2

রম্যরচনা - সাঈদা মিমি

Posted in


রম্যরচনা


ঔরঙ্গজেব সমাচার
সাঈদা মিমি





দিস ইজ আ

মা বাবা তার নাম রাখলো ঔরঙ্গজেব, বড়জনের নাম ছিলো দারাশিকো, ছোটপুত্র হুমায়ুন, এরপরে একমাত্র কন্যা জাহানারা, পুরো মুঘল পরিবার। তাদের পিতা বাবর একজন দর্জি, মা মেহেরুন্নেসা গৃহিণী। ঔরঙ্গজেব নাইন পাশ দিয়ে আর পড়লো না, সে ভেবেছিলো কোনও ধনীকন্যাকে বিয়ে করবে, আসলে ইচ্ছেটা ষোলআনা থাকলেও পনেরআনাই জলে গেলো, বড়ভাইয়ের বিয়ে হলো, ছোটভাইয়েরও, এরপর একমাত্র বোনের, ঔরঙ্গজেব মাঝখানেই ঝুলে থাকলো। তার আর বিয়ের সম্বন্ধ আসে না, আসবে কি? সে কোনও চাকরি করে? করবেই বা কেন? সে সম্রাটপুত্র কিংবা নিজেই সম্রাট, বাপের ঘাড়েই খায়। সেবার চৈত্র মাসে এক অবাক কাণ্ড হলো, এক স্কুল মাস্টারনী এল ঔরঙ্গজেবকে দেখতে, পাত্র পছন্দ হলে রাজি হয়ে যাবে। কালোকুলো মেয়ে, গড়নও সুবিধের নয়। তবু ঔরঙ্গজেব খুশি, পাত্রী চাকরিজীবি। ঘর ঘুরে দেখলো মেয়েটা, তারপর ঢুকলো পাত্রের কামরায়, কি থেকে কি হয়ে গেলো বোঝার আগেই দেখি, মেয়েটা নাক চেপে দৌড় আর বলছে, দিস ইজ পাঁঠার গন্ধ। ওহ হো, বলাই হয়নি, ঔরঙ্গজেব অতিরিক্ত গিধর, তার কামরায় ঘরের সদস্যরাও ঢোকে না। চ্যাংড়া মফিজ এইসব দৃশ্য দেখছিলো, পরদিন সকালে দেখা গেলো ঔরঙ্গজেবের কাঠের জানালায় কে বা কারা লিখে রেখেছে, দিস ইজ আ পাঁঠার গন্ধ।




ঔরঙ্গজেব ও পিতলের বদনা

ঔরঙ্গজেবের কিছু বিষয়ে শুচিবাই ছিলো বাড়াবাড়ি ধরনের, এই যেমন ঘরলাগোয়া কোনও বাথরুমে সে যাবে না, কাউয়ার দল চোখ মেলার আগে সে আমাদের বৈঠকখানা ঘরের পাশে দোকান কর্মচারীদের যে গণটয়লেট সেখানে যেতো, হাতে থাকতো একটা ঝকঝকে পিতলের বদনা, সেটা প্রতিদিন নিজেই মাজতো, শীত গ্রীষ্ম বারোমাস ব্রজেশ্বর স্টাইলে স্নান করতো পুকুরে, একটা ন্যাকড়া দিয়ে শরীর ডলতো আর স্নান শেষে গামছাটা পড়ে কোনওমতে লুঙ্গি ধুয়ে ঘরের দিকে হাঁটা দিতো, আমরা লজ্জায় ওদিকে যেতামই না। এদিকে ছোট কাকিমা কয়েকদিন থেকেই প্রশ্ন করে করে আমায় উত্যক্ত করছেন, “হ্যাঁ রে পরী, পাত্রপক্ষ তোকে দেখে যায়, কথা আগায় না ক্যান? তুই তো দেখতে কম সুন্দরী না!” এর উত্তর কাকিমাকে দেয়া সম্ভব নয়, প্রত্যেকটা বিয়ের সম্বন্ধ এলেই আমি আর প্রতুল মিলে ভাঙ্গানি দেই। কি করবো? আমার ভালোবাসার মানুষ আছে, এত পাত্র দেখার দরকার কি? কাকিমা একটু চুপ থেকে আবারও বলে ওঠেন, “কাল ভোরে দরজা খুলে যার চেহারা দেখবো তার সঙ্গেই তোকে বিয়ে দেবো!” হায় কাকিমা, ভোরে তো দুধওয়ালা এসে বেল বাজায়….. কাকা ব্যবসার কাজে বাইরে গেলে কাকিমার কাছে আমাকে রেখে যান। রাতের তামাশা রাতেই শেষ কিন্তু সকালে আমরা দরজা খুলতেই দেখি, ঔরঙ্গজেব পিতলের বদনা নিয়ে গণটয়লেটে যাচ্ছে! আমি হতভম্ব, কাকিমা প্রায় অজ্ঞান।



ছাত্ররা কেন না’ বলেছিলো

শেষতক বাবর দর্জি ক্ষেপে উঠলো একদিন, এই দামড়াকে আর কতদিন বসিয়ে খাওয়াবো? মেহের, ওকে কাজ করতে বলো, কিছু না পারলে আমার সাথে দর্জিগিরি শিখুক। ঔরঙ্গজেবের খুবই সম্মানে লাগলো, তার পেটে বিদ্যার জোর আছে, সে কিনা করবে দর্জির কাজ! নেভার….. হুংকার ছাড়লো সে, যদিও শব্দটা চিঁ হিঁ হ্রেষার মতো শোনালো। মাস্টারী করবো আমি…। ‘তা কর বাপু। এই যে আমাদের বৈঠকখানা ঘরের সাথে লজিং হুজুরের ঘর সেখানে বসে পড়া. নয়তো বৈঠকখানা ঘরেই’ -মেহেরুন্নেসা বেগম বললেন। কয়েকজন ছাত্রও জুটে গেলো, শুরুটা মন্দ ছিলো না, ছয় সাতজন ছেলেমেয়ে হেলেদুলে পড়ছে, ঔরঙ্গজেব একটা বেত হাতে বেশ ভাব নিয়ে পড়ায় এবং প্রতিটি লাইন পড়ানো শেষে বাচ্চাদের প্রশ্ন করে ‘বুঝতে পারছিস?’ এটা তার মুদ্রাদোষ, সেটা না হয় মেনে নেয়া গেলো। কিন্তু ঔরঙ্গজেব যতটা না বলে তার চাইতে বেশি থুতু ছিটায়, ওর সামনে দাঁড়িয়ে যে কথা বলবে সে থুতু ওয়াশ হয়ে যাবে। যারা জানে তারা ঔরঙ্গজেবের সাথে কথা বলে কোনাকুনি দাঁড়িয়ে, হতভাগা বাচ্চারা এসব কিভাবে জানবে? যখন জানাটা হলো তখন ওরা আর নিশ্চুপ বসে রইলো না, একজন স্যারকে দিলো একটা রুমাল, আর প্রত্যেকে হাতে রাখা শুরু করলো জাপানী পাখা, ঔরঙ্গজেব কথা বলতে শুরু করতেই তারা মুখের সামনে পাখা মেলে ধরে। বিষয়টা আর সহ্য হলো না ঔরঙ্গজেবের, একদিন সঠিক নিয়মে বেতপ্রয়োগ করে সে বেতটাকে ভেঙেই ফেললো। ক্ষেপে গেলো বাচ্চাদের বাবামায়েরা, তিনমাসে দেড়হাজার টাকা কামাইয়ের পর ঔরঙ্গজেবের টিউশনী ব্যবসা লাটে উঠলো।



সম্বল ওই ছারপোকা ঠাসা কম্বল তার বাল্যবন্ধু ছিলো…

মেহের ফুপু বেশ ভারী মহিলা ছিলেন, তিনি হাঁটাচলা করতেন ধীরে, কথাও বলতেন আস্তে খুব নীচুস্বরে, পান খেতেন, হাসতেন, কখনও ঝগড়া করতেন না। তবে দুই একদিন পরপরই আছাড় খেয়ে পড়ে যেতেন তিনি। কি মুশকিল, সারাবাড়ি তোলপাড়, কি হয়েছে? মেহেরুন্নেসা আছাড় খেয়েছে - অ, এ আর নতুন কি? যা সবাই মিলে তোল ওকে –অর্থাৎ আছাড় না খাওয়াটাই তার জন্য অস্বাভাবিক ঘটনা। সেই বান্দা একদিন টেনেটুনে ঔরঙ্গজেবের কম্বল ফেললেন ঘরের চালে, সাথে তর্জনগর্জন, ‘এই হারামজাদা আমার ছেলে হয় কেমনে? আমি এত ছিকছাক (সাফসুতরো) মানুষ, অরে কি হাসপাতাল থেকে বদলে দিয়েছে?’ মেহের ফুপুর জন্য কষ্ট হয়, একা একা কম্বল শুকাতে দিচ্ছেন, আমরা কেউ যাইনি, কাজের বুয়ারাও না, রিনিচিনির মা-বুয়া আম্মাকে বললো, ‘ওরে ভাবীছাব’ কোম্বল ভরা উরাস(ছারপোকা) আর কি গোন্ধ! মেহের আফায় ওয়া টানতেয়াছে কেম্নে?’  মেহের ফুপু ঔরঙ্গজেবের মা হয়ে ঠেকেছেন, তাই শীত আসার আগেই শুকাতে দিয়েছেন কম্বলটা। ঔরঙ্গজেব তখন বাসায় ছিলো না, ফিরে তার কম্বল চালের ওপর দেখেই এক চিৎকার, ‘কে আমার কম্বল ধরেছে?’ ‘আমি, আর কে তোর পিছামারা জিনিসে হাত দেবে? খবিশ, সারা কম্বলে ছারপোকা। বিছানা বালিশে সব বের কর, মর্কট পাঁঠা…… -মেহের ফুপু বলে শেষ করেছেন কি করেন নাই, চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে এক খাবলা দিয়ে কম্বল টেনে নামালো ঔরঙ্গজেব, ‘খবরদার আমার কোনও জিনিসে কোনওদিন হাত দিবেন না। খাটমল, মশা এরা আমার দোস্ত, অরা না কামড়ালে আমার ঘুম ভালো হয় না’, বলেই গটগট করে ঘরে চলে সে, মেহের ফুপু বাক্যহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।



পাড়ায় রটিয়া গেলো একি কারবার? মুখ দেখানোটা বুঝি হয়ে গেলো ভার…

সাত সকালে তিনটা কুকুর, আর ছয়টা ছানা মিলে শোরগোল। একটা বাড়ি বটে, এতগুলা কুকুর থাকার দরকার কি? কোথায় ঘুরছে, কাকে তাড়া করছে, কে কামড় খেলো, অতিষ্ঠ হবার উপক্রম। ঔরঙ্গজেবের একটা চাকরি হয়েছে, খাদ্যগুদামের রাত্রি পাহারাদার। আমরা বেঁচেছি, ঘাটে কিংবা উঠানে বা পিতলের বদনা হাতে তাকে যখনতখন দেখা যায় না। সে সারারাত পাহারা দেয়, পাখি ডাকার আগে বাসায় এসে ঘুমায়, দুপুরে খেয়ে আবার ঘুমায়, বিকেলে সত্তর দশকের নায়কদের মতো একটা বেলবটম প্যান্ট এবং সাদাকালো কোমর চিপা স্ট্রাইপ শার্ট পরে বের হয়ে যায়। মেহের ফুপুর গজরগজর প্রায়ই শুনি, ‘শুয়োরটার জামা কাপড় দিয়েও তেলা পোকার গুয়ের গন্ধ, এ কি পয়দা করেছি আমি এলাহী!’ তবে রবিবার ঔরঙ্গজেবের ছুটির দিন, ওই দিন আমরা ওঁদের বাসার ধারেকাছেও ঘেঁষি না। ঔরঙ্গজেবের স্বভাব চরিত্র খুবই ভালো কিন্তু তার আধামাইল দূর থেকে পাঁঠার গন্ধ, হয়তো একটু বাড়াবাড়ি ধরণের বর্ণনা হয়ে গেলো, হোক গে। তার ওপর শয়তানটা খালি গায়ে বাইরের বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কান চুলকায়, তারপর কাঠিটা মুছে আঙুল শুঁকে আবার চুলকায়, ওয়াক, ওয়াক… এমনি এক রবিবাবের ঘটনা, সেজ কাকিমা প্রতি রবিবার একজন ফকির খাওয়ান, সেদিন দুপুরে একপিস কালবোশ মাছ, আগের দিনের মাংস, আট মিশালি শাক আর ঘন ডাল দিয়ে একপ্লেট ভাত দিয়ে ফকিরকে বিদায় করেছেন কাকিমা, আধাঘন্টা পরে তুমুল হৈ চৈ, গালিগালাজ আর অভিসম্পাত। সবাই দৌড়ে আসে, গেটের কাছে ঔরঙ্গজেবের হাতে ভাতের প্লেট এবং তখনও সে খাচ্ছে, ফকিরটা বিবিধ উচ্চারণে চীৎকার করে যাচ্ছে। হলোটা কি? কি আবার, ফকিরের মেনু চেক করতে গিয়ে সে ফকিরের খাবারটাই খেয়ে নিয়েছে! মেহের ফুপু আর ক্রোধ দমন করতে পারলেন না, একটা চেলাকাঠ নিয়ে ধাঁই করে বসিয়ে দিলেন ঔরঙ্গজেবের পিঠে। সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়লো খবর, আমাদের কোথাও মুখ দেখানোর আর উপায় রইলো না….



সে কেবল হাত ধরেছিলো

ঔরঙ্গজেব দেখতে রাজপুত্রের মতো ছিলো না এবং কুচ্ছিতও নয়। নাকটা? বেশ টিকোলোl মুখটা? চৌকাl গায়ের রঙ? ফর্সা। হ্যাঁ, কবিতা আপু একদিন ক্ষেপে বলেছিয়া “ব্যাটাছেলের এতো সাদা হওয়ার দরকার কি? আমি এত কালো কেন?” কবিতা আপু আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়l। তখন যৌথ পরিবারগুলোয় এইরকম সবাই মিলেঝুলেই থাকতো। ঔরঙ্গজেব কবিতা আপুকে দেখলেই ঝুঁকে হাতদুটি জোড় করে বলতো, 'মা কালী করালী, নমস্কার' -ক্ষেপে উঠতো আপু, আমি কি এতই কালো, অ্যাঁ! সেই কবিতা আপুর বিয়ে হলো বেজগাওয়ে, পাত্র দোজবর কিন্তু বড় ভালোমানুষ। ঔরঙ্গজেব রঙ্গ করে বললো, মা কালী, রাতের আন্ধারে তোরে হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাবে না তোর জামাই। বিস্ফোরিত হলো কবিতা আপু, সেই প্রথমবারের মতো সত্যটা বলে দিলো। আরও চারবছর আগে যখন ঔরঙ্গজেব ক্লাস সেভেনে পড়তো, একদিন মেজকার বাঁশঝাঁড়ের নীচে কবিতা আপুকে প্রস্তাব দিয়েছিলো সে। আপুর দুটি হাত ধরে খুব বিনয় করে বলেছিলো, তোর চামড়া কালো কিন্তু বড় মিস্টি তুই দেখতে, আহা কি গড়ন! দেবীর মতন। আপু পটে যেতে পারতো। কিন্তু পুবমুখী বাতাস সব গড়বড় করে দিলো। ঔরঙ্গজেবের শরীরের বোটকা গন্ধ তার নাকে আছড়ে পড়তেই বমি এসে গেলো শুচিবাইগ্রস্ত কবিতা আপুর, হাতটা ছাড়িয়ে ওয়াক ওয়াক করে দৌড়। সেই থেকে ঔরঙ্গজেব আর কবিতা আপুর শত্রুতার সূত্রপাত।



ঔরঙ্গজেব বিড়ালটিকে গুতা দিয়েছিলো

মেহের ফুপুর একটাই শখ, প্রতি শুক্রবার সিনেমা দেখতে যাওয়া, ফুপাও এইক্ষেত্রে দুইধাপ এগিয়ে। চিপাচুপার মধ্য দিয়ে চলা জীবন, এই কষ্টের মাঝে ওই সিনেমা দেখাটাই একটু অক্সিজেন। এদিকে প্রতিদিনের দুধের হিসেবটা মিলছে না, একপোয়া দুধ আর একপোয়া পানি ইজ ইকোয়ালটু আধাসের, কিন্তু রাতে সবাইকে ভাগ করে দিতে গিয়ে কম কম মনে হয় যেন! গলার কাঁটা ঔরঙ্গজেবকে সন্দেহ হলো, চুপিচাপি নজরদারি করে দেখলেন ঔরঙ্গ দুধের পাতিলের কাছে যায় না, ফুপুর মায়াই হলো, আহা, ছেলেটা তার খবিশ বটে, চোর নয়। এইসব সাত আট চিন্তা মাথায় নিয়ে ফুপু ফুপা গেলেন নাইট শো দেখতে, ছবির নাম বেদের মেয়ে, আর ঔরঙ্গজেব ঢুকলো রান্নাঘরে। বিকেলে সে দেখেছে, মা তার দই পেতে রেখে গেছে। ঘরে ঢুকে কি দেখলো সে? একটা সাদা লোমের ময়লা বেড়াল খালি দুধের পাতিল চাটছে। বেড়াল এল কোত্থেকে? তা বাপু চারচালা কাঠের ঘর, দুইপুরুষ পুরোনো, ভাঙ্গা ছ্যাঁদা তো আর কম নেই, সেইরকম একটা দিয়ে বেড়ালবাবা প্রবেশ করেছেন। তবে রে চোরা, বলেই একটা লাকড়ি দিয়ে বেড়ালটার পেট বরাবর গুতা মারলো সে, ‘কেঁয়াও’ শব্দ করে ছুট লাগালো বিল্লি। মাঝরাতে ফুপু ফুপা ফিরেছেন, ফুপার কন্ঠে গান শোনা যাচ্ছে, ‘বাইর হও বাইর হওরে সাপ, লোকে তোমায় দেখতে চায়…,’ ফুপুও তরল মেজাজে, কেবল বেদের মেয়ের কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। ঘরের তালা খুলতেই দেখেন ঔরঙ্গজেব দরজার পাশে বসে কুঁইকুঁই করে কাঁদছে, বেড়াল কেঁয়াও করে ছুট লাগানোর আগে ঔরঙ্গজেবের হাতে খামচি দিয়ে গেছে, বাজু থেকে কনুই পর্যন্ত রক্ত জমা। সাপ বের হলো না। কিন্তু ঔরঙ্গজেবকে নাভির গোড়ায় চৌদ্দটা ইঞ্জেকশন নিতে হলো। প্রতিটা সুঁই ফোটানোর সময় সে একটা কথাই বারবার বলেছিলো, আমি কিছু করিনাই, কেবল বেড়ালটাকে কাঠ দিয়ে গুতা দিয়েছি।



ঔরঙ্গজেবের নীল ঘোড়া

বাবর দর্জি মানুষ খারাপ নয়, একটাই দোষ, সুন্দরী মেয়েদের দেখলে তার মাথা ঠিক থাকে না। বৌ মেহেরুন্নেছা দেখতে কুরূপা নয়, কিন্তু সে বুড়ি হয়ে গেছে, ভারীও। আফসোস, সে ভাবে, আরও অনেক কিছুই তো ভাবে, একটু সাহস করে কিছু কর্ম করেও ফেলে। এই যেমন কমবয়সি মেয়েরা জামার মাপ দিতে এলে গজফিতা নিয়ে স্মার্টলি দাঁড়ায় সে, চেস্টের মাপ নেয়ার সময় আলগোছে বুকে হাত দেয়, একটু টিপেটুপেও দেখে। কাহিনী চাউর হয়ে গেলো, মেহের ফুপু সব শুনে বাবর মিয়াকে বাসা থেকেই বের করে দিলো, তার একার সাহসে কাজটা হয়নি, পুরো পরিবারই পাশে দাঁড়িয়েছিলো। বাবর মিয়া নিরীহ ঘরজামাই হয়ে থাকতে চেয়েছিলো, কি হয়ে গেলো, হায়! যদিও শোধরাবার সুযোগে রইলো সে তক্কে তক্কে, আর কাহিনী রটে যাওয়ায় মফস্বলে কমে আসতে থাকলো তার কাস্টমার। বেলার মা তো স্পষ্ট বলেই দিলো, খবরদার ও ব্যাডার কাছে কেউ কাপড় বানাইতে যাও বুঝি, দুধি হাত দেয়! পুত্র ঔরঙ্গজেব কাহিনীটা মাথায় গেঁথে রাখলো। সেবার ফাল্গুন শুরুতে মামাতো ভাইয়ের বিয়ে, সারাবাড়িতে উৎসবের ধুম, রাতে হ্যাজাক বাতির আলোয় রঙ্গীন কাগজের সজ্জাগুলি ওড়ে, আর ওড়ে ঔরঙ্গজেবের হৃদয়ের নীলঘোড়া, রোমান্টিক ভাবনায় সে ভেসে যায়। ফানাফিল্লাহ অবস্থায় মানুষ কি করে তা সে নিজেও জানে না, যেমন ঔরঙ্গজেবও জানতো না, মৃদু আলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে রাঁধুনি লতিফার বুক টিপছে। লতিফা জানতো, সে উপভোগও করছিলো, তখনি ঔরঙ্গজেবের বড়মামা দৃশ্যটা দেখে ফেলেন। নাউজুবিল্লাহ, বলে তিনি ক্যাঁক করে ঔরঙ্গের ঘাড় চেপে ধরেন, হারামজাদা, কুলাঙ্গার বাপের আওলাদ। তারপরের বৃত্তান্ত ভাসাভাসা, ঔরঙ্গজেব কেবল উপলব্ধি করে, প্রথমবারের মতো পাওয়া স্বপ্নের নীলঘোড়া উড়ে উড়ে প্রথম আসমান পার হয়ে চলে যাচ্ছে।



তাবলিগে গেলো ঔরঙ্গজেব

ঔরঙ্গজেব তীব্র হতাশায় আক্রান্ত, কোনও নারী তাকে চায় না, একটা ভুল ট্রিপ সেই সম্ভাবনাকেও ধ্বংস করে দিলো, কে জানতো অন্ধকারে কাজের বুয়া দাঁড়িয়ে তার সোহাগ নিচ্ছে! সে নিজে অনুধাবন করার পর নিজের প্রতি এই প্রথম তার ঘৃণা জন্মালো। এখন তো ঘরের কেউ তার সাথে কথা বলে না, খাবারটাও একা খেতে হয়। একটা চাকরি জুটেছিলো অনেকদিন আগে, সেটাও নেই, নাইটগার্ড ঔরঙ্গজেব ঘুমিয়ে পড়েছিলো পাহারার বেঞ্চিতে, আর চোর সেই রাতেই এল। কত থানা পুলিশ, ধড়পাকড়, একমাস জেলের যবের রুটি খেয়ে তার শরীরে পাঁঠা-যব ধরনের গন্ধ তৈরি হলো। বাড়ি ফেরার পর আরেক নারকীয় অবস্থা, দেখে তার বিছানাপত্র ঝকঝকে, পুরা মাথায় রক্ত উঠে গেলো, কয়েক রাত প্রায় নির্ঘুম কাটানোর পর আবার মিশ্র গন্ধ তৈরি করতে সক্ষম হলো সে। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে একটু ঝিমুনি লেগে এসেছিলো, এমন সময় ট্যারা মনসুর এসে এক থাবড়া লাগালো ঘাড়ে, কি ভাবতাছস হালায়? ট্যারা মনসুর ধড়িবাজ কেজো, সব শুনে ঔরঙ্গজেবকে নিয়ে গেলো নটীদের পাড়ায়। প্রতিবাদ করার আগেই উপলব্ধি করলো, সে এক পানসে রূপসীর ঘরে বসে আছে.. এই পর্যন্ত থাক, বর্ণনা অপ্রয়োজনীয়। এরপর মেহের ফুপুর জমানো পয়সা চুরি করে সে নটীদের পাড়ায় গেলো। তারপরের ঘটনা সঙ্গীন, ধরা খেলো ঔরঙ্গজেব, উপরি পাওনা পিটুনি, তারপর জ্বর, সবশেষে প্রতিজ্ঞা, ‘থাকিতে হস্ত/ হবো না রমণীর দারস্থ…’ নাবালকরা পড়বেন না যেন। শয়তানটা প্রকাশ্যে বলে বেড়াতো এই পদ্য, মাকে অর্থ জিজ্ঞেস করে আমিও মার খেয়েছি। কাহিনী যখন বেতাল পথে, বড়কাকা বড় মসজিদের ঈমাম সাহেবের সাথে কথা বলে, তাবলিগে পাঠিয়ে দিলেন ঔরঙ্গজেবকে।



যারে দিবি ফালাইয়া, তারে লইয়া যা কালাইয়া

মুঘল পরিবারটি ঔরঙ্গজেবের বিষয়ে সিরিয়াস হয়ে উঠেছে। এই উৎকট সুযোগে বাবর মিয়া পুনরায় নিজ ঘরে প্রবেশ করতে পেরেছেন। সবার পা ধরে ক্ষমা চাওয়ার পর রাত্রির গোপনে স্ত্রীর পাও ধরেছেন তিনি। ভাবার অবকাশ কম যে, সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, মেহেরুন্নেসা এখনও অপ্রসন্ন। ইতিমধ্যে বড় একটা আছাড় খেয়ে তার পা মচকেছে, পুকুরে স্নান সেরে ফেরার সময় টের পেলেন কি যেন একটা হাঁটুর কাছে নড়াচড়া করছে, তারপর দেখেন আজদাহা এক জোক, অতঃপর আছাড়। লবন দিয়ে জোক ছাড়ানো হয়েছে, কিন্তু পা ফুলে ঢোল, বিকট চিৎকার দেওয়ায় গলাও বন্ধ। এদিকে এলাকায় মুখ দেখানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। পাড়ার ঢোল আফ্রিকান উপজাতিদের ঢোলের চাইতেও মারাত্মক। ওটাকে চোখে দেখা যায় না কিন্তু শব্দ করে ফিসফিস, তারপর সেই শব্দ বজ্রপাতের রূপ নেয়। এই মুহূর্তে প্রতিবেশীরা ঔরঙ্গকে বিয়ে করিয়ে দেবার দাবীতে সোচ্চার। মুশকিলে আছেন মেহের ফুপু, ‘কোনও মেয়ে তো হারামজাদার বৌ হতে চায় না! কোন অমাবশ্যায় এই জুতার খোলটাকে পেটে ধরেছিলাম আমি?’ পরামর্শ বেলার মা-ই দিলো, ‘যারে দিবা ফালাইয়া, তারে লইয়া যাও কালাইয়া।' মানে কি? কালাইয়া পটুয়াখালিতে, ওখানে বিবাহযোগ্য কন্যাদের অভাব নাই। ঘটক লাগানো হলো, দেখাশোনা চলতে লাগলো, শেষতক এক জোতদারের পাঁচ নাম্বার বিবির বড়কন্যার সন্ধান এল। একটা মিনিবাস ভাড়া করে পুরো দলবল রওনা দিলো পাত্রী দেখতে। মেয়ে পছন্দ হলে আজই বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হবে। একটা কথা না বললেই নয়, রান্না হয়েছিলো অনেক পদ, বুড়া গুড়াদের দল খেয়েছিলো নোলা ডুবিয়ে। অবশেষে ডিম গড়নের এক মেয়েকে এনে বসানো হলো পাত্রপক্ষের সামনে। সবাই করছিলো উসখুস, ঔরঙ্গজেব খুসখুস। কি যে হলো তার, প্রথমে তার পেটে কামড় দিলো, তারপর ধপাস করে পড়েই খিঁচুনি উঠলো। পাত্রের মৃগীরোগ, বিয়ে ডিসমিস। ঔরঙ্গজেব দাড়িজোব্বা রেখে যৌবনকে উৎসর্গ করে দিলো, যদিও সুখাদ্যগুলোর কথা তার সারাজীবনই মনে ছিলো।



2 comments: