0

মুক্তগদ্য - স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার

Posted in


মুক্তগদ্য


আমার একলা শাওন 
স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার



মন তুই যাস কোথা রে। 'রিমঝিম ঘন ঘন রে'

.... ঝপাৎ ঝপ। ঝপাৎ ঝপ। ইচ্ছে সুখে বৃষ্টি ভেজা।.. জন্মক্ষণে বিধাতা দিয়েছিলেন এক কোলকাতা বৃষ্টি।... তা এহেন বাদুলে কি
"শাওন গগনে ঘোর ঘন ঘটায়" এক জায়গায় দাঁড়ায়..... দে দৌড়... দে দৌড়। এক্কেবারে কৃষ্ণপদাবলীর দেশে ---। দরজাটা তো খোলাই আছে... দেউড়িতেও কেউ নেই... ঢুকেই পড়ি...

আহা! একি বাদল গো? ... অনেক মেঘ, অনেক গর্জন... অনেক বিদ্যুৎ -- অশনিপাত আর গহন ঘন আঁধার -- কাজল পরে আরো কৃষ্ণ - কাজল হয়েছে গো...। কৃষ্ণ নিজের কুঞ্জবাটিতে কেমন বসে আছে!! রাধাভিসার কত্ত কষ্টের ভেবে কপালে তিন রেখা টেনে দিলে.... আকাশের এ কোটি ও কোটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন জলদ দল এসেছে গাঢ় হয়ে।

বর্ষণ করে চলেছে জলভার। কি করে কাঙ্ক্ষিত স্থানে আসবে শ্রীমতী!

"কাজরে সাজিল রাতি
ঘন ভএ বরিস এ জলধর পাতি।।
বরিস পয়োধর ভার
দূরপথ গমন কঠিন অভিসার।।" 

হা রে বিদ্যাপতি!!...
মানস গঙ্গার পারে বর্ষা কি যে ভাবতে বসেছে... এত ভাবন কেন গো? ঊর্ধ্বলোক চারিণী -- ধূলিলীনা রাই কিশোরী কি ভাবছে --- এই রিমঝিম ধারা বুকে তুলে দিল মিলন বাসনা।.... যাও শ্রীমতী.... "যাইব কেমনে"..

"মন্দির বাহির কঠিন কপাট
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।
তাঁই অতি দূরতর বাদর দোল
বারি কি বারই নীল নিচোল"।।

তা 'গোবিন্দ দাস' এ কি আঁকলেন বর্ষার মোহন চিত্র।..... তা কি করা যাবে... মরি মরি!
ঘন মেঘপুঞ্জিত - বিদ্যুদবিলসিত --অশনি শব্দিত পবন আন্দোলিত... আর কি বাধ মানে?... 'রায় শেখর' মহাশয় লিখেই ফেললেন----

"গগন অবঘন মেহ দারুণ
সঘনে দামিনী চমকই।
কুলিশ পাতন শব্দ ঘন ঘন
পাবন খরতর বলগই।।"

বাব্বা! কি কঠিন কঠিন কথা!....
বাদুলে মেয়ে মন পালা --- পালা --। পা সরে না। বিভাষিত আনন্দে দ্বৈত ভূমিকা অভিনেত্রী বর্ষাসুন্দরী চণ্ডীদাসের রাধা হয়ে ছুঁয়ে দিল আমায়...

"এ ঘোর রজনী মেঘেরঘটা 
কেমনে আইব বাটে।
আঙ্গিনার কোণে বঁধুয়া তিতিছে
দেখিয়া পরাণ ফাটে।।''....

কি সুন্দর তুমি চণ্ডীদাস!... রাধার আর্তি সত্য -- প্রিয় মিলনের আর্তি সত্য -- কিন্তু কি করুণ মেঘাড়ম্বরময়ী বর্ষা শর্বরী! বর্ষা আমার কি রহস্যময়ী তুমি --- অভিসারকে ত্বরান্বিত করতে, বিরহ বেদন জাগ্রত করতে তোমার জুড়ি নেই -- প্রিয় কন্ঠ আলিঙ্গনে সুখী প্রিয়া আর যারা দূরবর্তী নক্ষত্রলোকে আছে ---

"মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথা:বৃত্তিচেত:!
ও বাদুলে মন যাস কোথা --- 
"শাঙন গগনে ঘোর ঘন ঘটা
নিশীথ যামিনী রে..."

এই তো আমার ঠাকুরের দেউড়ি গো ---- স্বপ্নমিলন-- শ্রাবণ যামিনী -- যুগপৎ কুহু- কেকার মুখরতা -- দাদুরী - ডাহুকীর, ঝিল্লীর মত্ত রব...
আ! কি শান্তি!... 

"সঘন গহন রাত্রি 
ঝরিছে শ্রাবণ ধারা..
অন্ধ বিভাবরী সঙ্গ পরশ হারা"....

ও কিশোর তুমি কি কিছু বলবে ----
'ভানুসিংহ' তুমি বলো বলো ----

" বাদর বরখন, নীরদ গরজন
বিজুলী চমকে ঘন ঘোর,
উপেখই কৈছে আওতো কুঞ্জে
নিতি নিতি মাধব মোর।।"

আমার যে বুক ভরা শাওন --- কবি "আঁধারে একেলা ঘরে"... 

'শ্রাবণ বরিষণ পার হয়ে
কি বাণী, আসে ওই রয়ে রয়ে'

....আর জ্বালাতন করিস নে বাদল মন -- ফিরে তো আসলি তিনভুবনের পারের 'ঠাকুরকে' প্রাণে নিয়ে.... বড়ো ব্যথা যে এই শ্রাবণে... 

"সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা
অন্ধ বিভাবরী সঙ্গ পরশ হারা".....

বাদুলে চোখতারা ঝাপসা -- মেঘভাঙা বৃষ্টি ধারা....

"ঝরছে রয়ে রয়ে ----'.....
অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে জাগে
আজি শ্যামল মেঘের মাঝে
বাজে কার কামনা"

......আমার গো আমার। এই বাদুলে মনের --- ফের রে এবার ঘরে ফের ---

"ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর"....

বৈষ্ণবপদাবলীর বর্ষার রসামৃত পান করতে বৈষ্ণব হবার দরকার নেই গো পুরবাসী.... কৃষ্ণকে অবতার মানা ---- না গো তারও প্রয়োজন নেই। শুধু এক বুক বৃষ্টিতে দেহাবরণ বাইরে এনে ভিজতে পারলেই --- পরম পাওয়া.....

"মনে পড়ে বরিষার বৃন্দাবন অভিসার
একাকিনী রাধিকার চকিত চরণ।
শ্যামল তমাল তল, নীল যমুনার জল
আর দুটি ছলছল নলীন নয়ন।
এ ভরা বাদর দিনে কে বাঁচিবে শ্যাম বিনে
কাননের পথ চিনে মন যেতে চায়।
বিজন যমুনা কূলে বিকশিত নীপমূলে
কাঁদিয়া পরান বলে বিরহ ব্যথায় -----"

আমার সব হারাবার শাওন
আমার জীবন ধারণ শাওন
আমার বুকের মধ্যে শাওন......


0 comments: