0

ধারাবাহিক : সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক

বানরায়ণ - ১৬
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



অস্তগামী সূর্যের আলোয় অযোধ্যার রাজপুত্রদের রক্ত যেন আরও বেশি লাল লাগছিলো। কেমন অসহায় ভাবে পড়েছিলেন দু’জন ধুলোর উপর! ওঁদের দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিলো।

সুষেণ ওঁদের শুশ্রূষা করছিলেন। ক্ষতস্থানে ওষুধের প্রলেপ লাগাচ্ছিলেন। মুখে, বুকে শীতল জল নিষেক করছিলেন। হনুমানও পরম মমতায় রামচন্দ্রের মাথাটি কোলে নিয়ে বসেছিলেন। এই অদ্ভূত মানুষটিকে যত দেখছি, তত আমার বিস্ময় বাড়ছে। বিপদের সময় কি করে যেন ঠিক এসে উপস্থিত হন। ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যখন সবার যুদ্ধ হচ্ছিলো, তখন ওঁকে কোথাও দেখতে পাইনি। কিন্তু যেই রাম-লক্ষণ বিপদে পড়লেন, সেই মুহূর্তে এসে উপস্থিত হলেন, এবং দু’জনের প্রাণরক্ষা করলেন। গতকাল রাতে আমার চরম বিপদের সময়ও ভোজবাজির মতন এসে পড়েছিলেন...

সুষেণের পরিচর্যায় রাম-লক্ষণ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিষ্কিন্ধ্যাবাহিনী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সূর্য ততক্ষণে অস্ত গেছে। হনুমান উঠে দাঁড়ালেন। আমার সঙ্গে এতক্ষণ একবারও চোখাচোখি না হওয়া সত্ত্বেও যে আমায় আগেই দেখে নিয়েছেন, সেটা আবার বুঝলাম। কারণ আবার ভীড়ের মধ্যে সোজা আমার দিকে চাইলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘‘প্রভা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, ঋচিক।’’

তাই তো! প্রভার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মাথা নেড়ে ছুটলাম কাল রাতে যেখানে ঘটনাটা ঘটেছিলো, সেদিকে। হনুমান ওকে ওখানেই অপেক্ষা করতে বলেছিলেন আমার জন্য। গিয়ে দেখলাম, মৃতদেহের স্তূপের মধ্যে মশাল হাতে একা দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বোধহয় আমাকেই খুঁজছে। আমি কাছে যেতে জোর করে ঠোঁটের কোণে একটা হাসি টেনে আনলো। আমিও হাসলাম। বোধহয় একটু বোকাটে হাসি।

‘‘কতক্ষণ এসেছো?’’ প্রশ্ন করলাম।

‘‘অনেকক্ষণ।’’ খুব আস্তে বললো প্রভা।

আর কি বলবো ভেবে পেলাম না। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর প্রভাই বললো, ‘‘আমরা কি খোঁজা আরম্ভ করবো?’’

তাই তো! ওর ভাইকে খুঁজতেই তো আসা। বললাম, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ! চলো।’’

তারপর সদ্য অন্ধকার হয়ে আসা যুদ্ধক্ষেত্রে মেদ-রক্ত-মৃতদেহের স্তূপের মধ্যে শুরু হলো আমাদের অনুসন্ধান। যাকে খুঁজছি, তাকে তো আমি চিনি না। যে আমার সঙ্গে খুঁজছে – আমার সম্পূর্ণ অপরিচিতা একটি মেয়ে, যে দেশ আমরা আক্রমণ করতে এসেছি, সেই শত্রু দেশের মেয়ে – তার সহোদর ভাই মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে এই যুদ্ধক্ষেত্রে কোথাও। হয়তো আমার পরম পরিচিত কারও হাতেই প্রাণ গেছে। হয়তো ভীষণ কষ্ট পেয়েছে নিজের দেশের মাটির উপর শুয়ে শেষবার নিঃশ্বাস নেওয়ার আগে... আর এখন তার বোন, তার একান্ত আপনার জন, এসেছে তাকে খুঁজতে... তার মৃতদেহের অন্তিম সংস্কারটুকু যাতে করতে পারে। আর আমি, তাম্বলি গ্রামের ঋচিক, হনুমানের নির্দেশ মতন তাকে সাহায্য করছি!

বড় ক্লান্তিকর এই খোঁজা। রাতের যুদ্ধক্ষেত্রের বীভৎসতার ভিতর যে নিজের প্রিয়জনকে খুঁজে না ফিরেছে, সে কোনওদিন বুঝবে না এই ক্লান্তির কথা। মাংসলুব্ধ পশুর দল মৃতদেহ ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। তার মধ্যেই যাদের দেহে এখনও প্রাণটুকু আছে, তাদের অবরুদ্ধ গোঙানি-কাতরানির শব্দ ভেসে আসছে। এই সব কিছুর সঙ্গে সারাদিনের পরিশ্রম মিলিয়ে মাঝে মাঝেই আমার কেমন অবসন্ন লাগছিলো। কিন্তু প্রভা দেখলাম অক্লান্ত ভাবে খুঁজে চলেছে। মৃতদেহ সরিয়ে সরিয়ে, শেয়াল-কুকুর তাড়িয়ে তাড়িয়ে মশালের আলোয় খুঁজে চলেছে ভাইকে। যেন ওতেই ওর জীবনের মোক্ষ...

তারপর বোধহয় হঠাৎ একসময় ওর আমার কথা মনে পড়লো। থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকালো আমার দিকে। বললো, ‘‘তুমি কি ক্লান্ত? যুদ্ধ করেছো সারাদিন?’’

আমি আবার হাসলাম। বোকাটে হাসি। ও জানে না যে আমি যোদ্ধা নই। সামান্য চিকিৎসাকর্মী। বললাম সে কথা ওকে। ও একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘তুমি মারোনি কাউকে এই যুদ্ধে?’’

আমি মাথা নাড়লাম। এই যুদ্ধে কেন, কোনওদিন কাউকে মারিনি। ভবিতব্যের টানে এসেছি। আসতেই হতো। অন্তত বুড়ো সোমুকের তাই-ই বক্তব্য ছিলো। কিন্তু সে সব কথা প্রভাকে বলে লাভ নেই। ও কিছুই জানে না আমার সম্বন্ধে। তাই শুধু বললাম, ‘‘তোমার বোধহয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।’’

প্রভাআরও কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর ধীরে ধীরে মাটির উপর বসে পড়লো। মন্থর, ক্লান্ত স্বরে বললো, ‘‘একটু বিশ্রাম নিই।’’

আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম, ও আমার থেকে অনেক, অনেক বেশি ক্লান্ত... আর একা।কাল বলেছিলো, ভাই ছাড়া ওর আর কেউ নেই। সেও তো এখন আর নেই। কিভাবে চলছে ওর? বয়স তো আমারই মতন। দু’এক বছর এদিক ওদিক হবে বড়জোর। হঠাৎ ওর সব কথা জানতে ইচ্ছা করলো আমার। একটু দূরে ওর মুখোমুখি মাটির উপর বসে পড়লাম আমিও।

প্রশ্ন করতে গিয়ে খেয়াল হলো, ও তো আমার নামটাও জানে না। কিছুই জানে না আমার সম্বন্ধে। কারও পরিচয় বা তার বিষয়ে কিছু জানতে চাওয়ার আগে আত্মপরিচয় প্রদান আমাদের জঙ্গলের নিয়ম। তাই নিজের কথা বলতে আরম্ভ করলাম।

প্রভা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একাগ্রভাবে শুনছিলো। মেয়েটার চেহারা অতি সাধারণ। ছোটখাটো ছিপছপে গড়ন। একঢাল ঘন, কালো চুল আপাতত অযত্নে পিঠের উপর ছড়ানো। আমাদের দেশের মেয়েদের সঙ্গে প্রায় কোনও তফাৎ নেই। শুধু চোখ দু’টোতে যেন কোন সুদূরের ছায়া। মন দিয়ে যে শুনছে আমার কথা, কিন্তু সেও যেন অন্তর্লীন কোনও এক অন্য চিন্তার প্রবল আকর্ষণ এড়িয়ে। কি ভাবছে প্রভা? সামনে ওর, বা ওর মতন লক্ষ লক্ষ লঙ্কাবাসীর অনিশ্চিৎ ভবিষ্যতের কথা?

যথাসম্ভব সংক্ষেপে আমার কথা বললাম ওকে। তাম্বলি গ্রামের কথা, ঠাকুর্দার কথা, আমাদের যুদ্ধে আসার কথা, আমার চিকিৎসাদলে যোগ দেওয়ার কথা, কিষ্কিন্ধ্যার কথা, রামচন্দ্রের কথা... শেষ করে থামলাম। প্রভা মুখ নীচু করে রইলো কিছুক্ষণ।তারপর হঠাৎ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘উনি কে?’’

বুঝলাম, হনুমানের কথা জানতে চাইছে। নিশ্চয়ই ওইরকম মানুষ ও-ও দেখেনি আগে। তার উপর গতরাতের ওই আশ্চর্য আবির্ভাব এবং আমাদের দু’জনের প্রাণরক্ষা। কৌতূহল হওয়াই স্বাভাবিক।

আমি একটু হাসলাম। এবার বোধহয় তেমন বোকাটে নয়। বললাম ওকে হনুমানের কথা। যতখানি জানি।শুনলো মন দিয়ে। কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, ‘‘ওঁর মতন আরও মানুষ আছেন তোমাদের বাহিনীতে?’’

এই কথাটা কেন জিজ্ঞেস করছে? একটু অবাক লাগলো। তবু বললাম, ‘‘আর একজন আছেন। নল। সেতুবন্ধনের কাজ উনিই তত্ত্বাবধান করেছেন। কেন জানতে চাইছো?’’

প্রভা উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করলো, ‘‘এঁরা কোথাকার মানুষ তুমি জানো?’’

আমার বিস্ময়টা বাড়ছিলো। যে প্রশ্নটা আমার মনের ভিতর সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছে, ও সেটাই করছে আমাকে। আমি কি সত্যিই জানি এঁরা কোথাকার মানুষ? কেনই বা এসেছেন এই যুদ্ধে রামচন্দ্রকে সাহায্য করতে? প্রভা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। উত্তরের অপেক্ষায়...

‘‘শুনেছি আর্যাবর্তের উত্তরে এক দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় আছে। তারও বহু উত্তরে এক হিমের দেশের মানুষ এঁরা। আমাদের অন্তত সেইরকমই ধারণা।’’ বললাম আমি।

আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। আমার অস্বস্তি হচ্ছে। তারপর প্রভা আস্তে আস্তে বললো, ‘‘কুবেরও সেখানকার মানুষ ছিলো।’’

চমকে উঠলাম। কুবের সম্বন্ধে কি জানে ও? লঙ্কায় কুবেরের রাজত্বের অবসান তো আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কথা। তখনকার কথা কতটুকু জানে মেয়েটা?

‘‘কুবেরের সম্বন্ধে কি জানো তুমি? কে ছিলেন তিনি? কোথা থেকে এসেছিলেন?’’

দূরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ প্রভা। তারপর মন্থর স্বরে বলতে আরম্ভ করলো... ‘‘ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনতাম... বাবারা যখন ছোট ছিলো, তখনকার কথা। এদেশে তখন ভয়, বিদ্বেষ আর অবিশ্বাসের রাজত্ব ছিলো... আর সে রাজত্ব চালাতো কুবের।’’

আমি উৎকর্ণ হয়ে শুনছি...

‘‘বহুদূর উত্তরের হিমের দেশ থেকে এসেছিলোসে আর তার সাদা মানুষের দল। সোনায় মোড়া বিশাল বিশাল জাহাজে করে। তাদের অর্থবল আর অস্ত্রবলের বিরুদ্ধে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলো লঙ্কার সরল আদিবাসীরা। তারা কোনওদিন ভাবতেই পারেনি, বিদেশী কেউ এসে এভাবে এখানে রাজত্ব কায়েম করে বসবে।’’

প্রভা থামলো। ‘‘কেন এসেছিলো ওরা?কিসের লোভে? তোমাদের দেশ কি খুব সম্পদশালী ছিলো তখন?’’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মাথা নাড়লো প্রভা। ‘‘সম্পদ কাকে বলে, এদেশের মানুষ তখন জানতোই না। ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে ছোট ছোট গ্রামে থাকতো। শিকার করতো, পশুপালন করতো, চাষবাষ করতো। হাজার হাজার বছর এইভাবেই কেটে গিয়েছিলো। তারপর যেদিন কুবের আর তার সাদা মানুষের দল এসে এখানে ডেরা বাঁধলো, সেদিন তারা প্রথম জানতে পারলো যে এই জঙ্গলে ভরা সবুজ দ্বীপটা নাকি সমুদ্রবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একদম আদর্শ জায়গা!’’

‘‘তারপর?’’ ওকে একটু দম নিতে দিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

‘‘তারপর সেই ভয়, বিদ্বেষ আর অবিশ্বাসের রাজত্ব।’’

আবার একটু নীরবতা। তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কুবের কি খুব অত্যাচারী রাজা ছিলেন?’’

‘‘আমি সঠিক জানি না।আমি তো তখন ছিলাম না।’’ একটু অন্যমনস্ক ভাবে বললো প্রভা, ‘‘যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কাছে শুনেছি, ব্যবসায়িক স্বার্থের ব্যাপারে সেছিলো নির্দয়। সেই স্বার্থে আঘাত লাগলে আঘাতকারীকে সেচরম শাস্তি দিতো।’’

‘‘কিরকম ব্যবসা? কেমন স্বার্থ?’’

আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো প্রভা।রাতের যুদ্ধক্ষেত্রের আবছা আলোয় ওর মুখটা অদ্ভূত লাগছিলো। কিছুটা নৈরাশ্য, কিছুটা বিতৃষ্ণা আর অনেকখানি রহস্য মাখা মুখটার পিছনে মনে হচ্ছিলো যেন এই দেশটার বিগত অর্ধ শতাব্দীর সম্পূর্ণ ইতিহাস লুকিয়ে আছে...

‘‘মানুষের ব্যবসা।’’ প্রভার কন্ঠস্বরে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে কেমন যেন একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেলো।

0 comments: