0

ধারাবাহিক - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


দিনমণি
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়



( দেবগ্রাম নামক অখ্যাত গ্রামের সম্পন্ন এক গৃহস্থের বালক এক প্রত্যুষে গৃহত্যাগ করিল সেই পরিবারেরই আশ্রিতা, অনাথা এক বৃদ্ধার সাহায্যে, যে বৃদ্ধার সেই বালকটি অপেক্ষা আপনজন আর কেহ নাই, কিন্তু অনাথা বৃদ্ধা পরিবারেরও কেহ নহেন। বালকটি আর কেহ নহে, সম্পন্ন পরিবারের গৃহকর্তার কনিষ্ঠ পুত্র। কিন্তু বালকটি গৃহত্যাগ করিল এমন এক সময়ে যখন গৃহে অপর এক সন্তানের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আসিয়াছে, বাটীস্থ সকলে ভীত, সন্ত্রস্থ। এমত সময়ে বালকটী গৃহত্যাগ করিল উচ্চবিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষা করিবার অভিপ্রায়ে। বালকটি গৃহত্যাগ করিল, কিন্তু বাটীস্থ সকলের কি হইল?)

পরবর্তী অংশ...




সকাল হইয়াছে, কিন্তু ভট্টাচার্য্য পরিবারের এখনও সকলের ঘুম ভাঙ্গে নাই। সবে শীতকাল উঁকি দিয়াছে, তাহার কঠিন রূপটি এখনও কেহ দেখে নাই, ভোরের হাওয়ায় আগমন বার্তাটুকু ঘোষিত হইতেছিল মাত্র। শীতের সকালের মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা বাতাস ঘুমের পক্ষে আরও মধুর হইয়াছে। এই সুমধুর ক্ষণে পুরুষমানুষের আরাম করিলেও চলে, বস্তুতঃ তাঁহারা তাহা করিয়াও থাকেন। দ্বিতল হইতে তাঁহাদের নামিতে দেরি হয়। বাহিরে বড় একটা যাওয়া নাই, কাজেই তাড়াও নাই। কিন্তু বাটীস্থ বৌ-ঝিদের শুইয়া থাকিয়া আরাম করিলে চলে না। ভট্টাচার্য্য পরিবারটিতে দ্বিপ্রহরে ভোজনের পাতা পড়ে প্রায় চল্লিশ হইতে পঞ্চাশটি, দুই বেলায় প্রায় একশত জনের আহারের ব্যবস্থা রাখিতে হয়। গৃহকর্তা-কর্ত্রী, পুত্র-পুত্রবধূগণ, এসো জন- বসো জন, আশ্রিত-আশ্রিতা, তাহাদের পুত্রকন্যাগণ, গৃহশিক্ষক, ব্যয়ামশিক্ষক, অতিথি- অভ্যাগত, ঠাকুর, চাকর ব্যতিরেকেও কর্তামশাইয়ের বৈঠকখানার দুই/চারিজন সর্বদাই থাকেন। সব মিলিয়া নিতান্ত লোক কম নহে। এতগুলি মানুষের ভোজনের যোগাড় করিতে সকাল হইতেই সাড়া পড়িয়া যায়। কিন্তু তাহারও পূর্বে নিদ্রাভঙ্গের পর আছে সকালের চা-পানের একটি পর্ব। পাকশালেরই একটি দিকে তাহা সম্পন্ন হইয়া থাকে। যেমন তেমন লোকেরা সেখানে আসিয়া চা পান করিলেও মনিবরা সেখানে আসিয়া চা পান করেন না, ঘরে ঘরে পৌঁছাইয়া আসিতে হয়।


সকালের চা পর্বটির দায়িত্বে থাকেন সুন্দরি দিদি। ইনি শিবতোষের পিসির কন্যা। সকলে সোনা পিসি বলিয়া ডাকে। যৌবনকালে অতীব সুন্দরী ছিলেন, এখনও গায়ের রঙ সোনার মত, তাই সোনা পিসি। বিধবা হইয়া একটি সন্তান লইয়া শিবতোষের আশ্রয়ে আছেন। সন্তানটি কন্যা। অতি সম্প্রতি তাহার বিবাহ হইয়াছে এক চট্টোপাধ্যায় কুলীন সন্তানের সহিত। রূপবান যুবক, উপনিষদ, শাস্ত্র, ইত্যাদি পড়িয়াছে, কিন্তু মা-বাপ নাই, খুড়ার নিকটে মানুষ। শিবতোষ তাহাকে গ্রামে কিছু জমি ও বসতবাটী নির্মাণের জায়গা দিয়াছেন। আর পাঁচটা গ্রামে পূজা অর্চনা করিয়া তাহাদের একরকমে চলিয়া যায়। যুবকটির নাম সদানন্দ। শিবতোষ তাহাকে স্নেহ করেন। সুন্দরি দিদি অথবা সোনা পিসিকেও তাহার জামাতা বাবাজী একত্রে থাকিবার অনুরোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু জামাতার বাড়িতে থাকিলে মান থাকিবে না, ইহা ভাবিয়াই তিনি যান নাই। যদিচ, প্রত্যহ বৈকালে তথায় সাক্ষাৎ করিতে যাওয়া চাই। নিন্দুকেরা বলে, যাইবার সময় এইবাড়ি হইতে প্রায় প্রতিদিন কন্যা-জামাতার জন্য ভেট্‌ লইয়া যান। কথাটির মধ্যে সত্য এবং মিথ্যা দুইই আছে। 


শিবতোষের জ্যেষ্ঠ পুত্র রণতোষের পত্নীর নাম পারুলবালা। বড়ো ঘরের কন্যা, বড়ো ঘরের পুত্রবধূ। সকালের চা-পর্বের সময় প্রত্যহ তাহার উপস্থিত থাকাটাই একটি বৃহৎ কাজ। তাহাকে আর কিছু করিতে হয় না। শুধু সকলের চা ঠিকমত গিয়াছে কিনা, সকলে চা পান করিল কিনা এই কাজটুকু করিলেই চলে। বাটির মধ্যমা পুত্রবধূটি আসিলে দুজনে একসঙ্গে চা পান করে। চা পান করিবার বিশেষ কোনও স্থান নাই। কখনও নিচের বারান্দায়, কখনও দ্বিতলের ‘আরাম ঘরে’ও সকালের চা পান করিয়া থাকে। বধূগণের বসিবার, গল্প করিবার জন্য শিবতোষ গৃহিণী দ্বিতলের বারান্দায় চিক দিয়া সুন্দর একটি বসিবার স্থান করিয়া দিয়াছেন, তাহারই নাম ‘আরাম ঘর’। মধ্যে মধ্যে তিনিও তথায় উপস্থিত থাকিয়া বধূদিগের সহিত দু/চার কথা কহেন। দুই বধূর মধ্যে প্রবল সখ্যতা। 



গৃহিণী বধূদিগকে বিশেষ ঝক্কি ঝামেলার মধ্যে ফেলিতে চাহেন না। এতগুলি বাহিরের লোক, শিবতোষের দয়ায় বছরের পর বছর বসিয়া বসিয়া অন্নধ্বংস করিতেছে, বিনিময়ে কিছু তো করা চাই! তাহারা তাহা না করিবে কেন? আর এতগুলি আশ্রিতার দল থাকিতে বধূগুলি সংসারের জোয়াল টানিবে কেন? নিন্দুকেরা অবশ্য বলিতে ছাড়ে না, যে তাহাতে শাশুড়ির হাত হইতে সংসারের চাবিকাঠিটি চলিয়া যাইবার ভয়েই এই ব্যবস্থা। সে যাহাই হউক, সকালবেলাতেই একখানি দামী শাড়ি অঙ্গে জড়াইয়া, এক গা গহনা পরিয়া, নাকে ফাঁদি নথ নাড়াইয়া পারুলবালা চা-পান পর্ব তদারকি করিয়া থাকে। অদ্যও তাহার তদারকি করিতেই পাকশালে প্রবেশ করিল। 



মধ্যমা বধূটি চঞ্চলা। কথা কহে সর্বদা, কাহাকেও ভয় নাই। বন্ধুকন্যা বলিয়া শিবতোষ বুঝি বা বধূটিকে কিছু প্রশ্রয় দিয়া থাকেন, কিন্তু গৃহস্থ সকলে তাহাকে প্রখরা, মুখরা বলিয়া থাকে। বধূটির বাপ নাই, অকালে মরিয়াছে, শিবতোষ একপ্রকার নিজ হইতেই তাহাকে গৃহে আনিয়াছেন। জ্যেষ্ঠা পারুলবালার মত তাহার গা ভর্তি গহনা নাই, থাকিলেও সে পরিত কিনা বলা যায় না। গহনা বেশী পরিলে তাহার গা চুলকায়, কিয়ৎক্ষণ পরিবার পর খুলিতে থাকে। দেখিতে ছোটখাটো পাখিটি, অথচ গলার স্বরে তীক্ষ্ণতা, গৃহিণী নাম দিয়াছিলেন—টুনটুনি, ডাকেন টুনি বলিয়া। বলিতে কি, শিবতোষ স্নেহ করিলেও গিন্নি টুনিকে ভয় পাইয়া থাকেন।


পাকশালের একপার্শ্বে যেখানে চা-পর্ব সম্পন্ন হয়, মধ্যমা বধূ টুনি আসিয়া পারুলের গা ঘেঁসিয়া বসিল। তাহার পর কানে কানে গুপ্ত কথা কহিবার মত কিছু বলিল। স্বামী ফেরার হইয়াছেন, গৃহে পুলিশের আনাগোনা, পারুলবালার মন ভাল নাই। তাহার স্বামীর কারণে গৃহে উৎপাত শুরু হইয়াছে, ইহাতে সে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুতে পড়িয়াছে, বুঝি বা দুঃখীও। স্বামী তাহাকেও কিছু কহেন নাই বলিয়া লজ্জ্বাও আছে। সে বুঝি ভাবিয়াছিল টুনি ভাসুর ঠাকুরের কথাই কিছু বলিবে, কিন্তু অন্য একটি কথা শুনিয়া বিস্মিত হইল। পারুল চমকিয়া শুধাইল---কি করে জানলি?’



টুনি চুপি চুপি কহিল ‘উনি সকালে উঠেই খুঁজেছেন, কোথাও পাননি’। মধ্যমা অতি সম্প্রতি স্বামীর ঘরে শুইবার অধিকারিণী হইয়াছে। জ্যেষ্ঠা পারুলবালা আগেই সে অধিকার পাইয়াছিল।


কিন্তু দুজনের কেহই এখনও সন্তানসম্ভবা হয় নাই।

(ক্রমশঃ) 





0 comments: