0

ছোটগল্প - সুমিত নাগ

Posted in


ছোটগল্প


আব্রাহাম, প্যান্টুল এবং শেষ উক্তি
সুমিত নাগ



।।১।।

দেওয়ালের ওপর ছোট্ট সোনালি মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে, দুই হাতের মুঠো বুকের কাছে রেখে, চোখ বন্ধ করলেন আব্রাহাম। বিড়বিড় করে কিছু বলতে লাগলেন, যেমন তিনি বলতে থাকেন প্রতিদিনই শুতে যাবার আগে, অন্তত একঘণ্টা সময় ধরে। তাঁর ঘাড় ঈষৎ নামানো, ঘন দাড়িতে আচ্ছাদিত থুতনি বুকের কাছে লেগে আছে, মাথার চুলগুলো, ঘরের কয়েকটা মোমের আলোতে যা প্রায় বাদামি, কাঁধ অবধি নেমে এসেছে, হাল্কা হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। তিনি মনে মনে রোজকার মতো বলে চলেছেন, ‘হে পরমপিতা, হে ঈশ্বর, হে পবিত্র আত্মা, আমাকে উপযুক্ত করো, আমাকে গ্রহন করো, আমার আত্মা যেন স্থান পায় তোমার স্বর্গের ধূলিতে, আমি তোমারই প্রতীক্ষায়, শেষ বিচারের দিনে যেন তোমার সামনে দাঁড়াতে পারি প্রভু, যেন...’। এই ভাবে তাঁর প্রার্থনা চলতেই থাকবে, রাত ক্লান্ত হয়ে আসবে, ঘুম এসে যাবে সমস্ত জ্বলতে থাকা মোমবাতিগুলোরও, হয়ত তারা কেউ কেউ নিজেকে পুড়িয়ে নিভে যাবে, কিন্তু আব্রাহামের প্রার্থনা থামবে না। শেষ অবধি যখন চোখ খুলে তাকাবেন তিনি, দেখবেন ঘর প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে, কোনওদিন হয়ত সম্পূর্ণ আঁধার, তখন তিনি দরজার পাশে গিয়ে খুঁজবেন টিউবলাইটের সুইচটা, যা এতদিনের অভ্যাসে চোখ বন্ধ করেও তিনি ছুঁয়ে ফেলতে পারেন। এবার আলো জ্বলে উঠবে সারা ঘরে, মোমবাতির যে নৈসর্গিক আলোক সারা পরিবেশে কৃত্রিম স্বর্গ তৈরি করেছিল, তা আচমকাই উবে যাবে কিন্তু তা কেবলই বাহ্যিক, বাইরের কারওর জন্য। আব্রাহাম আবার বিছানায় বসে গভীর ভাবে মনঃসংযোগ করবেন হাতের কাছের একটি বইয়ে, বাইবেল। হয়ত ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে খুলে বসবেন বুক অফ কিংসের কোনও একটি পাতা, কিংবা হয়ত মনে হবে ডেভিডের সেই কাহিনী, কিংবা বুক অফ জাজেস এর পাতায় হয়ত স্যামসনের কথা তার চোখে পড়বে ফের একবার বা হয়ত মনে হবে জেনেসিসের ‘কেন আর আবেল’ এর অংশটা পড়বার কথা, কিম্বা হয়তো শেষে তিনি ঘুরে ফিরে গিয়ে ফের খুলে বসবেন সেই আব্রাহাম ও তার শিশুপুত্র আইজ্যাকের কাহিনী, সেই আত্মত্যাগের কাহিনী, খুব প্রিয় তাঁর, সে যে তাঁর নিজেরই নাম, এই এক অন্য জন্মেরই আর কী! যদিও ইদানীং তিনি সেই শেষ উক্তিগুলো নিয়েই বেশি ভাবিত আছেন।

আব্রাহাম পড়তে পড়তে ঘড়ি দেখলেন। আজ আর বেশি দেরি করা যাবে না, কালকে অনেক কাজ আছে। তিনি বই রেখে শুয়ে পড়লেন আলো নিভিয়ে আর শোবার সময়ে মনে মনে বললেন, ‘প্রভু, আমি যেন তোমার পথে যেতে পারি। আমারই মতো কোনও অন্ধকারের প্রাণীকে দেখাতে পারি যদি তোমারই পথ, সেই আমার প্রতি তোমার সবচেয়ে বড় উপহার হবে’। এই ব’লে তিনি বুকের ও কপালের কাছে কাল্পনিক ক্রসের এক চিহ্ন এঁকে, বালিশে তাঁর মাথা হেলিয়ে দিলেন। শোবার সময় তিনি এই কথাটা রোজই বলেন। তিনি আজও ব’লে শুয়ে পড়লেন। বুকের কাছে ঝুলতে লাগল তাঁর সুন্দর সোনালি ক্রুশিফিক্স লকেট। 



।।২।।

অনেকের সঙ্গে গির্জার ভিতরে ঢুকে পড়ার পর প্যান্টুল অবাক হয়ে সবটা দেখতে লাগল। তার চারপাশ থেকে অসংখ্য মানুষ, তাদের সবারই গায়ে ভালো পোশাকআশাক, তারা হইহই করতে করতে ঢুকে কিছুটা চুপচাপ হয়ে গেছে এখন। বিশেষ কথা বলছে না কেউই, বললেও ফিসফিসিয়ে, মৃদু স্বরে। যদিও তার ওপর কেউ নজর রাখছে কিনা সেটা এখনও ও’ বুঝতে পারেনি। প্রথমে সে এপাশে ওপাশে নজর রাখছিল, সন্দেহজনক কিছু মনে হয়নি। তারপর একটা বারান্দা মতো অংশে সে ঢুকল, দেখল অসংখ্য ছবি দেওয়ালে দেওয়ালে টাঙ্গানো, তাদের সে ছবির পাশে লেখা নানান কথা, যা সে প্রথমে পড়তে কোনও আগ্রহ দেখাল না। সে মূলত ছবিগুলোই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে হঠাৎ কী মনে ক’রে একটা ছবির সামনে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, একটা বাচ্চা ছেলে ও তার বাবা হয়ত হবে, পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই বাবা-মতো লোকটার হাতে একটি ছুরি, তার এই ছবিটা দেখে কী যেন মনে হলো, সে সামনে একটু এগিয়ে গিয়ে সেই পাশের লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করল। দীর্ঘদিনের অনভ্যাস, দীর্ঘদিনের। চোখ মুখ কুঁচকে, ভ্রূভঙ্গি করেও সে বেশি কিছু উদ্ধার করতে পারল না। নাহ, কত কত দিন সে কিছুই পড়েনি, একমাত্র টাকার ওপরের লেখা সংখ্যাগুলো ছাড়া আর কিছু পড়ার আছে বলেও মনে হতো না তার, যদিও এক চিরকুটে সমরেশ বাবু ও’কে একবার একটা নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই যেবার হাতকাটা বসিরের মাথা কাটা পড়ল। কিন্তু সে অনেকদিন আগের কথা, তখন লাইনেও সে বেশ নতুন, অক্ষর জ্ঞান ছিল বলে ওর খাতির প্রথমেই বেড়ে গিয়েছিল সবার মধ্যে, আজ তার পরিণতি দেখে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও’। অনেক চেষ্টা করে সে কয়েকটা কথাই পড়তে পারল, ‘হয়’, ‘নয়’, ‘সন্তান’, ‘পর্বত’ তারপর হায়, অনেক কষ্টে এই ঈশ্বরের স্থানে, ‘ঈশ্বর’ কথাটা, তারপর আরও কয়েকটা, যা দিয়ে কোনও অর্থবোধক মানে সে গড়ে তুলতে পারল না। 

সে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ঘুরতে যাবে এমন সময় শুনল পাশ থেকে কোনও একটি মেয়েলি স্বর বলছে, ‘দেখো, এই হচ্ছে আব্রাহাম আর ঐ বাচ্চাটা আইজ্যাক। বলেছিলাম মনে আছে তোমাদের এদের কথা?’

সে দেখল একজন মধ্যবয়সি মহিলা তার সঙ্গে কিছু বাচ্চা ছেলে মেয়ে, স্কুলের ইউনিফর্ম পড়া, তাদের উদ্দেশ্যে এই কথা বলছে। 

প্যান্টুল নামটা শুনে আরও একবার ঐ ছবিটার দিকে দেখল তারপর সেখান থেকে চলে গেল। 

বিশাল এক হল ঘর। মোমবাতির আলোয় আচ্ছন্ন হয়ে আছে এই সকালেও। দেখেই ওর অদ্ভুত আকর্ষণ হলো এক। সে দেখল সামনে সারি সারি বেঞ্চি সাজানো আছে, কেউ কেউ বসে আছে সেখানে। সে একটা ফাঁকা বেঞ্চি, একেবারে এককোণে, তার ওপর গিয়ে বসে পড়ল। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ তার মনে হলো, সে এখানে যদি থেকে যেতে পারে কেমন হয়? ভাবতেই ওর মনে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। বাইরের সমস্ত ঝামেলা না মিটে যাওয়া অবধি, এখানেই থেকে গেলে কেউ খুঁজে পাবে না ও’কে। এর চেয়ে বড় ‘শেলটার’ আর কী আছে! কেউ কি বিশ্বাসও করতে পারবে, প্যান্টুল সমস্ত দুনিয়া ছেড়ে এই গির্জার মধ্যে বাস করছে? কে ধরবে ওকে? কে জানবে ওর কথা? কেউ না, কেউ না। প্যান্টুল ভাবতে লাগল কীভাবে সে এখানে থেকে যেতে পারে, কোনও কাজ যদি সে পায়, সে চাকরবাকর বা মেথর সবই চলবে, সে এমন কিছু নেই যা করতে পারে না। কিন্তু কোথায় কীভাবে বলবে? ভাবতে ভাবতে প্রচণ্ড ক্লান্তি পেল ওর। পেটে প্রচণ্ড লড়াই আরম্ভ হয়েছে, পায়খানাও করা হয়নি সকাল থেকে উঠে, কিন্তু এখন যা তাকে তাড়িয়ে মারছে তা হলো ক্ষুধা, প্রচণ্ড ক্ষুধা, তার মনে হলো গোটা বিশ্ব-মহাবিশ্ব সে গিলে খেতে পারে। তার মনে পড়ল কাল সন্ধ্যের পর থেকে সে কিছুই খেতে পায়নি। সে এখন বাইরে যেতেও পারবে ব’লে তার মনে হলো না। সেই ঝুঁকি নেওয়া কোনওমতে সম্ভব না। 

তার নজরে পড়ল, সামনে সাদা পোশাক পরিহিত একজন কেউ কিছু বলছে, সেই মহিলাটি ও তার স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা সেই ভদ্রলোকের কাছে কিছু শুনতে চেয়েছিল হয়তো, তিনি তাদের ব্যাখ্যা করছেন কোনও ঘটনা। সে তার বেঞ্চির একধারে সরে এলো, এখান থেকে সে শুনতে পাচ্ছে সেই কথা, সে শুনছে সেই কাহিনী, ‘কেন ও আবেল’ নামে খ্যাত বাইবেলে, কেন প্রথম হত্যাকারী, আবেল প্রথম শহিদ, হত্যার শাস্তি, তার অনুতাপ, কিছুরই শেষ নেই, ব্যাখ্যা করছেন সেই ভদ্রলোক। ‘ইনি নিশ্চয় চার্চের ফাদার’, মনে মনে ভাবল প্যান্টুল। সে মূর্খ হতে পারে, কিন্তু বাইরের যেকোনও বিষয়ে তাকে জেনে রাখতে হয়, চার্চের ফাদার কী সে জানবে না হতে পারে না। 

ভাবতে ভাবতে সে শুনল, ফাদার আরও একটা গল্প শুরু করছেন, মনে হয় তিনি এই বাচ্চাদের খুব ভালবাসেন, তার প্রশান্ত মুখ দেখে মনে হয় তিনি গল্প বলতেও ভালবাসেন খুব, তার সুন্দর কাঁধ অবধি চুল, তার গলার সোনালি ক্রুশিফিক্স বেরিয়ে এসেছে বুকের কাপড়ের ওপর, হাত দুটো কী সুন্দর ও আঙুলের ওপরটা খোলা থাকায় বোঝা যায় বেশ লোমশ ও পুরুষালী। এখন তিনি বলছেন, আব্রাহামের কাহিনী। বাচ্চারা এবং তাদের শিক্ষিকাও মন দিয়ে শুনছে সেই গল্প। একটা হত্যার গল্প, একটা ত্যাগের গল্প, শুনতে শুনতে আর এই ফাদারের শান্ত, সুন্দর মুখ নিঃসৃত শব্দগুলো প্যান্টুলকে ক্লান্ত করে তুলল। সে বেঞ্চির সামনে মাথা গুঁজে শুয়ে পড়ল, ক্লান্ত খুব ক্লান্ত লাগছে তার। একেই কাল রাতের অর্ধেকটা ঘুম হয়নি। মনে হচ্ছে আর এই শরীরটাকে নিয়ে এগোতে পারবে না সে। কতকাল একা পালিয়ে বেড়াবে, কতকাল একা ছুটে বেড়াবে? এইভাবে একা সে বাঁচবে কীভাবে? সামনে তাকিয়ে সে দেখল একটা সাদা, বড় মূর্তি কোনও রমণীর, তার কোলে এক সুন্দর শিশু, দেবশিশু। ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে, অন্তরের ব্যাথায়, এই জঘন্য, সব হারানো জীবনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে এক বৈরাগ্যের উদ্ভব হলো, মনে হলো মরে গেলেও শান্তি পাবে না ও’। বুকের কাছে একটা গোটা রক্তের ডেলা বারবার ধাক্কা দিতে লাগল। এইবার, দ্বিতীয়বার, কাল রাতের পর, আবার সেই বেঞ্চিতে শুয়ে প্যান্টুলের প্রচণ্ড কান্না পেল। তবে এইবার তার বউ বা ছেলের জন্য না, পুড়ে যাওয়া বাড়িটার জন্য না, প্রতিশোধের এই ভয়ানক আগুনে সে পুড়ছে বলেও না, তার হাত নিশপিশ করছে কিন্তু সে অসহায়, বড় অসহায়, কিন্তু সেই জন্যও না, তার নিজের জন্য কান্না পেল, প্রচণ্ড কান্না। সে কোথায় ছুটে বেড়াচ্ছে, কোথায় তার শান্তি, কোথায় তার জীবন সে কিছুতেই বুঝতে পারল না। কোনও ধর্মকথা সে কোনওদিন দু’কানে শোনেনি, শুনতেও চাইনি, কিন্তু এই বিশাল ‘হল’ ঘরের অসংখ্য বেঞ্চির মধ্যে একটায় বসে, প্রজ্বলিত মোমবাতির শিখার দিকে চেয়ে তার প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতে লাগল সারা দেহে। এই যন্ত্রণা, সেইবার গুলি খেয়ে বরজের জলায় প’ড়ে থাকার মতো না, সেই গুলি বের করার সময় সেই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার মতো না, সেই সময়গুলো মনে হয় একটা পা বা হাত বাদ দিয়ে দিলেই শান্তি মিলবে, কিন্তু এখানে সারা শরীর যেভাবে জ্বলছে, তা কাউকে বোঝানো সম্ভব না, অথচ সেটা সে অস্বীকার করতেও পারবে না, যেন হৃদয়টা খুলে ফেললে এর থেকে শান্তি পাওয়া যাবে। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

সমস্ত হল প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে। বিকেল হতে চলল। তিনি দেখতে পেলেন একটা লোক এখনও বসে। বিরক্ত হলেন না, বারবার ঘোষণা করা হয়েছে যদিও, সময় শেষ বলা হয়েছে এখনকার মতো, তবুও কিছু লোক থাকে যারা এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায়। কিছু না, একদিনের হুজুগ! তিনি ভালই জানেন। কিন্তু যে প্রভু তার সমস্ত সন্তানদের সমান চোখে দেখেন, ধনী- দরিদ্র- পুণ্যাত্মা- পাপী নির্বিশেষে সকলের তার কাছে অবাধ অধিকার, তিনিই বা তাদের দূরে সরিয়ে রাখেন কোন মুখে। তিনি ধীর পায়ে সেই মানুষটার কাছে এলেন। বললেন, ‘শুনছেন? সময় হয়েছে।’

উত্তর এলো না কোনও। তিনি আবার বললেন, ‘আপনাকে বলছি...।’

এবার উত্তর এলো না। 

তিনি কিছু না ব’লে এবার মানুষটির পোশাকের দিকে দেখলেন। সামান্য, অতি সামান্য বললেও বেশি বলা হয়। একটা খয়েরি শার্ট, তার রঙ খয়েরি যত না ধুলো লেগে আরও বেশি খয়েরি হয়ে গেছে, কিংবা ধূসর, পাশে তার গায়ের লাল রঙের চাদরটা কোনওমতে ভাঁজ করে রাখা, তাতে কোনও যত্নের চিহ্ন নেই। তার প্যান্টের অবস্থাও তথৈবচ, বেশ কিছু জায়গা ছিঁড়ে গেছে, বিশেষ ক’রে নিচের দিকটা। তিনি বেশ কৌতূহল অনুভব করলেন। এই ধরনের কোনও লোককে তিনি আজকের দিনগুলোতে হোক বা অন্য কোনও দিনে এই গির্জায় আসতে দেখেননি। এত বনভোজনের দলবল নিয়ে বা ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে আসা কেউ না। দেখেই মন হয় ভবঘুরে যেন, একাকী ! তিনি সস্নেহে মানুষটির চুলে হাত রাখলেন। ইসস, কী ভীষণ খরখরে এই চুল, পরিচর্যাহীন কত যুগান্ত ধরে। সেই চুল ঘাড় বেয়ে নেমেছে ঠিক তারই মতো, আবার খয়েরি আভাও আছে। তিনি মনে মনে হাসলেন। এ কি তারই অন্তর আত্মা নাকি! তিনি ঘুরে তাকালেন তার ঈশ্বরের দিকে। তোমার জন্মদিনে, একী দেখছি আমি। তিনি সেই মাথায় হাত দেওয়া অবস্থাতেই, কোমর ঝুঁকিয়ে মানুষটার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলতে গেলেন, ‘কে আপনি? উঠুন’। দেখলেন, আসলে মানুষটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তিনি মুচকি হাসলেন, আজ অনেক কাজ, কিন্তু এই মানুষটারও খবর না নিয়ে তিনি পারছেন না। কে বলতে পারে, স্বয়ং প্রভু এসেছেন হয়তো, এই বেশে।

-‘শম্ভু, শম্ভু... !’

একটি লোক তাড়াতাড়ি এলো। সে বাগানের কাজে ব্যস্ত ছিল এতক্ষণ। আজকের দিনে যত লোকজন এসে বাগানের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে যায়। এই গাছে হাত দেবে, ঐ গাছ থেকে ফুল তুলতে যাবে, অহহ, কী অত্যাচার এক দিনের জন্য। সে তাড়াতাড়ি এসে দেখল, ফাদার দাঁড়িয়ে আছেন কোমরের পিছনে হাত রেখে তাঁর পরিচিত ভঙ্গিতে আর একটা লোক বেঞ্চির ওপরেই, অচৈতন্যের মতো মাথা গুঁজে শুয়ে আছে। 



।।৩।।


‘পিতা, এদের ক্ষমা করো, যেহেতু এরা জানে না এরা কী করছে’- লুক। 

‘আমার ঈশ্বর, আমার ঈশ্বর, আমাকে পরিত্যাগ করলে কেন?’- মার্ক ও ম্যাথিউ।

আব্রাহাম মাথা তুলে আকাশটা দেখলেন, ঘন মেঘ, ক্লান্ত ঘন মেঘ, তিনি ক্লান্ত এই মেঘের মতই, ইদানীং তাঁর শেষ উক্তিগুলো নিয়ে বিশেষ ভাবিত হয়ে পড়েছেন তিনি আর আরও আরও বেশি করে খুঁজে বেড়াচ্ছেন এর প্রকৃত মানে। কতজন কত অর্থ করেছেন এর, কিন্তু কিছুতেই সন্তুষ্টি হয় না তাঁর, মনে হয় আরও কিছু আছে আরও, বিশেষ করে এই দুটি উক্তি তাঁর শেষ সাতটির মধ্যে বিশেষ ভাবে তাড়িয়ে বেড়ায় তাঁকে। 

ভাবতে ভাবতে তিনি স্কুল কম্পাউণ্ডের ভিতরে কখন ঢুকে পড়েছিলেন খেয়াল নেই, একটা বিশ্রী শব্দে তাঁর মনের চিন্তা নষ্ট হলো। তিনি পাশ ফিরে দেখলেন তিনটে ছেলে কথা বলতে বলতে হাসিতে ফেটে পড়ছে আর তাদেরই কারও মুখ থেকে এই অশ্লীল শব্দটা বেরিয়েছে। তিনি সেই দিকে স্থির চোখে তাকালেন। ছেলেগুলো তাঁকে দেখতে পেয়েই নিজেদের মধ্যে আলোচনা বন্ধ করে দিল। তাদের চোখে একটা অনুতাপের ছায়া। তিনি কিছু বললেন না তাদের, কিছু বলেনও না কাউকেই, এটাই দেখলেই আশ্বস্ত হন, এই অনুতাপ, জীবন থেকে জানেন, খুব কাছের একজনের জীবন থেকে, যাকে তিনি ছেড়ে এসেছেন এই নতুন জীবনে, এই অনুতাপ এক বড় সত্য, অন্তরশুদ্ধির এক পথ। তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, মোটামুটি সবই প্রস্তুত, বিশাল ফেস্টুন, ফ্লেক্সে ভ’রে গেছে সমস্ত স্কুল কম্পাউণ্ড, আজকেই উদ্বোধন তিনদিন ব্যাপী বিশাল উৎসবের, আজকে দু’শ বছরে পদার্পণ করছে স্কুল, সেই কবে পর্তুগিজদের হাতে তৈরি, এখানকার কেন সারা অঞ্চলের গর্ব এই স্কুল, তিনি খুব খুশি হলেন এই বিশাল আয়োজনের শুরুটা দেখে। 

সামনেই প্রিন্সিপাল তাদের তদারকি করতে ব্যস্ত ছিলেন, আব্রাহাম তাঁকে দেখে এগিয়ে গেলেন। যদিও তিনি স্কুলের সঙ্গে কোনওভাবে যুক্ত নন তিনি এখানে যথেষ্ট শ্রদ্ধেয়, বিশেষ করে সংলগ্ন গির্জায় তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য, এই গির্জাকে তিনি নিজের আত্মা মনে ক’রে কাজ করেন সেখানে তিনি। মাঝে মাঝে তাকে স্কুলে আসতেই হয়, কোনও কোনও ভাষণ দেবার সময়, কোনও কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, আর আজকাল সকালের প্রার্থনার সময় ছেলেদের পাঠটাও তিনিই করান, তাঁর তত্ত্বাবধানেই, তাঁকে সামনে রেখেই হয় সব। আজকেও হয়ত তাঁর দায়িত্ব থাকবে কিছু, তবে তিনি তা নিজে থেকে এগিয়ে জিজ্ঞেস করার জন্য গেলেন না, তাঁর আসল উদ্দেশ্য কোনও প্রয়োজন যদি হয় গির্জার তরফ থেকে তাঁর ব্যবস্থা তিনি করবেন। নিজের সম্মানের জন্য তিনি কখনই ভাবিত নন। তাঁকে দেখে হেসে সম্ভাষণ জানালেন প্রিন্সিপাল। কথা বলতে বলতে জানালেন-

-‘আপনাকেই কিন্তু এই অনুষ্ঠানের সূচনার দায়িত্ব নিতে হবে’।

-‘কিন্তু আমি কেন? আমি তো আর...’

-‘না না, আপনিই আমাদের স্কুলকে সবার থেকে ভাল রিপ্রেসেন্ট করতে পারবেন ব’লে আমরা বিশ্বাস করি। এটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত’।

-‘আমি তো আর সে অর্থে গির্জার...’

-‘না হলেও, তিনি কিন্তু আপনাকেই সব দায়িত্ব দিয়েছেন আর তাঁর অনুপস্থিতিতে আপনিই সব দায়িত্ব পালন করবেন, যেমন অন্যগুলোও করে আসছেন। তিনি তো আপনার থেকে আর কাউকেই বিশ্বাস করেন না’।

-‘কখনই একথা বলবেন না। তিনি অবিশ্বাস করেন না কাউকেই ...’।

আব্রাহাম চুপ করে গেলেন।

-‘তিনি কি আসতে পারবেন?’

-‘আমার মনে হয় না তিনি আসতে পারবেন, পারলে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হতো না। তবে, তিনি আসতে পারলে আমাকে কিন্তু অব্যাহতি দিতে হবে...’

প্রিন্সিপাল হাসলেন।

-‘শুনলাম কোনও মাননীয় মন্ত্রী আসছেন এর উদ্বোধন করার জন্য...’।

-‘অবশ্যই। তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী, তবে তিনি তো বাইরের মানুষ, আপনি এই স্কুলের, আপনার ভাষণ, আপনার দায়িত্ব অনেক বেশি, বিশেষ করে সবার সামনে স্কুলকে তুলে ধরার জন্য’।

আব্রাহাম আর কিছু বললেন না। মাথা তুলে স্কুলের চারপাশটা একবার দেখে নিলেন। বড় সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে এই প্রাঙ্গন। তখনই তাঁর মনে পড়ল সেই শেষ উক্তি দুটো, তিনি প্রিন্সিপালের থেকে বিদায় নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন সেখান থেকে, গির্জাতেও অনেক কাজ প’ড়ে আছে তাঁর।



।।৪।।

হঠাৎই একটা আলোর ঝলক প্যান্টুল এর চোখের ওপর এসে পড়ল। এপাশ ওপাশ ফিরে, সহজে ঠাওর করতে পারল না ঠিক কোথায় সে আছে। গা ঝেড়ে উঠে বসল, মানে উঠে বসে গা ঝাড়তেই হলো। সে দেখল সে একটা বাগানের মধ্যে শুয়ে আছে, চারদিকে কিছু লম্বা লম্বা ঝাউ গাছের মতো কিছু গাছ দাঁড়িয়ে, এছাড়াও অনেক ফুলের গাছও আছে। সে যেখানে শুয়ে ছিল সেখানে একটা বিশাল গাছ থেকে অনেক পাতা ঝরে প’ড়ে ওর সারা শরীর প্রায় ঢেকে ফেলেছে আর সেই সঙ্গে শুকনো ধুলো ছেয়ে গেছে ওর জামা কাপড়ের ওপর। তা জামা কাপড় বলতে আর কী! প্যান্টুল নিজের গায়ের চাদর, জামা আর প্যান্টের দিকেই দেখল। যা অবস্থা, তাতে নিজেরই নিজেকে চোরছ্যাঁচড় বলে মনে হচ্ছে। চাদরটাকে ভাল ক’রে জড়িয়ে নিয়ে সে সামনের পাঁচিলটা এক লাফে, ডান হাতে ভর দিয়ে টপকে নামল উল্টো দিকে। এদিকে খোলা রাস্তা, বড়সড়, এতেই যে একটা সমস্যা হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্যান্টুল দ্রুত ভাবতে লাগল কী করবে ও’। মাথা ঘুরিয়ে একবার তার কালকে রাতে শোবার জায়গাটা দেখে নিল। কে ব’লতে পারে আবার এই জায়গা রাতে বা দিনে আত্মগোপনের জন্য তার প্রয়োজন হবে না। প্যান্টুল কারও সঙ্গে কথা বলতে গেল না, চাদরটা সারামুখে ঢেকে রেখে চোখ দুটো সামান্য বের করে রেখেছে খালি, তবে ছেঁড়া প্যান্টের জন্য পায়ের দিকে বেশ শীত করছে। এখন সকাল সাতটা বাজেনি, সে একটা চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে উঁকি মেরে দেখে নিল সময়টা। সারা রাস্তায় এখনও কুয়াশা প’ড়ে আছে, বোঝা যাচ্ছে না দূর থেকে কিছু এলে। সে যানবাহন হোক বা মানুষ। হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগল এখন তার পক্ষে কী উপায়! কোথায় যাওয়া সম্ভব, শেল্টার দেবে কে? এই ভেবেই সে একবার ঘুরে তাকিয়েছে, আচমকাই সে দেখল, ভজা! ভজা নির্ঘাত ভজা, নির্ঘাত! ভাবতেই ওর কণ্ঠনালির ভিতরটা শুকিয়ে উঠল, হঠাৎ মন প’ড়ে গেল ঘুম থেকে উঠে এখনও পেচ্ছাপ করা হয়নি, পেটের কাছটাও চাপ লাগল হঠাৎ, এই হয় তার নার্ভাস হয়ে গেলে, অন্যের মতো প্যান্টে মুতে ফেলে না অবশ্য। সে বাঘের বাচ্চা, মনে মনে ভাবে সে। এই ভজাকে একদিন প্যান্টে মুতিয়েছে সে-ই, তাই নয় শুধু, হারামি মঙ্গলকেও, খালি বিভূতিকে কোনওবার হাতের কাছে পায়নি। কিন্তু বাঘের বাচ্চাকেও প্রয়োজনে লুকোতে হয়, সরে যেতে হয় যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে কোনও সময়, এটাই যুদ্ধের নীতি, মদনা ভালই বুঝিয়েছে ও’কে। সে একটু সরে গিয়ে রাস্তার ধারে পেচ্ছাপ ক’রে নিল। এতে হাল্কা হলো পেটের কাছটা আর মনটাও। 

ভজা আছে যখন কাছে পিঠে নিশ্চয় আরও অনেকে আছে। প্যান্টুল দ্রুত ঠিক করল কী করতে হবে। বাঁচতে হবে, বাঁচতে। নাহলে, কোনও কিছু হবে না, কোনও প্রতিশোধ, কোনও মূল্য চুকোতে পারবে না ও’। প্যান্টুল আবার ভাল ক’রে চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে সেখান থেকে সরে গিয়ে দ্রুত কুয়াশার মধ্যে দিয়ে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেই দিকেই হাঁটতে লাগল। এরই মধ্যে কুয়াশা একটু কাটতে আরম্ভ করেছে কিন্তু সে জানে তাতে কোনও সুবিধা তার হবে না। বরং ক্ষতিই হতে পারে। ক’জন আছে ওর সাথে প্যান্টুল জানে না, তাই কে কোন খানে ওঁত পেতে বসে আছে তা কিছু জানা নেই। হাঁটতে হাঁটতেই ওর মাথায় ঘুরতে লাগল, কে? কে ওর খবর দিতে পারে এদের? এত তাড়াতাড়ি কীভাবে জানতে পারতে পারে এরা? মদনাই কি? প্যান্টুলের মাথায় কিছু এলো না। সে আর এসব ভাবতেও চাইল না। হাঁটতে হাঁটতে সে দেখতে পেল সেই জায়গাতেই সে চলে এসেছে যেখান থেকে শুরু করেছিল আজকের দিনটা, অর্থাৎ সেই বাগানটা। সে একই ভাবে টপকে ঢুকল ভিতরে আর পায়ে পায়ে আরও ভিতরে চলে যেতে লাগল। তার জানা নেই ভিতরে কী আছে? এটা কি একটা বড় বাড়ি? দেখে তো মনে হয় না। প্রাসাদের মতো বড়। সে বাগানের ঐ দিকটায় যেতেই দেখতে পেল বেশ কিছু লোক একটা বড় ফটক সেখানে, বেশি কিছু মানুষ এই শীতের সকালেও গায়ে সোয়েটার, জ্যাকেট, মাথায় মাফলার, বাচ্চারা হনুমান টুপি ইত্যাদি জড়িয়ে হাজির হয়েছে গেটের সামনে। বেশিরভাগই অবশ্য কুড়ি বাইশের ছেলেমেয়েরা, দেখলেই বোঝা যায়, স্কুল কলেজে পড়ে। এদের কয়েকটা দল দেখতে পেল প্যান্টুল। কোনও মেলা নাকি? সে খুব সন্তর্পণে সামনের দিকে এলো। তবে এত সন্তর্পণে আসার কোনও কারণ ছিল না কারণ কেউই তার দিকে নজর দিচ্ছে না। তবুও সাবধানতা বশত সে একটা বড় থামের আড়ালে পিঠটা তাদের দিকে করে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ দেখলে ভাবত হয়ত এই খানেই কাজ করে-টরে সে। এদিকটায় সূর্যের আলো সোজা এসে পড়ছে আর সারা জায়গাটা ঝকঝকতকতক করছে একেবারে, ওধারের মতো অপরিষ্কার না। আহ, কতদিন এরকম দিনের শুরু দেখিনি ও’। মনে মনে ভাবল। এমন সময় একটা হালচাল দেখা গেল ভিড়ে, ভিড়টা এগোতে লাগল সামনের দিকে। সে ঝট করে সামনে এসে ভিড়ের দিকে মিশে যাবে কিনা ভাবল। ঠিক তখনই তার নজর প’ড়ল বাগানের ওদিকে একটা মূর্তি উঁকি ঝুঁকি মারছে। কে সে? মনে হলো এখানেই কাজ করে হয়ত। অন্তত হাঁটা চলার ভঙ্গি দেখে কিছু আলাদা বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু সাবধানের মার নেই! কে বলতে পারে এও ভজার সঙ্গে এসেছে কিনা! সে আর কিছুমাত্র না ভেবে, সামনের ভিড়ের দিকে চলে এলো। আসতেই ও’ বুঝতে পারল এখানে এত ভিড় কিসের, সামনের এই অংশটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে একটা বড় গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, এখানে আজকে কোনও পুজো আছে-টাছে নাকি? সে খৃষ্টানদের নিয়মকানুন কিছুই জানে না। এদিক ওদিক সে আরও একবার দেখল, তারপর ভিড়ের সঙ্গে মিশে গেল, বিশাল গেট দিয়ে তখন মানুষ ভিতরে প্রবেশ করছে। 


।।৫।।

গির্জাতেও আজ বিশেষ তদারকি চলছে। সামনের স্কুল প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠান, এই গির্জা তো আর সেই স্কুলের বাইরে না। বলা ভাল, এই গির্জাকে কেন্দ্র করেই এই স্কুলের স্থাপন হয়েছিল একদিন, গির্জার ওপরেই দায়িত্ব থাকত দেখাশোনার, আজ সেই দায়িত্ব যতই না থাক, স্কুলের কাজের সঙ্গে এর স্থান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। স্কুলের কোনও অনুষ্ঠানে এর দায়িত্ব কিছু কম না, অন্তত বেসরকারি ভাবে, বিশেষ করে যে সমস্ত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ এই অনুষ্ঠানে আসবেন তাঁরা নিশ্চয় এই গির্জাতেও আসবেন। সব কিছু প্রস্তুত থাকা চাই।

আব্রাহাম সব দেখে নিলেন। কাজ ভালই চলছে, আর বিশেষ কিছু বাকি নেই। এমনিতেই তাঁর তীক্ষ্ণ নজরের নিচে কোনও কিছুই অবহেলায় থাকে না, তাই কোনও জিনিসই একচুল এদিক থেকে ওদিক হয়নি এতদিনও, আর আজকেও হবে না। তিনি আত্মতুষ্টি অনুভব করলেন না। এটা আত্মগর্বী মানুষদের মানায়। তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করে পেরে খুশি। 

তিনি দরজা ঠেলে ঢুকলেন। 

-‘কেমন আছেন ফাদার?’

-‘ভাল আব্রাহাম। আজ অনেকটা ভাল’।

-‘রাতে ঘুম হয়েছিল কি?’

-‘ঐ যেমন’। 

ফাদার বিছানায় উঠে বসার জন্য আব্রাহামের দিকে তাকালেন। আব্রাহাম তাড়াতাড়ি তাঁর মাথা থেকে ঘাড়ের কাছটায় একটা বালিশ উঁচু করে রেখে তাঁকে সোজা করে বসিয়ে দিলেন। বসতে গিয়ে একটু কাশি হলো ফাদারের। হাঁফ ধরে গেল যেন।

-‘আপনি কি স্কুলের অনুষ্ঠানে যেতে পারবেন, ফাদার? ওরা আপনি গেলে খুবই খুশি হতো।

-‘তোমার কি মনে হয় আমি পারব এই শরীর নিয়ে?’

আব্রাহাম ঠোঁট চিপে মাথা নিচু করলেন।

-‘দুঃখ পেও না। আমি এই জগতে আর বেশি দিনের জন্য নেই। প্রভু আমার জন্য...’।

বিশ্রীভাবে কেশে উঠলেন ফাদার কথাটা শেষ না করেই। তাঁর মুখ থেকে লালা ছিটকে বেরিয়ে এলো। আব্রাহাম তাঁকে তাড়াতাড়ি জল এগিয়ে দিলেন গ্লাসে করে। কাঁচের গ্লাস। ফাদার দেখলেন, আব্রাহামের চোখে জল চলে এসেছে। তিনি তাঁর চোখের দিকে তাকালেন।

-‘তুমি মিথ্যে দুঃখ করছ। তুমি জানো আমি একটুকুও দুঃখী না’।

-‘আমি সেই জন্য দুঃখী না ফাদার। আমি আমার এই হতভাগ্য জীবনের জন্য শোক করছি। আপনি তো আমার সত্যিকরের পিতা, ফাদার তো নামে না। আমাকে এই নতুন জীবন দিয়েছেন, আপনার অনুপস্থিতি আমি কীভাবে...’

-‘তুমি কি প্রস্তুত নও, আব্রাহাম?’

-‘আমি জানি না’।

-‘আমি জানি। তুমি অবশ্যই প্রস্তুত। আমি তোমার জন্য গর্বিত। তোমাকে পেয়ে আমি আমার অন্তরের বিশ্বাসকে আরও বেশি জানতে পেরেছি, আব্রাহাম। আমি কখনও জানতাম না আমাকে ঈশ্বর সেই শক্তি দিয়েছেন যে আমি কাউকে...’

-‘আমার মতো কাউকে সঠিক পথ দেখাতে পারেন ’, আব্রাহাম শেষ করল কথাটা, ‘এ তো সত্য ফাদার, আপনিই আমার রক্ষাকর্তা’। 

-‘একথা বোলো না, রক্ষাকর্তা একজনই, তিনি এসেছিলেন আবার আসবেন। আর কেউ না, কেউ না...’

-‘অবশ্যই, ফাদার’, আব্রাহাম মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।

দুপুর হয়ে গেছে। আব্রাহাম ফাদারের ঘরের ডেস্কের ওপর বসেই তাঁর ভাষণের লিখিত রূপটা শেষ করলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল ফাদারকে দেখানোর, তিনি নিশ্চয় ভুলত্রুটিগুলো শুধরে দিতেন, কিন্তু তিনি মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন, ফাদার ইতিমধ্যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন, তিনি আর তাঁকে ডাকলেন না। এই ঘুম বড় প্রয়োজন তাঁর, অনেক রাতই ফাদার না ঘুমিয়ে কাটান, কালকেও সেরকম একটা রাত ছিল। তিনি কি আবার আগের মতো...? আব্রাহামের মনটা যন্ত্রণায় ভরে গেল, ফাদার ছাড়া এই পৃথিবী তিনি কল্পনাও করতে পারেন না, এই নবজন্ম, নতুন বিশ্বাস সবই তাঁর দয়ায়, প্রভু যীশুর দয়ায়। তিনি নিজে হাত ধরে সব শিখিয়েছেন তাঁকে, তিনি করে তুলেছেন সমাজে বসবাসের উপযোগী, তিনি ছিলেন বলেই শেষ বিচারের জন্য আজ আব্রাহাম প্রস্তুত হতে পারেন। 

‘তোমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে, কারণ মানব পুত্র সেই প্রহরে আসবেন, যখন তুমি তাঁকে প্রত্যাশা করোনি’- লুক। 

আব্রাহাম নিজের লেখা ভাষণটার দিকে একবার ভাল করে দেখলেন। কী দক্ষতায়, কালো কালিতে তিনি লিখেছেন এই ইংরেজি হরফগুলো, অথচ প্রথম যেদিন এখানে এসেছিলেন, তাঁর মনে আছে নিজের মাতৃভাষাও ভাল করে পড়বার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তিনি ফাদারের বিছানার কাছে উঠে গিয়ে বসলেন। ফাদারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ফাদারের চোখ বন্ধ, তিনি ঘুমোচ্ছেন।



।।৬।।

ভরদুপুরে যখন দরজার কড়া নেড়ে কেউ ডাকল, যখন চোখে সদ্য প্রস্ফুটিত পিচুটির কণা নিয়ে, আলু-পোস্ত খেয়ে আধো ঘুমে জর্জরিত মইদুল গিয়ে কাঠের দরজাটা ফাঁক করে দিল, তখন সে ভাবতেই পারেনি চোখের সামনে স্বয়ং আজরাইলকে দেখতে পাবে। সে হিংস্র সাপ দেখেছে এই ভাবে ছিটকে সরে এলো দরজার সামনে থেকে। দ্রুত তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল সে, প্যান্টুল। 

মইদুলের মুখ থেকে কথা বেরচ্ছিল না। তার দিকে তাকিয়ে হিসহিস করে প্যান্টুল বলল, ‘খুব কেত মেরে ঘুমনো হচ্ছে দেখছি, হারামজাদা ভেবেছিস আমি মরে গেছি?’

মইদুল ভয়ে ভয়ে বলল, ‘না প্যান্টুলদা, আমি সত্যি জানতাম না আজকে তোমাকে ছেড়ে দেবে’।

-‘সেই আনন্দেই আছিস বুঝি? ভাবলি জেলেই মরে প’ড়ে থাকব?’

-‘না না, সত্যি আমি জানলে তোমাকে নিতে যেতাম নিশ্চয়’।

কথাটা বলল বটে কিন্তু মইদুল খুব ভাল করে জানে সে জানলেও আর সেটা তারপক্ষে সম্ভব হতো না। মঙ্গলরা নজর রাখছে ওর ওপর, ভজাকে সে নিয়মিত দেখতে পাচ্ছে, ওর বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায় ওরা।

কিন্তু প্যান্টুল তার নিজের দাদার মতো। সেকি পারে ওকে ওর শত্রুদের হাতে তুলে দিতে?

-‘তুমি কি সোজা এখানে এলে?’

-‘হ্যাঁ, বানচোদগুলোকে বিশ্বাস নেই, বাড়ি গেলে রিস্ক হয়ে যেত’।

মইদুল একটা হাঁফ ছাড়ল। বাড়িতে গেলে আর কিছু দেখতে হতো না। দুর্ধর্ষ খুনি, গুন্ডা প্যান্টুলের বাড়ি ব’লে আজ আর কিছু অবশিষ্ট নেই, সব জ্বলে পুড়ে শেষ। তার বউ-ছেলের কোনও খবরও কেউ জানে না ব’লে খবর, তবে জানে মইদুল- বাড়ির পাশের ডোবারই ধারে পোঁতা আছে দুজনেই। সে কীকরে কথাগুলো বলবে ভেবে পেল না। যদি এখনি জানতে পারে প্যান্টুল, ভয়ানক খুনখুনি বেঁধে যাবে, আর তাতে রেহাই পাবে না সে নিজেও। সবাই দলবদল করেছে, তার কি একার দোষ? কার কাছে সাহায্য চাইবে সে? এই গোপন কথা বলাও অসম্ভব।

প্যান্টুলকে সে তার কাছেই রেখে দিল সেদিন। রাতে প্যান্টুল বলল তার বাড়িতে একটা খবর পাঠাতে হবে, তারা কেমন আছে সেটাও জানা দরকার। মইদুল শুনে ঢোঁক গিলল। পরেরদিন সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো মদনা। সেও প্যান্টুলের আরও এক সাগরেদ, ডান হাত। মইদুল তাকে ডেকে পাঠিয়েছে কারণ একা প্যান্টুলকে সামলানোর ক্ষমতা ওর নেই, বিশেষ করে যদি সে জানতে পারে তার পরিবারের সঙ্গে মঙ্গলের দলবল কী করেছে। 

মদনাকে দেখে প্যান্টুল খুশিই হলো। তাহলে পুরনো দলবল ঠিকই আছে, চিন্তার কিছু নেই। ঐ মঙ্গল আর বিভূতি হারামজাদাদের সে দেখে নেবে। তার আগে বাড়িতে কালকেই যাবে সে ঠিক করেছে। তারপর অন্য কাজ। কিন্তু খুব একটা নিশ্চিত হতে এ পারল না মদনার চোখমুখ দেখে।

-‘সেটা ঠিক হবে না দাদা’।

-‘কেন? বাড়িতে যাব না? আমার বাড়িতে কে কী করার ক্ষমতা রাখে?’

-‘তুমি বুঝছ না। দিনকাল আর আগের মতো নেই। আমাদের সব লোক ওদের হয়ে গেছে, ক্ষমতা যার হাতে। বিভূতি এখন এমএলএ হয়েছে, আমাদের কোনও দাম নেই আর’।

-‘সমরেশদা?’

-‘সব শেষ। কোনও ক্ষমতা নেই না, ফেকলু কুত্তা হয়ে গেছে’।

প্যান্টুল দপ করে জ্বলে উঠল। মইদুল প্রমাদ গনল দেখে। কেন এত তাড়াতাড়ি মদনা সব বলতে গেল।

-‘তোরা কি চুড়ি প’ড়ে বসেছিলি নাকি? মঙ্গলের মাথাটা কাটতে পারলি না? যেমন বসিরের মাথাটা কেটেছিলাম আমি?’

মদনা ধীর মস্তিস্কের লোক। সে হুট ক’রে কোনও সিধান্ত নেয় না। সে ধীরে ধীরে বলল, ‘আমাদের আর কোনও ক্ষমতা নেই দাদা, তুমি বুঝছ না, সব ওদের দিকে, আমার আর মইদুলের ওপরেও ওরা নজর রেখেছে, আমরা কেন্নোর মতো বেঁচে আছি, ওদের দয়ায় বলতে পারো, কোনওরকম কিছু দেখলে আমাদের ওপর কোপ পড়বে। হয়ত কালকেই, তুমি এসেছ যদি জানতে পারে, আছো এখানে... যা কিছু করতে পারে ওরা।’

মইদুল কিছু না ব’লে মাথা নিচু ক’রে প্যান্টুলকে আড়চোখে দেখতে লাগল। 

ঠিক হলো রাতেই তারা বেরিয়ে যাবে এখান থেকে, মদনা ভাল ভাবে বুঝিয়েছে প্যান্টুলকে, এখন শেল্টার কোথাও পাওয়া যাবে না। পালাতে হবে তাকে, স্রেফ পালাতে হবে। বাঘের বাচ্চাকেও পালাতে হয় সঠিক সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। এখন সেই সঠিক সময় না। প্যান্টুল এসব অনেক দেখেছে, কিন্তু এই অবস্থায় তার মাথাটাও একটু হলেও গুলিয়ে গেল। এত খারাপ অবস্থায় সে কোনওদিন পড়েনি। সেই ছিল অবিসংবাদিত রাজা এই অঞ্চলের, আর আজ তার রাজত্ব শেষ হয়ে গেল? কোনওদিন সে কি ভাবতেও পেরেছে সমরেশ বাবুও কুত্তার বাচ্চা হয়ে যাবে এই অঞ্চলে? যার নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খেত একদিন? অহহ, পলিটিক্স! এটা যে কী চড়াই-উতরাই জিনিস সে কখনও এভাবে আগে বোঝেনি। 

সেই সন্ধ্যের দিকে খেয়েই সে সারা শরীর চাদরে ঢেকে বেরিয়ে পড়ল। লাল রঙের বেশ মোটা চাদর, শেষ ডিসেম্বরের শীতটা বাগে আনতে পারছে মোটামুটি। সঙ্গে মদন, সে তাকে এই অঞ্চলটা পার ক’রে দেবে। কিছু টাকা আর একটা মেশিন সঙ্গেই আছে, মদনার কাছে ছিল। আসার আগে মইদুল প্রায় পায়ে প’ড়ে ক্ষমা চাইছে ওর কাছে থেকে। ‘প্যান্টুলদা এই দুর্দিনে তোমার কোনও সাহায্য করতে পারলাম না, মাপ কর আমায়’। মালটাকে সে একবার ভজার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, ভজাটা মঙ্গলের চেয়েও ভয়ানক, একেবারে নৃশংস, সেইবারই ওকে বাঁচাবার সময় বেধড়ক দিয়ে হাতের সুখ করেছিল প্যান্টুল, তারপর এই প্রতিশোধ নিল ওরা, রাতের বেলা একের পর এক লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়তে পড়তে শেষে ওকে ষড়যন্ত্র ক’রে জেলে দিল এরা। আগে পুলিশের বাবার ক্ষমতা ছিল ওর কলারে হাত দেয় ! প্যান্টুলের সারা শরীর জ্বলতে লাগল। 

বাইকে ক’রে ওকে নিয়ে যাবার সময় মদনাকে প্যান্টুল বলল, ‘আমার ফ্যামিলিটার কী হবে রে? ওদের তো মেরে শেষ করবে? আমি একবার দেখা করতে চাই। করেই ফিরে আসব। কী বলিস?’

মদনা সংক্ষেপে বলল, ‘না’।

-‘কেন? না মানে?’

-‘দাদা, তুমি বুঝছ না’।

মদনার সঙ্গে ওর তর্ক লেগে গেল যেতে যেতে। মদনাকে একটা থাপ্পড় মারল ও রাগের মাথায়, ‘আমি অর্ডার দেবো না তুই দিবি? এত সাহস তোর? আমি যা বলছি তাই কর’।

মদনা ঠোঁটে হাত দিয়ে দেখল ধারটা কেটে গেছে। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বাইক হাইওয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। সে এই প্রথম খুব সন্তর্পণে এবার আসল কথা খুলে বলল। সে ভেবেছিল এটা শুনে আর বোধহয় প্যান্টুলকে থামানো যাবে না, আজই না ভজা আর মঙ্গলের ডেরায় মেশিন নিয়ে দৌড়য়, কিন্তু দেখল তার বদলে প্যান্টুল ভেঙে পড়ছে, কান্নায় ভেঙে পড়ছে। মদনা অবাক হয়ে গেল। নিজে গুলি খেয়েও যে কাঁদে না সে কিনা...?

মদনা ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাইকে তুলে ছেড়ে দিয়ে এলো কিছু দূরে। দেখল প্যান্টুল অসহায় মানুষের মতো ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে, তারপর মিলিয়ে গেল।

আসলে প্যান্টুলের খুব ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। ঘুম না ক্লান্তি, প্রথমে এতদিনের রাগ, প্রতিশোধের আগুন মাথায় নিয়ে সে জ্বলছিল, তারপর কুত্তার বাচ্চার মতো সে পালিয়ে এলো আর এখন শুনল যে তার গোটা পরিবার...। তাই ভাবনার মতো কোনও কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। মস্তিষ্ক নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল, চোখের আর মনের দুয়েরই বিশ্রাম প্রয়োজন তার। 

রাত শেষ হচ্ছে। সে কোনওমতে আর শরীরটাকে নিয়ে যেতে পারল না টেনে । অচেনা রাস্তা এটা, কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। সে একটা ফুটপাথে শোবার ঝুঁকি নিল না। একটা পাঁচিল ঘেরা বাগান সে দেখতে পেল, পাঁচিল টপকে নামতেই দেখল, একটা বড় বাড়ি মতো, বাগানের একদিকে সে গাছের আড়ালে একটু জিরিয়ে নেবে ভাবল। রাস্তায় কুকুরগুলো খুব চিৎকার করছে। কখন যে চোখ লেগে গেছে সে বুঝতেও পারেনি। 

সেসময় অন্য দিকে যা ঘটলো প্যান্টুল অবশ্য জানতেও পারল না। ফেরার সময় মদনার মাথায় গুলি লাগল, বাইক সুদ্ধু সে ছিটকে পড়ল নর্দমার মধ্যে। মঙ্গল আর ভজা তখন মইদুলের বাড়িতে বসে, বিভূতি সরকারের নির্দেশ যে কী তা আর ব’লে দিতে হয় না।



।।৭।।

আব্রাহাম স্থির চোখে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীকে দেখছেন। তাঁর মাথার সামনেতে টাক পড়া শুরু হয়েছে, চুলের রঙ সাদা কালো মেশানো, পরনের ধুতিপাঞ্জাবী খুব বেশি রকমের শুভ্র। তাঁর গায়ের রঙ বেশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে, অন্তত তাই মনে হলো স্মৃতি থেকে আব্রাহামের। এখন অনুষ্ঠান চলছে তবে তাদের কাজ শেষ, বক্তৃতা-ভাষণ শেষ, স্কুলের সামনে যে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, তার পাশেই স্কুলের একটা ঘরকে ব্যবস্থা করা হয়েছে মন্ত্রীমশায়ের বসার জন্য। তিনি পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন তার পার্টির লোকজন ও স্কুলের শিক্ষকদের। প্রিন্সিপাল আছেন, আব্রাহামও আছেন। মন্ত্রীমশায় এবার ঘুরে দেখবেন এই দুই শতাব্দী প্রাচীন স্কুল। প্রিন্সিপাল তার দায়িত্বে, তিনিই স্কুলটা ঘুরে দেখাবেন, সঙ্গে আব্রাহাম থাকলে তাঁর সুবিধা, তিনি আব্রাহামকে পাশে বসিয়ে রেখেছেন। তারপর গির্জা ঘুরে দেখবার ইচ্ছাও প্রকাশ করলেন মন্ত্রীমশায়, আব্রাহাম সেই দায়িত্বেও থাকবেন।

আব্রাহামের বক্তৃতায় তিনি খুব প্রীত হয়েছেন, মন্ত্রীমশায় জানালেন তাঁকে। আব্রাহাম কিছু না ব’লে মাথা ঝুঁকিয়ে ধন্যবাদ জানালেন এবং বললেন তাঁর বক্তব্যও আব্রাহামের খুব ভাল লেগেছে। দুজনেই এই ঘরে, সোফার ওপর পাশাপাশি বসে আছেন। আব্রাহাম এখন নিজের কথা ভাবছেন, তাঁর সাদা পোশাক ঠিক ফাদারেরই মতো, তাঁর চুল কাঁধ অবধি নেমে এসেছে, চিরকালই তা কিছুটা খয়েরি, এখন তেলহীন হয়ে হয়ে আরও খয়েরি হয়ে গেছে, তাঁর দাড়ির রঙও তেমন কিছুটা কাঁচাপাকা, তাঁর মার্জিত আচরণ, শান্ত, স্থির কথা বলার ধরণ, কিছুরই মিল নেই আগের সাথে, তাঁর গায়ের রঙ ছিল ফরসা কিন্তু এখন তাঁকে বিদেশী ভেবে ভুল হয়, অন্তত তাঁর নাম ও চুলের রঙের সাথে মেলালে মনে হয় তিনি নিশ্চয় এদেশীয় নন। তাঁর গলায় ঝুলছে ফাদারের উপহার দেওয়া সেই সোনালি ক্রুশিফিক্সের লকেট। তাঁর হাতের কাছে একটা রূপোলী, ধাতু নির্মিত বড় ক্রস, যেটা তিনি তাঁর সঙ্গে রেখেছেন আজকে। হাতে ক’রে নিয়ে গিয়েছিলেন মঞ্চে, প্রভুর দূত তিনি এই বোঝাতেই তিনি রেখেছেন সঙ্গে। ক্রসের মাথাগুলো ছুঁচলো, এমনিতেও বেশ ভারী, গলার বসিয়ে দিলে কণ্ঠনালী ছিঁড়ে, ভলভল করে রক্ত বেরিয়ে সব শেষ কয়েক মুহূর্তে। মন্ত্রীমশায় চা খাচ্ছেন। আরও জলখাবারের ব্যবস্থা আছে নিশ্চয়। হাসছেন তিনি, হাসছেন প্রিন্সিপাল, হাসছেন উপস্থিত সকলে, আব্রাহাম মাথা নিচু করে শুনছে, তাঁর মাথায় ঘুরছে সেই শেষ দুটি বাণী প্রভু যীশুর। সেইসঙ্গে মনে পড়ছে, প্রথম যখন দেখলেন এই মন্ত্রীমশায়কে, সেই মুহূর্তটা, নাহ সেটা বর্ণনা করা যাবে না, তিনি নিশ্চিত হবার জন্য মন্ত্রীমশায়ের নাম জিজ্ঞেস করলেন তাঁর সঙ্গে উপস্থিত স্কুলের কমিটির চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ বাবুকে। তিনিই পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর সাথে, ‘ইনি মাননীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী শ্রী বিভূতি সরকার, আর ইনি হলেন...’, মন্ত্রীমশায় হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন তাঁর সঙ্গে। এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলেন আব্রাহাম। হাসি মুখ মন্ত্রীমশায়ের। নির্মল, নিরুদ্বেগ হাসিমুখ। 

আব্রাহাম এইবার হাতের বড় রূপোলী ক্রসটা শক্ত করে ধরলেন। মন্ত্রীমশায় কথা বলছেন, সবাই গদগদ হয়ে আছে তাঁর প্রতি। আব্রাহাম তাঁর চর্বি থলথলে গলার কণ্ঠনালিটা দেখলেন। একসময় বাঁহাতের কাজ ছিল এটা। তাঁর হাতের মুঠো ঘেমে যেতে লাগল, তাঁর সারা শরীর ঘেমে যাচ্ছে, একদিকে তাঁর মনে পড়ছে ফাদারের মুখ, ক্রুশিফিক্সে প্রভু যীশু, অন্যদিকে তাঁর মনে পড়ছে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রের মুখ, তাঁর মনে পড়ছে মঙ্গল, ভজা ও সেই সেদিনের বিভূতি সরকার, তিনি শক্ত করে ক্রসটা ধরলেন হাতের মুঠোয়-

--এখানেই পাঠক ভুল করেন। তাঁরা ভাবেন লেখক সব জানেন, তাঁরা বোঝেন না, লেখকও ঘটনাবলীর সামনে পাঠকের মতই অসহায়। তিনিও জানেন না ঠিক কী হতে পারে। তবে পাঠককে এখানে ধৈর্যের সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নিশ্চয় এই প্যান্টুল, আব্রাহাম, বিভূতি, ভজা, মঙ্গল, মইদুল, মদনা, ফাদার, প্রিন্সিপাল চরিত্রগুলো, এই গল্পের মতই কাল্পনিক কিন্তু কে বলতে পারে এও এক সত্য ঘটনা নয়? তাই পাঠককে আগে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে যেমন দাঁড়াতে হচ্ছে অসহায় লেখককেও।

কী করবেন আব্রাহাম? তাঁর এখনও মনে পড়ছে প্রভুর শেষের দিকের দুটি বাণী যা তাঁর সবচেয়ে প্রিয়, কিন্তু কোনটা তাঁর বেশি প্রিয়? তিনি ভাবছেন, তিনি ভাবছেন, তিনি ভাবছেন।

কে কাকে ক্ষমা করে? কার সাধ্য কতটুকু? এও এক দায় মানবের কাঁধে সেই যে তিনি বলে গেলেন- ‘পিতা, এদের ক্ষমা করো, যেহেতু এরা জানে না এরা কী করছে’।


0 comments: