0

প্রবন্ধ : সুনন্দা চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


দোলের একাল সেকাল
সুনন্দা চক্রবর্তী



“ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল 
                   লাগলো যে দোল ...”

বসন্ত এসে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয়ে গেছে শিমূল পলাশের সাথে শরীর মনের রং মিলান্তি। তা সে খাবার হোক বা উৎসব, বাঙালী সব কিছুকে আপন করে নিজের মতো করে গড়েপিটে নিতে বেশ সিদ্ধহস্ত, দোলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দোল অবশ্য কোনও ইংরিজি বা মার্কিনী আমদানী নয়, খাঁটি মুলতানি আমদানী। নানাবিধ পুরাণ কথার মতো এও এক বীরগাথা, দর্প চূর্ণের ইতিহাস।ভগবান বিষ্ণুর উপাসক হিরণ্যকশিপু অমরত্বের অন্ধত্বে ভুলতে বসলেন স্বয়ং ইশ্বরকে।তাঁরই পুত্র প্রহ্লাদ [এ ক্ষেত্রেও বাঙালী তাকে সযত্নে ‘পেল্লাদ’ করে নিয়েছে]। তাকে ঠিক রামের মতো বীর বলা যায় কিনা জানিনা, তবে সে বেঁকে বসল বাবার এই গোঁয়ার্তুমির বিরুদ্ধে।সে বাবাভক্ত না হয়ে রয়ে গেল বিষ্ণুভক্ত। আর এই সিদ্ধান্তে তো বেজায় চটলেন অহংকারী রাজা।একের পর এক শাস্তির নিদান দিয়েও পথে আনা গেল না ছেলেকে। সব শেষে সেই প্রাচীন পন্থা, ভাইপোর বিরুদ্ধে ছলের আশ্রয় নিল দাদার প্রিয় বোন হোলিকা। একেবারে শেষ করে দেওয়ার ফন্দি এঁটে ভাইপোকে নিয়ে বসলো চিতায়, কোনও সাধনার কথা বলে, নিজে বসলো আগুন থেকে বাঁচার এক সুরক্ষাচাদর জড়িয়ে। কিন্তু রাখে হরি মারে কে! যেই না আগুন জ্বলা, অমনি চাদর খুলে হোলিকার গা থেকে সটান প্রহ্লাদের গায়ে। বাবা গো মা গো করে পুড়ে ছাই হল হোলিকা। এদিকে ভগিনীর শোকে উন্মত্ত হিরণ্যকশিপু শুরু করেছেন প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা। এতে বিরক্ত হয়ে ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং নেমে এলেন নৃসিংহ অবতার হয়ে।বধ হলেন হিরণ্যকশিপু। একই চিতায় জ্বলল ভাইবোনের শব।পরদিন সকালে রাজ্যের প্রজারা সেই চিতার ছাই নিয়ে মাখামাখি করল কপালে। এই মুলতানের ‘প্রহ্লাদপুরী’র হোলিকা দহনের গল্প।

কিন্তু প্রহ্লাদপুরী ছেড়ে এ কথা যত বাইরে এসেছে, পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে ব্রজভূমির দিকে, ততই রূপ বদলেছে হোলি। রবীন্দ্রসংগীত থেকে নজরুলগীতি বা ভারতীয় প্রাদেশিক লোকগীতি সবেতেই ‘হোলি’, ‘হোরি’ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এবার আসা যাক ব্রজভূমির কথায়। ব্রজভূমি প্রেমিক পুরুষ কৃষ্ণের স্থান। এখানে হোলি কোনো বীরগাথা নয়, বরং অনেক বেশি করে প্রেমকথা, রাধা-কৃষ্ণের কথা। হোলি এখানে ভস্ম মাখা নয়, আবির মাখানো। ঘনশ্যামের ‘inferiority complex’ হতো শ্রীরাধিকা ও চন্দ্রাবলীদের ফর্সা রঙ দেখে। তাই চপলমতি কৃষ্ণ নতুন উপায় খুঁজল। কোনও এক বসন্তের পূর্ণিমায় অনেক রকম রং দিয়ে ভূত করে দিল সব ব্রজগোপীনিদের। কিন্তু এ কি হল! এতে রাধা যে হয়ে উঠলো আরো রমনীয়, মনগ্রাহী ও মনোলোভা। সে থেকেই বৃন্দাবনে হোলি শুরু। আজও সেখানে বসন্তে ষোলোদিন ধরে পালিত হয় এই উৎসব, আর হোলিকে কেন্দ্র করে ভারতের উত্তরে যা সবচেয়ে বেশী চর্চার দাবী রাখে, তা হল হোলির গান, রাজস্থানের ধামাল, উত্তরপ্রদেশ ছত্তিশগড়-এর প্রাদেশিক ‘ফোক’।দ্বারকাতে হোলি উদযাপনের মূল উপাদানই হল গানবাজনা। উত্তরপ্রদেশে আবার হোলির আরেক রূপ, লাঠমার। রাধারাণী মন্দির প্রাঙ্গণে জড়ো হয় কিশোর কিশোরীর দল, রাধাকৃষ্ণের সখাসখীর অনুকরণে ছেলেদের আবেশ-অভিসারের গান বা টিপ্পনী আর মেয়েদলের ছদ্মরাগে লাঠি প্রয়োগ, সব মিলেমিশে সেদিন সততই ‘প্রেমের বৃন্দাবন’। এছাড়া গোরক্ষপুরের ‘হোলি মিলন’ আদতেই মিলনোৎসব । উত্তরাখণ্ডের ‘কুমায়ুনী হোলি’ আবার রাগপ্রধান হোলি, আবিরের থেকে বেশী করে পিলু, ভীমপলাশী, সারং ‘বৈঠকি হোলি’ ও ‘খারি হোলি’র মূল উপাদান। ভোজপুরি ‘ফাগুয়া’ সমস্ত রাজনৈতিক রং ভুলিয়ে বিহারকে রাঙায় সত্যি কারের রঙে।দক্ষিণ ভারতে আবার হোলিতে পূজিত হন কামযুগল মদন ও রতি, হোলি যৌবনের উন্মাদনা, শীতের জড়তা কাটিয়ে নতুনের আবাহন, তোমার রঙে আমার হৃদয় রাঙানোর দিন। 

এবার ভারতের চৌহদ্দি ঘুরে ফিরি বাংলায়। ওই যে শুরুতে লিখেছিলাম - বাঙালী সব কিছুকে আপন করে নিজের মতো করে গড়েপিটে নিতে অভ্যস্ত, সত্যিই তো ,বাংলায় বসন্তোৎসব দেখলে কে বলবে দোলের বীজ অন্য কোথাও রোপিত হয়েছিল! শোনা যায়, কৃষ্ণপ্রেমী চৈতন্য বাংলায় নতুন করে দোল উৎসবের প্রবর্তন করেন। মহাপ্রভু মানবধর্মের সন্ন্যাসী, তাই চৈতন্য চেতনায় দোল পূর্ণিমা ‘forgive and forget’-এর দিন, একের রঙে সবার রঙিন হওয়ার দিন। পশ্চিমবঙ্গে দোল ‘দোলযাত্রা’ নামে বাংলা ক্যালেন্ডার গুলিতে লেখা হয়, তার কারণ দোল পূর্ণিমার দিন বহু অঞ্চলে পালকি করে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ নিয়ে নগর পরিক্রমার প্রচলন আছে। বাঙালি যেখানে, সেখানে খাবারের বিশেষ পদ এবং উৎসবের গান থাকবে না, তাই কি কখনও হয়? তাই মঠ, ফুটকড়াই, মালপো, পায়েস আর বসন্তসন্ধ্যা বাঙালির দোলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে দিন যায়, সময়ের সাথে সাথে উৎসব ও তার পালনের রীতিতেও বিবর্তন ঘটে। চৈতন্য যুগের দোল ও নয়ের দশকের দোল যেমন আলাদা। সে যুগে দোল বেশ খানিকটা পুজো-আর্চা কেন্দ্রিক, পুরুষ প্রধান। দিন দিন ধীরে ধীরে ভক্তিভাবের থেকে আনন্দ বসন্ত অনুভব ও তার প্রকাশ বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। “আজি দখিন দুয়ার খোলা” নাচটা তুলতেই হবে, বাড়ির পুজোটা তো মায়ের ব্যাপার। ষোল বছরের মেয়েটা দোলের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই ভাবতে আরম্ভ করত যখন প্রভাতফেরীতে নাচব, লালুদা নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠে পড়বে, বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখবে। সেই লালুদাও মনে মনে দুপুর বেলা শুয়ে ভাবছে, “সেদিন তো সব ছাড় , কুমকুম যখন ওদের বাড়ির রকটায় রং খেলবে, সুযোগ বুঝে আবির দিতে গিয়ে ছুঁয়ে দেখব গাল দুটো, যদি পারি খানিকটা লাল আবির সিঁথিতেও...।” ভাবতে ভাবতে দুপুর গুলো শেষ হয়ে যায়। না, দোলের দিন তার বেশী কিছু হল, লাগোয়া বাড়ির ছাদ ডিঙ্গিয়ে এক হল ওরা। ছাদের সিঁড়ির কোনায় ব্লাউজের প্রথম হুকটা খুলে খানিকটা রং...। দ্বিতীয় হুকটা আর খোলা হলনা। নিচ থেকে মা ডাকল “কুমকুম......!”

আজ সবকিছু আরেকটু খোলামেলা, সবের মতো বানিজ্যিকরণ হয়েছে দোলেরও। শহরকেন্দ্রিক জীবনে কম বাজেটের বসন্ত উৎসবের পাশাপাশি জায়গা করে নিচ্ছে ‘পূল পার্টি’, ‘রেইন ড্যান্স’ বা নিদেন পক্ষে ক্লাব পার্টি, ইটিং আউট। আগের বছর পাড়ার ছেলেদের বাঁদুরে রং আর পাঁক মাখাটা ঠিক পছন্দ করেনি সুজাত, তাই এবার সে ঠিক করেছে তার ফ্যামিলি আর দুটো বন্ধুর ফ্যামিলি নিয়ে ডায়মন্ড হারবারের এক হোটেলে যাবে। সামনে ভোট, তাই পাড়ার প্রভাতফেরীটা বেদখল করে নিয়েছে নেতার চামচাগুলো। দোলের শুভেচ্ছার নামে প্রচারটুকু সেরে নেওয়া, আর কি! এখন নুপূর যদি পাশের বাড়ির ছটুর থেকে গায়ে পড়া রং না মাখতে চায়, মাখবে না। সে আর তার ইঞ্জিনিয়ার বয়ফ্রেন্ড আগে থেকেই বুক করে রাখবে কোনও রিসোর্ট, ওখানে বিয়ারটা একটু দামী, ঠিক আছে, একদিন তো, নো ম্যাটার। কে জানে সে ছোড়দাদাদের ভাঙের লাড্ডুটা মিস করছে কিনা বা ‘শিলা মুন্নি’র সাথে বেজে বেজে উঠছে কিনা “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল...।”

0 comments: