1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - চয়ন

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


বইপত্র
চয়ন



১৯৯৭ সালের কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তমেকমেলা। প্রথম দিন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে পশ্চিমি তত্ত্ববিশ্বের এক আরাধ্য দেবতা -- জাক্ দেরিদা। তাঁর ভাষণের শেষে দেরিদা বললেন : "ভদ্রমহিলা ওমহোদয়গণ, প্লেনে আসতে আসতে মনের চোখে যে ছবি দেখেছি তার কথা আপনাদের জানাতে চাই। আমি দেখলাম বই প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে। পৃথিবীতে তার যেন আজ স্থান নেই। পালিয়ে এসে সেআশ্রয় নিল এই মেলায়।" ঠিক কী বলতে চাইছিলেন অবিনির্মাণ তত্বের প্রাণপুরুষ? তিনি বলতে চাইছিলেন যে কাগজে গড়া বস্তুটা আমরা হাতে ধরি সেটা আসল বই নয়। জড় পৃষ্ঠায় অক্ষরের শিকলপড়া বন্দী শব্দ আসলে মৃতকল্প। এই কথা গ্যেটে বলিয়েছিলেন তাঁর ফাউস্টকে দিয়ে : "The word expires, in passing to the pen/And wax and sheepskin lord it over men." রবীন্দ্রনাথওদেখেছিলেন যে মানবাত্মার অমর আলোক, কালো অক্ষরের শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় কাগজের কারাগারে বন্দী। তাহলে, কোথায় সেই মুক্ত শব্দ, আনন্দোচ্ছ্বল প্রকৃত গ্রন্থ? পাঠকের চেতনায়। তারস্বচ্ছন্দবিহারী মগ্ন পাঠের আনন্দে। একথা অনস্বীকার্য যে অবয়বধারী জড়গ্রন্থও পাঠকের কাছে এক সুখানুভূতি বয়ে আনে। নতুন বইয়ের গন্ধ, তার স্পর্শ পাঠককে এক প্রকার শৃঙ্গার সুখ দেয়। কিন্তুবই পাঠককে যে ব্রহ্মস্বাদ সহোদরতুল্য পরমানন্দ দান করে তার অধিষ্ঠান নানা অনুশীলনের ফলে স্ফটিক স্বচ্ছ, সুনির্মল মনের অধিকারী সহৃদয় পাঠকের চিত্তলোকে। দেরিদা বলতে চেয়েছিলেন, কলকাতার বইমেলায় রসিক পাঠকদের সমাবেশ তাঁকে আশ্বস্ত করছে যে এঁদের মননে বই সঠিক আশ্রয় ও স্ফূর্তি লাভ করবে। সারা পৃথিবীর ক্রমহ্রাসমান পাঠাভ্যাস তাঁকে শঙ্কিত করেছিল বইয়েরপরমায়ু নিয়ে।

২০১৭ সালের কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা। প্রথমদিন। নানান স্বাদের, নানান বর্ণ-গন্ধের নতুন নতুন বইয়ের সম্ভার নিয়ে ৩৩৩ নম্বর স্টলে উপস্থিত ঋতবাক পাবলিকেশন। সঙ্গে রয়েছেঋতবাকের মুদ্রিত সংস্করণ -- দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা। আর, তার মনে একবিন্দু শঙ্কা বা সংশয় নেই। কারণ, মনের চোখে সেও দেখছে এক ছবি। সে দেখছে :

"অগ্নির্ ভূম্যাম্ ওষধীষু --
অগ্নিম্ অপো বিভ্রতি অগ্নির্ অশ্মসু।
অগ্নির্ অন্তঃ পুরুবেষু
গোষু --অশ্বেষু -- অগ্নয়ঃ।।"

"মাটিতে আগুন, আগুন গাছে লতায়,
পাথরে পাথরে আগুন, আগুন জ্বলে।
গোরুতে ঘোড়াতে আগুন আগুন আগুন
প্রতি মানুষের গভীরে আগুন জ্বলে" (অনুবাদ : গৌরী ধর্মপাল)।

প্রতি গ্রন্থকারের আত্মভাষা -- যা তিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর মাতৃভাষার ধ্বনি স্রোত থেকে আজন্ম তিলে তিলে চয়ন করে--হলো বিশ্বভাষা পরাবাকের ঘুমন্ত বীজ। সৃজনের প্রচণ্ড উত্তাপে সেই বীজথেকে বার হয়ে আসছে এক 'নিত্যস্তোত্র বনস্পতি' (শব্দঝণ : গৌরী ধর্মপাল), এক অগ্নিগর্ভ বাণীর প্লাবন : বাক্। যা ছিল কেবল একজনের সাধারণী ভাষা, সেই উত্তাপ তাকে ভেঙে, চুরে, গলিয়ে, বিশ্লিষ্ট করে তাকে করে তুলছে অবন্ধনা। অক্ষরশৃঙ্খল ভেঙে জন্ম নিচ্ছে চির অধরা, চিরনবীনা, ধ্বনিময়ী, অদিতি রূপিণী ভাষা। ঋতবাক জানে, তার ঋতব্রতী আত্মজনদের সঙ্গে তার দেখা হবে এইমিলনমেলায়। তাঁদের হৃদমুকুরেই বিম্বিত হয় গ্রন্থের ভাবময়রূপ। যার দেখা দুইদশক আগে এখানেই পেয়েছিলেন পাশ্চাত্যের প্রাজ্ঞপুরুষ।

ঋতবাক ঋত এবং বাক্ উভয়কেই তার যাপনের অংশ করতে চায়। ঋগ্ বেদের দশম মণ্ডলের জ্ঞানসুক্তে উল্লিখিত হয়েছে বাক্ এর উৎপত্তি আর তার অপরিহার্যতা। হৃদয়ের গহনে সঞ্চিত ছিলউৎকৃষ্ট ও অমলিন জ্ঞান। ছাঁকনির সাহায্যে শক্তুকে ছাঁকবার মতন করে সেই জ্ঞানকে ধীমান ব্যক্তিবর্গ সযত্নে বার করে আনলেন বাক্ এর সাহায্যে। বাক্ ভাষা দিল জ্ঞানকে। কিন্তু, এই বাক্ এরঅধিকারীভেদ আছে। ভাষা ব্যবহার ক'রে সবাই। কিন্ত, মুষ্টিমেয় কতিপয় ভাগ্যবানের সম্মুখে বাক্ স্বেচ্ছায় স্বপ্রকাশ হন ।এই বাক্ এরই সাধনা ঋতবাকের। এবং, সে ঋতকেও অর্চনা করে।

যে সঙ্গতি, সামঞ্জস্য আর সুশৃঙ্খলা মেনে চলে বহির্বিশ্ব ও যে ন্যায়বোধ, নীতিবোধ দ্বারা নির্ধারিত হয় অন্তর্বিশ্ব তারই নাম ঋত।


ঋতবাকের ধর্ম তবে বাক্ এর সহায়তায় ঋতকে প্রকাশ। এই তার সাধনা। এই সাধনায় সে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে বহু ঋতব্রতীকে। সেই সব সমমর্মী, সমধর্মী সুহৃদদের সাথী ক'রে ঋতবাক পেতে চায়সেই ব্যপ্ত চেতনাকে যা সমস্ত সৃজনকে আবৃত ক'রে রয়েছে; যাত্রা করতে চায় সেই সিদ্ধলোকের উদ্দেশ্যে যেখানে বাণীর ধারা হৃদয়সমুদ্র থেকে সতত উৎসারিত হয়ে ব্যক্তি মানবের মননকে উর্বরাকরে। যে বোধ চেতনার 'সহিত' সম্পৃক্ত হয়ে বাক্ এর প্রসাদে সৎ সাহিত্যে প্রকাশলাভ করে কল্প, প্রকল্প, অণুকল্পে তাকেই অবয়ব দিতে প্রয়াসী ঋতবাক মুদ্রণ সংখ্যা। 

এর সঙ্গেই ঋতবাক কিছু স্বপ্নকে কায়া দানের প্রয়াসী। বস্তুত, এই প্রচেষ্টার আরম্ভ গতবছর থেকেই।



২০১৬ ২৫শে জানুয়ারী, আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হয় নন্দিনী সেনগুপ্তের অসাধারণ কবিতাসংকলন ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’। ঋতবাকের ব্যবস্থাপনায় নির্মিত প্রথম গ্রন্থ। ভূতত্ত্ববিদ নন্দিনীরও প্রথম মুদ্রিত সাহিত্যগ্রন্থ ছিল সেটি।

ভূতাত্ত্বিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রত্যাশিত ভাবেই আদ্যন্ত প্রকৃতির সুবাসে সুরভিত। তিনপর্বে বিভক্ত গ্রন্থের প্রথম পর্বে অরণ্য, দ্বিতীয় পর্বে মেঘ-জল-নদী মনকে আবিল করে তুললেও তৃতীয় তথা শেষপর্বে কবি ছুঁয়ে গেছেন সেই প্রকৃতিরই সন্তান, ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রমী সর্বকালীন ছিন্নমূল মানুষের মর্মস্পর্শী অন্তরবেদনা... সামগ্রিকভাবে যা একজন মননশীল কাব্যপাঠকের সচেতন কাব্যতৃষ্ণাকে চূড়ান্তভাবে তৃপ্ত করে নিঃসন্দেহে। এককথায়, নন্দিনী সেনগুপ্তর 'অরণ্যমেঘবন্ধুর দল' একাধারে প্রকৃতিপ্রেমী ও সমাজসচেতন কাব্যরস-পিপাসু পাঠকের সংগ্রহে স্থান পাওয়ার দাবী রাখে প্রশ্নাতীত ভাবেই।

এবছর ঋতবাকের প্রচেষ্টা আরও সুশৃঙ্খল, আরও ব্যাপক তার কর্মযজ্ঞ। মোট চোদ্দটি গ্রন্থ নিয়ে প্রকাশনাজগতে পদার্পণ করেছে ঋতবাক পাবলিকেশন।

বেশী কিছু তো নয় মাত্র একটু রুটির স্বপ্ন। বেশীদূর নয় অল্প কয়েক
পা হাঁটা। বেশীক্ষণ নয় কয়েকটি খণ্ড মুহূর্ত। এর মধ্যেই হিমবাহী রাতের ঘরে নীলচে নদীর ষড়জ থেকে নিষাদ ছোঁয়া রাগমালিকা।পথের বাঁকে নদীর সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন চেনা ছায়া, চেনা হাওয়ায় ভরসা যাপন 'মুহূর্ত রাগ'এর। কলিঙ বেলে বৃষ্টি নামে, কাঙাল শরীর দুচোখ বুজে পুড়তে থাকে তবু প্রেম থাকে অপ্রেম থেকেদূরেই। চিত্রকল্পে, ব্যঞ্জনায়, ধ্বনিতে ও কবিতার যাদুতে মুহূর্তকে অনন্ত করে। যাদুকরের নাম মৈনাক সেনগুপ্ত।

বিবি বসুর 'মনগহন' নাগরিক মনের গহনে সন্ধানী আলোক রশ্মি ফেলে দেখে নিতে চায় তার অবক্ষয়িত রূপ। সম্পর্কের নানা রঙ, ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপের কালের বিবিধ কৃত্রিমতা, আত্মপ্রবঞ্চনা, ইংরিজি ভাষা নিয়ে কাঙালপনা ---মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের নানা পরিচিত অনুষঙ্গকে নিরিখ করে কথক কন্ঠস্বর। মনগহনের মূল শক্তি তার সরস নির্মোহতা। এক বিদগ্ধ নিরাসক্তি নিয়ে কথনপ্রবাহবয়ে চলে কাহিনী থেকে কাহিনীতে। আশা, আশাভঙ্গ, যাপনের নানান জটিলতা -- এই সব কিছুকে খণ্ড খণ্ড স্ফটিকের মতো সত্যদৃষ্টির আলোর সামনে ধরে 'মনগহন'। ঠিকরে যায় নানাবর্ণের দ্যুতি।


স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দারের 'ওরে মন তোর বিজনে' মনকথার সংকলন। গদ্য ও পদ্যের কৃত্রিম ভেদাভেদকে অস্বীকার ক'রে এই বইটিতে সংকলিত রচনাগুলি কথন প্রবাহের ধারাকে স্মৃতিরেশেরঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে নিয়ে চলে। কখনও রোদ, কখনও ছায়া, কখনও বা রসের ধারাবর্ষণ লেখিকার কথনবিশ্বে। বিজনে ব'সে সৃজনশীল মন যেন শুনতে পায় পরমসুন্দরের চরণধ্বনি। প্রগাঢ়জীবনবোধ, সত্য-শিব- সুন্দরের কাছে ভক্তিপ্রণত আত্মনিবেদন রচনাগুলির মধ্যে ভাবগত ঐক্যসাধন করে। রচয়িতার জীবনদর্শন, তাঁর আঁতের কথা, তাঁর মনন সব মিলিয়ে এ বই রচনার মধ্যে একজীবনমায়ার বিস্তার ঘটায়। স্বাধীন সঙ্গীতের মতো।


চয়নের 'বইঘর' এক সংলাপ। বই এবং পাঠকের সংলাপ। তাঁর বইঘরে লেখকের আলাপচারিতা পাঠকের সঙ্গে। যে আলোটুকু এসে পড়েছে এই দু'মলাটে তাতে বোঝা যায় এই কথন অন্ধকারের মধ্যেআলোর সন্ধান। আত্মদীপ হওয়ার প্রয়াস। সাহিত্যের ক্ষেত্রে শ্রেণীবিভাজন মানে না চয়নের বইঘর।শিশু,কিশোর কিংবা প্রাপ্তমনস্কতায় তার সাবলীল গতায়াত।যাতায়াত ভাষা থেকে ভাষায়,দেশ থেকেবিদেশের সাহিত্যে।কিন্তু তা কোথাও দুর্বহ নয়,সাবলীল গদ্যভাবনায়,গল্প বলার মুন্সিয়ানায় তা জটিলতা উত্তীর্ণ।জ্ঞান আছে,বোধ আছে।চেনা সাহিত্যকে আরো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার আনন্দআছে। এই আনন্দই পঠনের মূল কথা। আনন্দধারা চারিয়ে যায় পঠন থেকে মননে; মনন থেকে যাপনে। বইঘর তার সামগ্রিকতায় এক যাপন আলেখ্য রচনা করে।

ত্রিওলের জন্ম মধ্যযুগের ফ্রান্সে। ইংরিজি ভাষায় এর প্রথম ব্যবহার
হয় ত্রয়োদশ শতকে। কিন্তু, তার পরের শতকগুলিতে এ কবিতা তেমনভাবে জনপ্রিয় হয়নি। রবার্ট ব্রিজেসের হাত ধরে ত্রিওলেআবার ইঙ্গভাষায় ফেরে ঊনবিংশ শতকে। জনপ্রিয়তাও অর্জন করে। টমাস হার্ডি প্রমুখ অনেকেই এর ব্যবহার করেন। তবে, এ জনপ্রিয়তাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

ত্রিওলে প্রধানতঃ আয়ামবিক টেট্রামিটারে লেখা আট লাইনের কবিতা। এতে প্রথম, চতুর্থ আর সপ্তম লাইন হুবহু এক এবং দ্বিতীয় আর শেষ লাইনও তাই। ত্রিওলে লেখা রীতিমত আয়াসসাধ্য আরসেইকারণেই বোধহয় তার তার তেমন প্রচার হয়নি। 
বাংলা ভাষায় প্রথম বিশুদ্ধ ত্রিওলে সংকলন পল্লববরন পালের অসাধারণ কাব্যগুণসমৃদ্ধ 'ত্রিওলে ৫০' দুই মলাটের মধ্যে ধরে রাখা আজকের ইতিহাস, আগামীর প্রতিস্পর্ধা।



আমেরিকান কবি বুকাওস্কির কবিতা অনুসৃষ্টিকার শুভঙ্কর দাশ আগেও অনুবাদ করেছেন। প্রথম কুড়িটা কবিতা নিয়ে গ্রাফিত্তি থেকে একটা ছোটো বই বেরিয়েছিল। তার সঙ্গে পরে আরওতিরিশটা কবিতা জুড়ে ভাষালিপি থেকে বেরোয় ‘চার্লস বুকাওস্কির কবিতা’। এই কবিতাগুলো নতুন। দৈবাৎ তাঁর হাতে আসে একটা বই। ‘বুকাওস্কি ব্যাক টু দা মেশিনগান-১’। বইটা বার করেছেনপৃথিবীর কয়েকজন বুকাওস্কি ভক্ত মিলে। একটি আন্ডারগ্রাউন্ড প্রকাশনা। কারণ, প্রকাশকের নামধাম ঠিকানা ওতে কিছুই নেই। ওঁরা কেন এটা করলেন? কারণ তাঁরা দেখছিলেন ১৯৯৪এ বুকাওস্কিরমৃত্যুর পর বড় বড় প্রকাশকরা বুকাওস্কির লেখা কাটা ছেঁড়া করে নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে তা সম্পাদনা করে প্রকাশ করছেন। ম্যানুস্ক্রিপ্টের সাথে মেলালে যা অনেকটাই আলাদা। বুকাওস্কিরলেখার ধার কমিয়ে করা হয়েছে মোলায়েম। তাই তাঁরা সরাসরি ম্যানুস্ক্রিপ্টের সাথে মিলিয়ে তাঁর রচনা প্রকাশে সচেষ্ট হয়েছেন। যদিও এর জন্য তাদের কারাবাস পর্যন্ত ঘটতে পারে। ওই বইয়ের প্রথমখণ্ড থেকে এই অনুবাদগুলো। আসলে রূপান্তরশিল্পীর কিছু করার ছিলনা ওই প্রতিবাদে গলা মেলানো ছাড়া। তাঁর এই প্রতিবাদের নাম 'অসম্পাদিত চার্লস বুকাওস্কি'।



বিষাদ ও বিপণ্ণতার মধ্যের ফারাক ও মিল দুই মলাটের মধ্যে ধরে রাখার প্রয়াস সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য্যের 'অনন্ত পাথর সরিয়ে'। শব্দের অলজ্জ নগ্নরূপ দেখতে চেয়ে এক বিমূর্ত র অপারগতায় আর্ত এইলিপিবন্ধন। মননঋদ্ধ রচনা শৈলীর বন্ধন মুক্তির চিরায়ত প্রচেষ্টায় দীর্ঘ কয়েক বছর পর প্রস্তর প্রাচীর ভেঙে মুক্ত হলো কবির প্রতিবিম্ব। শরীরি রূপ নিল স্বপ্ন।


আত্মবিলুপ্তি নয় আধুনিক কবিতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত কবির নিজস্ব সত্তা। এই কবিতা বিশ্বাস করে কবিতা কোনও একমাত্রিক অর্থ বহন করে না; সে 'হয়ে উঠতে' থাকে কবির ক্রমপরিণতির সঙ্গেসঙ্গে। কবির সঙ্গে জায়মান কবিতার বিবর্তন ঘটে। তাই, বিকচমান প্রাতিস্বিকতার হদিশ যে কবিতায়, তাই আধুনিক কবিতা।

এই যুক্তিতেই অনুপম দত্তের 'পাপোশে রাখি আর্তনাদ' একটি আধুনিক কবিতার সংকলন। অনুপমের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হ'ল তিনি বহিঃ প্রকৃতিকে আত্মপ্রকৃতি দ্বারা অনুবিদ্ধ করেন। তাই,পাপোশে জমে দ্বিধা দ্বন্দ্বের ধুলো, ভাঙা কাপ বাতিল হওয়ার মানে জানে, শরতের আকাশে ভাসে ষড়যন্ত্রের মেঘ এবং চতুর কড়িকাঠ সুযোগ খোঁজে। যে আর্ত বিপন্নতায় দড়ি হাতে অশথের কাছেএকা একা যেতে হয় সেই একই বিপন্নতা অনুপমের কবিতার। বরং তা আরও তীব্র। কারণ, অশথের শাখা অন্তত প্রতিবাদ করেছিল; এই কবির চেতনা ইতিহাসের পাঠ নেয় ক্ষতচিহ্নের কাছ থেকে।ত্রস্ত, চকিত নাগরিক অস্তিত্ব হাসির নীচে দেখে ত্রাস। যে সময়ে কবির বাস সে সময় সত্যিই কোনও আশ্বাস আপাতভাবে বহন করে না। সেই কারণেই, "অন্ধকার মাঠে লুকিয়ে আছে জলরঙেরখড়কে ডুরে" এবং হয়তো যে এ শাড়ি পরেছিল তার লাশও।


সাফল্য নয় স্বপ্ন ধার্য ক'রে মানুষের দাম...স্মরণে সাক্ষাৎ, বিস্মরণে মুক্তি...সখ্যতা অস্তিত্বের অর্থ ...
১৯২৬ এ 'স্যাণ্ড অ্যাণ্ড ফোমে' এরকম কিছু শব্দের কুসুমমালা জীবনের কন্ঠে পরিয়েছিলেন খলিল জিব্রান। সব্যসাচী ভট্টাচার্য্যের 'গহন কুসুম' সেই মালা থেকে খসে পড়া কিছু ফুলদলের ডালি।



পার্থ দেবের 'একলা একায়' বইটিতে কবি একলা বসে কবিতাকে ভালোবাসার গল্প শোনান। খাতার সাদা পাতারা আদর করতে বলে, পুরনো আঁচড়গুলো এক তুমিকে ছুঁয়ে কবিতা হয়। ঝরাপাতাশুনিয়ে চলে সম্পর্কের নানারূপের গল্প। কবির মগ্নচেতনা এই চিহ্নময় মরজগৎ থেকেই প্রতীক খুঁজে নিয়ে যাপনকে কবিতা করে তোলেন।


সরিৎ চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'দিলনাজ' সুরের বাঁধনে প্রাণের বাঁধা পড়ার গীতিময় কাহিনী। বেহালা বাদিকা রাইমা, সঙ্গীত শিল্পী দিলনাজ এবং সারেঙ্গী বাদক সিরাজের ভিন্ন ভিন্ন জীবনচর্যা এক হয়েযায় ঠুমরির তসিরে, তিলক কামোদ, ছায়ানট, আহির ভঁয়রোর মায়াবী বুনোটে। কল্লোলিনী বরুণার প্রাণ মিশতে চায় সুরসাগরে।



সুবল দত্তের 'নিঃসঙ্গতা তার' নির্বাচিত প্রবন্ধের সংকলন। এক অভিনব বিশ্লেষণী শৈলীতে মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যাগুলিকে পুরোভূমিতে স্থাপন করে গ্রন্থের বিভিন্ন রচনায় লেখক বিভিন্ন মানবিক ও সাময়িক ঘটনা পরম্পরাকে নতুন ভাবে দেখতে চেয়েছেন।





সরিৎ চট্টোপাধ্যায়ের 'শব্দকল্পদুড়ুম'কে ভ্রম-নিরসন-প্রয়াস বলা যায় অক্লেশে। লেখক সমাধা করতে চেয়েছেন বাংলা বানানবিধিতে "কি' বনাম 'কী' বিতর্কের; রচনা করতে চেয়েছেন ণত্ত্ব-ষত্ব বিধানের নতুন ভাষ্য। লেখকের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে, তাঁর প্রকল্প একান্তভাবে তাঁরই মাত্র। সেক্ষত্রে, ঋতবাক বানানবিধি বা অন্য কোনও বানানবিধির সঙ্গে লেখকের চিন্তার দ্বন্দ্ব থাকতেও পারে।


এই সব বাণীসাধনার বিবিধ উপাচার নিয়ে মনন মিলন মেলায় উপস্থিত ঋতবাক। তার একটিমাত্র চাওয়া। বাণীর সাধক এইসব রচয়িতাদের এবং আগামীর ভাষাশিল্পীদের মিলিত প্রয়াসে যেন গতানুগতিক শব্দার্থ পরম্পরাকে ছাপিয়ে ভাষা উত্তীর্ণ হয় এক সিদ্ধলোকে। বঙ্গভাষা যেন তার পরিসর আরও বিস্তৃত করতে পারে। ঋতবাক তাই প্রার্থনা করে,

"নৃ নব্যসে নবীয়সে সূক্তায় সাধয়া পথঃ।
প্রত্নবদ্ রোচয়া রুচঃ।"

"নব নবতর সূক্তের তরে দাও পথ করে দাও।
অতীতেরি মতো দীপ্তির পরে দীপ্তি ঝলমলাও।"




ঋণস্বীকার : 
১) বেদের কবিতা -- গৌরী ধর্মপাল। 
২) মুদ্রণের সংস্কৃতি ও বাংলা বই। -- সম্পাদনায় স্বপন চক্রবর্তী।


1 comment: