ্নাতি নরোহপরাণী তথা শরীরাণী যথা বিহায় জীর্ণানন্যানী........"

ব্যপ্ত চরাচরে নতুন করে আর একটা দিন শুরু হবে আর খানিক পরেই। পাঁচুর দেখতে পায়, আরে, ঐ তো ছেলেটা ঘরে ফিরেছে। ওহ...আজ তো পঞ্চমী, হ্যাঁ, আজই তো আসবার কথা ছিল খোকার পানাগড় থেকে।

-কি রে ছুটি পেলি তাহলে?

হ্যাঁ, মা। আসলে আমাদের হাই ভোল্টেজ লাইনের কাজ তো, কন্টাক্টর বলল, পুজোর কদিন বন্ধ থাকবে।

- তা বেশ। কিন্তু পুজোয় এই একঝুড়ি পুরোন জামাকাপড় কেন নিয়ে এলি ঘরে, কাচতে?

তুমি হাসালে মা, পুজোয় কেউ কাচাকুচি করে। আসলে মনে হল, পুরোনো গুলোকে ছেড়ে যখন নতুনই পরব, তখন ওগুলো তোমার কাছেই থাকুক। কেউ চাইলে দিতে পারবে।

পাঁচু বুঝতে পারে, পূবকোণের ঐ রাঙ্গা আকাশটার মত জীবনও কত ইঙ্গিতময়, কত বিচিত্র। ক্ষনে ক্ষণে সেও রং বদলায়। দেরী না করে বালি থেকে উঠে পড়ে পাঁচুঠাকুর। এবার ঘর ফিরতে হবে। ঘরে বৌটা কি করছে কে জানে। এবার তার পাশে গিয়েও যে দাঁড়াতে হবে তাকে।

2 comments:

  1. অনবদ্য। এর বেশী কিছু বলার ভাষা নেই আমার।

    ReplyDelete
  2. Debasis Dasgupta10 August 2016 at 12:55

    I am speechless, Spellbound

    ReplyDelete