ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
তমসায় কেঁদে উঠলো কেঁপে কেঁপে, আর তার অন্তর দৃষ্টিতে জেগে উঠলো ইতিহাস
পেরো
আনাড়ি জংলীদুটোকে দিয়ে কাজ করানো খুব কঠিন। এটা পেরো হাড়েহাড়ে বোঝে। খরস্রোতা পাহাড়ি জঙ্গলি নদীর একেবারে পিছল খাড়া খাই থেকে একটা মানুষের দেহ এত উপরে উঠিয়ে আনা এমনিতেই ঝামেলা। তার উপর এই লোকগুলো মানুষ পাথর কাঠের গুঁড়িকে একই গুরুত্ব দেয়। এইসবকে দিয়ে দল তৈরি করে শিক্ষিত লোভী অমানুষ শোষকদের সামনা করা খুব কঠিন কাজ। গাছপালা জানোয়ার পাখি পোকামাকড় জংলী মানুষ যেই হোক না কেন, জঙ্গল রানী তার প্রজাকে এক অতিন্দ্রিয় স্পর্শকাতরতা দিয়েছে। বিপদ এলেই সে তাকে আগেভাগে তার সংকেত দিয়ে দেয়। সংকেত পড়ে নেওয়ার ক্ষমতাও সে তাকে দেয়। বংশানুক্রমে সেই সংকেত আদিবাসীরা তাদের পূর্বজের কাছ থেকে পায়। এই নিয়মেই জঙ্গলের প্রাণী বিপদসংকুল বনানীতে বেঁচে থাকার ক্ষমতা পায়। বাজ পড়ার আগে মানুষের চুল খাড়া হয়ে যায় ছুঁচের মত। সতর্ক হয়ে যদি সে সেখান থেকে সরে যায় তো ভাল, নচেত্ মৃত্যু। বাঘ আসেপাশে ওত পেতে থাকলে তার গায়ের বিকট গন্ধে সতর্ক হয়ে যায় শিকার। একধরনের বুনোঘাসও মারণ বিপদের সময় বিকট গন্ধ ছড়ায়। যার ইন্দ্রিয়ের সাড় আসে সেই বাঁচে। কিন্তু এই দোগলা আদিবাসীরা ওই স্পর্শকাতর ক্ষমতাটি দিনদিন হারিয়ে ফেলছে যেন। আর আমি কি ওদের চেয়ে আলাদা? পেরো দোষারোপ করে নিজেকে। আগে জঙ্গলে দিশাহারা পথহারা হয়ে মাসের পর মাস যখন ঘুরে বেড়াতাম, খাদ্য পানীয়ের কোনও কি অভাব হতো? বড় বড় পাথরের কোলে লম্বা লম্বা রসালো ঘিকুমারির পাতা থেকে জল, বনকলা, মহুল, ঘুঘু আর সাপের মতন তুড়মাছ। উইঢিবি ভেঙে সাদা সরস উইপোকা। ফরফর করে ডানা মেলে উইগুলো উড়তো আর আঁজলা ভরে ধরতাম আর মুখে পুরতাম। কিন্তু উইঢিবি ভাঙ্গলেই যে উই ডানা মেলে উড়তে থাকবে তা নয়। সেই উইঢিবি যদি সাপের কবলে থাকে, তা ভাঙ্গতেই ফোঁস করে লাফিয়ে বিষধর খরিস কপালে ছোবল মারলেই তার আর বাঁচার উপায় নেই। কিন্তু তখন এমন হতো, ঢিবির গায়ে হাত বুলিয়েই বুঝে যেতাম সেটাতে নির্বিষ ডানাওলা পূর্ণ উই আছে, কি ভিতরে শমন।
কিন্তু আজকাল সেই হুঁশটা আর নেই। কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি আজকাল। শহুরে মানুষের ফন্দিফিকির শিখে এমন হচ্ছে হয়ত। আমার তো নাহয় কারণ আছে, কিন্তু এই আদিবাসী ভাইগুলোর? জংলি নদীর মারন পিছল উঁচু পাড়ের উপরে জেরকাকে তুলে আনতে যে কি কষ্ট হলো সেটা বলে বোঝানো যাবে না। তার উপর খাড়ির ভিতরে রাত নামছে। জেরকাকে উপরে তুলে আনতে একবার ওদের কাঁধ থেকে যখন পিছলে আবার সে মাথার ভরে গড়িয়ে পড়ল, তখন পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলাম ওটা মড়া। জেরকা ওই অবস্থাতেও যে মারা যায়নি সেটা জঙ্গল রাণীর কৃপা। জেরকা এখন হাত পা ছড়িয়ে মড়ার মতন মাটিতে পড়ে। চাঁদনী আলোয় গোরা সাবজী হলুদ চট্টানের উপর শোয়া কালো মেয়ের খোলা বুকে কান রেখে শুনছে সে বেঁচে আছে কী না। পেরো চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে রয়ে গেল। বড় অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। অবশ্য সাবজী জেরকার গায়ে লেপ্টে যেতেই পারে। সাবজীর হক আছে। কিন্তু পেরোর গা রিরি করে ওঠে। জেরকা তো ওর মা, সেটা পেরো ভালই জানে। কিন্তু ওই জানা অব্দি। মন প্রাণ সাড়া দেয় না। কোনও অনুভূতি হয়না জেরকার সামনাসামনি হলে। বরং অস্বস্তি হয়। এমনকি কোনও প্রাণীরই মাদা পছন্দ নয় তার। পেরোর একটু দেখা পেলেই জেরকা মুখে কাপড় দিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয়। এই ব্যাপারটাও পেরোর মাথায় ঢোকেনা। পেরোর মাথায় তাই হয়তো একটাই নির্দেশ কাজ করে। মাদী বাদ দিয়ে সমস্ত মদ্দা জানোয়ার তার হয় শিকার, নয় খাদ্য। এরমধ্যে মাদী হিংস্র হলেও তাকে এড়িয়ে চলে। পেরো জানে জেরকা সাবজীর মতন না হলেও কিন্তু শিক্ষিত। আদিবাসী বুনো মানুষের হকের জন্য জেরকা শহরের বাবুদের সাথে অনেক লড়াই করে। অনেকবার জেল খেটেছে। ওকে এখন কে জখম করেছে কে জানে? এই কথা মনে আসতেই পেরোর গা গরম হয়ে গেল। গতকালই একটা লোভী পোচারকে সে খাঁড়ির দলদলে পুঁতে দিয়ে এসেছে। জেরকার অনিষ্টকারীকে সে কোনও মতে ক্ষমা করবেনা। ধরতে পারা চাই। আসলে লোভী চোরডাকাত খুনীর চেয়ে অনেক বেশি শয়তানী বুদ্ধি ওই সরকারি লুঠেরাদের। ওদের কাছ থেকে ভালো কিছুই আশা করা যায় না। সরকারি চাকুরে হওয়ার আগেই তাদের রক্তের স্বভাব বদলে যায়। তারপর শুরু হয় নিজের চামড়া বাঁচিয়ে চাকরি বাঁচিয়ে ধীরে ধীরে লোভকে আর তোষামদপ্রিয়তাকে কি ভাবে পরিশীলিত করা যায় দিনরাত এই চিন্তা। আদিবাসীদের নানান অনুদান সরকারি অফিসে যখন আসতো তখন পেরো সকলকে নিয়ে সেখানে যেত আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতো। ওদের চোখে শিক্ষিত হওয়ার অহংকারের পর্দা, তাই পেরোর সামনেই ঐসব নাটক চলতো। ভাবতো বুঝি পেরো জঙ্গলী নির্বোধ। পেরোর গা গসগস করতো রাগে।
সাবজী উঠে দাঁড়ালেন। পেরোকে বললেন,- নাড়ি খুব কমজোর। মাথায় গায়ে প্রচুর আঘাত। মনে হয় কেউ ভোজালি দিয়ে অনেক জায়গায় স্ট্যাব করেছে। শরীরে মনে হয় খুন খুব কম। আদিবাসী রক্ত বলেই এখনও প্রাণ আছে। জ্ঞান ফেরাতে হবে। এখান থেকে ওকে সরানো দরকার। ঘরে নিয়ে চল।
ঘরে নিয়ে যেতে হবে? পেরো অবুঝের মতো সাবজীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নির্জন বনানীর জ্যোত্স্না। চারদিক পরিষ্কার দৃশ্যমান। সাবজী বললেন –জানি পেরো। তোদের ঘর বলে তো এখন কিছুই নেই। আপাতত আমার ঘরে নিয়ে চল। তুই তো এখানে মোস্ট ওয়ান্টেড। তোর মাথার দাম পাঁচ লাখ। আমাদের গ্রামের সবাই ছাড়া ওরা কেউ তোর এখানে আসা যাওয়ার খবর জানেনা। দেখ আমরা সবাই কতো ভালবাসি তোকে। জেরকার নামেও ওয়ারেন্ট আছে। তবু আমি ম্যানেজ করে নিতে পারব। লেফ্টনেণ্ট সমুর সাথে যা হবে তার চেয়ে এর জান বাঁচান বেশি প্রয়োজন। তুই ওখানে পৌঁছে দিয়ে চলে যা। আমি সামলে নেব।
কি মনে হতে পেরো জেরকার পাশে বসে পড়ল। হাত বাড়িয়ে গলার পাশে আঙুল দিয়ে একটা শিরা টিপে নাড়ির স্পন্দন অনুভব করতে লাগলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সাবজী থোড়া রুকিয়ে। ইসকা বদন গর্ম করনে কে লিয়ে এক দাওয়া ম্যায় জানতা হুঁ। বদন ঠাণ্ড হো রাহা হ্যায়। ম্যায় আভি লায়া- এই কথা বলে সেখান থেকে হাওয়ার বেগে অদৃশ্য হয়ে গেল।
চাঁদটা যেন মস্তবড় রূপোর থালা হয়ে আকাশে ঝুলে আছে। জঙ্গলের এই এলাকাটা সবচেয়ে উঁচু। এখান থেকে পৃথিবীটা ঢালু হয়ে গড়িয়ে অশেষ অন্ধকারে নেমে গেছে। রাতচরা মাংসাশী শ্বাপদের ধর্মই হচ্ছে রাতের বেলায় শিকারের খোঁজে ওরা পাহাড়িয়া জঙ্গলের নিচে নেমে যায়। টাপু তাই সবচেয়ে নিরাপদ। পেরোর কাছে এই জঙ্গলের এলাকা নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মতই চেনা। চোখ বন্ধ করেও যেখানে খুশি যেতে পারে। যেতে যেতে বিছুটির ধারালো পাতায় পা ঘষটে গেল। অজস্র ছুঁচ বেধার মতো পাদুটোতে অসহ্য জ্বালা। পেরো লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়তে লাগলো। একটা মস্ত চৌড়া বাঁশ ঝাড় পেরিয়ে একটা ফিট সাদা মতন জায়গায় এল। কোয়ার্জ পাথরের একটা স্তুপ থেকে হাজার চাঁদ ঠিকরে প্রতিফলিত হচ্ছে। চাঁদের আলোতেও চোখ ধাঁধিয়ে যায়। পেরো দেখল তার গায়ে চকরা বকরা নক্সাকাটা আলো। একটু এগিয়েই একটা গর্তে বেশ কিছুটা ঝাড়ির সামনে উবু হয়ে বসল। প্রচুর কলস উদ্ভিদের পাতা ঢাকনা খুলে ফাঁদ পেতে রয়েছে। পাতার ডগা ছোটো ঘটি আকারের। কলসগুলোর মুখ মধুতে চকচক করছে। অনেক জায়গায় কলস পাতা দেখেছে পেরো। সেগুলো খুবই ছোটো। এখানকারগুলো অনেক বড়। প্রায় এক হাতের আঁজলার সমান। পেরো কয়েকটা কলসপাতা ছিঁড়ে নিল। আর একবার একটু ছোটো দৌড়। এবার লম্বা লম্বা ঘন গাছের আড়ালে একটা গোল মতন চত্বর।চত্বরটার মাঝে চ্যাটালো পাথর।পাথরে মাঝে মাঝে কয়েকটা ছোটো বড় গর্ত। চত্বরের চারপাশের গাছগুলোর লম্বা লম্বা ডালগুলো পাথরের উপরে নুয়ে। গাছের ওই শাখাগুলোতে প্রচুর মৌচাক ঝুলে আছে। প্রকৃতির কি অদ্ভুদ খেয়াল ! পাথরের উপর ঘন হয়ে নুয়ে থাকা ডালগুলি থেকে ঝুলে থাকা মৌচাকের মধু বৃষ্টির জলের সাথে বা এম্নিতেই হাওয়ার দাপটে টপ টপ করে ঝরে পড়ে জমা হয় পাথরের গর্তে। পচন হয়। তৈরি হয় বিরল মদ মাধ্বী। মহা সঞ্জীবনী সুরা। পেরো জানে এখানকার মৌমাছিগুলো ভয়ানক হিংস্র।মারকুটে। তবে এখানকার সন্ধান শুধু পেরোই জানে। আর জানে একটা ভালুক। ভালুকটা আসে গভীর রাতে। এসে মধু সুরা পান করে যায়। পেরো কখনও কখনও আসে সন্ধ্যের গোড়ায়। ওদের ভিতরে অজান্তেই একটা বোঝাপড়া হয়েছে। কেউ কাউকে ঘাটাতে চায়না।
খুব সাবধানে পা টিপে টিপে পেরো একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। পাথরের চট্টানটা হালকা সাদা, তাই গাছের ঘেরায় অন্ধকার হওয়া সত্বেও আভাসে বোঝা যায়। চোখ কান খোলা রেখে কিছুক্ষণ দেখল নিঃশব্দ নিঝুম। কেউ নেই। হামাগুড়ি দিয়ে পাথরের মাঝবরাবর পৌঁছে একটা গর্তে হাত ডুবিয়ে দেখল বেশ কিছুটা তরল জমা আছে। কলস পাতা কয়েকটা ডুবিয়ে তাতে ভরে নিলো আর আঁজলা ভরে কিছুটা খেয়েও নিলো। সেখান থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে দৌড় লাগালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে হাঁফাতে হাঁফাতে প্রথমেই মাটিতে পড়ে থাকা জেরকার গলার কাছে হাত দিয়ে দেখলো গা ঠাণ্ড কিন্তু গলার কাছে ধুকধুকি নড়ছে।
0 comments: