undefined
undefined
undefined
রম্যরচনা - স্বাতী ব্যানার্জী
Posted in রম্যরচনা
রম্যরচনা
বীরত্ব
স্বাতী ব্যানার্জী
চোপাকুমার এমনিতে শান্ত তবে সকল বিষয়ে তার জ্ঞান সম্পর্কে কেউ সন্দিহান হয়ে উঠলে তিনি মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, রাজমাতার সাথে তার তর্ক বিতর্কের কথা। দুপুরবেলা আমতেল চুষতে চুষতে তিনি বললেন,”জানো দিদুন আজ ফিউরিয়াস সেভেন আছে।”
"সে কি, এত রাগ ভালো নয় দাদুভাই ।"
"রাগ? রাগের কথা কে বললো?"
“ওমা তুমিই তো বললে রেগে আজ সাতখানা হলে।”
“উফ্! এটা একটা মুভি দিদুন, কার রেসের মুভি, ফাস্ট অ্যান্ড দি ফিউরিয়াস-এর সাত নম্বর পার্ট, এর আগে আরও ছয়টা আছে। ইসস... আমিও যদি ওমনি গাড়ি চালাতে পারতাম অত স্পিডে!”
“অ”
“শুধুই অ, জানো কি ডেঞ্জারাস গেম! পল ওয়াকার তো মরেই গেল।”
“দাদুভাই খুব জোরে গাড়ি চালানোর মধ্যে কোন বীরত্ব নেই।”
“কে বলেছে নেই। জীবনটাকে বাজি রেখেই তো মানুষ কাজ করে বীর হয়। মাইকেল শুমাখারের নাম শুনেছো?”
“না ভাই, তোমার কথা মানতে পারলুম না। যদি নিজের জীবন বাজি রেখে কেউ এমন কাজ করতে পারে যাতে অন্য আরও কারুর উপকার হয় তবে বুঝি সে বীর। ইতিহাস বলে ....”
“ইতিহাসের কথা ছাড়ো। অমনি অনেক গল্প আমি জানি। জানো গতির একটি নেশা আছে। আমি মাঝেমধ্যেই সৌরভের স্কুটিটা চালাই। দিদুন বাবাকে বলো না আমাকে একটা বাইক কিনে দিতে প্লিজ।”
“একটা গল্প শুনবে ভাই?”
“আমি কি এখনও বাচ্চা আছি নাকি? আচ্ছা যদি বাবাকে বলো বাইকের কথাটা তবে শুনতে পারি।”
“আমার পাড়ায় এক মেয়ে ছিল, নাম তার আন্নাকালি। তারা অনেকগুলি ভাইবোন। আগে অনেক গুলি ভাইবোন মরে গেছে কিনা তাই এই নাম। তা বড় কষ্টের জীবন তাদের। আন্নাকালি সবচেয়ে বড়। তাদের বাবা সার্কাসে বকরাক্ষসের খেলা দেখাতেন। মাসে দশে ঘরে আসতেন।”
“বকরাক্ষসের খেলা কি গো দিদুন?”
“সার্কাসে একজনকে রাক্ষসের মতো সাজানো হয়। তাকে শেকলে বেঁধে রাখা হয়। এরপর তার হাতে মুরগি, পায়রা এইসব দেওয়া হয় আর সে দাঁতে কামড়ে তাদের গলা চিরে রক্ত খায়।”
“ইসস... কি সাংঘাতিক! এখনকার দিনে এমনি করলে পুলিশ ধরবে। উনি কি সত্যি রক্ত খেতেন দিদুন?”
“মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য, সংসার প্রতিপালনের জন্যে কত কিই যে করতে হয় দাদু, সংসার বড় নিষ্ঠুর জায়গা। তা সে যাকগে, তোমাকে যা বলছিলুম দাদুভাই। আন্নাকালির বাবার রোজগারেই মূলত তাদের সংসার চলত। একবার তার বাবার ভারি জ্বর হল, দিন যায় জ্বর আর সারেনা। অমনি দশাসই মানুষ শুকিয়ে বিছানায় মিশে গেলো। তখনকার দিনে গরিব মানুষের চিকিৎসা বলতে তেমন কিছুই ছিল না।”
“সে কি, তাহলে তো লোকটা মরে যাবে। আর ওর বউ ছেলেমেয়ে খাবে কি?”
“সেটাই তো কথা দাদু। আন্নাকালির মা লোকের বাড়ি ধান বেছে মুড়ি ভেজে কোনওমতে বাচ্চাদের খাওয়া জোটাতে লাগল। তা একদিন সেও পড়ল জ্বরে। ছোট ভাইবোনদের খেতে দেওয়ার মতো একটি দানাও নেই ঘরে। আন্নাকালি পড়লে মহা বিপদে।”
“তাপ্পর! তাপ্পর!”
“তারপর পাড়ায় একদিন হলো হন্টন প্রতিযোগিতা। যে একসাথে দুদিন না থেমে হাঁটতে পারবে সে পাঁচশ টাকা পাবে।"
“শুধু হাঁটা! ধুর্। এতে বীরত্বের কি আছে?”
“আছে দাদু আছে। হাঁটতে হাঁটতে না থেমে তুমি জল শরবত খেতে পারো, কিন্তু বাথরুমের কাজ দুদিন করতে পারবে না। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে একঘেয়ে হাঁটা শুধু মাত্র শক্তির অপচয়। এতে কোনো বুদ্ধি, বীরত্ব বা দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু প্রচণ্ড শারীরিক কষ্টের কাজ। যাই হোক অনেকেই হাঁটা শুরু করলো। মেয়েদের মধ্যে শুধু আন্নাকালি। তখনও মেয়েরা এত বাইরে বেরোতো না। অনেকেই মুখ টিপে হাসলে। তখনকার সামাজিক রীতির তোয়াক্কা না করে সংসার বাঁচাতে ছেলেদের সাথে সমানে সমানে লড়াই করা কম বীরত্বের কাজ ছিল না দাদুভাই।”
“তারপর বলো কি হলো?”
“তারপর হাঁটতে হাঁটতে কেউ ছয় ঘন্টা কেউ আট কেউ দশ ঘন্টা পর থেমে গেল। টলতে টলতে টিকে রইল হাতে গোনা কয়েকজন আর আন্নাকালি । একদিন রাত পেরোলো। পরদিন মাত্র দুজন। রোদ চড়তেই অন্যজন রণে ভঙ্গ দিল। টলটল করতে করতে রইল শুধু আন্নাকালি। একসময় সেও অজ্ঞান হয়ে গেল। দুদিন পূর্ণ হতে তখনও ঢের দেরি।”
“সে কি! মেয়েটা হেরে গেল? এবার টাকা না পেলে কি হবে?”
“তখনকার দিনে মানুষের মনে মায়া দয়া একটু বেশিই ছিল দাদু। তাই পুরো সময় হাঁটতে না পারলেও সবচেয়ে বেশি সময় হাঁটতে পারার জন্যে সে তিনশো টাকা পেল।”
“বাঃ এটা দারুণ। এবার তো আন্নাকালির মা বাবা সেরে যাবে। সংসার আবার চলবে। তখনকার দিনে তিনশো টাকা তো অনেক, না দিদুন?”
“জীবন অত সহজ নয় গো দাদুভাই। কিছুদিন চললেও আবার দারিদ্র ফিরে এল। কারণ ওর বাবা গেল মরে। এরপর মা আরও ভেঙে পড়লেন। শাকপাতা গেঁড়ি গুগলি কুড়িয়ে আন্নাকালি ভাই বোনের পেট ভরানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু এভাবে আর কদিন চলে। তাই একদিন আন্নাকালি পুরনো সার্কাসে তার বাবার মালিকের সাথে দেখা করলে।”
“কেন, ওখানে কতক্ষণ হাঁটতে পারবে? সার্কাস তো মাত্র দু তিন ঘন্টার।”
“না দাদুভাই, হাঁটা নয়, সে পেলে বাবার পুরনো কাজ। নিজের ঘেন্না, লজ্জা সব বিসর্জন দিয়ে সে রাক্ষসী সেজে পায়রা, মুরগির গলা চিরে রক্ত খেয়ে রোজগার করতে লাগলো। নাম নিলে পুতনা রাক্ষসী। দূর দূর থেকে লোকজন পুতনা রাক্ষসীকে দেখতে আসতো। সবাই তাকে ভয় পেতো, এমনকি তার ভাই বোনেরাও। গ্রামের কেউ তার সাথে কথা বলতো না। কোনও বন্ধু ছিল না তার। বিয়ে থা হওয়ারও কোনও আশা ছিল না। সংসারের জন্য সে তার গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করে দিলে। অন্যের ভালোর জন্যে এই কাজকে আমি বীরত্বই বলবো দাদুভাই। এবার তুমি বলো খুব জোরে বাইক চালানোকে কি এরকম বীরত্ব বলা যায় দাদুভাই?”
“সত্যি দিদুন, এটা তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু আঠারো বছর বয়স হলে আমাকে মটর সাইকেল চালানো শিখতে হবেই। তুমি তখন বাবাকে বলবে তো? ও দিদুন বলবে তো? ও দিদুন?”
খুব সুন্দর করে একটা গল্প মনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। দারুন।
ReplyDelete