ছোটগল্প - সুনৃতা মাইতি
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
মা এবং তার তিতলী
সুনৃতা মাইতি
ড্রইং রুমের জানলার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল সাত বছরের তিতলী। কালো রঙের চৌখুপি কাটা গ্রীল আর ওই ঠাসাঠাসি বহুতলগুলোর ফাঁক ফোকড় গলে উঁকি মারছে থমথমে মাঝদুপুরের ফ্যাকাসে আকাশ। এই গ্রীলের ফাঁক দিয়েই রোজ টকাস করে সূয্যি ওঠে। যেন ওই বহুতলগুলোর পিছন দিয়ে একখানি ঝাঁঝালো রঙের চোখ ধাঁধানো বল কেউ খুব জোরে ছুঁড়ে দেয় ওই সবচে উঁচু আকাশপানে। এমন কেউ ....যার গায়ে খুব জোর। বজরংবলীর মতো। আবার সাঁঝ নামার আগেই পশ্চিম আকাশে ছেঁড়া মেঘের গা ঘেষে খেলা করে হালকা নীল লাল রঙের মিশেল। কে কাকে টেক্কা দেবে। খোলা জায়গায় এমন গোধূলিবেলায় বাবা মায়ের সঙ্গে গাড়িতে যেতে যেতে তিতলী লক্ষ্য করে দেখেছে সেসময় সূর্যটাও হয়ে যায় গনগনে আগুনে রঙা। আর সেই কমলি সূর্যটাও তাদের সঙ্গে সঙ্গে যায়। ভারী আমোদ হয় তখন তার। কিন্তু তার বইতে যে লেখা আছে... সূর্য মোটেই ঘুরন্ত নয়।
রোজ রোজ এই গ্রীলের ফাঁক দিয়েই তিতলীর ব্যস্ত সমস্ত দিনগুলো রাতের আধাঁরে মিলে যায়। তার যে কত্ত কাজ...উফ্। সবচে আগে পড়াশুনা। তারপর আছে ছবি আঁকা, গানের ক্লাস কিংবা নাচের স্কুল। সেও ছুটছে ....আর সাথে সাথে তার মাও। মুশকিল হয় এইসব ছুটির দিনগুলোতে। স্কুলও নেই আর দুটি মনের কথা কইবার ...মিশা, তিয়াসা আর নয়নারাও নেই। আর ঘরে থাকলেই মায়ের শুধু কাজ আর কাজ। আর কাজ ফুরিয়ে গেলে ওই মাপা সময়টাতে মা সটান সেঁধিয়ে যায় লম্বা চওড়া স্মার্ট ফোনের মধ্যিখানে। তখন মা একলা একলাই হাসে ...কখনও জোরে জোরে ....কখনও মিটিমিটি। এইসব সময় মাকে খুব অচেনা মনে হয় তিতলীর। ডাকলেও সাড়া দেয়না। আর নাছোড়বান্দা হয়ে ডাকলে রেগে মেগে বলে...."যাও এখান থেকে ...এখানে কি...অ্যাঁ...যাও গিয়ে হোমওয়র্ক করতে বসো গে" মায়ের যেন সব কিছুতেই রাগ আর সব কিছুতেই মানা। টিভি দেখতে মানা, গেম খেলতে মানা....ফুচকা, গোলাবরফ আর রোল খেতেও মানা। স্কুল গেটের বাইরে বরফ কাকু আর ফুচকাওলা কাকু....কারও দিকে তাকানোই মুশকিল তিতলীর পক্ষে। কিন্তু সে বেশ জানে ওই বরফ কাকু বরফগুলো চুরচুর করে গুড়িয়ে, মুঠো পাকিয়ে তাতে ঢেলে দেয় রং বেরং সিরাপ। কিংবা ধরো ওই ফুচকা কাকু। পেটমোটা টোপা ফুচকা নিয়ে খুচ করে একটা ফুটো করে তাতে ঠুসে দেয় ঝাল আলুমাখা। আর ওপরে ঢেলে দেয় টক্ টক্ অমৃত জল। ভাবলেই তার জিভ সুড়্সুড় করে ওঠে। কখনও অবশ্য মেজাজ ভালো থাকলে হাজি রোল সেন্টার পেরোবার সময় মা বলে ওঠে "খুব খেতে ইচ্ছে করে না তিতলু? তাইলে চোখ বন্ধ করো...আর নাক বাড়িয়ে গন্ধ নাও....ঝটপট....হু হু... ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম্"।
কিন্তু এই যে খাঁ খাঁ দুপুরবেলা, দূর দূর অব্দি কাকপক্ষীর নিশানটুকুও নেই, বাইরে আগুনে বাতাসের হলকা, আশপাশের সবকটা দরজা জানলা নিপাট বন্ধ .....এমন নিঝুম সময়ে তিতলী করে কী? তার যে মোটে ঘুম আসেনা।
ভারী পর্দা টানা আধো আধো আলো মাখা শোবার ঘরে মা তখন ঘুমিয়ে পড়েছে ক্লান্তিতে। পাশে সঙ্গী মুঠোফোন। ওই ফোনের মধ্যে যে কত কেরামতি! সে সব জানে।সেদিন মায়ের বন্ধু সুপ্তিমাসী খুউব গর্ব করে হাত নাচিয়ে নাচিয়ে বলছিল.."আমার মেয়ে না গ্যাজেটের ব্যাপারে সবজান্তা ...গেমস, ডাউনলোড, চ্যাটিং....সওব। আর মোবাইল তো জলভাত।" তখন তিতলীর পেট গুড়্ গুড়্ করে খুব হাসি পাচ্ছিলো। ভাগ্যিস মা জানেনা ....ওই মুঠোফোনের রহস্য সে দিব্যি ভেদ করে ফেলেছে।
শোবার ঘরে পা টিপে টিপে ঢুকেই মায়ের আলমারি থেকে একটা ধোঁয়া রং ওড়না বের করে সে পেঁচিয়ে নেয় মাথায়। বাহ্, বেশ বড়ো চুল হয়ে গেলো তো! তারপর মায়ের জিনিসপত্র ঘেঁটে কিছু সাজুগুজুও করে নেয় ফটাফট। এবারে মায়ের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে সুরুৎ করে বেরিয়ে আসে ডাইনিংমুখো। বাবা রে! এযে মেঘ না চাইতেই জল।এই দেখো, ফোনের ভেতরে ছোট ছোট বৃত্তে হাসি হাসি মুখে তুবলি মাসি, পিন্টুকাকু, এষা কাকিমা ও হাবলুদাদারা কেমন তার দিকে তাকিয়ে। দাও সকলকে একটা করে....হাইই ই পাঠিয়ে। কি মজা! কি মজা! আনন্দে একপাক নেচে নেয় সে। এমন সময়ে কানের কাছে দুখানা পরিচিত আঙুলের খটখটে স্পর্শ। তিতলী সটান কাঠের পুতুল। সামনে হাঁড়িমুখে মা দাঁড়িয়ে। "বড়ো সদ্দারী শিখেছ....আমার লিপস্টিক...কাজল সব মেখে....ইসস...আর ফোন নিয়ে কি করিস রে?...হায় হায় তলে তলে এদ্দুর...আবার মেসেজিং চলছে..আমি কোথায় যাই ..হে ভগবান! দেখাচ্ছি মজা!" এক ঝটকায় মায়ের হাত ছাড়িয়ে তিতলী তখন পেছোতে পেছোতে দেওয়ালে ঠেকে গেছে। তার ফুলো ফুলো ঠোঁট দুটো কাঁপছে তিরতির। চোখের মণি দুটি স্হির। যেন আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস। "তুমি তো আমার সাথে একটুও খেলোনা...একটুও গপ্পো করোনা....আমি কি করি বলো তো...?...খালি বলো...ছবি আঁক...স্টোরিবুক পড়....নয়তো পড়তে বস্..... সবসময়....আমার ভাল্লাগে না... ভাল্লাগে না... একটুও ভাল্লাগে না।" তার চোখ দিয়ে নেমে আসে তপ্ত দিনশেষের ক্লান্ত ঝড়বাদল। মা তখন হাঁ। তার চোখে পলক পড়ছেনা মোটে। তারপর মুহূর্তের পর মুহূর্তেরা হেঁটে চলে, দৌড়ে বেড়ায় ...ডিগবাজি খায়। ডাইনিং-এর চেয়ারে মা গালে হাত দিয়ে বসে থাকে ঠায়।
সেই রাত্তিরেই কল্পডানায় ভর দিয়ে জানলার ফাঁক গলে চুইয়ে পড়া জোত্স্নায় ভিজে মা তিতলীকে শোনায় দুষ্টু মিষ্টি ভূত শশীমুখীর গল্প। গল্প শেষ হবার আগেই সে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় প্রশান্তিতে। মায়ের হাত তখন নিশপিশ করে উঠেছে বহুদিন আগের হারানো কলমটা খুঁজে নেবার ইচ্ছেয়। কিন্তু ক্লান্তি ...। গভীর ক্লান্তির ডাকে সাড়া দিয়ে ঘুম পাড়ানি মাসী পিসিরা ধীরে ধীরে দখল করে নেয় মাকে। শুধু মায়ের চোখের কোণে লেগে থাকে কয়েকটা জোত্স্নাধোয়া মুক্তা বিন্দু।
এরপর কয়েকটা দিন কাটে পালকের মতো সুমসৃণ। গল্পের কি আদি অন্ত আছে ? যেমন ধরো ব্যলকনির রেলিং ধরে হেঁটে যাওয়া পিপড়েদের কীর্তি কলাপ। কিংবা ধরো জানলার গ্রীলে বসা চড়াই পাখির চু কিতকিত...। নিদেনপক্ষে শোবার ঘরের নধরকান্তি টিকিটিকি দম্পতি ....এবং তাদের ছেলেপুলেদের নিত্যদিনের কাণ্ড। একটা পেছনমোটা পাখাওলা পিপড়ে আছে....তিতলীর মতে সে হলো পিপড়ে স্কুলের প্রিন্সিপাল। আর কিছু ঝামেলা বাজ পিপড়ে আছে....তারা হলো গিয়ে যোদ্ধা ছাত্র দল। মা বললো "জানিস তিতলী ওই টিকটিকিগুলো কিন্তু লিজাড নয় ...ওরা গেকো। আসলে বহু বহু বছর আগে ওরা ছিল তোম্বাপানা ডাইনোসর.....কপাল দোষে শুঁটকে শুঁটকে হয়ে গেল টিকটিকি।" তিতলী ডাইনোসরের এহেন রদবদলে প্রবল মজা খুঁজে পায়। আর থাকে শশীমুখি ...কথায় কথায়। রান্নাঘরে গ্যাস ওভেন জ্বলছে শুধুমুধু। মা বল্লো..."না তো, আমি নিভিয়েছি তো।" অথবা লিফ্ট তিনতলার বদলে চলেছে পাঁচ তলায়। তিতলী মাকে চোখ টিপে বললে, "এ শশীমুখি না হয়েই যায় না"!
কিন্তু তিতলীর তালে তাল মেলাতে গিয়ে মায়ের ছকে বাঁধা সংসার যে তালকানা হয়ে উচ্ছন্নে যায় যায়। বাবার অফিসের নিয়ম বাঁধা ভাত দিতে দেরি হয়ে গেলো দুদিন। সেদিন রাতে বোয়াল মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে খেতে বাবা চশমার নীচ দিয়ে নাক কুঁচকে বললেন "গরম মশলা দাওনি বুঝি ...আর রসুনটাও কষেনি...কাঁচা কাঁচা গন্ধ ছাড়ছে"। সপ্তাহান্তে ঠাম্মা দাদাই বেড়াতে এসে ঘরদোরের অবস্হা দেখে ছ্যা ছ্যা করে উঠলেন। বাথরুমে পা পিছলে পড়তে পড়তে অতিকষ্টে সামলে নিল পিসিমণি। কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিল... মানদা মাসী। ধাঁ করে চারদিন ডুব। মায়ের মাথা আবার আগের মতো গরম।
এমনই এক খরতপ্ত দিনে সংসারের জি-হুজুরি করতে করতে মায়ের হঠাৎ মনে পরে গেলো তিতলীরাণীর কথা। বড্ড নিশ্চুপ লাগছে আশপাশ। "কি করো তিতলু...গেম খেলছো না, টিভি দেখছো না...তবে কি আমার মোবাইল?" বলতে বলতেই সাবান মাখা হাতদুটো নিয়ে মা দ্রুত ছোটে সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে। ড্রইংরুমে সোফার একটি কোণ ঘেষে নিজের সংসার সাজিয়ে বসেছে কন্যা। সামনে মায়ের মাসকাবারী ডায়েরী। ধমকাতে গিয়েও থেমে যায় মা তারপর শুধোয় "কি করো তিতলু?" টলটলে মায়াবী চোখদুটো নিয়ে তাকায় সে মায়ের দিকে, "তোমার তো সময় নেই মা....তাই শশীমুখির গল্পটা আমি বলছি আর লিখছি এই খাতায়। তুমি তো গল্পটা শেষই করলেনা...আমার খুউব মজা লাগছে মা....তোমারও এমনই লাগে?"
আলুথালু মায়ের চোখ দিয়ে তখন নেমে আসছে সেই গলিত মুক্তাবিন্দুরা। হয়তো তাই। হয়তো তিতলী রাণীর ডানায় ভর করেই শেষ হবে মায়ের ওই অসম্পূর্ণ ইচ্ছে গল্পটা।
বারে বারে মুগ্ধকরা লেখনী। মুগ্ধতায় ছেয়ে আছি।প্রণাম আপনাকে।।
ReplyDelete