বিশেষ নিবন্ধ : সুস্মিতা বসু সিং
Posted in বিশেষ নিবন্ধ
বিশেষ নিবন্ধ
দেখতে নারী
সুস্মিতা বসু সিং
যারে দেখতে নারী, তার চলন বাঁকা...
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন – নারী-ই লিখেছি, বানান ভুল নয়... না’রি লিখিনি। কেন লিখেছি, সেই প্রসঙ্গেই আসছি। তবে হ্যাঁ, একটা কথা সবার আগে জানিয়ে রাখা ভালো। আমি কিন্তু একেবারেই পুরুষবিদ্বেষী নারীবাদী নই। সঙ্গী হিসাবে পুরুষ ছাড়া জীবনধারণ করার কথা ভাবতেই পারিনা। সহজাত নারীবৃত্তি দিয়েই হয়তো পুরুষের সাহচর্য উপভোগও করি। কিন্তু একথা যেমন সত্যি, তেমনই আধুনিকমনস্ক নারী হিসাবে, ঘরে বাইরে সমানতালে নারীর স্বাধীনচেতা স্বাবলম্বী চরিত্র বৈশিষ্ট্যকেও সমধিক গুরুত্ব দিই, একথাও অনস্বীকার্য। আর যাবতীয় বিতর্কের সূচনা মনে হয় সেখান থেকেই।
নিজের কথাই বলি। আমার দিদিমা ছিলেন সেই যুগের বারো ক্লাস পাস। বাড়ির ছোটবউ, ছয় ছেলেমেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ী, ভাসুর ননদদের নিয়ে তাঁর ভরন্ত সংসার। অসম্ভব ভালো রান্নার হাত, সারদেশ্বরী আশ্রমিক বিদ্যালয়ের গরীব মেয়েদের জন্য নিজে হাতে ফ্রক, ব্লাউজ, সায়া বানিয়ে দেন, এই পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু তাই বলে লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখা!! জানতে পেরে পুলিশ কমিশনার শ্বশুর প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন। বিয়ের আগে মেয়েটা যে নিজের ছোট মেয়ের সহপাঠিনী ছিলো! দেশ পত্রিকার দপ্তরীকে ডেকে পাঠিয়ে দিলেন কবিতা, ছাপার জন্য। শাশুড়ীর মুখ হলো ভার, তবুও মেনে নিলেন। কিন্তু বাড়ির ছোটবউ এরপর যা শুরু করলেন, সেটাতে আর চুপ করে থাকা দায় হলো। সেলাই জমা দেবার নাম করে বেরিয়ে, কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রিভলবার, কার্তুজ, দরকারী চিঠিপত্র, জরুরী কাগজপত্র, গুরুত্বপূর্ণ দলিল, ইত্যাদি পৌঁছে দেওয়া শুরু করলেন বিপ্লবীদের কাছে। মেয়েদের একটা দল গড়লেন এই কাজ আরও বিস্তৃতভাবে করার জন্য। সক্রিয়ভাবে যোগ দিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। শ্বশুরমশায়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল, শাশুড়ি রাগে ফেটে পড়লেন। শ্বশুরমশাই ছোটবউমাকে ডেকে জানতে চাইলেন, তুমি কি করছো, তা তুমি জানো তো? দুর্দমনীয় মেয়েটার সম্মতিসূচক ঘাড়নাড়া দেখে কোমল হলো শ্বশুরের দৃষ্টি। বললেন, বেশ, তবে আমার নাতিনাতনিদের যেন অযত্ন না হয়। শাশুড়ী কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন এক্কেবারে।
এহেন দিদিমার তৃতীয় সন্তান আমার মা। দাদু প্রথম জীবনে মিলিটারিতে ও পরবর্তীকালে পুলিশে চাকরী করতেন বলে স্থায়ীভাবে বাড়ীতে প্রায় থাকতেনই না। তাই দিদিমার একক তত্ত্বাবধানেই বড় হয়ে ওঠা। অসম্ভব কমনীয় এক বহিরাবরণের অন্তরালে অদ্ভূত ঋজু নীতিনিষ্ঠ চারিত্রিক দৃঢ়তা মাকে একদিকে যেমন স্বাতন্ত্র দিয়েছিলো, তেমনিই এই একই কারণে মায়ের দুর্গতিরও অন্ত ছিলো না। বিয়ের আগে বি এ পাস করে স্কুলে পড়ানো, দক্ষিণী থেকে গান শিখে ও পরে দিলীপ কুমার রায়, সুচিত্রা মিত্রর কাছে গানের চর্চা করে মহাজাতি সদন, রবীন্দ্রসদন, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন দাপিয়ে গান গেয়ে বেড়ানো মেয়ের বিয়ে হলো পঞ্চাশ জন সদস্যের এক যৌথ পরিবারে, যেখানে প্রগতির আলো প্রবেশ করতে সময় লেগেছিলো আরও প্রায় দুই দশক। সেখানে বিনা প্রতিবাদে যাবতীয় অন্যায় আবদার মুখ বুজে অন্য বউদের মতো মেনে নিতে পারতেন না বলে বেয়াড়া বউ-এর দুর্গতিও আটকানোর সাধ্য ছিলো না কারোর। সে বাড়িতে গান করা তো দূরের কথা, বাড়ির মেয়েদের গান শোনাটাই ছিলো একটা গর্হিত অপরাধ। আমার এঞ্জিনিয়র বাবা ফিলিপসের রেডিওর সঙ্গে কানেক্ট করে সারা বাড়িতে এখানে ওখানে বক্স লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ঘড়ি মেলানোর ছুতো করে একটা ছোট্ট ট্রানজিস্টার রেডিও-ও কিনে দিয়েছিলেন মাকে। সেখানে বাড়ির বৌদের বই পড়াও ছিলো এক আশ্চর্য ঘটনা। আমার র্যালিস ইণ্ডিয়া-র চেয়ারম্যান ঠাকুরদার বক্তব্য ছিলো, বাড়ির বউরা সব সময় নতুন নতুন শাড়ী পরে এক গা গয়না ঝমঝমিয়ে আহ্লাদ করে ঘুরে বেড়াবে... তাদের আবার এমন বেয়াড়া শখ থাকবে কেন?
এমন ‘সুবর্ণলতা’র যুগ আমরা পেরিয়ে এসেছি নিঃসন্দেহে। আজ প্রগতিশীল বাঙালী পরিবারে মেয়েরা অনেক স্বাধীন। কিন্তু কোথায় যেন একটা ‘তবু’ কিছুতেই পিছন ছাড়ে না। আর তাই, বাড়ির পুরুষটির আয় নারীটির আয়ের চেয়ে বেশী হওয়া উচিত। আর তাই, সংসারের সামগ্রিক পরিচালনার দায়িত্ব একান্তভাবেই নারীর একার। অসম্ভব, এখন ম্যাচের খুব ক্রুশিয়াল মোমেন্ট, এখন রুটি আনতে যাওয়া যাবে না, প্লিজ রাগ কোরোনা সোনা... একটা কিছু ম্যানেজ করো, প্লিজ। ও হো... কাল বনির এগ্জ্যাম বুঝি? সুইটহার্ট বেটা, গো অ্যান্ড স্টাডি... মাম্মা কে জ্বালিও না... বস যদি দুর্ভাগ্যক্রমে একজন নারী হন, তবে তো চাকরী জীবনটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। নাইটপার্টি থেকে ড্রিংক করে আমি ফিরিতে পারি, ঠিক আছে... কিন্তু তাই বলে তুমিও!! না না জানি, সামান্যই, তবু... বিশেষ করে আজ যখন আমি যাইনি তোমার সঙ্গে!! আসলে আমার কিছুই না, কে আবার কি মনে করে, তাই বলছিলাম, আর কি!! কাম অন্, ডারলিং...ডোন্ট বি সো মীন, মিষ্টু আমার আপন মামাতো বোন। আচ্ছা, সোম যেন তোমার কেমন বন্ধু হয়? স্কুলের বন্ধু, বলেছিলে ...না? বাড়িতে কে কে আছে? বউ কি করে... না না... জাস্ট কৌতূহল, আর খি!! আরে, তুমি রাগ করলে নাকি? রাগলে তোমাকে এমন সুন্দর লাগে না... হেঁ হেঁ... নিজেকে আর...
কি? ভুল বলছি কিছু? তাহলেই বলুন!! যারে দেখতে নারী, অনাদিকাল থেকেই তো তার চলন বাঁকা... আর সেটা সিধে হওয়ার চান্সও জাস্ট নেইই...
সিধে তো হতেই হবে সুস্মিতা।
ReplyDeleteপশ্চাতে রেখেছো যারে/সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
ভারি ভালো লাগলো তোমার লেখা আর মনে পড়লো বিদ্রোহী কবির দুটি পংক্তি-সেদিন সুদূর নয়/যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে,গাহিবে নারীরও জয়।।
সিধে তো হতেই হবে সুস্মিতা।
ReplyDeleteপশ্চাতে রেখেছো যারে/সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
ভারি ভালো লাগলো তোমার লেখা আর মনে পড়লো বিদ্রোহী কবির দুটি পংক্তি-সেদিন সুদূর নয়/যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে,গাহিবে নারীরও জয়।।