বিশেষ রচনা - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in বিশেষ রচনা
বিশেষ রচনা
শঙ্খঘোষ
দীপারুণ ভট্টাচার্য
মাঝে মাঝে শুধু খসে পড়ে মাথা
কিছু-বা পুরোনো কিছু-বাতরুণ।
হাঁক দিয়ে বলে কনডাকটর :
পিছনের দিকে এগিয়ে চলুন।
কবি শঙ্খ ঘোষ, এই নামটির সঙ্গে আমার প্রথম কবে পরিচয় হয়েছিল, মনে নেই। তবে ওঁর প্রথম যে কাব্যগ্রন্থ আমি পড়েছিলাম তার নাম, "শবের উপরে শামিয়ানা"। সবে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে তখন মাথায় চেপেছে কবিতার ভূত।
এরপর পড়েছি ওঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ। যেমন ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘নিহিত পাতালছায়া’, ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ ইত্যাদি। কবিতা ছাড়াও পড়েছি তাঁর অন্য স্বাদের লেখা যেমন, ‘জার্নাল’ বা ‘কবিতার মুহূর্ত’। কবিতায় এক অদ্ভুত চিত্ররূপ সৃষ্টি করতে পারেন শঙ্খবাবু। সহজ ভাষা দিয়ে স্পর্শ করেন অতল গভীর। তাঁর, 'শূন্যের ভিতরে ঢেউ' কবিতাটির কয়েক লাইন উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না ---
বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেইএক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়
কোনো ভাষানেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যত দূর মুছে দিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর,
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই। (সংক্ষিপ্ত)
তিনি সামাজিক সমস্যাগুলোকে দেখতেন খুব সাধারণ চোখে, তাই লিখেছেন,
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
কবির জন্ম ৬ই ফেব্রুয়ারী ১৯৩২ সালে অধুনা বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায়। অঞ্চলটি পদ্মা ও মেঘনা নদীর মিলনস্থল। তিনি লিখেছেন, 'মেঘনার মতো তার শরীরে আদুল শুয়ে আছি'।
তাঁর কবিতার ভাষা অন্যদের চেয়ে আলাদা। ধরা যাক 'বোধ' কবিতাটি;
যে লেখে সে কিছুই বোঝেনা
যে বোঝে সে কিছুই লেখেনা
দু-জনের দেখা হয় মাঝে মাঝে ছাদের কিনারে
ঝাঁপ দেবে কিনা ভাবে অর্থহীনতার পরপারে!
শঙ্খবাবু সব সময় জীবনকে দেখেছেন খুব সাধারণ ভাবে এবং সেই ভাবেই প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই চার লাইন কবিতার পর আর ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন-
লোকে বলে ভুল, আর আমিও কি জানিনা যে ভুল?
তবু তার মাঝখানে ডুবে আছি, যেভাবে মহিষ
নিজেকে নিহিত রাখে নিরুপায় জ্যৈষ্ঠের ডোবায়
বাতাস শুষেছে যার অবশ চোখের অলসতা।
মনে আছে তাঁর 'পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ' কাব্যগ্রন্থটি যখন পড়েছিলাম তখন আমার ১৭ কি ১৮ বছর বয়স। শিখতে শুরু করি কিভাবে লিখতে হয় অক্ষর বৃত্তে বা মাত্রা বৃত্তে। শঙ্খবাবুর কবিতার ধারা অনুকরণ ও করেছি তখন।
এবছর, ২০১৬ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাচ্ছেন শঙ্খ ঘোষ। সাহিত্যে অবদানের জন্য ভারত সরকারের দেওয়া সবচেয়ে বড় সম্মান, জ্ঞানপীঠ। এবার একজন বাঙালী রাষ্ট্রপতি এই সম্মান তুলে দেবেন আর এক বাঙালী কবির হাতে। দৃশ্যটা চিন্তা করে বেশ ভালো লাগছে। এর আগে এই সম্মান পেয়েছেন ১৯৯৬ সালে মহাশ্বেতা দেবী, ১৯৯১ সালে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ১৯৭৬ সালে আশাপূর্ণা দেবী, ১৯৭১ সালে বিষ্ণু দে এবং ১৯৬৬ সালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
শঙ্খ ঘোষ বাহান্নতম (৫২) মানুষ যিনি এই সম্মান নিয়ে আমাদের সম্মানিত করবেন। কারণ, আমার মনে হয় পুরস্কার কবিকে যতটা সম্মানিত করে তার চেয়ে অনেক বেশি সম্মানিত করে তাঁর পাঠকদের। জ্ঞানপীঠ ছাড়াও শঙ্খ বাবু পেয়েছেন ভারতীয় নাগরিক সম্মান পদ্ম-ভূষণ (১৯১১), রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৮৯) ইত্যাদি। তাঁকে ২০১৫ সালে Indian Institute of Engineering Science and Technology, শিবপুর, ডি.লিট উপাধি দেয়। একই সম্মান তাঁকে দিয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ও।
কবিরা অভিমানী। তাই অভিমান স্বাভাবিক তাঁরও। তিনি লিখেছেন,
কে তোমার কথা শোনে? তুমি-ই বা শোন কার কথা?
তোমার আমার মধ্যে দু-মহাদেশের নীরবতা।
তাঁর গদ্য পড়তে গিয়ে জেনেছি তিনি কতটা সঙ্কোচ বোধ করেন নিজেকে প্রকাশ করতে। চিরকাল প্রচার বিমুখ থেকেছেন তিনি। যদিও প্রয়োজনে তাঁর উপযুক্ত ও সুনির্দিষ্ট প্রতিবাদ আমরা বারবার দেখেছি। তিনি লিখেছেন, 'ভোর এল ভয় নিয়ে, সেই স্বপ্ন ভুলিনি এখনও'। কিংবা আরো স্পষ্ট বলেছেন-
বাসের হাতল কেউ দ্রুত পায়ে ছুঁতে এলে আগে তাকে প্রশ্ন করো তুমি কোন দলে
ভুখা মুখে ভরা গ্রাস তুলে ধরবার আগে প্রশ্ন করো তুমি কোন দলে
পুলিশের গুলিতে যে পাথরে লুটোয় তা কেটেনে তুলবার আগে জেনে নাও দল
…
রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাস বার আগে প্রশ্ন করো কোন দল তুমি কোনদল
(সংক্ষিপ্ত)
আজ ৮৫ বছরের এই তরুণ কবিকে প্রণাম করতে চাই, বলতে চাই, ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন। তাঁর 'পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ' কাব্যগ্রন্থটির দুটি কবিতায় সুর করেছিলাম একসময়, তখন আমার ১৮ বছর। ইচ্ছা ছিলো তাঁকে শোনাবার। সুযোগ হয়নি। ভাবছি you tube এ তুলে দিলে কেমন হয়। যদি ভক্তের কানের ভিতর দিয়ে এই গান পৌঁছে যায় ভগবানের কাছে!
তুমি কি কবিতা পড়ো? তুমি কি আমার কথা বোঝো?
ঘরের ভিতরে তুমি? বাইরে একা বসে আছো রকে?
কঠিন লেগেছে বড়ো? চেয়েছিলে আরো সোজাসুজি?
আমি যে তোমাকে পড়ি, আমি যে তোমার কথা বুঝি।
শঙ্খ বাবুকে প্রণাম।
0 comments: