0

প্রাচীন কথা - সুহোত্র

Posted in


প্রাচীন কথা


অনঞ্জনের দিনলিপি
সুহোত্র




প্রথম দিন:

কাল সক্কালে রওনা। বাইরে এখন সাজো সাজো চলছে। এক অক্ষৌহিণী সৈন্য এসেছে। বাপুর ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। চারদিকে চড়কি দিয়ে বেড়াচ্ছে। কখনও দেখছে শূল, মুগুর, বড় বড় পাথর, গাছের গুঁড়ি এইসব অস্ত্র শস্ত্র ঠিক ঠাক আছে কিনা। আবার কখনও রথের তদারকি করছে। বাপুর রথটা আমার খুউউব ভাল লাগে। পুরো লোহায় গড়া, ভাল্লুকের চামড়ায় ঢাকা, ওপরের ধ্বজায় শকুনির ছবি। 

পাখির ছবি অবশ্য আমরা সবাই গায়ে আঁকি। বাপুকে তো বড়দাদা খগ বলে ডাকেও। আমার দাদার বড় ভাই। দাদা মানে বাপুর বাপু। দাদাকে আমি মোটে একবার দেখেছি। তখন আমি খুব ছোট। আমার আরও চারটে দাদা আছে। ঠামু বলে। আরও বলে আমার সেজদাদার রঙ আমার মতই কালো। ছোট ঠামুও নাকি কালো। আমি ঠামুকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু, মাঝে মাঝে যে কিসব বলে আমি কিচ্ছু বুঝি না। বলে বাপু নাকি রাজপুত্তুর। আমিও নাকি তাই। বলে শিগগিরি.. কি যেন? হ্যাঁ...ধমরো রাজ্য না কি যেন একটা হবে। সেখানে সবাই মিলে মিশে থাকবে। আজ্জঅনাজ্জ.. না কি সব যেন..থাকবে না সেখানে। সে যাক গে। 

বড়দের কথা অনেক সময়ই বোঝা যায় না। আর অত কান দিলে দরকারি কাজ করাও যায় না। আমার কত কাজ। দীঘির জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে এপাড় ওপাড় করা, পাহাড় বেয়ে উঠে ঈগল ছানাদের সঙ্গে ভাব করা.. পাহাড়ে উঠলে না তারাগুলো হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় মনে হয়। এখানে আমার সঙ্গে খেলার কেউ নেই। তাতে অবিশ্যি আমার তেমন দুঃখু টুঃখু নেই। পাহাড়ের ওপরে আমাদের গুহাটার পাশ বরাবর উঠে গেলে যে গুহাটা তাতে যে ভাল্লুকীটা থাকে তার চারটে ছানা আছে। তাদের সঙ্গে খেলি। পাহাড়ের ওপর থেকে হেইইইওওও বলে চ্যাঁচালে একদম আমার মত গলায় কে যেন ওও ওও ওও বলে সাড়া দেয়। মাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তর না দিয়ে বেজায় চটে গেল, "ফের তুই পাহাড় চড়েছিস অনঞ্জন? পাজি ছেলে! কতবার না বারণ করেছি? ফের উঠলে দেখবি মজা! যাও, এখন দয়া করে লেখা পড়া কর। নইলে তোমার আজ্জ দাদারা ঘেন্না করবে তোমায়।" বোঝো! কি জানতে চাইলাম আর কি সব বলে দিল! বড়দের কথার সত্যি মাথামুণ্ডু নেই। 

আমার নাম কিন্তু অনঞ্জন নয়। ওটা মার দেওয়া নাম। মা কিছুতেই ঠামুর দেওয়া নামটায় ডাকবে না। এটাই নাকি বেশি ভাল নাম। এর মানে নাকি নিষ্পাপ! মার সব ভাল শুধু এইটা ছাড়া। লিখতে হবে, পড়তে হবে। অস্ত্র শিক্ষা করতে হবে। পৈতেটা গলায় রাখতে হবে! কি জ্বালা বাপু! গাছে চড়তে গেলে পটাং করে ছিঁড়ে যায়। বাপুকে বলতে গেলাম। বাপু খানিকক্ষণ হা হা করে হেসেই অস্থির। তারপর,আমায় টপাত করে পিঠে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল ঝর্ণা ছাড়িয়ে। হুঁ হুঁ ব্বাবা। তার মানে একটা গল্প আগচ্ছতি! 

ঝর্ণা পার হয়ে ঝোলা পাথরের তলায় বসা মানেই বাপু গল্প বলবে। আমার বাপু সবার সেরা। পাহাড়ের মত উঁচু, চওড়া বুক, তামার মত রঙ। মাথাটা ধরে বসতে কি মজা! একটাও চুল নেই! মাথাটা পুরো ঘটের মত! এ মা ছি! গুরুজনদের সম্বন্ধে এসব ভাবতে নেই। আমার বাপু ভৈমসেনী হৈড়ম্বর মত বাপু আর কারো নেই। থাকতেই পারে না! লিখতে গিয়ে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বড় হলে সব গুছিয়ে লিখতে পারব। হ্যাঁ, হিজিবিজি লিখতে আমার খুব মজা লাগে। এই পুঁথিটা পাহাড়ের এই খোঁদলে লুকনো থাকে। কাল যাবার সময় সঙ্গে নেব বলে বার করেছি। এতে রোজ লিখি না। মনে অনেএএক কথা জমা হলে লিখি। আমার ধনুক, বাণ, মুষল সব গোছান হয়ে গেছে। বাপু আমায় নিজে অস্ত্রবিদ্যা শিখিয়েছে। কিন্তু, আমি এখনো কোনও জ্যান্ত কিছু মারি নি। মারতে পারি নে আমি। ভারী কষ্ট হয়। 

তা সে যাক। সে দিনের কথা বলি। বাপু আমায় পিঠ থেকে নামিয়ে খানিক্ষণ সোজা সামনের দিকে চেয়ে রইল। তারপর খুব নরম গলায় বলল, "জানিস অঞ্জন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমারও পৈতে পরতে বিচ্ছিরি লাগত। তোর ঠামু একটা সোনার পৈতে করে গলায় ঝুলিয়ে দিল। কারণ, আমার ধমনীতে আজ্জ রক্ত বইছে।" 

বাপু ঠিক ঠাকই বলেছিল শব্দটা কিন্তু আমি ওটা ভাল করে বলতে পারি না। যাক গে! বাপু বলে চলল, "আমরা রক্ষ বংশীয়। আবার আমার জন্ম কুরুবংশে। এ যে কি টানাটানি তুই বড় হলে বুঝবি বাপ। হ্যাঁ রে, তোর দাদাকে মনে পড়ে?" আমি ঘাড় নাড়লাম। বাপু হেসে বলল, "তুই তখন একরত্তি। একদিন তোর ঠামু বলল ব্রত শেষ হয়েছে একটা মানুষ বলি দেওয়া দরকার। বুঝলি অঞ্জন, আমি পড়লুম মহা সমস্যায়। একদিকে আমি শিখেছি মানুষ বলি অনুচিত। অন্যদিকে তোর ঠামুর আদেশ। কি যে জ্বালা! অকার্যমেতচ্চ ময়াদ্য কার্যং/ মাতুর্নিয়োগাদপনীয় শঙ্কাম!" বাপুর সব ভাল কিন্তু মাঝে মাঝেই কটমট করে কি বলে কিচ্ছু বুঝি না! রাগ হ'ল। বাপুর পিঠে মাথা দিয়ে ঢুঁ মেরে দিলাম একটা। বাপু হেসে বলল, "হবি তো হ এক বামুনের মেজ ছেলেকে পাওয়া গেল। কি ঝামেলা বল তো? একদিকে শিখেছি বামুন দেবতা, অন্যদিকে নরবলি আমাদের কুলপ্রথা। তা সে যাক। শেষমেশ কিছুই করতে হ'ল না! সে ছোঁড়া জল খেতে গিয়ে আর ফেরে না। 

মধ্যম মানে মেজ বলে দু তিনবার চেঁচিয়ে ডাকতেই তোর দাদা মানে আমার বাপু হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল, এই যে এসেছি। তুই তো জানিস পাশা খেলায় হেরে তোর দাদারা সব বনে এসেছিল? তা পাশেই ওদের আশ্রমে তোর দাদা ব্যায়াম করছিল। আমি বললাম আপনি আবার কোন মধ্যম? তোর দাদা হেসে বলল, আরে সব ব্যাপারেই আমি মধ্যম। রাজকূলে, ভাইদের মধ্যে, পঞ্চভূতের মধ্যে, যাঁরা চরম শক্তিমান তাঁদের মধ্যে! মানে, আমার চেয়ে ভাল মধ্যম তুমি আর পাবে না। তাই অন্য মধ্যমটাকে ছেড়ে দাও। আমি বললাম, দূর মশাই, আমার বাবা এসে বললেও ছাড়ব না। মায়ের আজ্ঞায় ধরেছি একে। তিনি বললেন তোমার মা এর নাম? আমি বললাম হিড়িম্বা। তিনি হঠাৎ আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, বেশ আমি শরীর বিনিময় করছি। তোমার মার কাছে আমায় নিয়ে চল। 

নিয়ে এলুম। তখনই তুই দেখেছিস তাঁকে। মনে পড়ে?" আমি চোখ বুজলাম। স্পষ্ট মনে পড়ে। বাপুর চেয়েও লম্বা। কাঁচা সোনার মত গায়ের রঙ। গলাটা শাঁখের মত। চোখ দুটো পদ্মের পাপড়ির মত। তখন এত বাখান করতে পারি নি। এখন অল্প অল্প পারি। বড় হয়ে আরও ভাল পারব। এত্ত এত্ত পুঁথি লিখব তখন! বাপু বলে চলল, "তোর দাদা তোর ঠামুকে একটা কথা বলেছিলেন অঞ্জন। জাত্যা রাক্ষসী ন সমুদাচারেণ..গুঁতোস না, গুঁতোস না..মানে তুমি জাতে রাক্ষসী বটে কাজে নও। সেই থেকে ভেবে চলেছি রে আমরা আসলে কি!" বাপু চুপ করে কিসব ভাবতে লাগল। চুপচাপ থাকলে আমার মোটেই ভাল লাগে না। বাপুর চওড়া পিঠে মুখ লুকোলাম। বাপুর ঘোর ভাঙল। হেসে উঠে আমায় কোলে তুলে বলল, "চ, তোকেও একটা সোনার পৈতে বানিয়ে দিতে বলি গে!" 

তারপর দিন কাটল। মাস, বছর। হঠাৎ খবর এল দাদা ডেকেছেন বাপুকে। কোথায় যেন খুব যুদ্ধু হচ্ছে বাপুকে যেতে হবে। 

কাল রাতে মা আর বাপু খুব ব চ সা করছিল। এই শব্দটা আমি নতুন শিখেছি। কেমন চালিয়ে দিলুম! আমি ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে গলা নামিয়ে গুহার কোণায় গিয়ে কথা বলছিল। আমি কিন্তু পুরো জেগে। আমি দেখেছি বড়রা ছোটদের তেমন ঠাওর করে দেখে না। যাই হোক, মা বলছিল, "তুমি যেতে হয় যাও। আমার অনঞ্জন যাবে না।" বাপু বলছিল, "একথা কেন পৃষোদরী? তুমিই দিনের পরদিন ওকে শিখিয়েছ যে ওকে রাজকূলের যোগ্য হতে হবে। আজ ওর পিতৃকুল বিপন্ন। যেতে ওকে হবেই।" 

মা হঠাৎ কেঁদে ফেলল, "ওগো আমি বুঝেছি ওই আজ্জরা আমাদের কোনওদিনই আপন করবে না। মাতাঠাকুরাণী কোনওদিন জ্যেষ্ঠা কুলবধূর মান পান নি। ভেবে দেখ। তোমাকে ওরা বার বার ব্যবহার করছে। বনে আসার আগে তোমায় কোন খবর দিল না। আমার কথা, অনঞ্জনের কথা কখনও জানতে পর্যন্ত চায় নি। সেই যেবার গন্ধমাদনের পথে সম্রাজ্ঞী চলতে গিয়ে বসে পড়লেন অমনি ডাক পড়ল তোমার। আজ্জ কত্তারা পাহাড় চড়তে কাবু হন! তুমি পিঠে করে পৌঁছে দিলে। একটা কৃতজ্ঞতার শব্দ শুনেছ? আমার অনঞ্জনও ওদের কাছে কোনও মান পাবে না।" 

বাপু খানিক চুপ করে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "যেতে আমাদের হবেই। কিছু করার নেই পৃষোদরী। এ আমাদের রক্তঋণ শোধ।" ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত ওই শব্দটা আমার কানে গুনগুন করতে লাগল : র ক তো ঋণ, রক্তোওওঋণ.. রওকতো ঋণ। 



দ্বিতীয়দিন: 

কদিন হ'ল এসেছি এখানে। মার যত আবোল তাবোল চিন্তা। সব্বাই কি ভাল। দাদারা, কাকারা : বিন্ধ্যকাকা, সোমকাকা, শতানীককাকা, শ্রুতকাকা, কীর্তিকাকা, অভিকাকা...আর দাদামামা। কি সুন্দর! কি সুন্দর! ছোটঠামু, বড়দাদা, দাদা, সেজদাদা, সবাই কত ভালবাসে আমায়! কিন্তু বেশীক্ষণ ভাব করার সময় পাইনি। যুদ্ধু চলছে তো! দাদাদের দাদাকে সেজদাদা বাণের বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। এখন দাদাদের গুরুদেব যুদ্ধু চালাচ্ছে। গুরুদেবের একটা ছেলে আছে অশ্ব না কি যেন নাম। কপালে একটা মণি আছে। ওকে দেখলেই আমার ঘেন্না ঘেন্না লাগে। খালি বেছে বেছে ছোটদের সঙ্গে যুদ্ধু করতে আসে। খায় তেমনি অভিকাকার হাতে মার! আজ থামি।



তৃতীয় দিন: 

কষ্ট হচ্ছে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অভিকাকাকে সাতটা বুড়োধাড়ি একসঙ্গে মিলে মেরে ফেলেছে। ওদের মধ্যে গুরুদেবটাও ছিল। সেজদাদা পাগলের মত হয়ে গেছে। কাল থেকে আমি যুদ্ধে যাব।



চতুর্থদিন: 

সময় নেই হাতে। একটুও না। সারথিকে রথ সাজাতে বলে এসেছি। আমায় এখুনি বাপুর কাছে যেতে হবে। সকালের দিকে দাদামামা বাপুর পিঠে হাত রেখে কি সব বলল। তারপর থেকেই বাপু ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। কেউ বাপুর সামনে যেতে পারছে না। রাত নেমে এসেছে তবু যুদ্ধ চলছে। বাপুর সঙ্গে লড়ছে অশ্ব। আমার একটা ঘোড়া মারা গেল। 

আমি শিবিরে ফিরে এলাম। অন্ধকার শিবির। আমি বর্মটা খুলব বলে হাত তুলেছি হঠাৎ কানে এল বাইরে দুজন কথা কইছে। সেজদাদা আর দাদামামা। সেজদাদা বলছে, "মাধব আপনি আমায় যুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনলেন যে?" দাদামামার হাসি শুনলাম, "আমিই ওই ব্রাহ্মণ বিদ্বেষী রাক্ষসকে যুদ্ধে উৎসাহিত করেছি পার্থ। আজ ওকে থামাতে কেউ পারবে না। অচিরেই কর্ণ একপুরুষঘাতিনী শক্তি হানবেন ওর ওপর। তুমি নিঃসপত্ন হবে! একটা রাক্ষস বলি চায় ব্রহ্মাবর্তের ধর্মযুদ্ধ!" 

আমার বাপু ব্রাহ্মণ বিদ্বেষী! রাক্ষস!! 

মা, মা গো তুমি ঠিক বলেছিলে। যাই করি, যতই করি এরা আমাদের আপন করবে না! ঠামু তোমার সেই রাজ্যটা কোনদিনই গড়া হবে না! আমাকে এখুনি বাপুর কাছে যেতে হবে। বলতে হবে চলে এস বাপু। এ যুদ্ধ আমাদের নয়। যাই আমি। 


*************************************************************************************

বালক অঞ্জন তার পিতার কাছে পৌঁছতে পারে নি। সে সেই গুরুপুত্রকে মহাতেজে আক্রমণ করেছিল। কিন্ত, দেখতে দেখতে সে তার রথ, অশ্ব এবং ধনুক হারায়। আর তার অল্পক্ষণ পরেই এক বাণ তার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামার হাতে নিহত হয় মধ্যমপাণ্ডব ভীমসেনের পৌত্র, মহাবীর ঘটোৎকচের পুত্র অঞ্জনপর্ব্বা।।




[মহাভারতের ঘটনাক্রম একটু আগে পরে করে নিতে হয়েছে। সাহায্য নিতে হয়েছে ভাস রচিত 'মধ্যমব্যয়োগ' নাটকটিরও]

ঋণস্বীকার : ১) মহাভারতের চরিতাবলী --- সুখময় ভট্টাচার্য।
                      ২) মহাভারতের লঘুগুরু -- নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী।





0 comments: