ধারাবাহিক - রাজর্ষি পি দাস
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
ফেরা
রাজর্ষি পি দাস
সপ্তমী
অক্টোবর ২০২০
আজ সকালে অনেকক্ষণ দুর্গার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, কিছুই মনে করতে পারি নি। কানে আসছিল ঢাকের শব্দ কিন্তু ঢাকিকে দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবে দেখছিলাম খোকনদের পুকুরে খলসে মাছ আর সব্জে-বেগুনী লেজের ঝাপট।
পা ঝুলিয়ে বসে আছি, হাতে সিগারেট, রিজেন্ট রেড। পায়ের নীচ দিয়ে হুহু করে বেরিয়ে যাচ্ছে রেলনুড়ি, ছাই রঙা। সামনে সাদা বালির মতল দেখতে ধুলোর ঢিবি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁটা ঝোপ এবং ন্যাড়াবৃক্ষ তেপান্তর দিগন্ত ছুঁয়েছে। আকাশে সূর্য ঠিক কোথায় বোঝা যাচ্ছে না, চারিদিকে একরকম ধূসর আলো। কোথাও কোনও সবুজ নেই, প্রাণীপক্ষীমুক্ত অঞ্চল চিড়ে দুলতে দুলতে চলছি এক অজানা, অচেনা লক্ষ্যে। দুলছি বেশ বিপজ্জনক ভাবেই, মাঝেমধ্যেই অর্ধেকের বেশি শরীর বাইরে চলে যাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার সাথে সাথে অদৃশ্য। মিঠুন চক্রবর্তীর মত চুল সারা চোখে, মুখে। এক নতুন অনুভূতি, জীবনে কক্ষনো ট্রেনের পাদানির উপরে বসি নি। বিপদ এবং স্বাধীনতার এই মেলামেশা - একেবারে নতুন। তার উপর এতে কোনও বকাঝকা নেই, ঝাকাস! আমি পাত্তাই দিচ্ছি না আমার ট্রেনের পাশাপাশি চটপট জায়গা বদল করা ক্ষুদে ঘূর্ণিঝড়ের মিছিলকে, পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে, মনে হচ্ছে আমার ফেলে আসা বসবাসের প্রেতাত্মারা আমার পিছন ছাড়ছে না! ফোট! কতদূর দৌড়বি আমার সাথে? ফ্যাকাসে আকাশী টিনের সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে আসার দিন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বেলগাছের হাসি দেখেই বুঝেছিলাম আমি গৌহাটিতে ফাইন্যাল পরীক্ষায় ফেল করব না। ফিরে আসব না!
ক্লাস বারোয় ফেল, অথচ ক্লাস টেনে গরিমা নিয়ে উতরে কামরূপ এক্সপ্রেসে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সে ট্রেনিং-এর জন্য শরতের ফিরোজা মেঘের মতন আকাশী রঙের টিনের ট্রাঙ্ক নিয়ে বেরিয়ে গেলাম আমার শৈশব-বাল্য-কৈশোরের আস্তানা ছেড়ে। মনে পড়ছে, বাড়ির দরজার সামনে পুরোন বেলগাছে গতকালের আটকে যাওয়া একটা ঘুড়ির কঙ্কাল! দুরঙ্গা, লাল আর নীল! আমি ঘুড়ি ওড়াতে পারি না, মানে শিখি নি বা শিখতে চাই নি। কারণ পয়সা। একটা ঘুড়ি কিনলেই তো আর ওড়ানো যায় না। সুতো, লাটাই, মাঞ্জা সব মিলিয়ে প্রায় ৪-৫ টাকার ধাক্কা! অনাথ বোসের মাঠ যতদিন ছিল ঘুড়ি, ফুটবল, দুর্গাপুজো, ক্রিকেট, পিট্টু, ইত্যাদি ছিল। ক্লাস টেনের পর সব বন্ধ। অনাথ বোসের ঘ্যামা ছেলেরা, যারা উকিল, চার্টাড একাউন্ট্যান্ট এবং আরো কিছু, আমাদের কৈশোরের সবুজে সিমেন্টের প্রাসাদ গড়ে মাত্র তিনমাসে আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক করে তুলেছিল। কোথায় খেলেটেলে ধূলো মেখে বাড়ি ফিরব, তা না বড়ো রাস্তায় ননীদার পানদোকানের সামনে সিগারেট, খৈনি, তাম্বুল পানের গন্ধের সাথে সিনেমার ঝগড়া নিয়ে জেরবার! আমরা খুব হিংসা করতাম বরপাথার, তাম্বুলবাড়ি, শ্রীপুরিয়া, নিউকলোনি, মিশনপাড়ার ছেলেদের। কারণ ঐ একটাই, তখনও ওদের পাড়াতে অনাথ বোসের কোন নাথ মাঠে সিমেন্ট দূর্গ গড়ে তোলে নি। আমরা কৈশোরেই দুম করে যুবক হয়ে গেলাম। সদ্য যুবকরা কি করে? মেয়েবাজি, নেশাবাজি, সিনেমাবাজি আর এসব করতে দরকার পয়সাবাজি। আমরা খগেশ্বর রোডের বাঙালি কিশোর, অসমিয়া-বাঙালি ঝামেলার প্রথম বাইপ্রোডাক্ট জেনারেশন, যারা ভাষা নিয়ে ইতিমধ্যেই হীনম্মন্যতায় ভোগা শুরু করেছিল, তারপর মাঠ হারিয়ে ইনোসেন্স হারালাম। তো, ওইসব উথালপাথালের মধ্যেও একটা মাঠ বেঁচে ছিল। এবং, সেটা সিমেন্টের! তপুদের ছাদ। আমাদের মাঠের ত্রিশভাগের একভাগ। নন্তু সেই একভাগে ঘুড়ি উড়িয়ে ছিল গতকাল। আর হঠাৎ বৃষ্টি আসাতে ঘুড়ি আর ঘরে তুলতে পারে নি। তপু, সুবীর, বাপ্পা, থব, কটপার্থ, পার্থ, খোকন সবাই অকাল বৃষ্টিতে ভিজে কৈশোরের উত্তেজনা আমাদের গলির বেলগাছে লটকানো অবস্থায় ছেড়ে যে যার বাড়িতে! আমি বাবার গাড়িতে ওঠার আগে আর একবার দেখে নিলাম ঘুড়িটার কঙ্কালকে! হালকা দুলছে। যেন আমাকে পুরো শরীর দুলিয়ে টাটা করছে।
সুপারফাস্ট ট্রেনে এই প্রথম, তার উপর ব্রডগেজ লাইন। ব্রডগেজ লাইনে ট্রেনের চরিত্র পুরোটাই বদলে যায়। তিন মাস আগে পশ্চিমবঙ্গে, মানে আমার মামাবাড়ি-দমদম আর দাদুর বাড়ি গোবরডাঙ্গায় যাবার সময় আমি প্রথম ঐ ব্রডগেজে চাপি! বঙ্গাইগাও থেকে মনে হয়েছিল হঠাৎ পৃথিবীটা অন্যরকম। ঐ হুহু যাত্রাতে আমার মনে হয়েছিল আমি আর এক রইলাম না, এবার ঠিক বদলে যাবো। পড়ায় মন দেবো, টিকিট ব্ল্যাক, তীরখেলার নাম্বার, গ্যাবারডিন কাপড়ের স্মাগলিং সব ছেড়ে দেবো, আর, রাখীর সাথে কথা না বলতে পারার সমস্ত গ্লানি ধুয়ে মুছে দেবে এই গতি! আর আমার মা, তারপর বাবা, যেখানে আমার ফিরতে হয় বারবার, আমাকে বুঝতে পারবেন কিছুটা ...অন্তত আমার মতন কোরে যে, আমার একটা সাইকেল দরকার। কিন্তু ফিরতে হলো সস্তা ভিলেনের মতন। আমি ক্লাস বারোর পরীক্ষায় টোটাল তেরো পেয়েছি! যে কিনা স্কুলে থাকাকালীন কুলীন ছাত্র ছিলাম। মাত্র দুবছরে এত বড় পতন! মা কাঁদতে কাঁদতে ফেরার সময় বলেছিল মিটারগেজ লাইনে ট্রেনের চাকা গড়ানোর পর। সত্যি বলছি, ব্রডগেজে বললে আমি যে কোনও একটা স্টেশন থেকেই পালাতাম।
পালানোর অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই, ঐ আঠারো ছুঁইছুঁইতে তিন বার। পালানোর সময় দেখেছি ব্রডগেজে আমার সাহস বেড়ে যায়। নাহলে ঐ রাত একটার সময় ছুটন্ত ট্রেনের দরজা বেয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে ঘড়িচোরকে ধরার সাহস কোথা থেকে এসেছিল। ঐ প্রথম এবং শেষ ছুটন্ত ট্রেনের ছাদে দাঁড়িয়ে হাঁটা, এবং চাঁদহীন রাতে আগত ব্রীজকে কল্পনা কোরে উপুর হয়ে ট্রেনের ছাদে মিশে যাওয়া আর শিরদাঁড়ার উপর ব্রিজের লোহার ঠাণ্ড হিম –আমি আর বুড়া - আমরা দেওয়াল-প্রতিবেশী, বাল্যবন্ধু। আমরা দুজন বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম স্মাগলার হবো বলে। লক্ষ্য, শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট। সবচেয়ে বড় ট্র্যজেডি হলো আমরা পাক্কা একদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা সারা শিলিগুড়ি এফোঁড়ওফোঁড় করে ফেলেও হংকং মার্কেটের খোঁজ পাইনি! কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহসও ছিল না কারণ, আমাদের মনে হচ্ছিল, হংকং মার্কেটের কোথায় জানতে চাইলেই সবাই জেনে যাবে যে আমরা স্মাগলার হতে চাই! আর তার উপর আটঘন্টা খোঁজাখুঁজির পর প্রতিটা লোককেই স্মাগলার মনে হচ্ছিল। আর স্মাগলার হওয়াটা যতটাই স্বপ্নের ততটাই অপরাধবোধের--অন্তত অমিতাভ বচ্চন, বিনোদ খান্নার সিনেমা তো তাই বলে! নাকী পাপবোধ, সারা সিনেমা জুড়ে পাপ করতে করতে শেষের দিকে পুণ্য করার তাড়না!
পাপ! এই কুফা শব্দটা এই অসাধারণ মুহূর্তে মনে এল কেন? হ্যাট! আমি এই পাপ-পুণ্যের বেড়াজাল থেকে সত্যি চিরদিনের জন্য লখনৌ মেলে বেরিয়ে গেছি। হঠাৎ চোখ উথলে জল! আমি আবার কাঁদছি কেন! কি হলো! কার উপর এত অভিমান? ওই ফেলে আসা শহরে কে ভালবাসে তোকে? তোর বাবামা যেখানে তোকে সবচেয়ে বেশি হ্যাটা করতো, যাকে ভালবাসিস সে বলতো, ‘বাবা না করেছে এসব করতে’, সাথে কি একটা চাস বোঝাতে গিয়ে বারবার, বারবার হেরে যাওয়া, তোকে তোর বাবা মা ট্রেনে গলা দিতে বলতো না! কতবার কল্পনা করেছিস লিডুগামী ট্রেনের নীচে টুক কোরে গলা -- ট্রেনটা দুম কোরে গতি কমিয়ে দিল। ক্যানো?
ঘাড় বের কোরে, ঝুঁকে দেখলাম ট্রেনটা বাঁক নিচ্ছে। বেশ লাগছে দেখতে ট্রেনটাকে, পানের খয়ের রঙ মেখে একটা ধাতব অজগর বনিয়মের নাইট ফ্লাইট টু ভেনাস ড্রামের তালে তালে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের - মানে, আমরা ২৬ জন, ১৮-১৯ বৎসরের ছেলে সাথে আরও কত মানুষের বিশ্বাস আর সিকিরিউটি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমদের পৌঁছে দেবে। আবার চোখে জল। সবকিছু ঝাপসা। কানে একটা নতুন শব্দ। কাঁদতে কাঁদতে মনে করার চেষ্টা করছি... শব্দটাকে মনে করার। চোখের জল ঠোঁট চুঁইয়ে মুখে। আমি আর কাঁদতে চাইছি না, প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করছি, কানের শব্দটাকে ধরে ফেলার। ইয়েস। নদী। ব্রীজ। নীচে তাকিয়ে দেখি আমি ব্রীজের উপর! নীচে, অনেক নীচে নদীর সরু সরু স্রোত, জলের ফেনার হালকা আভাস। কিন্তু নদীকে এত পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি কেন, ব্রীজ কোথায়? মাথা তুলে দেখি ব্রিজের কোথাও এতটুকু রেলিং নেই। উপরন্তু ট্রেনের ডিব্বা আমার পা-সহ প্রায় ব্রিজের বাইরে। মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত, মাথাটা বোঁ কোরে উঠল। মনে হচ্ছে পড়ে যাবো। পড়ে যেতে, আমার ভীষন পড়ে যেতে ইচ্ছে করছে, টানছে অনেক নীচ থেকে এক অজানা নদীর মৃতদেহ! এখন কোনও জল নেই কোথাও! অদৃশ্য নদী ডাকছে, আয় আয়। চোখ সরাতে পারছি না, চোখের পাতা পড়ছে না, পড়ে গেলাম আর কি! সয়ে গেল হাত সিগারেটের প্যাকেটের স্পর্শ পেতেই। লাল রিজেন্ট আর দেশলাই আমাকে টেনে তুলল যেন, আমি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এই প্রথম শুনতে-বুঝতে পারলাম মৃত্যুর ডাক। অথচ সাড়া না দিলে, বেঁচে বেরিয়ে গেলে জীবনে দেখা সবথেকে সুন্দর অভিজ্ঞতা!
পশ্চিম আসাম, শিলিগুড়িতে এরকম ব্রিজ পেরিয়েছি কিন্তু সেগুলো নদীর প্রায় কাছাকাছি, ঘন সবুজের মধ্যে একটা ভয়ভয় খেলার মতন নদী পেরিয়ে ওপার। এত উঁচুতে, সবুজবর্জিত, সুতোর মতন নদীর উপর, খরখরে হাওয়ার মধ্যে এত নিঃসঙ্গ ভূতুড়ে ব্রীজ - দেখো এখনও ব্রিজ শেষ হয় নি! এই ১৮-১৯ বছর বয়সে কতবার সুইসাইড করার কথা ভেবেছি, কিন্তু এত কাছাকাছি এসেও লাফালাম না কেন? হঠাৎ কেউ পিছন থেকে মাথাটা নেড়ে দিল, নূপুর। আমাদের দলের লিডার ।
- কি করতাসত এইখানে বইস্যা? পইড়া গ্যেলে! ঊঠ ভিতরে চল।
ওকে দেখলেই আমার নামের সাথে লিঙ্গ-ধারণার সাথে একটা ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। তিন দিনের পরিচয়, এরমধ্যে আমি অন্তত তিরিশ বার বলেছি। ৬-১ ইঞ্চি চেহারা একজন পুরুষের নাম নূপুর কি কোরে হতে পারে! এটা একটা অত্যাচার। নূপুর তাই আমাকে এড়িয়ে চলে। হয়ত গুনে কম পড়েছিল, ও এক ঘণ্টা পরপর মুখ গোনে, ছাব্বিশটা মুখ, কম পড়লেই- দাস চল ভিতরে চল। এদিকে ট্রেন ব্রিজ পেরিয়ে মাটিতে নামল! একটি ব্যতিব্যস্ত রেডিও হঠাৎ কিশোরের গানের সাথে শান্ত হলো, রাজু চলে রাজু/আপনে মস্তিমে ডুব /কোই জী ইয়া মরে...পরিস্কার ধরমেন্দ্রকে দেখতে পেলাম ট্রেনের পাশাপাশি সাদা পঙ্খিরাজ রাজুর পিঠে বসে টগবগ—না না ধর্মেন্দ্র আমার প্রিয় হিরো নয়, তবে খুব সম্ভবত এই ‘রাজু চলে রাজু’ গানের সিনেমা ‘আজাদ’ থেকেই আমার টিকিট ব্ল্যাকে দীক্ষা আর মারপিটের শুরু। এখন আজাদ সিনেমার নায়ক আমার দিকে হাত নাড়ছে আর রাজু ঘাড় নাড়ছে। ওই রাজুর পিঠে চেপে কতবার স্বপ্ন দেখেছি আমি কোনও অচেনা রাস্তায় হারিয়ে গেছি! রাজু চলে রাজু...
#
গত তিন দিনে আমার জীবনযাপন ম্যজিকের মতন পুরো বদলে গেছে। রাজা দাস মানে রাজা কিন্তু দাস হয়ে গেছি- AC U/T DAS SK. আমার ভাল নাম শিশির কুমার দাস। সেই কোন ছোটবেলায় বাবার মুখে ওই নরম শিশির শব্দ কতবার শুনেছিলাম মনে করা বেশ শক্ত। স্মৃতিক্লান্ত কানে শুধু রাগ-ঘেন্না মেশানো রাজা আর রাজা। সত্যি তো রাজা যদি দাস হয়, তাহলে রাজা আর দাস দুজনেই তো বিপন্ন। গত তিন দিনে আমার লিখিত নাম, দাস এস কে আর শ্রবণে শুধু দাস। রাজা আর দাসের স্ববিরোধীতা, অতুলনীয় টানাপড়েন, বিরক্তি, হিংস্রতা, হতাশা, উৎকেন্দ্রিকতা, সুইসাইড প্রবণতা, দিশাহীনতা, নোংরা-গ্লানিসর্বস্ব-কালাপাহাড়ি-সব উধাও। আমি এখন শুধুই দাস। বেবাক, বিস্মিত, ফুরফুরে, আত্মহারা, এক সদ্য স্বাধীন যুবক, দাস।
সামনে ইকবাল, দুহাত তুলে, - দুস্ত ছিলি কই। একহাত হইবো নাকি?
নূপুর ফোঁস কোরে উঠে –দাস ট্রেনে ঐসব চলবো না, রিক্রুটিং সেন্টারে করসত্ করসত্...এখন আমার আন্ডারে ঐসব আর হইব না!
ইকবাল তার দুর্লভ মোলায়েম গলাতে –-- করলে কি করবা...মারবা? ওইসব গল্প শেষ...আর কাউরে মানুম না, তুমি মারলে আমিও মারুম।
আমি চমকে উঠলাম, এ তো আমার মনের কথা! কিন্তু আমি যা যা করতাম আর করব না। নতুন কিছু করব। জুয়া আর খেলব না।
ইকবাল বলে - আরে দুস্ত জুয়া ছাড়া তাসের আর কোনও খেলা নাই নাকি...!
আমি তিন পাত্তি ছাড়া আর কিছু জানি না।
নূপুর বলে ওঠে, আমি রঙ মিলান্তি জানি।
সাথে সাথে ইকবালের অবজ্ঞা – লও, মাত শুনো, রঙ মিলান্তি আবার একটা খেলা নাকি...মাইয়ালোকের খেলা! মরদের খেলা খেলুম, ব্রিজ।
ডানদিক থেকে কেউ বলে উঠল, ফিলিং হাংরি। মনিপুরী ছেলে, নামটা এখনও উচ্চারণে আঁটছে না, তাই মনে থাকছে না! ফিলিং হাংরি -- দুজন মনিপুরী আর দুজন সৈনিক পরিবারের ছেলে ছাড়া বাকী সবার বুঝতে একটু সময় লাগল, ইংলিশে বলা হলো কিনা! ইকবাল, নূপুর কিছু বলার আগেই ক্ষিদেতে প্রায় লাফিয়ে উঠল যেন, হক কথা, ভুইলাই গেছিলাম!
- ফিলিং হাংরি মানে আমার তো পেট গিয়া স্পাইনালে ঠেকছে। এই যে টিম লিডার গাড়ী থামাও, না হলে ঘোরাও, কিছু একটা কর।
ইকবালের ভঙ্গিতে প্রায় সবাই হাসিতে হোহো। নূপুর রেগে গিয়ে —ইকবাল, তুই কিন্তু সেই গুয়াহাটি থেইক্যা বেশি কথা কইতাসত...একদম ঝ্যাং করবি না, ষ্টেশন আইলে দেখা যাইব, এখন নিজের জায়গায় গিয়া ব।
ইকবাল আমার হাত ধরে বলে, কেলা, বাল শুনুম তোর কথা, এই দাস চল ত দরজায়! নূপুর দাঁতদাঁত পিষছে! ওদিকে গুঞ্জন বাড়ছে, ফিলিং হাংরি কথাটা সাংঘাতিক সংক্রামক।
-ক তো তোর কিসের দুঃখ? -ইকবালের সিগারেট প্যাকেট খুলতে খুলতে বেশ আত্মবিশ্বাসী একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, যার উত্তর যেন ওর জানা। দুজনে দরজায় পাদানীতে পা ঝুলিয়ে পাশাপাশি দুলছি। ইকাবালের পাতলা চুল অমল পালেকরের মতন। উড়ছে। এই প্রথম ইকবালের চোখেমুখে বিষাদ দেখলাম। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, হালকা বসন্তের দাগ, মুখে সিগারেট। ওমপুরী ওমপুরী ভাব একটা মুখে- আবার সেই রংঘর আর আক্রোশ সিনেমার নাম!
-আরে ক ক, আমি জানি দুঃখ না থাকলে কেউ বাড়ি ছাইরা পালায়! ইকবাল উত্তেজিত।
আমি ‘পালায়’ শব্দটা শুনে আবার চমকে উঠলাম, এত যা বলে সব আমার কথাই বলে। ইকবাল পকপক কোরে সিগারেট টেনে আমার হাতে দিয়ে বলে –তরে আমি মার্ক কইরা রাখছি, ঐ যেদিন জাঙ্গিয়া পইরা খালি গায়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে-- কত জানি...ছাড়, তুই আমাগো সাথে তিন পাত্তি খেলতে বসলি, আমি তরে বুইঝ্যা গেছিলাম যে, তুই আমার মতন।
আমি ওর ফিলটার উইলস টেনে বলি – মানে?
ইকবাল বলে, মানে বুঝাইতে পারুম না...আবার তুই আমি যখন ফাইন্যাল লিস্টে আইসা পড়লাম- তুই লক্ষ্য করসত, যারা সিগারেট খাইতাছিল, জুয়া খেলতাছিল তুই আর আমি ছাড়া একটাও সিলেক্ট হয় নাই!
– কি কইতে চাইতাসত তুই? আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম!
–মানে আসলে আমরা চুদুরভাই না! একটা দুঃখ আমাগো এইগুলা করায়। ক তোর দুঃখটা কী!
ইকাবাল হাত বাড়িয়ে আমার কাছ থেকে সিগারেট ফেরত নেয়!
0 comments: