0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক

জলরেখা - ১৫ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত




সেভ করবার পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিরূপ একটু খুঁটিয়ে দেখে মুখের পক্সের দাগগুলো, হাত বোলায় গালে। নাহ্‌, অনেকগুলো দাগ বেশ মিলিয়ে গেছে। কিন্তু বেশ কিছু এখনও আছে। আয়নার মানুষটাকে হেসে নিরূপ সান্ত্বনা দেয়। বলে ওঠে, ‘সব দাগ মিলিয়ে যায় না’। আয়নার মানুষটাও উল্টে হাসে। বলে ‘তাই?’

-তা নয় তো কি? 

-‘দাগ মিলিয়ে যাবার জন্য কি এখন রূপচর্চা শুরু করবে? নিরূপ?’ টেনে টেনে প্রশ্ন করে আয়নার লোকটা।

-‘না, সেটা করব না। আমি নিজের চেহারা নিয়ে, আই মিন, বাইরের রূপ নিয়ে ভাবি না’... জবাব দেয় নিরূপ।

-ভেতরের চেহারা নিয়ে ভাবো? একটু শুনি সেটা কেমন? 

-কেমন আবার? আমি নিরূপ। কাজের মানুষ। আমার কাজ ছাড়া কিছু আমি ভাবি না।

-তোমার আপন শুধু তোমার কাজ? তোমার পরিবার... তোমার বাবা, মা, নীরু ... এরা আপন নয়?

-আমি তো সেটা বলিনি। 

-তাহলে কি বলেছ?

-বলেছি আমার প্রায়োরিটির কথা। কাজ করলে, কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে আমি ভালো থাকি। আর পরিবার, বাবা, মা আর নীরু এরা... এরা তো আমার সাপোর্ট সিস্টেম। এরা আছে বলেই...

-এরা আছে বলে কি?... বল, থামলে কেন? এরা তোমার প্রায়োরিটি নয়?

-অবশ্যই প্রায়োরিটি। 

-তাহলে এখনও একবার বাড়ি গেলে না কেন? তুমি তো জানো বাবা অসুস্থ।

-হ্যাঁ, জানি। কিন্তু যখন খবর পেলাম, তখন আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। কি করে যেতাম?

-তখন অসুস্থ ছিলে। এখন? এখন তো অনেকটা ভালো আছ। এখন যাও।

-হ্যাঁ, যাবো। দুদিনের একটা কাজ সেরে নিয়ে যাবো। 

-কি কাজ? গরম পড়েছে। এখন তো ফিল্ডের কাজও হবে না।

-না, ফিল্ডের কাজ নয়। আবার একটা জিনিস দেখতে হবে।

-কি দেখবে?

-দ্যাখো, তোমার পেছনে টেবিলের দিকে তাকাও। 

-হ্যাঁ, তাকালাম। কি আছে?

-দ্যাখো, একটা ফাইল নীল রঙের।

-হ্যাঁ। ফাইল। কি আছে ওতে? অফিসের ফাইল?

-না। ওটা অফিসের ফাইল নয়। ওটা সরমাদি দিয়ে গেছে। ওতে অনেকগুলো ব্লক, গ্রাম আর মানুষের নামের লিস্ট আছে। 

-ওটা নিয়ে তুমি এত ভাবছ কেন?

-ভাবছি, কারণ না ভেবে পারছি না। 

-ওই মানুষগুলোকে তুমি চেন? 

-না। 

-সরমাদি চেনে?

-নিশ্চয়ই। অনেককেই চেনে। অনেকে ওঁর পেসেন্ট। কেউ চিকিৎসা করছে এখনও। কেউ বন্ধ করে দিয়েছে।

-সরমাদি এসব ঝামেলার মধ্যে তোমাকে ডাকছে কেন?

-উফফফ, কি করে বোঝাই, আমাকে ডাকেনি। আমিই সেধে বারে বারে ডকুমেন্ট চেয়েছি ওঁর কাছে। উনি অনেক খেটে অন্য হেলথ সেন্টারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে খুব তাড়াতাড়ি এই পেসেন্টদের লিস্ট বানিয়ে দিয়েছে। 

-ওদের কি হয়েছে?

-ওদের পা বেঁকে ধনুকের মতো হয়ে যাচ্ছে। কেউ পঙ্গু হয়ে গেছে।

-কি করে হলো?

-আমার ধারণা জল খেয়ে। স্রেফ জল খেয়ে। 

-জল খেয়ে? অপুষ্টি? মানে ওরা কি আর কিছু খেতে পায়না?

-হ্যাঁ, অপুষ্টি তো আছেই। সেজন্যই এই রোগটা বেশি করে থাবা বসাচ্ছে। কিন্তু সেটা আসল কারণ নয়। আসল কারণ হলো জল। 

-তুমি কি করে নিশ্চিত হচ্ছ যে জল?

-আমি নিশ্চিত নই। আমার ধারণা। অনেকদিন আগে পড়েছিলাম। আরও পড়তে হবে। জলে ফ্লুওরাইড আছে বলে আমার ধারণা। যতটা থাকলে পান করা যায়, নির্ঘাত তার থেকে অনেক বেশি আছে। সেজন্য গ্রামকে গ্রাম পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। গত কুড়ি বছর আগেও এরকম ছিল না। মানুষ এখানে ঝর্নার জল, নদীর জলে জীবনধারণ করত। এখন চাপাকল বসেছে। যেসব ব্লকে বসেছে, সেসব জায়গায় এই রোগের বাড়বাড়ন্ত। 

-তার মানে তুমি বলতে চাও উন্নয়ন না হলে হয়ত এরকম হতো না?

-না, আমি তো তা বলিনি। 

-আর কি বলবে?

-আমি বলতে চাই, ওই জল পান করবার যোগ্য নয়। জল পরিশোধন করে ফ্লুওরাইড বের করে দিতে পারলে তবে সেটা পান করা যাবে। যদ্দিন সেটা না করা যায়, তদ্দিন চাপাকল সিল করে দিতে হবে।

-সেটা কিভাবে সম্ভব?

-‘জানি না, জানি না’... অসহায়ভাবে মাথা নাড়ে নিরূপ। ‘তার আগে তো প্রমাণ করতে হবে যে জলগুলো খারাপ, দূষিত।

-সেটা কিভাবে করবে?

-সেটাই তো বলছি। আমি দুদিন, ঠিক দুদিন ঘুরে ঘুরে ওই ব্লকের চাপাকলগুলোর জলের স্যাম্পল কালেক্ট করব। তারপর সেগুলো কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা করাব। এইফাঁকে অফিসের লাইব্রেরি থেকে এই বিষয়ে আরও পড়াশুনা করে নিশ্চিত হব যে এই সমস্যাটা জলের জন্যই হচ্ছে। সম্ভব হলে আরও এক্সপার্ট যারা আছেন তাদের সঙ্গে কথা বলব।

-বেশ। ভালই তো। যাও। ভালই তো হবে। বাবা, মা, নীরু ... ওদের সঙ্গেও কদিন কাটিয়ে আসতে পারবে। 

-‘না। না-আ- আ- আ...’ চীৎকার করে ওঠে নিরূপ।

-‘এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন?’ আয়নার লোকটা বলে। 

-কি করে ভুলে গেলে যে ওরা কেউ এখন কলকাতায় থাকেনা? কলকাতায় যাওয়া মানেই ওদের সঙ্গে থাকা নয়। 

-তাহলে? 

-‘তাহলে আর কি? যাবো। কলকাতার কাজ সেরে তবে যাবো। দেরি হবে। এখানকার কাজ একটু সামলে নি আগে’। নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত নিরূপ সরে যায় আয়নার মানুষটার সামনে থেকে। ফিল্ডের পোশাক গায়ে চড়িয়ে নেয়।

0 comments: