বিশেষ রচনা - হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়
Posted in বিশেষ রচনা
বিশেষ রচনা
মহাশ্বেতা
হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়
কোথাও কোনও ভূমিকম্প হয়নি সেদিন। যদিও বিগত ২৮ জুলাই, বিকেল তিনটেয় তিনি চলে গেলেন। অথবা, হয়েছে কোথাও, বিশাল এই দেশের সেই অন্ধকার অর্ধাংশে, যার তরঙ্গ সৌভাগ্যবশত, আমাদের আইনক্স জীবনে কখনও পৌঁছয় না, অন্তত এখনও পর্যন্ত পৌঁছয়নি কোনওদিন।
কোনও প্রতিষ্ঠানের দাক্ষিণ্য তিনি পাননি কখনও, অথবা চানওনি কোনওদিন। কমলকুমার, অমিয়ভূষণ কিংবা মহাশ্বেতাদের প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্যের প্রয়োজনও হয় না কখনও। কখন যে তাঁকে সংবর্ধিত করে গেছে কোনও জ্ঞানপীঠ, কিংবা দেশিকোত্তম, হয়তো তা নিয়ে দুর্ভাবিত হওয়ার মতো সময়ও ছিলো না তাঁর। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক নিজের গরজেই অনুবাদ করেন তাঁর ছোটগল্প আর উপন্যাস, লিখে যান তাঁকে নিয়ে পাতার পর পাতা, নিজের গরজেই, কেননা তাঁকে বাদ দিলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এক সুবিশাল দেশের বিশালতর এক জনগোষ্ঠীর সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস। আক্ষরিক অর্থেই, মহাশ্বেতা ছিলেন "প্রতিযোগিতার পরপারে", কেননা জীবনে, সৃজনে ও কর্মে তাঁর নিঃসঙ্গ মহিমা এবং উত্তুঙ্গ দূরত্ব যেন তাঁকে জীবৎ কালেই করে তুলেছিলো আশ্রয়দায়িনী কোনও অতি দীর্ঘ মহীরুহ, যেন দীপ্যমান কোনও প্রতিষ্ঠান---স্বয়ংপ্রভ, অননুকরণীয় স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল।
১৯২৬ থেকে ২০১৬, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছেন তিনি। দেখেছেন মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর, উত্তাল সেই মুক্তির দশক, কত সামাজিক, রাজনৈতিক উত্থান- পতন। অনুভব করেছেন বারেবারে, যে জীবনকে আমরা নিশ্চিন্ত জীবন বলে ভুল করে সানন্দে বেঁচে আছি প্রতিদিন, তার গভীরে আসলে দুশ্চিকিৎস্য ক্ষত তৈরী হয়েছে দিনে দিনে। কেননা তার বৃদ্ধি ও বিকাশের সঙ্গে প্রাচীন এই দেশের বৃহদাংশের মানুষের জীবনযাত্রার কোনও সম্পর্ক, কোনও সঙ্গতি নেই। আর তাই অবশ্যম্ভাবী এবং অনিবার্য সর্বনাশ সম্পর্কে সতর্কও করতে চেয়েছেন আমাদের, তাঁর রচনার প্রতিটি অক্ষরে। কতটা সতর্ক আমরা হলাম, অথবা আদৌ হলাম কী না, আগামীদিনের ইতিহাস হয়তো তার উত্তর দেবে। তবে এটুকু বলতে পারি নির্দ্বিধায়, আগামী সে ইতিহাস তাঁরই কলমে রচিত মানুষের ইতিহাস, প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস, সাব-অল্টার্নের ইতিহাস।
ঘটনাবহুল কোনও উপন্যাসের মতো তাঁর জীবন অথবা বর্ণময় তাঁর বিপুল সাহিত্য কীর্তি কোনওটিই আজ আমি আলোচনা করতে আসি নি, আজ এই অতিসন্নিহিত শোকাচ্ছন্ন মুহূর্তগুলি সম্ভবত তার উপযুক্ত সময়ও নয়। তবে সেদিন কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে আমার ইনবক্সে এক বন্ধুর প্রেরিত বার্তায় যখন ভেসে উঠলো তিনি আর নেই, অজান্তেই আমার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেলো আচম্বিতে, আর আমি দেখতে পেলাম গভীর অন্ধকারে কোনও স্তনদায়িনীর ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠলো হঠাৎ, মুষ্টিবদ্ধ হলো হাজার চুরাশির মায়ের হাত, বিস্তীর্ণ কোনও অরণ্যে কে যেন হাঁক দিয়ে উঠলো "উলগুলান" ...আর সেই মুহূর্তেই চোট্টি মুণ্ডার তীর উড়ে গেলো আকাশে।
যেতে তো হয়ই সবাইকে।আমরাও যাবো, যাই, তবে কী জানেন, সেই যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখে গিয়েছিলেন না---কোনো কোনো পদচিহ্ন রঙীন/চলে যাওয়ার পরেও থেকে যায় ছাপ।।
0 comments: