2

ধারাবাহিক - রাজর্ষি পি দাস

Posted in


ধারাবাহিক


ফেরা – ২
রাজর্ষি পি দাস



ষষ্ঠি 

অক্টোবর ২০১৯ 

ডক্টর অর্পিতা বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। আমাকে অনুশাসনে বাঁধতে বাঁধতে অপরাধী করে তুলছে। সারাদিন নিজেকে ক্রিমিন্যাল মনে হয়। আজ বাড়ি ফাঁকা, তাই আমিও ঠিক করেছি একটা ২ লিটার আর সি ফাঁকা করে দেবো! সবাই মার্কেটিং এ গেছে! -সবাই বলতে? আশ্চর্য এ বাড়িতে আমি ছাড়া আর কে থাকে! 



ঠিক আজকের দিনে, ষষ্ঠীতে, আমার প্রথম হিরো গান্ধী ঢাকি আসত। সুদূর তিনসুকীয়ার খগেশ্বর রোডের খেলার মাঠে আজকের দিনে ঠিক দুপুর ২-৩ এর মধ্যে আমার হিরোর পদার্পণ ঘটত। আমি মহালয়ার দিন থেকে দুপুর গুনতাম। গান্ধী এসেই ঢাকে প্রথমে ডানহাতের কাঠির ডি ঢি ড্যাং/ ডি ঢি ড্যাং/ ডি ঢি ড্যাং-ব্যাস পড়াশুনা বন্ধ, নিয়মনীতির মৃত্যু, অপার স্বাধীনতা, মা ঠিক ঢাকের বাঁ কাঠি বাজার আগে বলত--নে তোর গান্ধী এসে গেছে! সারা শরীরে নোনতা শিহরণ নিয়ে এক হাতে হাফপ্যান্ট ধরে ঐ যে দৌড়–আহা বাড়ি থেকে মাঠে পৌঁছনোর ঐ ২ মিনিটের আনন্দ আমি আজও অতিক্রম করতে পারি নি। প্রথম ট্রেনে চড়া, প্রথম নারীর সম্মতি, প্রথম বেতন, প্রথম পাহাড় বা সমুদ্র- কেউ পারে নি। ঐ দৌড়তে দৌড়তে চোখ ভিজে যেত আর যখন আমি গান্ধীর সামনে গান্ধী ঝাপসা। আমার হিরো আমার দিকে তাকিয়ে যথারীতি গোঁফের হাসি। দুতিনবার পাক মেরে অফ তালে বাজিয়ে সোজা আবার বোধনের তালে - ইতিমধ্যে আমার বন্ধুরা- না শুধু আমার বন্ধুরা নয়, দাদা-কাকু-জেঠু-দাদু সবাই হাসিহাসি মুখ নিয়ে গান্ধীকে ঘিরে দাঁড়াত। শুধু আমার নয় পুরো পাড়ার ছুটি ঘোষণা করত আমার হিরো। 

বাজানো শেষ হলে আমরা ক্ষুদেরা ঝাঁপিয়ে পড়তাম, কারণ এবার ঢাকের পেছনে জল ঘষার পালা – কে আগে! কোনওদিন সামনের চামড়ায় স্পর্শ করার সুযোগ পাই নি, দাদারাও পেতেন না। গান্ধী নিজের ঢাক বলা যায় বুকে আগলে রাখতেন। আমরা ঘ্যানঘ্যান করলে গান্ধীর প্রতিবছর এক উত্তর – কোন ক্লাস? আমরা কোনও উত্তর দিতাম না। কারণ আমরা পরের উত্তরটা জানতাম – মেট্রিক পাশ কর, তারপর।

আমার কাছে পূজার চেয়ে অনেক বড় ছিল আমাদের ঢাকি। বাকী যাঁদেরকে নিয়ে এত হুলুস্থুলু তাঁরা তো সবাই মাটির ডেলা। বাক্যালাপ করা যায় না, প্রতিক্রিয়াশূন্য রংচঙে তিনজন মহিলা, দুজনপুরুষ, একটি সিংহ, একটি কেলানো মহিষ, একটি নেংটি ইঁদুর, একটি পেঁচা, একটি ময়ুর, একটি হাঁস ও একজন গণেশ। পেছনে এক একা মাকড়শার ঝুলের মত শিব ঝুলছে। প্রতিবছর একই সমাহার। হ্যাঁ গণেশের প্রতি আমার একটা পক্ষপাতিত্ব ছিল, সেটা কেন বলতে পারবো না, হয়ত ভবিষ্যত দেখেতে পেতাম সেটা তখন বুঝতে পারতাম না, এখন আয়নার সামনে দাঁড়ালে বুঝি। 

আমার হিরো কিন্তু প্রতিবছর নতুন কিছু না কিছু তাল তুলে আনত। সেটা অষ্টমীর রাতে আরতি প্রতিযোগিতায় আছড়ে পড়ত আর আচ্ছা আচ্ছা আরতি করিয়েরা তাল কেটে দাঁড়িয়ে পড়ত। তবে ভুপতিদার ব্যাপার আলাদা ছিল, গান্ধীও ওঁকে শ্রদ্ধা করতেন। ভুপতিদা মানেই আরতিতে প্রথম পুরস্কার। দুজন দুজনকে দাঁড় করিয়ে দিত আর হাসত। একমাত্র ঐ ভুপতিদার আরতির সময় গান্ধী পায়ে বড় ঘুঙুরের গোছা পড়ত আর ভুপতিদার তো ওটা নিজস্ব শব্দমেজাজ ছিল। ধুনুচি খেলা শেষ হলে শুরু হতো দুজনের আসল নাচ, ঐ প্রথম তালনৃত্য কাহাকে বলে দেখা। পাড়ার মেয়েরা রবীন্দ্র সংগীতে নাচত কিন্তু সেটা কেমন যেন বাসীরুটি খাওয়ার মত শক্তশক্ত লাগত! 

ভুপতিদার ধুনুচি করিশ্মা দেখানোর সময় গান্ধী তিনতালে বাজিয়ে যেত, তারপর নিজের নতুন তাল ঢাকে খুব মৃদু থেকে চড়া, ততক্ষণে দুজনের পায়ের তিনবেড়ির ঘুঙুর, ভুপুতিদাকে একটা একটা সময় দাঁড়িয়ে পড়তে হতোই।! সাথে তুমুল হাততালি আর চিৎকার, না ভুপতিদার হেরে যাওয়ার জন্য নয়, কারণ এবার শুরু গান্ধীর নাচ। ভুপতিদা হাসতে হাসতে তিনবেড়ির ঘুঙুরে তালটা ধরে রাখতেন আর গান্ধী অদ্ভুত সব তাল, মাঝেমধ্যেই মধ্যে শুধু ডানহাতের চেটো দিয়ে ঢাক ঘষে অভূতপূর্ব সাউন্ড - সর্বোপরি শূন্যে লাফিয়ে লাফিয়ে মুহূর্মুহূ ঘুরে দাঁড়ান। কাঠি কিন্তু চলছে-- শিরদাঁড়া দিয়ে আনন্দ উথলে চোখের জল সাথে প্রবল ধোঁয়া, টিউবের আলো, ঢাকের তাল আর ঘুঙুরের ছমছম মিলেমিশে এক অস্পষ্ট স্বর্গীয় আবহে একজন শীর্ণ ঢাক বাদকের ঐ স্কীল, স্টাইল, প্রাণশক্তি এক জলজ্যান্ত দেবতার জন্ম দিত। 

না, একজন ঢাকির ঐ ম্যাজিক, শোম্যানশিপ আর কোথায়! আমি দামড়া হয়ে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের অনেক ঢাকি দেখেছি, শুনেছি- নাঃ! আর ঢাকের ঐ টোন! এখন ঢাক শুনলে মনে হয় বেসুরো বাজছে। 

না, মেট্রিক পাশ করার পর গান্ধীর সাথে আর দেখা হয় নি, ততদিনে জাতি-ভাষা দাঙ্গায় গল্প সব অন্য হয়ে গেছে। তবে আমার হিরো আমার মধ্যে এখনো বেঁচে আছে। জানি না গান্ধীদা এখনও বেঁচে আছে কিনা বা কোথায় থাকে। সে এখনও ষষ্ঠীর দিন-- দুপুর ২-৩ এর মধ্যে ঠিক বেঁচে ওঠে, সে যেখানেই থাকি না কেন, বেজে ওঠে আর দশমী পর্যন্ত স্বাধীন ও উদ্দাম আমি -- ২ লিটার RC আছে গান্ধীদা। না, পুরো নাম জানি না! চিয়ার্স গান্ধীদা! 

ঘুণো খামরাই অর্দ্ধেক ২ লিটার আর সি বোতলের দিকে তাকিয়ে ভয়ে পাথর হয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কটা বাজে? ঘুণো দুবার জিজ্ঞেস করার পর উত্তর দিল – আড়াইটে!

গান্ধীদা যেবার থেকে আসা বন্ধ করে দিল, আমি তখন ক্লাস এইট–আর দুবছর বাকী মেট্রিক পাশ করতে! কিন্তু ঐ বছর পুজোর আগেই ডেকা-টিটু, আমাদের পাড়ার একমাত্র অহমীয়া সমবয়সি ছেলে, মাঠে আসা ছেড়ে দিয়েছে। ফুটবল খেলায় সামান্য লাথালাথি, যেটা ভীষণ স্বাভাবিক ছিল, ডেকা টিটুর একটা উক্তি আমাদের সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ‘ক্যালা বঙ্গালি’। কেলা শব্দটা অহমীয়াতে একটা মজা করার শব্দ, প্রয়োগ হতে শোনা-দেখা হাসি ঠাট্টার মধ্যে। বিশেষ করে সমবয়সীদের মধ্যে। সিরিয়াসলি ব্যবহার করা হতো কাউকে হেটা করার জন্য, অপমান করার জন্য। কিন্তু একটা পুরো জাতির জন্য, তাও আবার বাঙালির জন্য এই বিশেষণ জীবনে প্রথম শুনে আমার হতবাক হয়ে পড়েছিলাম বেশ কিছুক্ষণের জন্য! নন্তু, আবার দুএকবার ওকে থামানোর চেষ্টা করলে টিটু ঘাড় গুঁজে আরও একবার বলে উঠেছিল – ক্যালা হুনিছা নে কিম কলুন ময়? একটা শিরশিরানি আবহের মধ্যে সবাইকে হতভম্ব করে ডেকা টিটু ঐ যে একবারও পিছনে না তাকিয়ে মাঠ ছাড়ল, তারপর আর আসামে বাঙালীর জীবন আগের মত রইল না। আমরা সবাই ভয় পাওয়া মহিষের মত মাঠের মাঝখানে গায়ে গায়ে গা ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ বসেছিলাম। বড়দের মুখে শোনা নিজেদের ভাষা –পরিচয়ের সংকট প্রথম অনুভব করলাম। আমরা কোনওদিন টিটুকে আহমীয়া ভাবি নি, আমাদের মত একজন ভেবেছি, কেউই ওর সাথে অসমীয়া ভাষায় কথা বলতাম না। তবে পিছনে লাগার সময় অসমীয়া বলতাম --- ‘ডেকা তর পোঁদখন এনেকা’ বলে নন্তুর নিজের পাছা বেকিয়ে দাঁড়ানোটা সবাইকে হাসিয়ে দিত। এমনকি ডেকা টিটুও হেসে ফেলত। তারপরই শুরু হতো একটা ছদ্ম-তাড়া, ধরে ফেলতে পারলে ধস্তাধস্তি। না হলে ঐ তাড়াতেই যে যার বাড়ী। বাকী সবাই হেসে লুটোপুটি। এবং পরের দিন আবার সেই মাঠ – হয় ফুটবল নাহলে ক্রিকেট অথবা পিট্টু... কিন্তু এবার সবাই কোনওরকম কথা না বলেই বুঝে গেলাম টিটু আর আসবে না। তাঁর তিন-চারদিন পর শুনেছিলাম জেঠুর স্বগোক্তি – ‘বাঙালির আবার মাইর খাইবার সময় আইসে। ক্যালা বঙ্গালী’ 

ক্যালা বঙ্গালীই বটে! আমাদের ব্যারাকে, মানে মজুমদার ব্যারাকে বিখ্যাত সেনাইরাম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষক ভট্টাচার্য স্যার ওঁর পরিবার নিয়ে আমাদের ব্যারাকে থাকতেন। তখন আমি ক্লাস সেভেন। উনিও দেখি একদিন ডেকা টিটুর ঘটনার পর ওনার সদাহাসি মুখে শুকনো হাসি ছড়িয়ে আমাদের সবাইকে ‘যাও দে’ বলে ভাই, মাকে নিয়ে চলে গেলেন। ভট্টাচার্য স্যার গতমাসেও আমাদের বাড়িতে বা বুড়াদের বাড়িতে ওঁর ঘাড় পিছন দিকে হেলিয়ে ব্র্যান্ডেড হাসি হেসে সবাইকে টাটকা রাখতেন। কিন্তু কথা বলতেন একদম নীচু গলায়, মার্জিত, শিক্ষিত উচ্চারণ। সাধারণ অহমীয়াদের উচ্চারণ দোষ ওঁর ছিল না। উনি বলতেন, নিখুঁত বাংলায় – বৌদি আমাদের ঐ তাম্বুল পানটা উচ্চারণের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে! বলেই একটা তাম্বুল পান মুখে নিয়ে সেই ব্র্যান্ডেড হাসি – হো হো হো- উনি ব্যারাকের যেই বাড়িতেই থাকুন না কেন ওঁর হাসি প্রত্যকটা বাড়িতে গমগম করত। দেখতে অনেকটা গ্রিক দেবতাদের মতন, নাক আর থুতনি সহ, পাকা গমের মত গায়ের রঙ, মাছ খেতে ভীষণ ভালবাসতেন-- বিশেষ করে ইলিশ মাছ। সেটা কি জানতাম না। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে পেয়াজ পর্যন্ত ঢুকত না। উনি হা হা করে হাসতে হাসতে বলতেন -- আমি কিন্তু বাঙালি মেয়েকেই বিয়ে করব! বৌদি আপনি তো কলকাতার মেয়ে আমার জন্য একজন সুন্দরী ...। হ্যাঁ, উনি শুদ্ধ কলকাতার বাংলা বলতেন। আমরা বলতাম- কেল্কেশিয়ান কয়! 

ডেকা ডাক্তার আর ভট্টাচার্য স্যার ছাড়া খগেশ্বর রোড পাড়ার আর মাত্র একমাত্র অসমীয়া ফ্যামিলি গোহাই ফ্যামিলি, যাদের পূর্বপুরুষের নামে আমাদের পাড়া খগেশ্বর গোহাই রোড। ওঁদের ফ্যামিলির সবাই ঐ দেবতার মত দেখতে, পার্থক্য, নাকচিবুক আর গায়ের রঙ, মানে ভট্টাচার্য স্যারের তুলনায়। গায়ের রঙ মুসুর ডালের মত আর নাক চিবুক মঙ্গলইড। গোঁহাই পরিবারের কেউ কখনও পাড়ার কোনও বাঙালি মহিলা আর শিশু-বালকদের সাথে অহমীয়া ভাষায় কথা বলতেন না। ডেকা পরিবারের কেউ না, ভট্টাচার্য পরিবারের কেউ না। ফলে, অহমীয়া ভাষার মত একটি মিষ্টি আর মেলড্রামাটিক ভাষা আমার মা আর আমার আর শেখা হলো না। বাল্যে শেখা হয় নি আমার আশেপাশে কেউ বলতেন না বলে আর পরে শিখি নি ‘কেলা বঙালী’ আন্দোলনের একজন অন্যতম চরম ভিক্টিম হয়ে। যদিও আমাদের পাড়ার কোনও অহমীয়া সদস্য ভুল করেও, ঐ বছর ১২, ডেকা টিটুর একবার মুখখারাপ করা ছাড়া, কোনও অপ্রীতিকর শব্দ তো দূরের কথা কোনওরকম কঠোর শরীরীভাষাও প্রকাশ করেননি -- কক্ষনো না! কোনওদিনও না! 

তবে আমি কিন্তু ভিক্টিম হবার রাগ আর হতাশা অনেকদিন অব্দি ভুলতে পারি নি। সংখ্যালঘু হবার যন্ত্রণা শেয়ার করা যায় না। বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। একটা অদ্ভুত ভয়, নিজের ছায়াকে দেখে চমকে ওঠার মত! দাঁতে দাঁত চেপে আমি আমার প্রিয় অসমীয়া বন্ধুদের সাথে নিজের পাড়ায় হলে বাংলা বলতাম আর বাইরে হলে হিন্দি বলতাম। মাতৃভাষা আর রাষ্ট্র ভাষা থেকে সরতাম না। এমনকি ১৯৯২ তে গুয়াহাটির সবচেয়ে স্পর্শকাতর এলাকা, ‘আলফা’ অঞ্চল- ‘লাচিত নগরে’ আমার এয়ার ফোর্সের সিনিয়র কলিতাদার বাড়িতে হিন্দি কথা বলা শুরু করলে ওনার দিদি কলিতাদাকে – তুমি কই আছিলা হি তিনচুকিয়ার লরা! কলিতাদা সাথে সাথে- কলকাতার বাংলায় আমাকে– দাস বাংলা বল... বাংলা...! দিদিও সাথে সাথে হেসে অসমীয়া আঙ্গিকে কলকাতার বাংলা বলা শুরু করলেন এবং ২-৩ রকমের মাছ দিয়ে প্রায় গ্রাস বানিয়ে খাইয়ে দেবার মত যত্ন করেন। সাথে বাঙ্গালী আর অসমীয়াদের মাছ রান্নার মিল ও অমিল নিয়ে টানা বাংলায় ৩০ মিনিট বক্তৃতা, পরিশেষে ‘বাঙ্গালীরাই ভাল মাছ রান্না করে’ দিয়ে সমাপ্তি। শুধু দিদিই নন, বাড়ীর অন্যান্য সদস্যরাও আমার সাথে কথা বললেন ঐ বাংলা ভাষায় প্রায় আরও ২ ঘন্টা--আমার ষ্টেশনে যাওয়ার জন্য গাড়ি বের করা অব্দি। সেই প্রথম আমার কোনও অসমীয়াভাষীদের সাথে বাংলায় কথা বলতে মারাত্মক কষ্ট হচ্ছিল। খাওয়ার পর প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমি হেরে যাবো-এই প্রায় অসমীয়া বলা শুরু করলাম বলে! হেরে যাওয়া শব্দটা ব্যবহার করলাম কারণ আমার তখনও মনে হতো, আমার ১৩ বৎসর বয়স থেকে পতন ও পচনের যাবতীয় অসমীয়াদের। বড় হয়ে বুড়ো হয়ে আজ বুঝি আমি ভুল ছিলাম। আমার ২ থেকে ১৮ বৎসর অব্দি বেড়েবর্তে ওঠার ভুমিভাষা তথা ভুমিজনগনের প্রতি অনীহাই আসামে ‘কেলা বঙালি’ আন্দোলনের বোধন। হয়তো পূর্ববাংলাতেও বাঙালি মুসলমানদের প্রতি হিন্দু বাঙ্গালীদের দৈনন্দিন জীবনে চরম হেটা করার অভ্যাসের ফল পূর্বপাকিস্তান! তারপর বাংলাদেশও জন্ম নিল ঐ হেটা করার বিরোধীতা থেকে। তফাত, প্রথম ক্ষেত্রে ধর্ম, দ্বিতীয় অবস্থায় ভাষা! ভাষা আমার মনে হয় ধর্ম থেকেও বেশি শক্তিশালী, অন্তত ভাষা হারালে যে মানসিক ডিপ্রেশন আসে তার সাথে অন্য কোনও কারণের কোনও তুলনাই হয় না! 

তবে বাঙালি কারা! চিটাগাং থেকে খেদানো জেঠু বরিশাল থেকে পালানো বাবাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন 

বাবা বলতেন ‘আমরা’! 

জেঠু এই ‘আমরা’ শব্দটিকে কখনও কাউন্টার করতেন না, শুধু ক্যাপ্সটনের ধোঁয়া ছাড়তেন। বাঙ্গালীর দ্বিতীয় মাইগ্রেশনে, যারা ব্যবসায়ী, তাঁদের নতুন জেনারেশন চলল কলাকাতার দিকে আর যারা সিলেটি চলল শিলচরের দিকে! এই প্রথম শুনলাম বাংলা ভাষার জন্য প্রথম প্রাণ দিয়েছিলেন সিলেটের ছাত্র! আমার প্রিয় বন্ধু বুড়া চোখ ভাসিয়ে বুক ভাসিয়ে চলে গেল শিলচরে! মামা বাড়িতে! দুম করে একটা সামজিক বসবাস চারদিক থেকে ভেঙ্গে পড়ল! এই প্রথম বাঙালি বুঝতে পারল - আসাম আর তাহাদের নয়। 

যখন বাঙ্গালির দ্বিতীয় মাইগ্রেশন চরমে, জেঠু একদিন তাঁর হলুদ তর্জনী আর মধ্যমার মাঝখানে ক্যাপ্সট্যান সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ইজ্রায়েলীদের নাম শুনেছেন? ইজ্রায়েলী...! বাঙালি হিন্দুদের ভবিষ্যত কি জানেন! মাঠে ঘাটে নিজের দ্যাশরে বুকে নিয়া ঘুইর‍্যা বেরাইতে হইব, খুব শিগরী দেখবি আমাদের আর কোনও দ্যাশ থাকবো না! 

এই প্রথম শুনলাম ‘বাঙালি হিন্দু’ শব্দ! 



বাদাম আনতে গিয়ে কোথায় চলে গেলে ঘুণো? ও ঘুণো ...ঘুণো! আররে... বোতলটা কোথায় গেল!!

2 comments: