0

স্মৃতির সরণী : গৌতম দত্ত

Posted in


স্মৃতির সরণী


দখিনো হাওয়া...
গৌতম দত্ত



স্কুলে ছাত্র থাকাকালীন শচীনকর্তার গান খুব একটা ভাল লাগতো না। রেডিওতে শুনতাম ওনার অনেক গানই। বাড়ীতে যে সব ৭৮ আর পি এমের রেকর্ড কাকারা আনতো সেগুলোর মধ্যে শচীনকর্তার রেকর্ড দেখিনি কখনো। কেমন যেন একটা ভাঙা ভাঙা নাকি নাকি গলা। মনে ধরেনি ওই বয়সে।

তারপর কলেজে ঢুকে একটু আঁতেল হবার চেষ্টা শুরু হল। রবীন্দ্রনাথ পড়তে শুরু করলাম নতুন করে। পুরোনো দিনের অনেক শিল্পীর হাল হকিকৎ জানতে শুরু করলাম। এইভাবেই জ্ঞান-রাজ্যের দরজা আস্তে আস্তে ফাঁক হতে শুরু করলো। এক বন্ধুর প্রিয় শিল্পী তখন শচীনকর্তা। শচীন দেব বর্মণ বলতে সে অজ্ঞান। আর খোলা গলায় মাঝে মাঝে গেয়ে উঠত শচীনকর্তার গানের সঞ্চারীর দুটো লাইন। খোলা দরাজ গলায় সে এক দারুণ অনুভূতি! ওই রকম দু’লাইন গান শুনে ইচ্ছে হত বাকিটা শোনার। কিন্তু ব্যাটার ওইখানেই থেমে যেত গান। পরে বুঝেছি, আমাদের শচীনকর্তার গানে আকৃষ্ট করতেই তার এই প্রয়াস জারী ছিল।

কিন্তু একদিন কি জানি কেন আমরা শুনলাম একটা পুরো গান। আহা! সেই প্রেমে পড়লাম সুরের যাদুর, কথার মালার। গানটা এখনো যেন নতুন করে ধরা দেয় আমার কাছে যখনই শুনি কোথাও।

“শোনো গো দখিনো হাওয়া, প্রেম করেছি আমি
লেগেছে চোখেতে নেশা দিক ভুলেছি আমি

মনেতে লুকানো ছিল সুপ্ত যে পিয়াসা
জাগিল মধু লগনে বাড়ালো কি আশা

উতলা করেছে মোরে আমারি ভালবাসা
অনুরাগে প্রেম শরীরে ডুব দিয়েছি আমি

শোনো গো মধুর হাওয়া প্রেম করেছি আমি

দহনো বেলাতে আমি প্রেমেরো তাপসী
বরষাতে প্রেম ধারা শরতের শশী

রচিগো হেমন্তে মায়া শীতেতে উদাসী
হয়েছি বসন্তে আমি বাসনা বিলাসী

শোনগো মধুর হাওয়া প্রেম করেছি আমি
লেগেছে চোখেতে নেশা দিক ভুলেছি আমি ”

প্রথম দুটো কলিই চমকে দিল মনটাকে। গোয়েঙ্কা কলেজের সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম থোকা থোকা আগুন ঝলসে দিচ্ছে আমাদের চোখ। পাশের লম্বা দেওদার গাছটার পাতায়ও যেন ঠিকরে পড়েছে সেই আগুনের টুকরো ছিটে। বুঝলাম, বসন্ত এসেছে কলকাতায়।

কি সুরের দোলা! যেন সাগরের ঢেউ। এই উঠছে, এই ভাঙছে সশব্দে। তার সাথে ঢোল, বাঁশী আর দোতারার অপূর্ব মিশেলে সেই বসন্ত দুপুরে প্রেমেই পড়ে গেলাম শচীনকত্তার। “হয়েছি বসন্তে আমি বাসনা বিলাসী” কলিটা যখন সে গাইল, তা শুনে সব কটা বন্ধুর কথা বন্ধ। এমন কি বেশ অনেকক্ষণ ধরে আমাদের অনুভবে কম্পন তুলে দিয়ে গেল এই গান। সে দিনের সেই দুপুরে সত্যিই মনে হল, বসন্ত এলো। এলো আমার জীবনে।

তারপর শুনতে চাইলাম বাকি সব গান। কিন্তু তখন তো আর এত উপকরণ ছিল না আমাদের। তাই রেডিওই ভরসা। টেপ রেকর্ডার তখন বেশ মহার্ঘ আমার কাছে। উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল পারসেন্টেজ আর বাবার কম ইনকামের কারণে প্রথম বছর বৃত্তি পেলাম কুড়ি টাকা করে মাসে। বছর শেষে সরকারী টাকা পেলাম। একসাথে দুশো চল্লিশ টাকা। ১৯৭৪-এ। নগদে। প্ল্যান আগেই করা ছিল তাই সোজা পিসেমশাইকে ধরে রেডিও কিনলাম। ট্রানজিস্টার। তিন ব্যান্ডের ছোট্ট “নেলকো” কোম্পানীর। কি আনন্দ তখন। আমার নিজের টাকায় কেনা। রাতে বালিশের পাশে নিয়ে শুনতাম আকাশবাণী কিংবা “বিনাকা গীতমালা” – রেডিও সিলোন-এ। 

আড্ডা বেড়ে যাওয়ার কারণে পরের দু বছর পেলাম ফ্রি স্কলারশীপ। মানে আর মাইনে লাগেনি কলেজে। কিন্তু আরো দুবার টাকাগুলো পেলে হয়তো একটা টেপ-রেকর্ডার কিনতে পারলাম। কিন্তু সে সুযোগ হয়েছিল অনেক পরে।

যা বলছিলাম। বসন্ত এলো আমার। গোটা বি টি রোডের দু ধারেই ছিল অসংখ্য পলাশ গাছ। চোখ পড়তে শুরু করলো সেই দিকে। কৃষ্ণচূড়া তখনো খুব কম। দুই ফুল মিশে গেল গানে - 

“পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ায় আগুন জ্বেলে ফাগুনবেলা 
রঙে রঙে রাঙিয়ে তুলি...
আমি কস্তুরী সে মৃগের মতো 
নিজের গন্ধে নিজেই ভুলি...”

উফফ্‌, জাস্ট অসাম্‌। তাও তো আমরা “গেভাকালারে” দেখতে পারিনি “পথে হলো দেরী”। সাদা কালোতেই বসন্ত এলো উত্তমকুমারের হাসি আর সুচিত্রার চোখের ইশারায়! এখনো মনে পড়লে রোমাঞ্চ হয় শরীরে। 

আমি গ্রামে মানুষ হইনি। তাই বসন্তকে পেয়েছি আমার শহরে এই সব গান, কবিতা আর সিনেমার মাধুর্য দিয়ে। মাতাল হয়েছি পলাশের রঙে আর দখিনা হাওয়ায়! বসন্তকে পেয়েছি সরস্বতী পুজোর ভোরে, বাসন্তী রঙা শাড়ি পড়া ছাত্রীদের উচ্ছ্বল কলতানে। বসন্তকে পেয়েছি লাবণ্য আর অমিত রায়ের শিলং পাহাড়ে। বসন্তকে পেয়েছি নরেনকে বাড়ীতে ডেকে এনে 

বিজয়ার অকৃপণ সেবামাধুর্যের ছোঁয়ায়। বরানগরের অজস্র গাছ গাছালির পাতায়। পালপাড়া সাধারণ গ্রন্থাগারের সেই পুরোনো কাঠের র‍্যাকের বইয়ের তাকে।

এভাবেই ফিরে পেতে চাই বারে বারে আমার সেই যৌবনের বসন্ত বাতাসকে।

0 comments: