0

প্রবন্ধ - কুন্তল মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


সংস্কৃতির ভাষা
কুন্তল মুখোপাধ্যায়



কথা বলা। শুধু তো কথা নয়, বলাও। বলা মানে অন্যের উদ্দ্যেশে বলা। তার মানে অন্যের সঙ্গে সংযোগ তৈরী করা। বাণী তা সে। ব্যক্ত বা অব্যক্ত, সরবে, নীরবে, নিভৃতে যেভাবেই প্রকাশিত হোক, তার মূল লক্ষ্য কিছু মানুষকে শোনানো; এমনকী প্রতিধ্বনি হলেও, নিজেকে শোনানো।শোনানোটা যদি অবজেকটিভ ফ্যাক্টর হয়, তবে যা শোনানো হচ্ছে তা নিশ্চয়ই সাবজেকটিভ, এবং শোনানোটাও যাকে শোনানো হচ্ছে তার কাছে পৌঁছেই হয়ে যাচ্ছে সাবজেকটিভ। এ যেন থিসিস্‌ - এন্টিথিসিস্‌ এবং সিনথেসিসের খেলা। আর একথাও প্রায় সবাই জানে এবং মানে কথার জোরে, যুক্তির জোরে অন্যকে আনা যায় যিনি বা যারা কথা বলছেন তাদের পক্ষে। কথার জোরে বুঝিয়ে বলতে পারলে, সমাজে হিংসার প্রয়োজন হয় না। কথা বা বাণীই হলো ক্ষমতার মূল সূত্রখণ্ড। ক্ষমতা পেতে, ধরে রাখতে এবং ক্ষমতার নিরিখে সমাজকে চালাতে হিংসা ছাড়া কথাই হলো চূড়ান্ত অস্ত্র। এখান থেকেই একটা হাইপোথিসিস-এর জন্ম, সংস্কৃতির কথা বলে কিছু হয় না। কারণ কথাই সংস্কৃতির বহি:প্রকাশ; এবং সংস্কৃতি যার নিয়ন্ত্রণে, ক্ষমতাও তার নিয়ন্ত্রণে।

অতি সম্প্রতি আমাদের নাটকে, চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত কথা বা বাণী সংস্কৃতির এই ক্ষমতায়নের বহিঃপ্রকাশ। সদ্য সদ্য মুক্তি পাওয়া কিছু বাঙলা ছবি এবং বাঙলা নাটকের সংলাপের কথা এবং সেই কথা শুনে দর্শক-শ্রোতাদের তুমুল হর্ষধ্বনি এই ক্ষমতায়নকেই প্রতিষ্ঠা দেয়। বাঙলা সংস্কৃতির একটি প্রচলিত মীথ চলচ্চিত্রে, নাটকে পুলিশ মানেই খারাপ কথা, যা শালীন নয় তা বলবে। পুলিশদের চারপাশের পরিবেশ, ক্রিমিনালদের সঙ্গে যাদের মেলামেশা তাদের ভাষার গণ্ডি ভেঙে ফেলে; কথার, ভাষার অপরাধীকরণ ঘটে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সেগুলি ব্যবহৃত হয় যখন ক্রিমিনালদের সঙ্গে কথোপকথন ঘটে সেই সময়। যখন তারা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজন পরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন এমনটি বলেন না। ইদানীং কালের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার তাঁর ছবিতে পুলিশ-অফিসারদের মুখে যথেচ্ছ তথাকথিত অকথ্য কথা বলিয়েছেন, “বাইশে শ্রাবণ” ছবিটিতে দুই মুখ্য প্রোটাগনিস্ট চরিত্র একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার এবং অন্যজন শাস্তিপ্রাপ্ত অবসৃত পুলিশ অফিসারের মুখে অনর্গল অশ্লীল কথা জুগিয়ে গেছেন। ওই একই চলচ্চিত্রে একজন মিডিয়া সাংবাদিক পুরুষ ও পুলিশ কমিশনারের মুখে কিন্তু সফিস্টিকেটেড কথাই বলানো হয়েছে। “আলতাফ্‌ গোমস্‌” নাটকে পুঁজির মালিক ও তারই সহায়ক হয়ে ওঠার কথা, অথচ নাটকে তা নয় এমন পুলিশ অফিসারের মুখে প্রায় ওই একই ধরনের কথা বা ভাষার প্রয়োগ ঘটেছে। যে দর্শক-শ্রোতা এই কথাগুলো শুনছেন তাদের অধিকাংশের বেশী শ্রোতা এই সব বাণী শ্রবণে যেভাবে তুমুল হর্ষ ও উল্লাস প্রকাশ করছেন, যা একটি অনন্য সামাজিক অভিজ্ঞতা, আবার বেশ কিছু দর্শক শ্রোতা ছবিতে-নাটকে ব্যবহৃত ওই ভাষার হিংস্রতার কাছে বিনম্র পরাজিত ব্যক্তিত্ব হিসাবে হয় নীরবে ধিক্কার জানাচ্ছেন বা ওই স্পেস্‌ বা স্থান ত্যাগ করছেন। এই সামাজিক অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যায় এই চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার-পরিচালকদের এক ধরণের “টার্গেট দর্শক” আছেন। এই টার্গেট দর্শক স্বভাবতই নাগরিক যুবা, আরবান ইয়ূথ এবং বেশ কিছু আগমার্কা বুদ্ধিজীবি। সংযোগ সুত্রের “কে বলছেন এবং কাকে বলছেন” এই ধারণাটি এখানে স্পষ্ট, কিন্তু “কেন বলছেন” –এই বিষয়টি আমাদের আলোচনার মূল সূত্র।

গোটা পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ-হিংসা-সন্ত্রাস বিরোধী ছবি হিসাবে পিকাসোর “গোয়ের্ণিকা”-র আবেদন সংযোগ সূত্রের এই – “কে-কাকে-কিভাবে-কেন” বলছে রূপকল্পের (এখনও অবধি সুস্থ সংস্কৃতির) বহিঃপ্রকাশ। উদার মানবতাবাদী ছবি হিসাবে পথের পাঁচালী, দো বিঘা জমিন, অপরাজিত, কোমলগান্ধার, সুবর্ণরেখা, ভুবনসোম প্রভৃতি আরও নানা চলচ্চিত্রের কথা বলা হয়। বাঙলা নাটক রচনার বিচারে রক্তকরবী, চাঁদ বণিকের পালা, টিনের তলোয়ার, রাজরক্ত এমনকি সাম্প্রতিক অতীতের উইংকল্‌-টুইংকল্‌-ও একই গুণে সমাদৃত। এগুলোর প্রত্যেকটিই সমাজ সাপেক্ষ বাস্তব। বিগত শতাব্দীর ষাট ও সত্তর দশকের হারানের নাতজামাই, ভিয়েতনাম, ব্যারিকেড, দুঃস্বপ্নের নগরী প্রভৃতি নাটকেও পুলিশ ও সামরিক অফিসারদের কালো চরিত্র প্রদর্শন করানোর জন্য তাদের মুখে বেশ কিছু শ্লীল নয় এমন অপশব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। সেই সময়ের সমাজ বাস্তবতার নিরিখে এই সব নাটকের রচয়িতা ও নির্দেশকরা খুবই সরল ভাবে দুনিয়াটাকে সাদা-কালোয় বিভাজিত করে নাটকের চরিত্রদের মুখে এইসব কথাই যোগান দিতেন। আমাদের আলোচ্য নাটক ও চলচ্চিত্র দুটিতে এই ধরণের অপশব্দ প্রয়োগের মাত্রাগত তারতম্য অনেক প্রবল।

বিগত শতাব্দীর ষাট-সত্তর দশকে হাংরি সাহিত্য ও তাদের প্রকাশ মাধ্যম “ক্ষুধার্ত” পত্রিকায় কথা ও ভাষা ব্যবহারের এক নৈরাজ্যবাদী, প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এই আন্দোলনের দর্শন ছিল, জীবন সম্পর্কে একটা নতুন বোধ, নতুন চিন্তা এবং নতুন সাহিত্য ভাষা সৃষ্টি করা। কিন্তু আমাদের আলোচ্য নাটক ও চলচ্চিত্র দুটিতে নাট্যভাষার বা চলচ্চিত্রের কথ্য টেকস্‌টি জীবন সম্পর্কে কোন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় বহন করছে কী? “তিস্তা পারের বৃত্তান্ত”, “উইঙ্কল-টুইংকল” সেই সময়ের প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এমন এক প্রতিবাদী সামাজিক-রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরী করেছিল যা সেই মুহূর্তে সংবেদনশীল প্রভূত মানুষের মনের রূদ্ধ আবেগের অর্গল মুক্ত করেছিল। হাংরি সাহিত্য যেমন ঘোষনা করেছিল, তাদের পত্রিকা খোলা “আধুনিকতার শবদেহের উপর উল্লাসময় নৃত্য”। হাংরি আন্দোলনের ক্ষেত্রে সাহিত্যের ভাষা যৌনতাকে স্বাভাবিক প্রকাশে, স্বাধীনতার বড় স্পেসে নিয়ে যেতে চেয়েছে, সদ্যপ্রয়াত নবারুণ ভট্টাচার্যে’র “হারবার্ট” তার প্রমাণ। দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসে ও সুমন মুখোপাধ্যায়ের নাটকে কাহিনীর মূল চরিত্র “বাঘারু’র” মুখের ভাষা, মঞ্চে তার স্বল্প পোষাকে উপস্থিতির সমসাময়িক প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি ও চিন্তার জগতে এক বৈপ্লবিক ভাবনার দরজা উন্মুক্ত করেছিল। কিন্তু ‘আলতাফ গোমস্‌’ ও ‘বাইশে শ্রাবণ’ নাটক ও চলচ্চিত্রে নাট্যভাষা, চলচ্চিত্রের ভাষা ও যার প্রয়োগ কোনও প্রভাব সৃষ্টি করে না, কারণ এই নাটকের ও চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রগুলি শেষ অবধি প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ হয়ে যায়। ‘বস্তুসমূহের ষড়যন্ত্রময় অবস্থানের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ এবং এই বিদ্রোহ সেই জীবনের, সেই সমাজের বিরুদ্ধে, যেখানে অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষ বুঝতে পারে যে সে ভূল জীবন যাপন করে চলেছে। এই আত্মআবিস্কারের পথে মানুষের মনে চেতনার সঞ্চার হয়, এবং সেই চেতনার সূত্র ধরে মানুষ চয়ন করে শব্দ যা প্রকাশ পায় ভাষায়। এই ভাষা নির্মান করতে চায় এমন এক সমাজ, যা প্রচলিত সমাজের বিপ্রতীকে দাঁড়িয়ে নিজের স্বাতন্ত্র স্পষ্ট করবে।

আমরা, ভাতের হাঁড়ি থেকে দু’টো ভাত টিপে ভাতসেদ্ধ হয়েছে কিনা, তেমনটি দেখার জন্য যে চলচ্চিত্র ও নাটকদুটিকে বেছে নিয়েছি, সেগুলির অনন্যতা তাদের নির্মান কাঠামোয়। এই নাটক ও চলচ্চিত্র বাস্তব সমাজকে দেখতে চেয়েছে নির্মাতাদের সাবজেকটিভ দৃষ্টিভঙ্গীর অনুসরণে। “বাইশে শ্রাবণে’র” কর্মচ্যুত পুলিশ অফিসারের জীবনে মদ্যপানের মধ্য দিয়ে কনশাস্‌ লেভেল ভাঙ্গার উদ্যোগ এবং মদের বোতলকে বন্ধুভাবে গ্রহণের যে জীবনধারা, সংস্কৃতি প্রদশির্ত হয়েছে তার মধ্য দিয়ে পরিপার্শ্বকে আঘাত করার গর্জন আছে, কিন্তু সত্য উদ্‌ঘাটন নেই। চারপাশের মূঢ়তা ও অন্যায় সম্পর্কে এই চলচ্চিত্রের কথ্য ভাষা তেমন সক্রিয় নয়। “আলতাফ্‌ গোমস্‌” নাটকে প্রভূত তর্জন গর্জন করে পুলিশ অফিসারটি ব্যবসায়ী পুঁজির কাছে আত্মসমর্পণ করে। বর্তমান সময়ের আর্থ সামাজিক গতির অংশ হয়ে, রাজনৈতিক নেটওয়ার্কের মধ্য থেকে নাট্য ও চলচ্চিত্র সৃক্ত করা তাদের প্রতিবাদ স্পষ্ট করতে চাইছেন, কিন্তু তার প্রভাব ও পরিমণ্ডলের বাইরে যেতে না পারার দরুন সেই প্রতিবাদ ফলবতী হতে পারছে না। বাইশে শ্রাবণের পুলিশ অফিসারটি সমাজতত্ত্ববিদ দূর খেইমের সূত্রানুযায়ী সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মহত্যা করে। আলতাফ্‌ গোমস্‌ ও পুঁজির কাছে নতিস্বীকার করে। এই দুটি চলচ্চিত্র ও নাট্য শিল্পকর্মের মুখ্য চরিত্রগুলির এবং সেই সূত্রে শিল্পকর্মদুটির মধ্যে কোনও দায়িত্ব বা রেসপনসিবিলিটির প্রশ্ন নেই। অথচ কিছুদিন আগের “তিস্তা পারের বৃত্তান্ত”, “উইংকল টুইংকল” বা আরও আগের “রাজরক্ত” নাটকের মধ্যে এই দায়িত্ব বা রেসপনসিবিলিটি ছিল। প্রদর্শিত শিল্প মাধ্যমগুলির ভাষার মধ্যে, বলা কথার মধ্যে যদি দায়িত্ব না থাকে তবে সংস্কৃতির ভাষার ও অবনমন ঘটতে বাধ্য। আমরা জানি,


১। সমাজ --------------- প্রতিফলিত হয় --------------- নাটক ও চলচ্চিত্রে


কিন্তু এও জানি

২। নাটক ও চলচ্চিত্র --------- প্রভাবিত করে ---------------- সমাজকে


বাইশে শ্রাবণ ও আলতাফ্‌ গোমসের নির্মাতারা প্রথম মডেলটিকে সামনে রেখে তাঁদের কাজকে, শিল্পের ন্যায্যতা দেবেন। কিন্তু প্রথম মডেলটির মতো দ্বিতীয় মডেলটিও যে সামাজিক ন্যায্যতা ও স্বীকৃতি পায়, তা অভিজ্ঞতার নিরিখেই আমরা লাভ করি। দেখা যায় রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারের, চায়ের আড্ডায় এবং বিভিন্ন ঠেকের আলোচনায় কী অবলীলাক্রমে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে জেনিটাল অরগ্যান-এর উল্লেখ করে কথা বলা হয়। প্রথম মডেলটির সমর্থকরা বলবেন, এই সমাজকে তারা প্রতিফলিত করেছেন নাটকে-চলচ্চিত্রে, আর দ্বিতীয় মডেলটির প্রবক্তারা বলবেন নাটক বা চলচ্চিত্রে দেখানো হচ্ছে বলেই সমাজে এই ধরণের ভাষা প্রয়োগ দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল ডায়নামিকস্‌ বা সামাজিক গতিশীলতার সূত্রে নাটক ও চলচ্চিত্র-এর সঙ্গে দর্শকের সংযোগ সাধনের সূত্রটি সমাজ ও সংস্কৃতির ভিতরে প্রদর্শিত এই শিল্প মাধ্যম দুটির নিজস্ব অভিপ্রায় এবং দর্শকের স্ব-অভীপ্সা উভয়ের পারস্পরিক নিরিখেই বানানো হয়। 


৩। সমাজ--------উৎসারিত অভিপ্রায়--------নাটক ও চলচ্চিত্র ------- দর্শক 


নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতারা জীবনের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করার কাজেই অশ্লীল শব্দ বা অবশব্দ ব্যবহার পূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন এবং কোনও দায়িত্ব না নিয়েই। ফলে সংস্কৃতির ভাষায় ও রেটরীতে বাস্তবের অর্ন্তনিহিত কোনও সত্য নেই।

কেন নেই এটা বুঝতে গেলে সমসাময়িক সমাজের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝতে হবে। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে রেপানিজম্‌ ও ম্যাচারিজম্‌ শুধু আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে নয়, গোটা পৃথিবীতেই বাজারী অর্থনীতির পথ সুগম করে তোলে। কেইনসীয় রাস্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনীতির পথ বদল করে রাষ্ট্র “নুন্যতম রাষ্ট্র” বানিয়ে এই সময়ই বাজারের সার্বভৌমিকতার প্রবর্তন ঘটেছে। এই বাজারীপুঁজির দাপটে রাষ্ট্র যেভাবে আগে সমাজ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালত করতো তা হ্রাস পেতে থাকে। রাষ্ট্রীয়নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বাজার সংস্কৃতিকেও করে তোলে বাজারী সংস্কৃতি। আর এই বাজারী সংস্কৃতির হাত ধরে সংস্কৃতির আঙিনায় লুম্পেনদের আধিপত্য শুরু হয়। সূচীত হয় লুম্পেন সংস্কৃতির দাপাদাপি। সংস্কৃতির মাধ্যমগুলিতে বিশেষ করে টেলিভিসনে, সিনেমায়, থিয়েটারে, সংবাদপত্রের থার্ডপেজে এবং বিজ্ঞাপনে এই লুম্পেন সংস্কৃতি মৌরুসিপাট্টা তৈরী করে। কমে যায় খেটে টাকা উপার্জন করার প্রবণতা, বেড়ে যায় চিট্‌ফান্ডের রমরমা। সমাজ জীবনে প্রকট হয়ে ওঠে নারীর অবমাননা, শিক্ষা ও শিক্ষকের অপমান, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ। লুম্পেনরা, সমাজবিরোধীরা জানে তাদের শাসন করার কেউ নেই। এই লুম্পেনদের প্রতিনিধিত্ব করে যে শাসকশ্রেণী, তাদের প্রশ্রয়ে এবং আশ্রয়ে এক প্রশ্নহীন আনুগত্যের সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে সমাজজীবন। এমনতর সমাজ জীবনই জন্ম দেয় নিস্ক্রিয় সংস্কৃতির, আদর্শহীন দায়বদ্ধতাহীন এক জীবনধারা। একজনের অধিকার বজায় রাখতে গিয়ে অন্যের অধিকার যেন ভঙ্গ না হয়, সমাজ জীবনে এই পারস্পরিক দায়বোধ থেকে সামাজিক দায়বদ্ধ সংস্কৃতির জন্ম হয়। নিস্ক্রিয় সংস্কৃতিতে এই দায়বদ্ধতা নেই। তাই সংস্কৃতি প্রকাশের মাধ্যমগুলিও কোনও চিন্তা বিবেচনা না করেই শব্দরাজি বা ভাষা ব্যবহার করছে। গেঞ্জি, লুঙ্গি কিংবা নাইটি পড়ে যেমন স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অফিসে যাওয়া যায়না, রাজনৈতিক দলের মঞ্চ থেকে হামলার ডাক দেওয়া যায় না, তেমনই প্রদর্শিত শিল্প মাধ্যমগুলিকেও খেয়াল রাখতে হয় তাদের ভোক্তার কাছে তারা কি ভাষা ব্যবহার করবেন।

এখন যে দুটি নাট্য ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনকে আমরা বেছে নিয়েছি, তাদের ভোক্তা কারা? টার্গেট দর্শক কারা? কলকাতা ও কলকাতার নিকটবর্তী শহরের মধ্যবিত্ত এবং মলসংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন বেশ কিছু মধ্য ও উচ্চবিত্ত হোয়াইট কালার জবহোল্ডার, ব্যবসায়ী এবং আর্থিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থাকা সত্ত্বেও মানসিক অতৃপ্তিতে ভোগা মানুষজন। এদেরকে ক্যাটার করার জন্যই অবশব্দ প্রয়োগকে একটি লক্ষ্যাভিমুখী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। বাজারী সংস্কৃতি, ভোগবাদী সংস্কৃতির এটিই প্রাথমিক চরিত্র। মঞ্চে নাটক দেখার সময় এবং সিনেমা হলে ছবি দেখার সময় হল অন্ধকার হয়ে যাবার পর ব্যক্তিমানুষ একা হয়ে যায়, এবং অন্যদের থেকে অন্ততঃ সাময়িক ভাবে মানসিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেই বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে ভোগবাদী সংস্কৃতি অবশব্দ’র প্রয়োগের দুটি মাধ্যমকে নিজের মত ব্যবহার করে ব্যক্তির অবদমিত কামনা আকাঙ্খা পূরণের চেষ্টা করে। বাড়িতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সামনে যা পারছে না, বা অফিসে, পাড়ার ভীড়ে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা বাধোবাধো ঠেকছে সেখানে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে তীব্র গালাগাল, খিস্তি শুনে হাততালি দিয়ে ওঠা বা উল্লাস করা, এই অবদমিত কামনারই বহিঃপ্রকাশ। আর রয়েছে প্রেক্ষাগৃহে সেইসব তরুণ-তরুণীর অবস্থিতি যারা দায়বোধহীন এক নিস্ক্রিয় সাংস্কৃতিরই ফসল। প্রকাশ্যে বলতে যা বাধোবাধো ঠেকছে, অন্যের মুখে তা শ্রবণে পুলকিত হচ্ছে নিস্ক্রিয় সংস্কৃতিজাত এই টার্গেট দর্শকরা। ভোগবাদীনিস্ক্রিয় সংস্কৃতির অংশীভূত হয়ে শিল্প সৃজকেরা নিজেদের সাংস্কৃতিক প্রকাশ ভাষ্য হিসাবে এই পন্থাকেই বেছে নিচ্ছেন। ভোগবাদী সংস্কৃতির অধীশ্বর বাজারে তার ক্ষমতা দিয়ে নিজের স্বার্থে সংস্কৃতির ভাষা তৈরী করছে। আর এটাও সবাই জানেন, “ক্ষমতাই ভাষাকে নির্মাণ করে।” ক্ষমতা ভাষার যে সমন্বয়ের দক্ষতা তাকে বিনষ্ট করে, ক্ষমতা সংস্কৃতির সূত্রে মানুষের যে জ্ঞান, চৈতন্য উদ্ভব হবার কথা, তাকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতা। ক্ষমতাই শেখায় ডেসডেমোনাকে হত্যা করার পর ওথেলোর মানসিক যন্ত্রণা প্রকাশ জন্য ওথেলোকে নগ্ন হতে হবে, এবং কোন প্রক্রিয়ায় ওথেলোর অভিনেতা যার নগ্নতা প্রকাশ করার অভিব্যক্তি প্রস্তুত করছেন তাও দৈনিক পত্রিকার পাতায় ফলাও করে প্রকাশ পায়। ৬০-৭০ দশকের হাংরি আন্দোলনকে ভাষার অশ্লীলতা নিয়ে শুনতে হয়েছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। অবদমিত যৌনতা বলতে সেই সময় বলা হয়ে ছিল, “তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি শূন্য বিছানায়”। কবিকে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনা সংস্থার হাতে হেনস্থা হতে হয়েছিল। আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পুলিশ অফিসার আলতাফ এবং বাইশে শ্রাবণের হতাশ অবসাদগ্রস্ত পুলিশ অফিসার নাটকে, চলচ্চিত্রে যে ভাষার প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন মঞ্চে, ছবিতে তা যে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় পাচ্ছে, তা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদ প্রকাশনার আনুকূল্যও লাভ করছে। বাজারীপুঁজি, ভোগবাদী সংস্কৃতির এই সমন্বয়ের ফসল আজকের সংস্কৃতি, ভাষার অবনমন।।





0 comments: