0

অণুগল্প - মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর

Posted in










ছবি - ত্বিষাম


অণুগল্প


স্ত্রৈণ 
মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর 



হারমোনিয়ামটা পেল্লায় সাইজ। সাবেকী আমলের। জার্মান রিডের। কালের প্রহারে শরীরে ছোপ ছোপ দাগ পড়ে গেলেও এর বনেদী চেহারায় এখনও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। 

বংশলতিকা বেয়ে বেয়ে হারমোনিয়ামটার জিম্মাদার এখন আমি। এর মূল মালকিন ছিলেন আমার প্রপিতামহী অন্তরা চৌধুরী। তিনি ছিলেন বেথুনের গ্র্যাজুয়েট এবং সংস্কৃতিমনা। তখন ব্রিটিশ আমল। ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার বেশ নাম। শুনেছি আমার জমিদার প্রপিতামহ খান বাহাদুর ঈসমাইল হোসেন তার রূপে-গুণে ফিদা হয়ে যান। এবং সামাজিক প্রতিপত্তির প্রভাব খাটিয়েই হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া মেয়েটিকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তোলেন। বিয়েতে শাড়ি, গহনা এবং অন্যান্য সওগাতের সাথে বিলেতে স্পেশাল অর্ডারে তৈরী এই হারমোনিয়ামটাও ছিলো। 

আমার পিতামহের কাছে শোনা টুকরো টুকরো গল্প বিশ্লেষণ করে আমি অনুমান করি, খান বাহাদুর ঈসমাইল হোসেন চৌধুরী অসম্ভব ভালবাসতেন স্ত্রী অন্তরা খানকে। বিয়ের পর তিনি ঘরকুণো হয়ে পড়েন এবং অন্তরা চৌধুরীর গানে বুঁদ হয়ে থাকতেন সারাটা দিন। নিশ্চয়ই অন্তরা চৌধুরী তার একমাত্র শ্রোতাকে প্রগাঢ় ভালোবেসেই গান শোনাতেন এবং সেই সাথে চলতো এই হারমোনিয়ামের রিডগুলোতে তার ললিত আঙ্গুলের পরশ। অবশ্য বিষয়টিকে নেতিবাচক বিশ্লেষণও দেওয়া যায়। বিয়ের পরপরই খান বাহাদুর সম্পূর্ণ স্ত্রৈণ হয়ে পড়েন এবং সেই সাথে শুরু হয় জমিদারীকর্মে তার চরম অবহেলা। ঠাকুর্দার মুখেই শুনেছি বিয়ের পর থেকেই খান বাহাদুররে জীবিকা হয়ে পড়ে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে জমি বিক্রি করা। আমার ঠাকুর্দা হাশেম চৌধুরী যথেষ্ঠ বৈষয়িক হলেও তার পক্ষে জমিদারী উদ্ধার করা আর সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া ইতোমধ্যে ভারত ভাগ হয়ে গেছে এবং পূর্বপাকিস্তানে জমিদারী প্রথা বিলোপও হয়ে গেছে। 

সঙ্গীতে আমার অনুরাগ দেখেই একদিন ঠাকুর্দা বললেন, 'কবীর, মায়ের হারমোনিয়ামটা তো অনেকদিন আগলে রাখলাম। আমি তো গানের গ-ও বুঝি না। আমাদের বংশে শুধু তুই-ই মায়ের গুণটি পেয়েছিস। নিয়ে নে তুই, আর কেউ তো এর মর্যাদা বুঝবে না।' খুশীতে ডগোমগো হয়ে সাথে সাথেই নকশীকাটা বাক্স থেকে বের করে বাজাতে শুরু করি। স্কেলিং পুরোপুরি নষ্ট। নিয়ে গেলাম ঢাকার সেরা হারমোনিয়ামের কারিগর ‘যাদব এন্ড যাদব’ কম্পানির অতুলবাবুর কাছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন তিনি। শেষটায় হতাশ হয়ে বললেন, ‘এটা আর ঠিক হওয়ার নয়। এর আয়ু শেষ হয়ে গেছে। অ্যান্টিক হিসেবে ইচ্ছে করলে রেখে দিতে পারেন’। সেই থেকেই হারমোনিয়ামটি ড্রয়িং রুমে শোভা পাচ্ছিলো। 

ঠাকুর্দা গত হয়েছেন অনেক বছর। বাবা-মাও গত। এক সপ্তাহ হলো বিয়ে করেছি। মৌসুমীও গান গায়। ফুলশয্যার পরের রাতে ড্রয়িং রুমে রাখা হারমোনিয়ামের বাক্সটি ওর চোখে পড়ে। ডালা খুলে বের করে হারমোনিয়ামটি নিয়ে এল বেডরুমে। আমি বললাম, ‘মিছেমিছি টেনে নিয়ে এলে, এটার স্কেলিং তো ঠিক নেই। এর আয়ু শেষ। ঠিক আছে তোমাকে কালকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দেবো’। ওর মুখে রহস্য হাসি। কিছুক্ষণ আঙ্গুল চালালো রিডগুলোতে। তারপর গাইতে শুরু করলো – 

তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ 
ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া 
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক .. 

ওমা ওর সুরেলা কন্ঠের সাথে তাল রেখে হারমোনিয়াম তো ঠিকই বাজছে। কোথাও এতটুকু ছন্দপতন নেই! নিজেকে মনে হচ্ছে জমিদার খান বাহাদুর ঈসমাইল হোসেন চৌধুরী আর ও আমার প্রেয়সী স্ত্রী অন্তরা চৌধুরী। মুগ্ধ হয়ে শুনছি গান। আমারও স্ত্রৈণ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।


0 comments: