1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ : রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


একুশে ফেব্রুয়ারির চিন্তা, পুনশ্চ
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য


এবারে আর গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্ত (১৮৮৭-১৯৬১) ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তার জন্য তাঁকে অনেক পুলিশি অত্যাচার সইতে হয়েছিল। স্বাধীন ভারতেও রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে ডাক পড়েছিল তাঁর। নিজের সচিবকে মুখে মুখে একটি চিঠির বা আর কিছুর বয়ান বলতে বলতে তিনি সংজ্ঞা হারান। আর তা ফিরে আসেনি। প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় তাঁর মুখ দিয়ে অস্ফুট কিছু কথা বেরিয়ে আসছিল। প্রথম প্রথম কেউই সে ভাষা বুঝতে পারেননি। ইংরিজি তো নয়ই, এমনকি পোশাকি হিন্দিও নয়। ঠাওর করে একজন বুঝলেন : সেটি গাড়োয়াল অঞ্চলের ভাষা, পন্ত-এর যেটি মাতৃভাষা।

উচ্চশিক্ষার ভাষা নিয়ে আলোচনা করতে বসে এই ঘটনাটি লিখে গেছেন গোপাল হালদার (চতুষ্কোণ,বৈশাখ ১৩৬৯, পৃষ্ঠা ১)

জন্মভূমি আর মাতৃভাষা নিয়ে যে আবেগ দেখা যায় সেটি সর্বদাই সৎ ও শুদ্ধ – যদি-না অন্য কারুর জন্মভূমি বা মাতৃভাষা নিয়ে কোনো ব্যঙ্গ বা হিংসের ভাব তার মধ্যে থাকে। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে নিজের জন্মভূমি আর মাতৃভাষা নিয়ে গৌরব বোধ করার। কাউকে তাতে খাটো করা হয় না। কার জন্মভূমি কত ধনী, কার মাতৃভাষা কত সমৃদ্ধ – সে নিয়ে রেষারেষি বা টক্কর দেওয়ার মনোভাব একেবারেই অচল। কোন্‌ ভাষার কতজন লেখক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন – সেই নিয়ে গর্ব করা,অন্যদের হেয় করাও নিজের মাতৃভাষার প্রতি প্রীতির নিদর্শন নয়। উল্টে বলা যায় : অন্য লোকের জন্মভূমি আর মাতৃভাষাকে অশ্রদ্ধা করলে নিজের জন্মভূমি আর মাতৃভাষাকেই অপমান করা হয়।

পাকিস্তান আমলে ঢাকায়, স্বাধীন ভারতের কাছাড়ে ও অন্যত্র ভাষা আন্দোলনের সূত্রে বহু তরুণের প্রাণ গিয়েছিল, মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন সব বয়সের মানুষ। রক্ত ঝরিয়ে ভাষার মান রক্ষা হয়।আর্থিক বা রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার চেয়ে ভাষার দাবি এক তিলও কম নয়। তার কারণ : এই দাবির সঙ্গে কোনো বিশেষ শ্রেণীর বা গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িয়ে নেই; জড়িয়ে আছে সেই ভাষায় যাঁরা কথা বলেন তাঁদের সম্মান নিয়ে বাঁচার প্রশ্ন। ভাষা-শহিদরা তাই কোনো বিশেষ ভাষার শহিদ নন, সামগ্রিকভাবে ভাষা-শহিদ। জাতীয়তার সীমা ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বয় যেখানে সেই ভাষার লোক আছেন তাঁদের সকলের ইজ্জত বজায় থাকে ভাষা-শহিদদের দৌলতে।

গত কয়েক দশকে মাঝে মাঝেই দেখা গেছে : কিছু লোক ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বিলাপ করছেন এই বলে যে, পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতে বাঙলাভাষার অবস্থা নাকি নিদারুণ খারাপ, তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।কেউবা আবার পুবদিকে আঙুল দেখিয়ে বলছেন : বাঙলাভাষা যদি বাঁচে তবে ঐ ওপার বাংলাদেশেই বাঁচবে।

এইসব বিলাপবিলাসীদের দেখে মায়া হয়। বিশ কোটি মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, দুনিয়ার সব কোণে যখন বাঙলাভাষী মানুষ ছড়িয়ে আছেন, তখন বাঙলাভাষার জিম্মাদার বলে ভারতের একটিমাত্র অঙ্গরাজ্যকে ধরা হবে কেন? ত্রিপুরা নয় কেন? সেখানে কি এইধরনের অনর্থক বিলাপ শোনা যায়? অসমে, উত্তরপ্রদেশে, বিহারে কি বাঙলার চর্চা নেই? হতেই পারে আর্থিক ও অন্যান্য কারণে ঐ সব অঞ্চলের বাঙলা স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানকার বাঙালি ছেলেমেয়েরা ইংরিজি বা হিন্দী মাধ্যমের স্কুলে পড়ছে। তাতে বাঙলাভাষার কি এমন লোকসান? তারা তো বাড়িতে বাঙলাই বলে। তারা যদি বাড়িতেই বাঙলা পড়তে শেখে, পড়ার অভ্যাস বজায় রাখে - সেই তো যথেষ্ট। ভাষা বাঁচে মুখে, সমৃদ্ধ হয় লেখায়। পাঠক থাকলে লেখকও থাকবেন। ছাপা বই বা পত্রিকা এখন আর বিকল্পহীন নয়, তার পাশাপাশি আছে ই-পত্রিকা, ই-বই। সেগুলি পড়া ও সেগুলিতে লেখার মধ্য দিয়েই সারা বিশ্বর বাঙলাভাষীরা তাঁদের মাতৃভাষার প্রতি আসল কর্তব্য পালন করবেন।

1 comment:

  1. Jotartha bolechen, Sir, nijossho drirho bhongimai. Socheton holam. Dhonyobad.

    ReplyDelete