5
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


বাংলার গান : বাঙালির গান – ৩

গানের একাল :গানের আকাল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



আগের সংখ্যায় ‘বাংলার গান : বাঙালির গান’২য় পর্বে বাংলাগানের স্বর্ণসময়ের কথা বলেছি। এই পর্বে সেই সময়কে পাশে রেখে একালের গানকে বুঝতে চেয়েছি। অতএব, বাংলা গানের সেই স্বর্ণসময়কে আর একবার ছুঁয়ে যেতে হবে। গত শতকের ত্রিশের দশকটা ছিল সেই স্বর্ণসময়ের প্রস্তুতি পর্ব আর চল্লিশ থেকে মধ্য আশি পর্যন্ত তার ব্যাপ্তি যে সময়ের গানকে চিহ্নিত করেছি ‘সোনার গান :শোনার গান’ বলে। ত্রিশের দশকে শচীনদেব বর্মণ ত্রিপুরার রাজপরিবারের বিলাস-বৈভব ছেড়ে গানের ভুবনকে বেছে নিলেন, বাংলা আধুনিক গানের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন, বাংলা গানের গায়কী ঠিক করে দিলেন অনেকটাই আর নিয়ে এলেন আধুনিক বাংলা গানে অনন্য আভিজাত্য। নিজের জীবনকথায় শচীনদেব লিখেছেন, “১৯৩০ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত এই ৫৬ বছরে লোকসঙ্গীত ও ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের সংমিশ্রণে নিজস্ব ধরণের সুর রচনা করলাম, যা অন্য কারো সঙ্গে মিলল না। এইভাবে আমি নিজস্ব গায়কী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম।” (তথ্যসূত্র : শচীন কর্তা / পান্নালাল রায়)। প্রায় সমকালেই, সামান্য পরে, এলেন এবং বাংলা গানের ভুবনকে আলোকছটায় ভরিয়ে দিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, সুধীরলাল চক্রবর্তী, যুথিকা রায় প্রমুখ। তারপর চল্লিশ থেকে ষাট এই সময়কালে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অখিলবন্ধু ঘোষ, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মান্না দে, উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর সেন, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, ইলা বসু, বাণী সরকার, তালাত মামুদ, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, গায়ত্রী বসু, গীতা দত্ত, আরতি মুখোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, মৃণাল চক্রবর্তী, নির্মলা মিশ্র এবং আরও কত শিল্পী সুরকা্র আধুনিক বাংলাগানের ভুবনকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে গিয়েছেন।এঁদের গান আমাদের জানান দিল, শব্দের সঙ্গে সুরের সার্থক সংযোজন কি অবিস্মরণীয় মহিমার সৃষ্টি করে। আমরা অনুভব করলাম সুর ছাড়া মানব হৃদয়ের অন্ধকার অভ্যন্তরে প্রবেশের আর কোনও পথ খোলা থাকে না। বস্তুত, বাংলা সাহিত্য-শিল্প সৃজনের ক্ষেত্রে এতো বড় রোমান্টিক আন্দোলন আর হয়নি।

গানের তো তিনটি উপাদান - বাণী, সুর আর গায়কের কন্ঠ মাধুর্য। ত্রিশ দশকে আধুনিক বাংলা গানের, সঙ্গীত রচনার ও সঙ্গীত প্রশিক্ষণের অলিখিত সম্রাট ছিলেন নজরুল ইশলাম। সমকালেই এবং কিছু পরে উঠে এসেছিলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত (১৯০৮-১৯৪৪), কমল দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৭৪), সলিল চৌধুরী, রবীন চট্টোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, নচিকেতা ঘোষ (১৯২৫-১৯৭৬), অনিল বাগচী, সুধীন দাশগুপ্ত, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। শচীনদেব আধুনিক বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন এবং নিয়ে এলেন এক নতুনতর গায়নশৈলী; তবে, তার পেছনে আরো দুজনের নাম সমান মর্যাদায় উল্লেখ করতে হবে।এঁরা হলেন শচীনদেবের কুমিল্লার দুই সাথী, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য। এই তিনজনের যুগলবন্দিতেই এসেছিল আধুনিক বাংলা গানের নতুন আভিজাত্য এবং আধুনিক বাংলাগানে শচীনদেবের গৌরবময় প্রতিষ্ঠা। বাংলা রেকর্ড সঙ্গীতে তখন নজরুল ইশলামের প্রবল উপস্থিতি। সঙ্গীত রচনায় নজরুল প্রভাব বলয়ের বাইরে এসে আধুনিক বাংলা গানের সুর রচনায় নতুন রোমান্টিক ধারার সূচনা করলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত। সঙ্গীতবেত্তা ও গবেষক রাজ্যেশ্বর মিত্র লিখেছেন, “শচীনকর্তাকে যথার্থ গৌরব প্রদান করেছিলেন একজন অসামান্য সুরকার, কুমিল্লার হিমাংশুকুমার দত্ত।তখনকার দিনেও গান ছিল নটীমহলে কেন্দ্রীভূত । নজরুল তাঁদের দিয়েই রেকর্ড করাতেন অধিক ক্ষেত্রে, কিন্তু হিমাংশুকুমার ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির কম্পোজার ...। যাঁদের গলায় পেশাদারি ভালগারিটি ওতপ্রোতভাবে নিহিত ছিল তাঁদের দ্বারস্থ তিনি কোনওকালেই হননি, তাঁদের প্রচুর জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও। তিনি বাংলাগানকে সেই সমাজ থেকে মুক্ত করে পরিমার্জিত রুচিশীল শিল্পীমহলে প্রতিষ্ঠিত করলেন।” শচীনদেব বাংলা সিনেমার ডাক পাননি তেমনভাবে। প্রবল অভিমানে ১৯৪৪এ তিনি মুম্বাইয়ে চলে গেলেন স্থায়ীভাবে আর হিন্দি সিনেমা-সঙ্গীতকে নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মৃত্যু হয় হিমাংশুকুমারের। ফলে শচীনদেবের পরবর্তী প্রজন্ম সুরসাগরকে পেলোই না। সুধীরলাল চক্রবর্তীও চলে যান মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। তারপরে, বাংলা রোমান্টিক গানে শুরু হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-যুগ । সংশয় নেই, হেমন্তই একমাত্র শিল্পী যিনি তাঁর ঐশ্বরিক কন্ঠমাধুর্য আর অননুকরণীয় গায়কীর গুনে রবীন্দ্রগান, সিনেমার গান ও বেসিক রেকর্ডের গানে গায়ন ও সুর রচনায় অনন্য লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন ।

কাব্যের লাবণ্যই বাংলাগানের আশ্রয়, আমরা জানি। আমরা একথাও জানি, বাংলা গানের স্বর্ণ সময় কারও একক প্রয়াসে আসেনি। এসেছিল গায়ক, গীতিকার ও সুরকারদের সম্মিলিত প্রয়াসে। গায়কের কন্ঠমাধুর্যে, সুরের স্নিগ্ধতায় আমরা অবগাহন করি, কিন্তু নেপথ্যে থেকে যান গীতিকার। বাংলা গানের স্বর্ণসময়ে প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিকদের অনেক কবিতার সার্থক সঙ্গীতায়ন হয়েছে যেগুলি বাংলাগানের ভুবনে ‘লেজেণ্ড’ হয়ে আছে।সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা ‘ছিপখান তিন দাঁড়, তিনজন মাল্লা’ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র । কে ভুলবে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা ও সুধীন দাশগুপ্তর সঙ্গীতায়ন আর প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে সেই গানটির কথা ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ / মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই’ (১৯৫৫), কিংবা সন্ধ্যা মুখার্জীর কন্ঠে সলিল চৌধুরীর সুরে কবি বিমল ঘোষের ‘উজ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ (১৯৫৩), বাণী ঘোষালের কন্ঠে সলিল চৌধুরীরসুরে অন্নদাশংকর রায়ের ছড়া ‘তেলের শিশি ভাংলো বলে খুকুর পরে রাগ করো’ (১৯৫৫), ১৯৬০এ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ও সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গীতায়নে, কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবিতা ‘সাগর থেকে ফেরা’ (‘সবুজের ছোঁয়া কি না তা বুঝি না’)। এবং সলিল চৌধুরী-হেমন্তর যুগলবন্দী সুকান্ত ভট্টাচার্যর রাণার, অবাক পৃথিবী, ঠিকানা আর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ‘পালকি চলে’ – এই সব প্রবাদপ্রতিম গানগুলির কাছেই আমরা বারবার ফিরে আসি। এসব গানের বয়স বাড়ে না।

সফল কবি মাত্রেই সফল গীতিকার নন, আবার সফল গীতিকারদের গানে আধুনিক কাব্যের স্পর্শ থাকে, যদিও তাঁরা কবির মর্যাদা পান না। আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগে মোহিনী চৌধুরী, সুবোধ পুরকায়স্থ, অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায়, শৈলেন রায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, প্রবীর মজুমদার, মিন্টু ঘোষ, শ্যামল গুপ্ত, কানু ঘোষ, পবিত্র মিত্র, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল দত্ত, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়রা স্মরণীয় হয়ে আছেন । গানের ক্ষেত্রে শ্রোতাদের প্রত্যক্ষ স্বীকৃতি পান গায়করাকিন্তু গানের প্রাণ তার বাণী রচনা করেন যাঁরা, গানকে সুরে বাঁধেন যাঁরা তাঁরা অন্তরালেই থেকে যান। কৃষ্ণচন্দ্র দে গীত, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান’ গানটির গীতিকারের নাম মোহিনী চৌধুরীআমরা ক’জনই বা জানি? ১৯৪৫র সত্য চোধুরীর কন্ঠে প্রবাদপ্রতিম ‘পৃথিবী আমারে চায় রেখোনা বেঁধে আমায় / খুলে দাও প্রিয়া, খুলে দাও বাহুডোর’ কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বহুশ্রুত ‘বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা / দূর নীলিমায় ওঠে চাঁদ বাঁকা’ এরকম অনেক শিখরছোঁয়া গানের গীতিকার ছিলেন মোহিনী চৌধুরী। জগন্ময় মিত্রের কালজয়ী রোমান্টিকগান ‘চিঠি’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম গানের গীতিকার সুবোধ পুরকায়স্থরা আড়ালেই থেকে যান।অর্থকোলীন্য তারা লাভ করেননা,ক্যাসেট বা সিডিতে তাঁদের নাম থাকেনা, গানের জলসায় তাদের তাদের নাম উচ্চারিত হয় না, তাঁরা কবে চলে যান আমরা জানতেওপারি না। উপেক্ষায়, হতাশায় মান্নাকন্ঠের অজস্র গানের গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তো ফেরি লঞ্চ থেকে ঝাঁপ দিয়ে গঙ্গার অতলেই তলিয়ে গেলেন । 

আজ ষাট-সত্তর বছর পরেও যখন ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড় / হে মনবলাকা মোর অজানার আহ্বানে চঞ্চল পাখা মেলে ধর’ (ইন্দ্রাণী), ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি নাইবা জ্বলে’ (রবীন মজুমমদার ১৯৫৫),‘মাটিতে জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছে’ (ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ১৯৫৬),‘চাঁদের এতো আলো’ (তালাত মাহমুদ ১৯৫২), ‘ওগো মোর গীতিময়’(সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ১৯৫০), ‘আমার গানের স্বলিপি লেখা রবে’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯৫৮), ‘কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছো’ (দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ১৯৬৫) – এসব গান ভেসে আসে আমাদের কানে, আমরা আনমনা হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে যাই । 

কিন্তু তারপর? মধ্য-আশিতে পৌছে আমাদের শিল্প-সাহিত্যে সৃষ্টির ভান্ডারের মত গানের ভুবনেও নেমে এলো চোখে পড়ার মত শূন্যতা। শচীন দেববর্মন ১৯৬৯এ তাঁর শেষ গানের রেকর্ড করে চলে গেলেন ১৯৭৫; সুধাকন্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর ৫৪ বছরের সঙ্গীত-সফর শেষ করে চলে গেলেন সেপ্টেম্বর ৮৯তে ৬৯ বছর বয়সে; আশির দশকেই চলে গেলেন শ্যামল মিত্র (১৯৮৭),অখিলবন্ধু ঘোষ (১৯৮৮), গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার (১৯৮৬), নচিকেতা ঘোষ (১৯৭৬), রবীন চট্টোপাধ্যায়। নব্বইএর দশকে গানের ভুবন থেকে শেষ বিদায় নিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী (১৯৯৫) মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । একুশ শতকে পা দেবার আগেই বাংলাগানের ভুবনকে শূন্য করে চলে গেলেন সোনার দিনের প্রায় সব শিল্পী, শুধু থেকে গেলেন তখন প্রায় গানহীন মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী, সবিতা চৌধুরী, আরতি মুখোপাধ্যায়রা,গানের আকাল দেখার যন্ত্রণা নিয়ে। এই শূন্যতা এতো শীঘ্র পূরণ হবার নয়। অতএব নব্বইএর দশকে শুরু হল বাংলাগানের ঝোঁক বদল ।

১৯৯২এ ঈর্ষনীয় কন্ঠসম্পদের অধিকারী সুমন চট্টোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা গানের জগতে এলেন, প্রকাশিত হল তাঁর গানের ক্যাসেট ‘তোমাকে চাই।’ক্যাসেট কোম্পানী ক্যাসেটের লেবেলে নাম দিলেন ‘জীবনমুখী’ গান । সুমন তার আগেই রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে বাংলা গানে এসেছেন। প্রায় একই সময়ে নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, শিলাজিৎ প্রমুখ এক ঝাঁক নবীন শিল্পী তথাকথিত জীবনমুখী গানের জগতে হুড়মুড়িয়ে এসে গেলেন । তাঁরা আধুনিক বাংলা গানের একটা নতুন ছাঁচ তৈরি করতে চাইলেন । এঁদের কেউ কেউ বললেন তাঁদের শুনে আসা গানের ভাষা ছিল বোকা বোকা- জীবনসম্পর্কহীন। এতোদিন আধুনিক গান ছিল একটা সমবায়িক শিল্প - গীতিকার, সুরকার ও গায়কের সমবায়িক প্রয়াস আর তাঁরা নিয়ে এলেন ‘ওয়ান পার্সন মিউজিক’ বা একক ব্যক্তির সঙ্গীত। গানের কথা সুর ও গায়ন একই ব্যক্তির, এমনকি গলায় ঝোলানো তারযন্ত্রের বাদ্যসংগতও তাঁরই । এই ‘ওয়ান পার্সন মিউজিক’ কোন নতুন উদ্ভাবন নয়; আমাদের বাউল গানও একক ব্যক্তির সঙ্গীতই । তফাত এই যে সেই গানে মাটির স্পর্শ আর এঁদের গানে টুংটাং গীটারের শব্দ সহযোগে গলার শির ফুলিয়ে একটানা গেয়ে যাওয়া, গানের মুখড়া,অন্তরা, সঞ্চারীর কোন বালাই না রেখে। কাব্যের লাবণ্য সেইসব গানের আশ্রয় ছিল না। কলেজ কমনরুম ও রকের আড্ডার হালকা ভাষাতে মোড়া সেইসব গান। গানের জলসায় সুমন, নচিকেতা ছোট-খাটো ভাষণও দিতেন গান শুরুর আগে, কটু শব্দের গালি দিতেও অনীহা ছিলনা তাঁদের (এখনও কি দেন? জানি না।) তখন বোঝা দায় ছিল নচিকেতার গান না কচিনেতার ভাষণ!

আমাদের আধুনিক বাংলা গানের যে ধারণা বা কনসেপ্টে সোনার দিনের যে সব গান আমরা শুনেছি, তাতে গানের ভাষা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু গানের সুরটিই কানে লেগে থাকতো বেশি । তাই রবীন্দ্রনাথের গান বা জনপ্রিয় আধুনিক গানের সুর যন্ত্রসঙ্গীতে বাজানো যায় কিন্তু জীবনমুখী গানের তকমা দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি ক’রে যা চালানো হ’ল তাতে এমন হবার নয়। সে গানে এলোমেলো কথা অনেক আছে কিন্তু সুর গুরুত্বপূর্ণ নয়। গানের কথা ও সুরের যে সমন্বয় একটা গানকে কালোত্তীর্ণ করে, তথাকথিত জীবনমুখী গানে তা ছিল না। কেউ কি কখনো শুনেছেন যন্ত্রসঙ্গীতে নচিকেতা, অঞ্জন দত্তদের জীবনমুখী গানের সুর? এইসব গান প্রথম প্রথম বাজার পেলো, বলা ভালো বাজার খেলো;তাঁরা ক্যাসেট করলেন, বিক্রিও হ’ল কিন্তু তাঁদের গান মুখে মুখে ফিরলো না। যে কোনও তরুণ বা তরুণী আপন গৃহে সন্ধ্যায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে ‘শালা স্বাধীনতা’, ‘নাভির নীচে শাড়ি ইটের নীচে ঘাস’, ‘মেয়েছেলে আর মানুষে লেগেছে খটাখটি’, ‘গড়িয়াহাট মোড়ে ডানাকাটা পরী’ এমন সব কুৎসিৎ শব্দ ঠাসা গান গাইবেন কি? ফল যা হওয়ার তাই হলো। অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ, তাঁদের প্রতিভার অপচয় ঘটিয়ে হারিয়ে গেলেন।

প্রয়াত সলিল চৌধুরী একটা ব্যাঙ্গাত্মক ছড়ায় লিখেছিলেন – 

‘আলু খুঁইজ্যা পাইলাম না রে তাই
খাইলাম কচুমুখী
সুর খুঁইজ্যা পাইলাম না তাই
গাইলাম জীবনমুখী’ ।

দশ বছরের মধ্যে ‘জীবনমুখী’ গান মুখ থুবড়ে পড়ল । আর ‘গানের দেখা নাই রে গানের দেখা নাই’ আমাদের এহেন হাহাকারের মধ্যে বাজারে এসে গেলো বাংলা ব্যান্ড । এও বিদেশ থেকে আমদানি করা ব্যাপার। হরেক কিসিমের যন্ত্রের জগঝম্প, কোমর দোলানো গান। গান যেন শোনার নয়, দেখার । প্রথম প্রথম সে গান কানে ভেসে এলে ভ্রম হত, গান না মাতালের চীৎকার! গানের তো একটা সর্বজনীন দিক আছে; গানের সুরে মানুষ ডুবতে চায়, স্নিগ্ধতায় অবগাহন করতে চায়। গানের ভেতর দিয়ে মানুষ তার স্নায়ুকে শান্ত করতে চায়, তার কর্মের ক্লান্তি অপনোদন করতে চায়। কিন্তু, আধুনিক বাংলা গানের নামে অমার্জিত কথার ফুলঝুরি আর শিরা ফোলানো চীৎকার শ্রোতাদের ক্লান্তিনিয়ে এলো । চলচ্চিত্রের গানও আর মানুষকে টানতে পারলো না।

সু্মন যে বছর ‘তোমাকে চাই’ ক্যাসেট নিয়ে সাময়িক হৈচৈ ফেললেন, তার পরের বছর ১৯৯৩তে রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমির বার্ষিক কার্যবিবরণী তে বলা হয়েছিল “আধুনিক বাংলা গানের বাণীর দুর্বলতা বিষয়ে সভা উদ্বেগ প্রকাশ করে। সুর ও বাণীর মেলবন্ধনের অভাবে বাংলা আধুনিক গান তার আসন হারাচ্ছে। এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন” । (তথ্যসূত্র : ‘অন্দরমহলের ছবি : বাংলা গান’/শোভন সোম - ‘দেশ’ পত্রিকা-এপ্রিল ২০০১)বাংলা গানের দুর্গতি মোচনের জন্য একটি উপ-সমতিও নাকি হয়েছিল।তারপরও প্রায় পঁচিশ বছর হতে চললো, প্রতি বছর মহা ধুমধাম ক’রে সঙ্গীত মেলা হয়, কিন্তু বাংলা গানের দুর্গতি মোচনের কোন সংকেত পাওয়া যাচ্ছে না।

গত পনেরো-কুড়ি বছরে শ্রীকান্ত আচার্য, ইন্দ্রনীল সেন, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, লোপামুদ্রা মিত্র, চন্দ্রাবলী দত্ত রুদ্র, স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্ত, ইন্দ্রাণী সেন, মনোময় ভট্টাচার্য, রূপঙ্করের মত একঝাঁক সুকন্ঠ গায়ক উঠে এসেছেন সত্য, কিন্তু এদের একজনও নিজস্ব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা গানকে শাসন করতে পারেন এমন বলা যাচ্ছে না।তাঁদের কেউ কেউ ৫০/৬০ দশকের জনপ্রিয় আধুনিক গানগুলির রিমেইক বা পুনর্নির্মাণ ক’রে শিল্পীর দায় মেটাতে চাইলেন, কেউবা আশ্রয় নিলেন রবীন্দ্র–দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্তর গানে। ইন্দ্রনীল – শ্রীকান্ত - ইন্দ্রাণীরা কেন নিজস্ব সৃষ্টি করতে পারলেন না, এ বড় বিস্ময়। রেকর্ড কোম্পানী (ক্যাসেট ও সিডি) এদের নিজস্ব সৃষ্টির ওপর ভরসা না রেখে ক্রমাগত অতীত দিনের গানের পুণর্নির্মাণ করালেন,তাঁরা প্রভূত উপার্জন করলেন, কিন্তু আধুনিক বাংলা গানের সৃজনভূমিতে জোয়ার আনতে পারলেন না। অতএব, গান শোনা বাঙালির হাতে রইল পেন্সিলই – মানে রবীন্দ্র-নজরুল- দ্বীজেন্দ্রলাল-রজনীকান্তর গান আর চিরন্তন লোক জীবনের গান।

কোথায় যেন পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের কথা ‘প্রত্যেক যুগের মধ্যেই একটা কান্না আছে, সে কান্নাটা হল সৃষ্টি চাই’। আশির পর থেকে তো গানপ্রিয় বাঙালি এই কান্নাই তো কেঁদে চলেছে! সৃষ্টি চাই, নবীন কালে নবীন শিল্পীর নবীন গান। একালের গানের এই সৃষ্টিহীনতাকে গানের আকাল বলবো না তো কি বলবো?

[ বলেছিলাম তিনটি পর্বে লেখাটা শেষ করবো। পারলাম না। তিনটি পর্বে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুলকে সামান্য ছুঁয়েছি বটে, লোকজীবনের চিরকালীন গান অধরাই থেকে গেছে আমার লেখায়। চতুর্থ ও শেষ পর্বে বলবো সে কথা ।]



5 comments:

  1. একালের ছকভাঙ্গা আধুনিক কবি , গীতিকার কম্পোজার গিটার বাদক সকলকেই এই প্রবন্ধটি পাঠের আমন্ত্রণ রইল ! সত্যিই কি গান হারিয়ে যাচ্ছে ; না কি আমাদের কান ? ভীষণভাবে ভাবাল প্রবন্ধটি !!!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. ফাল্গুনী মুখার্জী21 January 2017 at 16:11

      লেখাটা মনযোগ দিয়ে পড়েছো বুঝলা । ধন্যবাদ ।

      Delete
  2. পুরানো গানের শুধু সুর কেনো দাদা, কথাগুলোও মনের কোনে ভেসে ওঠে অথচ আধুনিক গান শুধু কানে ভাসে মনে নয়...

    ReplyDelete
  3. অনেক অনেক শুভেচ্ছা। পড়ি, অপেক্ষায় থাকি পরের পর্বের জন্য। তবে পরের এক পর্বেই শেষ করতে পারবেন বলে মনে হয়না। খুব ভালো লাগছে

    ReplyDelete
  4. প্রবন্ধটি ১৯৩০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা গানের বিবর্তনের এক মূল্যবান নথি বলেই বিবেচনা করতে হবে । পড়ে প্রায় ৯০ বছরের বাংলা গানের ইতিহাসকে সংক্ষিপ্ত আকারে জানতে পারলাম । কিন্তু জানবার ক্ষুধা অসীম । তাই মন আরো কিছু চায় । আসলে বাংলা গানের সামগ্রিক ইতিহাস কে বিশদে জানতে খুবই আগ্রহী ।
    যেমন বাংলার আখরাই, খেউড় , টপ্পা , লোকসঙ্গীতের উৎপত্তি , বিস্তার উন্নতি বা অবলুপ্তি কিভাবে হলো তারপর ধাপে ধাপে আধুনিক যুগে প্রবেশ এবং উন্নতির শিখরে আরোহনের বিশদ বিবরণ ও তৎসহ বিশ্লেষন বাঙ্গালীদের জানা দরকার । এবং তারপর আবার অধঃ পতন! কেন এই হঠাৎ শূন্যতা ?
    সবচেয়ে ভালো হয় আপনি যদি এই বিষয়ের ওপর একটি বই লেখেন তাহলে বাঙালি জাতি দারুন উপকৃত হবে এবং আপনার প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবে ।
    যেটুকু জানতে পারলাম এর জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।🙏🙏

    ReplyDelete