ছোটগল্প - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
গার্জেন
মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
মেয়ের মনের কথা কিছুতেই ধরতে পারে না সুলেখা। দিনকে দিন মেয়েটা কেমন রহস্যময়ী হয়ে উঠছে যেন। আচ্ছা, সুলেখার যে পঁয়ষট্টি বছর বয়স সেটা তো মেয়েটা মাথায় রাখবে, না কি? এই বয়সে এত হেঁয়ালী পোষায়? সারাটা জীবন সুলেখা তার স্বামীর ইচ্ছায়, তেমন কোনও সাজ সাজেনি, অথচ সুলেখা যে সাজতে ভালোবাসত না, তা তো নয়। বিয়ের আগে বাবা দাদার সংসারে ক্ষমতাই ছিল না ট্যালকম পাউডারের বেশি কোনও প্রসাধন কেনবার। বিয়ের পর আর্থিক ক্ষমতা থাকলেও স্বামীর অমতে কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। স্বামী গত হয়েছেন বছর তিনেক, এখন সুলেখারও বয়স হয়েছে, প্রথম কয়েকদিন বেশ বাঁধন ছাড়া মুক্তির আস্বাদ পেয়ে নিজের ইচ্ছে মতো সাজার চেষ্টা করলেও, সুলেখা বুঝেছে এখন আর তার সেই বয়স নেই। এ তো বিদেশ নয় যে, খুনখুনে বুড়ি হয়েও লিপস্টিক পমেটম সব লাগাবে। তায় বিধবা মানুষ, বেশ বাকি জীবনটুকু শাদা শাদা শাড়ি আর প্রসাধন বর্জিত সজ্জা, এটাইতো সামাজিক নিয়ম। তাছাড়া এত বছরের অনভ্যাসে সুলেখাও আবিষ্কার করেছে যে, অল্প বয়সের মতো ঠিক যেন উৎসাহ পাচ্ছে না। কিন্তু মেয়ে বিদেশে থেকে অনেক কিছু শিখেছে। আজকাল কেমন অবলীলায় মায়ের মুখের ওপর বলে, "তোমার আর বাবার বিয়েটা তো চূড়ান্ত মিসম্যাচ। তুমি বাবার যোগ্যই নও। ইনফ্যাক্ট, বাবা যে লেভেলের মানুষ, বাবার আসলে বিয়ে, সংসার এগুলো করা উচিত হয়নি। উনি অন্য জগতের মানুষ। আর তুমি হলে সাধারণ, ঘরোয়া। বেশ সাজুগুজু করবে, শাড়ি গয়ণা ছানাপোনা এই নিয়ে জীবন কাটাবে, সেই টাইপ। কেউই তোমরা খারাপ নও, কিন্তু একজন আরেকজনের উপযুক্ত নও, এটাই সাফ কথা"।
আজ কোত্থেকে সুলেখার পছন্দের নীল রঙের একটা বালুচরী কিনে এনেছে। বালুচরী শাড়ির সুলেখার সখ ছিল। কিন্তু তখনকার দিনে স্বামীর একমাসের মাইনের দামের শাড়ি পরবার মতো মানসিকতা সুলেখার ছিল না। পরে বহু বহু বার আক্ষেপ করেছে মেয়ের কাছে, "কিনলে বোধহয় ভালোই করতাম, থাকলে তুই পরতে পারতিস"। মেয়েটার কিন্তু একাধিক বালুচরী আছে, তার বাবারই দেয়া, তবুও মায়ের আক্ষেপ শুনে বুঝতে পারে ওই "থাকলে তুই পরতে পারতিস" অংশটা কথার কথা। আসলে মায়ের নিজের পরতে না পারাটাই কাঁটার মতো ফোঁটে।
বেশ সুন্দর সুন্দর সোনার গয়না পরিয়েছে মেয়েটা, গয়না পরতে সুলেখা অসম্ভব ভালোবাসত। অল্প বয়সে কোথাও ঘুরতে টুরতে গেলেও এক গা গয়না পরত। বিয়ে বাড়ি হলে তো কথাই নেই। তখনের সময়ে তো আর এত চুরি ছিনতাই হতো না। মাথার সেই এক ঢাল চুল এখন প্রায় অবশিষ্ট নেই, তবু কেমন কায়দা করে ফলস খোঁপা দিয়ে চুল বেঁধে দিয়েছে। সুলেখার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে, কি ঘটাতে চাইছে মেয়ে বুঝতে না পেরে। হঠাৎ মেয়ে নিজে হাতে এত সব শাড়ি, গয়না, প্রসাধনী তুলে দিল মায়ের হাতে। আবার কি কি সব ভালো ভালো খাবার কিনে আনল, কে বলে আসবেন। বাইরের কেউ সুলেখাকে এই রূপে দেখলে ভিরমি খাবে না? তবু আয়নার সামনে থেকে সরতে যেন মন চাইছিল না সুলেখার।
"আসুন, আসুন। আমি যে কি বলে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাব"
"সে না হয় না ই জানালে মা, আমি বড় লোভী, তোমার প্রস্তাব তাই কোনও মতেই ফেলতে পারলাম না। না হলে, আজকাল বড় একটা বার হই না"
"আপনি বসুন, আমি মা কে ডাকছি, জল রেখেছি একটু মুখে দিন ততোক্ষণ। উঁ, বাই দ্য ওয়ে, আপনাকে আমি কি বলে ডাকব?"
"কেন? ইংরেজী মতে 'আঙ্কল', সেটাই তো সবথেকে উপাদেয়, কেমন সম্পর্ক হলোও আবার আড়ালেও রাখা গেল, তাই না?"
"বেশ, তবে তাই হোক। যদিও এসব ডাক আমার পোশায় না"
পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঘরে এসে দেখে রক্তশূন্য চেহারায় সুলেখা দাঁড়িয়ে ঘেমে নেয়ে অস্থির। মেয়ে এসে ধরতেই ঝপ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল ওর হাতের ওপর। মা কে শুইয়ে, বাইরের ঘরে খবর দিয়ে, ডাক্তার বাবুকে কল করে নীলা। মায়ের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় পাশে বসে থাকে, ভয় পায় যদি অঘটন ঘটে কিছু, সারাজীবন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
চোখ বুজে শুয়ে সুলেখা শুধু ভেবেই চলেছে- এটা স্বপ্ন না সত্যি? তার বাড়ির বসার ঘরে যার গলার আওয়াজ শুনল, শেষবার শুনেছিল আজ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কি তারও বেশি কিছু বছর আগে; তাও ভোলেনি আওয়াজটা। বয়সের ছাপ পড়লেও আওয়াজটা চিনতে তার এতটুকুও ভুল হয়নি সুলেখা জানে।
সেদিন দুপুরে সবাই খাওয়া দাওয়ার পর মুখশুদ্ধি মশলা চেয়েছিল সুলেখার কাছে। সুলেখা যখন মশলা দিতে যায় মা বাবা কেউ ছিল না তখন সেই ঘরে উপস্থিত। "সুলেখা শোনো" বলে হাত ধরতে চেয়েছিল অগ্নি। কি জানি কেমন ভয় পেয়ে এক লাফে পালিয়েছিল সুলেখা। সেদিনও এমনই শরীর অস্থির করেছিল, তফাৎ শুধু, মা বুঝতে পারেনি, আজ মেয়ে যেমন বুঝল। অগ্নি, আজ সুলেখার বসার ঘরে? তাকে কোথায় পেল নীলা? আজ এত সাজগোজ করানো এ সব অগ্নির জন্য? কিন্তু এই বয়সে অগ্নির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে কি করে? বুকের ভেতরে হাঁপর, হাত পা ঘেমে একশা।
"মা, মা গো, চোখ খোলো" কান্না ভেজা নীলার আওয়াজে সত্যিই চোখ মেলে সুলেখা। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে আসা জল মোছায় মেয়েটা পরম মমতায়। একটু চোখ বোলায় সুলেখা ঘরে আর কেউ আছে কিনা। মনেমনে বোধহয় প্রত্যাশা ছিল নীলা ছাড়া আরও কারোর থাকবার।
"আমার শাড়ি টাড়িগুলো বদলে দে" আবার চোখ বুজে ফেলে ক্লান্ত স্বরে,বলে সুলেখা।
"কেন? থাক না, মেয়েটার এমন সখ হয়েছে, বেশ লাগছে তো" উত্তর যে অগ্নির থেকে আসবে ভাবতেও পারেনি। তার কথায় কেঁপে উঠল, লজ্জায় রাঙ্গা হল অষ্টাদশীর মতো। নিজেকে যেন অচেনা লাগে সুলেখার। এতদিন অন্যদের সম্পর্কে কেমন বিশ্রী মন্তব্য করত সে, আজ টের পাচ্ছে সে সব তার অজ্ঞতারই পরিচয়। এই বয়সেও কেউ রূপের প্রশংসা করলে, কেউ প্রেম ঘন কথা বললে বেশ লাগে। স্বামীর কাছ থেকে না পাওয়া কদরগুলো অন্য কোনও পুরুষের থেকে পেতে মন্দ তো লাগছে না। নিজেকে বাগ মানানোর চেষ্টা করেও বিফল হচ্ছে সুলেখা।
"সুলেখা" ডাক দিয়ে হাতের ওপর হাত রাখে অগ্নি। সুলেখার কি অদ্ভূত অনুভূতি হয়, মনে হয় তড়িৎ বইছে শরীরে। অথচ আগুন জ্বলা বয়সে যখন স্বামীর স্পর্শ পেয়েছিল এমন মধুর যন্ত্রণার অনুভূতি কোনওদিনও হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না। তখন ছিল যান্ত্রিক অচেনা কে চেনা, আর এ যেন চাতক পাখির ইচ্ছাপূরণ।
"সারাটা দিন কোথা দিয়ে কাটল টেরই পেলাম না। তোমায় এইভাবে পাবো কোনওদিন ভাবতেও পারিনি। তোমার সাথে বসে খাওয়া দাওয়া, সে তো সেই শেষ যেদিন তুমি ও বাড়ি এসেছিলে সেইদিন করেছিলাম। তবে কি, বড় আড়ষ্ট লাগে, ভয়ও লাগে। এই বয়সে তোমার সাথে গল্প করব তোমার প্রস্তাব মতো ঘুরতে বেড়াতে যাব তোমার হাত ধরে, লোকনিন্দা হবে না? মেয়েদেরকে শ্বশুরবাড়ি জবাবদিহী করতে হবে না? নাঃ, তারচেয়ে বরং এতটা কাল যেমন চলছিল সেটাই ভালো ছিল। আমি নিজেকে স্বামী সন্তান দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছিলাম, তুমি হারিয়েই গেছিলে আমার জীবন থেকে। কেন যে তুমি নীলার কথায় সায় দিলে?"
"সায় না দিয়ে যে উপায় ছিল না, আমার। নীলা আর লীনা দুজনে তো প্রায় একই বয়সী। তোমার মেয়ের নাম আমার মেয়ের নামের সঙ্গে মিল আছে জেনে আরও অদ্ভূত লেগেছিল। কিসের যেন একটা ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম। দেখো, তুমিও একা এই বাড়িতে, আমিও একা বৃদ্ধাশ্রমে। বললাম তো, আমার স্ত্রী মারা যাবার পর লীনা বাড়ি বেচে আমায় ওই একটা বৃদ্ধাশ্রমে রাখল। না করতে পারিনি, একে তো অত বড় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করা, তায় আমার একাকীত্ব কাটানো সব মিলিয়ে বৃদ্ধাশ্রমই তো বেস্ট। সেখানে অসুস্থ হলে অন্ততঃ বিনা চিকিৎসায় মরে পড়ে থাকব না। এখন ধরো, আমার বাড়ি যেহেতু নেই আর, কাজেই তোমার বাড়িতেই আমাদের থাকতে হবে। আর সমাজ, শ্বশুরবাড়ি সেগুলোকে সরিয়ে রাখ না, সু। মেয়েরা এমন ম্যাচিয়র্ড পদক্ষেপ নিচ্ছে যখন, তার মানে তারা কি না ভেবে করেছে? আজ বরং ওদের কে গার্জেন মনে করো। মা বাবারা এই ব্যবস্থা যদি সময়কালে করতেন, সত্যিই কি তুমি আপত্তি করতে? এখন আমাদের শারিরীক চাহিদা তলানিতে এসে ঠেকেছে, কিন্তু তুমি বলতো, শুধুই কি শরীরের জন্য বাঁচা? তোমার আমার মনের কোনও চাহিদা নেই? তবু, তোমার আপত্তি থাকলে জোর করব না, সেদিনও যেমন জোর না খাটিয়ে চলে গেছিলাম, আজও যাব। শুধু সেই সময়ে বয়স অল্প ছিল ধাক্কাটা সামলে নিতে কষ্ট হলেও অসম্ভব কিছু হয়নি, এখন পারব কিনা জানি না; এইটুকুই যা"
ঝাপসা চোখে নিজের ঘরদুয়ারকেই যেন কেমন অচেনা লাগে সুলেখার।
খুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteBeautiful. Write more.
ReplyDelete