0

স্মৃতির সারণী - সুতপা পাত্র

Posted in



স্মৃতির সারণী 


চার ভাগের এক ভাগ 
সুতপা পাত্র


আমার দু বছর বয়স থেকে ষোলো বছর বয়স অব্দি কেটেছে রেলকোয়ার্টারে। বাবা কাঁচরাপাড়া ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। আমাদের কোয়ার্টারটি ছিল মাঠের একদম উপরে, দক্ষিণমুখী। তিন খানা ঘর পর পর, একদিকে রান্নাঘর, আর স্টোররুম, তার সাথে টানা একটা লম্বা বারান্দা, বারান্দা পেরিয়ে উঠোন, উঠোনের মধ্যে একদিকে বাথরুম, অন্যদিকে স্নানঘর। উঠোনে আর বাথরুমে ছিল একটা করে চৌবাচ্চা, রোজ সকালে বিকেলে নিয়ম করে তাতে জল আসত। তবে উঠোনের চৌবাচ্চাটা আয়তনে বড় ছিল। মাকে দেখেছি প্রতি সপ্তাহে একদিন নিয়ম করে শ্যাওলা পরিস্কার করতে। আমার দু বছর বয়সে যখন এই কোয়ার্টারে আসি, তখন গাছপালা বিশেষ কিছু ছিল না। মা উঠোনের একদিকে মাটি জড়ো করে তার চারপাশে ইঁট দিয়ে ঘিরে সেখানে একটা জবাগাছ পুঁতেছিল। চারাগাছ্টাতে একটা কি দুটো নতুন পাতা গজাত, আমি গিয়ে পাতাগুলি ছিঁড়ে দিতাম। আমি পাতা ছিঁড়ব বলে যে ছিঁড়তুম তা ঠিক নয়, নতুন কচি পাতাগুলিতে হাত বোলাতে গিয়ে কখন যে বৃন্তচ্যুত করে ফেলতাম বুঝতেই পারতাম না। তখন, মা বাধ্য হয়ে বাবাকে বলে কতগুলো পুরনো ইঁট জোগাড় করে জবা গাছটির চারপাশে আর একটু উঁচু করে দিয়েছিল, এর ফলে গাছটি আমার নাগালের বাইরে চলে যায়। এতে অবশ্য আমার পাতা ছেঁড়া বন্ধ হয়েছিল। পরে উঠোনের এককোণে বাথরুমের পাশের একটা জায়গায় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে উঁচু করে মাটি রাখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে আমি যখন ক্লাস থ্রি-তে কি ফোরে পরি, ওখানে আমি নিজের হাতে একটা পেয়ারা গাছের চারা লাগাই। আমি ওই চারাটি অবশ্য একজনের বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলাম। আর উঠোনের একদিকে ছিল তুলসীমঞ্চ, মঞ্চ ঠিক বলা যায় না, ঠিক একই কায়দায় বারান্দার সাথে সংলগ্ন দেওয়ালটাতে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে তার মধ্যে মাটি দিয়ে একটা বর্গাকৃতি জায়গা করা হয়েছিল, সেখানেই লাগানো হয়েছিল একটি তুলসীগাছ, তুলসীগাছ ছাড়াও সেখানে মাঝে মাঝে আমি অপরাজিতার বীজ এনে পুঁতেছি, লতানো গাছ তো, বড় হলে দেওয়ালটিকে অবলম্বন করে উপরে উঠত, তখন গাছ ভরে ফুল হতো, বছর দুয়েকের বেশি বাঁচত না এই গাছ। আবার ওই একই জায়গায় কখনও লাগিয়েছি হলদে গাঁদা, কখনও বা নয়নতারা। আর শীতকালে উঠোনে কিছু টবে, বাবা মরসুমি ফুলগাছ লাগাত। জবাগাছটি পরে অনেক বড় হয়। বসন্তকাল থেকে গ্রীষ্ম কালে কখনও কখনও গুণে দেখেছি সত্তর আশিটার উপরেও ফুল ফুটত। আর শীতকালে ফুল খুব কম ফুটত। তবে, শীতকালে প্রায়ই মাদুর নিয়ে জাবাগাছ্তালায় এসে বসতাম রোদ খiওয়ার জন্য, কখনও বা সেখানে বই পরতাম, কখনও বা অঙ্ক কষতাম।

মাঠের উপর বিশাল বাসন্তীপুজো হতো চৈত্র মাসে। সারা কাঁচরাপাড়ার মধ্যে ওই একটি জায়গাতেই বাসন্তীপুজো হতো। অস্টমী-নবমীতে অনেক লোক হতো। দুর্গাপুজো, কালীপুজোও হতো। বাসন্তীপুজোর সময় মাঠের চারপাশে নাগরদোলা, বাদাম-কটকটি, এগরোল, খেলনাপাতি, প্রভৃতি নানারকমের দোকান আসত। সবই জানালা দিয়ে দেখতে পেতাম। এই জায়গাটা যার জন্য ‘বাসন্তীতলার মাঠ’ বলেই খ্যাত ছিল।

মাঠে বারোমাসই খেলা চলত; ক্রিকেট, ফুটবল, শীতকালে ব্যাডমিন্টান সবই। প্রত্যেকদিন বিকেলবেলা আর ছুটির দিনে সকাল থেকে ক্রিকেট খেলা শুরু হতো। আর মাঠের পাশে বাড়ি হবার দরুন, প্রায়ই ঘরে এসে বল ঢুকত; তার পরক্ষণেই কাকিমা বল চাই করে দরজায় কটকট। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে মাথায় বল লাগতে লাগতে বেঁচে গেছি। কোনও কোনও দিন মা বিরক্ত হয়ে বল দিতে চাইত না, বেচারা ছেলেগুলি তখন কাঁচুমাচু মুখ করে বলত, ‘কাকিমা আর করব না’l যথারীতি আবার একটি চার কি ছয় হাঁকালেই আবার যেই কি সেই….l ভাগ্গিস আমাদের জানলায় কোনও কাঁচ ছিল না; ছিল কেবল লোহার শিক, একটা জানলায় চারটে শিক। বল অনায়াসে জানলার গণ্ডি অতিক্রম করে ঘরে এসে পড়ত। (পরবর্তীকালে তিনটি ঘরের দুটিতে নেট বসানো হয়েছিল।) 

বর্ষাকালে টানা দু-তিন ধরে বৃষ্টি হলে মাঠে জল জমে যেত, ব্যাঙ এসে ডাকত গ্যাঙর গ্যাঙ। আর সেইসঙ্গে শুরু হতো পারার ছেলেদের ফুটবল খেলা। দেখতে দেখতে মাঠের জল ক্রমশঃ পাঁক হয়ে পচে যেত। দুর্গন্ধে তখন ঘরের জানলা খোলা দায় হয়ে উঠত। যতদিন না রোদ উঠে পাঁক শুকোচ্ছে, মাঠের কর্দমাক্ত চেহারার দিকে তাকানো যেত না।

আমাদের কোয়ার্টার থেকে একটু দূরে মাঠ ছাড়িয়ে রাস্তার ধরে একটা গুমটি দোকান ছিল। আমরা ‘উঠোন কাকুর দোকান’ বলতাম, কেন ‘উঠোন কাকু’ বলতাম, তা জানি না। ছোটবেলা থেকে সবাইকে ওই নামেই ডাকতে শুনেছি। উঠোন কাকুর দোকান পেরিয়ে ছিল মেন রোড, যেখান দিয়ে আজও বাইশ নম্বর, বাস যায়। উঠোন কাকুর বয়স ছিল চব্বিশ কি পঁচিশ, যখন দোকান করা শুরু করে। মাঝারি গড়ন, বলিষ্ঠ হাত-পা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, বাবার মুখে শুনেছি, উঠোন কাকুরাও কোয়ার্টারে থাকত, উঠোন কাকুর বাবা দাদারাও রেলে চাকরি করতেন। উঠোন কাকুর পড়াশোনা বেশি দূর হয়নি, অগত্যা তারা তাকে একটা দোকান খুলে দেয়। ওই দোকানে পাওয়া যেত না হেন কিছু ছিল না; চাল, ডাল, নুন, চিনি, পাঁপড়, সুজি, টুথপেস্ট, সাবান, শ্যাম্পু, চকলেট, লজেন্স, খাতা, পেন .. আরও কত কী!! মনে পরে, খুব ছোটবেলায়, আমি যখন কে. জি. বি. কি ক্লাস কে. জি. এ. তে পড়ি, উঠোন কাকুর দোকানে দশ পয়সার এক ধরনের লজেন্স বিক্রি হতো, টেস্টটা ছিল অনেকটা হজমলা টাইপের, টক-মিষ্টি। আমি তখন একটু দামি চকলেটের থেকে ওই দশ পয়সার লজেন্স খেতে খুব ভালবাসতাম। মাঝে মাঝে বাবার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে এক টাকায় দশটা কিনে নিয়ে আসতাম। তখন বাজারে এত ডেয়ারী মিল্ক, এক্লায়র্সের আধিপত্য ছিল না, এরপরের দিকে এলো মহাল্যাকটো, তার অনেক পরে এক্লায়র্স। কিন্তু সেই দশ পয়সার হজমোলার স্বাদ আজও মিস করি।l

…..আজ ছয় বছর হলো কোয়ার্টার ছেড়ে এসেছি। যখন ছেড়ে চলে আসি, তখন আমার জবাগাছটা ডালপালা মেলে আরও অনেক বড় হয়ে গেছে। পেয়ারা গাছটাতেও আগের থেকে অনেক বেশি ফল ধরত। 

আশেপাশের লোকজন কোয়ার্টার ছেড়ে চলে যাওয়ায় এখন সেই সব বাড়িগুলি বেদখল হয়ে গেছে। কোয়ার্টারের দেওয়াল হয়ে উঠেছে ঘুঁটে দেবার জায়গা, মাঠ হয়েছে আজেবাজে বখাটে ছেলেদের আড্ডাখানা, মদ-গাঁজার আখড়া। বন্ধ হয়ে গেছে দুর্গাপুজো, বাসান্তীপুজো। আজ আর ওখানে হাজার লোকের ভিড় হয় না, বল পড়লে কেউ চেঁচিয়ে ওঠেনা, উঠোন কাকু আজ ঝিমোয়…l 

আর আমার জীবনের শৈশব, কৈশোর, যৌবন অর্থাৎ মোটামুটিভাবে জীবনের চার ভাগের একভাগ জুড়ে রয়েছে কোয়ার্টার। তাই, আজও স্বপ্নে ভেসে ওঠে কোয়ার্টারের মাঝের ঘরটা, যেখানে আমাদের বড় খাটটা রাখা ছিল, সেই উঠোন, জবাগাছ আর পেয়ারাগাছ। আজও পেছন ফিরলে দেখি আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাওয়া সেই ছেলেবেলা, মন কেমন করা সেই বারান্দা, আর একটা বিষণ্ণ মাঠ...

(পুনশ্চ: এই লেখাটি স্পেশালি তাঁদের জন্য, যাঁরা জীবনের কোনও না কোনও সময় কোয়ার্টারে কাটিয়েছেন।)





0 comments: