প্রাচীন কথা - মিথিল ভট্টাচার্য্য
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
পরাহত ভাগ্যনায়ক
মিথিল ভট্টাচার্য্য
মহাভারতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক শ্রীকৃষ্ণকে কোনও দেবতা রূপে না দেখে শুধুমাত্র একজন অসামান্য কূটনীতিবিদ, একজন বিচক্ষণ রাজনীতিক, ও সর্বোপরি একজন দোষ গুণে মেশানো ধূসর চরিত্র রূপে কল্পনা করে একটি কাহিনী লেখার সামান্য প্রচেষ্টা এই রচনা। মহাভারতে কৃষ্ণ এমন একজন চরিত্র যিনি মূল কাহিনীর সঙ্গে থেকেও নেই, না থেকেও ওতপ্রোত ভাবে জুড়ে আছেন। পুরো মহাভারত জুড়ে তাঁর ভুমিকা খুটিয়ে দেখলে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়, কূটনীতির কোন পর্যায়ে কোনও ব্যক্তি যেতে পারেন, প্রত্যক্ষভাবে কিছু না করেও গোটা সমাজ এবং একাধিক রাজ্যের রাজনীতিকে কীভাবে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন সেটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। এই অসামান্য কূটনীতিবিদের সঙ্গে বিশ্বের ইতিহাসে অপর দুই কূটনীতিবিদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।তাঁরা হলেন চাণক্য ও বিসমার্ক। এই দুই ব্যক্তিও নিজেদের অঙ্গুলিহেলনে তৎকালীন সময়কে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু এদের অন্তিম পরিণাম কী? দুজনেরই প্রায় এক। শেষ জীবনে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ নির্বাসন এবং একাকীত্বকে সঙ্গী করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা। আর কৃষ্ণের অন্তিম সময় এগিয়ে এসেছে কুরুমাতা গান্ধারীর অভিশাপে। কিন্তু এই অভিশাপ কি সত্যি অভিশাপ? নাকি এর পেছনেও লুকিয়ে রয়েছে এক অজানা ইতিহাস? এই প্রশ্নগুলিকে মাথায় রেখেই এই পরাহত ভাগ্যনায়কের জীবনের কাহিনী রচনার দুঃসাহসিক প্রয়াস।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ছত্রিশ বছর অতিবাহিত। জীবনের এই নতুন অধ্যায়ে আর্যাবর্তের রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে দ্বারকার রাজপ্রাসাদের নিস্তরঙ্গ জীবনের এই নতুন পর্বে এসে ফেলে আসা অতীতকে যেন আরও একবার নতুন করে ফিরে দেখতে চাইছেন দ্বারকাধিপতি আর্যাবর্ত নিয়ন্ত্রক শ্রীকৃষ্ণ। অবশেষে বার্ধক্যের ছায়া যেন তার উপরও নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে, শারীরিক এবং তার থেকেও বেশি মানসিক ভাবে। দ্বারকার রাজপ্রাসাদের অলিন্দ থেকে বাইরের ভূমির দিকে তাকালেন শ্রীকৃষ্ণ। সময় সরণী বেয়ে যেন ফেলে আসা অতীতের পথে ছুটে যেতে চাইছে তাঁর মন। দ্বারকার সমুদ্র অদৃশ্য হয়ে তাঁর চোখের সামনে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠলো কুরুক্ষেত্রের সেই রক্তাক্ত প্রান্তর। আর কেউ যদি নাও জানে তিনি নিজে তো জানেন যে এই মহাসংগ্রামের ঋত্বিক ছিলেন তিনি স্বয়ং। তাঁর নিজের স্বপ্নকে বাস্তবের রূপ দিতে এক ভয়ঙ্কর রাজনীতির খেলা তাঁকে খেলতে হয়েছিল। সবার অজান্তে কত মানুষকে যে তিনি দিনের পর দিন ব্যবহার করে গেছেন তার হিসেব বোধ করি আজ তাঁর নিজের হাতেও নেই। জগত সংসারের সবার কাছ থেকে নিজের প্রকৃত পরিকল্পনা সযত্নে লুকিয়ে রাখতে হয়েছে তাঁকে সারা জীবন ধরে। কেউ জানতে পারেনি তাঁর প্রকৃত অভিপ্রায়। না, ভুল হলো। শুধু একজন, শুধু মাত্র একজন ব্যক্তি তাঁর প্রতিটি পরিকল্পনা, প্রতি অভিপ্রায়ের নির্ভুল প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছিলেন তাঁর সামনে। এমন একজন যাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা চিরকাল অদৃশ্য ছিল সবার কাছে। এমন একজন যাঁর নিজের ত্যাগ তাঁকে সমাজের কাছে একটি শ্রদ্ধা মিশ্রিত করুণার স্থান প্রদান করেছিল। কেউ কোনওদিন তাঁর বিচক্ষণতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে গুরুত্ব প্রদান করেনি, তাঁর সুপরামর্শে কর্ণপাত করেনি। শ্রীকৃষ্ণ স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন এই মহান ব্যক্তিত্বের কাছে এসে, এবং বোধ করি জীবনে প্রথমবার ভয় পেয়েছিলেন তিনি। ভয় পেয়েছিলেন সেই সত্য স্বীকার করতে যা তিনি নিজের কাছ থেকেও অতি সন্তর্পণে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেই সত্যদর্শী ব্যক্তিত্ব, শতপুত্রবতী অথচ পুত্রহীনা, তেজস্বিনী অথচ সংসার নিস্পৃহা কুরুমাতা দেবী গান্ধারীর প্রতিটি বাক্য যেন আজও শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতিপটে অঙ্কিত হয়ে আছে - “তুমি সকলকে প্রতারিত করতে পার কেশব, কিন্তু নিজেকে কিভাবে করবে? যে রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে তুমি আর্যাবর্তের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলে, আজ আর্যাবর্তে সেই আদর্শের স্থান কোথায়? আর্যাবর্তের কথা না হয় বাদ দাও, তোমার জীবনেও সেই আদর্শের আজ স্থান কি সত্যি রয়ে গেছে? জীবনের যে পথে তুমি যাত্রা শুরু করেছিলে একবারও ভেবে দেখেছ সেই পথ থেকে আজ কতটা বিচ্যুত তুমি?” আজও কথাগুলি যেন তাড়া করে বেড়ায় শ্রীকৃষ্ণকে। সত্যিই কি তিনি জীবন পথের যাত্রায় নিজের মূল মন্ত্র থেকে এতটাই দূরে সরে এসেছেন? এই মহাযুদ্ধ তিনি চেয়েছিলেন সত্যি, কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থে তো চাননি, চেয়েছিলেন যুগান্তর আনতে। তবে আজ সেই যুগান্তর কোথায়? নিজের ফেলে আসা সময়ে যেন আরও একবার হারিয়ে যেতে চান আর্যাবর্তের প্রকৃত অধীশ্বর। একটু একটু করে সময়ের বিপরীত স্রোতে তিনি হারিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর জীবনে আসা প্রতিটি চরিত্রকে তিনি যেন আরও একবার নতুন করে খুঁজে পাচ্ছেন, দেখছেন তাদের প্রস্থান এবং আগমন। আজ এই প্রৌঢ়ত্বের শেষ ধাপ থেকে যেন কালের বিপরীত উজানে তিনি ফিরে যাচ্ছেন যৌবনে ,সেখান থেকে আরো সুদূরের ফেলে আশা অতীতে, তাঁর বৃন্দাবনের কৈশোরের সেই মধুর রঙিন দিনগুলিতে। ওই তো মা যশোদা স্নেহে ভরা কৃত্রিম বকুনি দিয়ে ডাকছেন তাঁকে, “কৃষ্ণ হতভাগা গেছিলি কোথায়? সারাদিন ছেলের কোনও সারা অব্দি নেই, কোথায় টো টো করে ঘুরছিলি দস্যি?” বৃন্দাবনের সেই দিনগুলি আজও তাঁর জীবনের সব থেকে মধুর সময় হয়ে আছে। কোনও চিন্তা নেই, নেই কোনো দায়িত্বের ভার। এক সামান্য গোয়ালা সর্দারের দুর্দান্ত ডানপিটে ছেলে তার বন্ধুদের নিয়ে সারাদিন ধরে গোটা বৃন্দাবন যেন দাপিয়ে বেড়াত। নিজের অজান্তেই নিজের সমস্ত বন্ধুদের দলপতি বনে গেছিলেন যেন কীভাবে। জীবনের সেই একমাত্র উন্মুক্ত সময়। দস্যিপনার বোধ করি কোনও সীমা পরিসীমা ছিলনা। আর সেই দস্যিপনার আড়ালেই গোটা বৃন্দাবনবাসীর মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, এরই সঙ্গে এসেছিল একের পর এক গুপ্তঘাতকের আক্রমণ। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর সেদিন তাঁর জানা ছিলনা। কিন্তু, সেই অজ্ঞতা তাঁকে রোধ করেনি এই চোরাগোপ্তা আক্রমণ থেকে বাঁচতে। আর সেই বাঁচার প্রচেষ্টা বোধ করি নিজের অজান্তেই তাঁকে শিক্ষিত করেছিল জীবনের সবথেকে মূল্যবান মন্ত্রে, “জীবন সংগ্রামে বিজয়ী হতে গেলে ভাবাবেগকে দূরে সরিয়ে দিয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে মস্তিষ্ককে, যেখানে শক্তি দিয়ে জয় অসম্ভব, সেখানে জয় পেতে গেলে ব্যবহার করতে হবে কৌশলকে।” আর এই মন্ত্রই তাঁর পরবর্তী জীবনে হয়ে উঠেছিল সবথেকে বড় অবলম্বন। কিন্তু আর্যাবর্তের ভবিষ্যৎ ভাগ্যবিধাতা তাঁর জীবনের প্রথম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন এই সময়েই। জীবনে প্রথমবার নিজের বুদ্ধিমত্তা ও নেতৃত্ব শক্তিকে অনুভব করতে পেরেছিল সেই কিশোর। আজও যেন সেই ঘটনার স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব যেন দেখতে পান তিনি। দীর্ঘ দিন ধরে বৃন্দাবনের বুকে চলেছিল এক অনাবৃষ্টির কোপ। সেই অনাবৃষ্টির অভিশাপ কাটাতে কী না করা হয়েছিল, পূজা- অর্চনা, যজ্ঞ- সবকিছু। আর তারপর সেই অভিশাপ আরও বড় সর্বনাশ হয়ে যেন ফিরে এসেছিল সেই অসহায় মানুষগুলির জীবনে। অনাবৃষ্টির অভিশাপের থেকেও শতগুণে ভয়ঙ্কর হয়ে ধ্বংসের রূপ নিয়েছিল প্রবল বর্ষণ। সেদিন দিশেহারা হয়ে পড়া মানুষগুলোর দায়িত্ব নিজের অজান্তেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল সেই সুকুমার কিশোর।সমস্ত বৃন্দাবন খুঁজে অবশেষে গোবর্ধন পাহাড়ের নিরাপদ গুহাগুলোতে প্রতিটি অসহায় মানুষকে পৌঁছে দিতে পেরেছিল সে। তার জীবনের সেই প্রথম বিজয়ের দিন। এক চোদ্দো বছরের কিশোর নিজের বুদ্ধিমত্তা ও বিচার শক্তিতে সেই দিন গোটা বৃন্দাবনের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর্যাবর্তের ভাগ্যবিধাতা হওয়ার পথে নিজের অজান্তেই সেই দিন প্রথম পা ফেলেছিল সেই সদা চঞ্চল দুরন্ত কিশোর। বৃন্দাবনের সেই দামাল কিশোর সেই দিন থেকেই গোটা বৃন্দাবনের সমস্ত মানুষের ভালবাসার সঙ্গে প্রথমবার শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমও যেন নিজের অধিকারে জয় করে নিয়েছিল। আর এইসবের মাঝে দূর থেকে নিঃশব্দে এসে তার পাশে দাঁড়াত কোনও এক অনাম্নী অঙ্গনা, কোনও দাবি ছাড়াই হৃদয়ের টানে বাঁধা পড়েছিল সেদিন দুটি প্রাণ। সেই রঙিন দিনগুলি মনে পড়লে আজও, এই আসন্ন বার্ধক্যেও, এক মধুর স্মৃতিতে হারিয়ে যায় তাঁর মন। কিন্তু সমস্ত স্বপ্নেরই একটা সময় আসে অবসানের পালা। তাঁর জীবনেও বৃন্দাবনের এই লীলাচপল দিনগুলির অবসানের মর্মান্তিক বার্তা নিয়ে আগমন ঘটেছিল এক অবাঞ্ছিত আগন্তুকের।
(ক্রমশ)
0 comments: