2

প্রবন্ধ : বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


মানভূমের আঞ্চলিক কবিতা
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়



পুরুলিয়া জেলার আঞ্চলিক উপভাষায় লেখা কবিতা সাধারণের কাছে মানভূঁইয়া কবিতা নামেই অধিক পরিচিত। অবিভক্ত মানভূমের মধ্যে এই ধরনের কবিতার তেমন কোনও প্রচলন ছিল না। যা ছিল তা লোকগান, ঝুমুর, টুসু, ভাদু। এইসব লোকগানের মধ্যে লোকজীবনের চিত্র যেমন ছিল, ছিল দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহের প্রভাব ও ভাবনার প্রতিশ্রুতি। ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর মানভূম ভেঙ্গে পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি হলেও মানভূম শব্দটির বিলোপ ঘটেনি আমাদের জীবন চর্চা এবং লোকজীবন থেকে। সভ্যতার ক্রমাগ্রসরণে কোনও জাতি বা ভূখণ্ড তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা ধারা নিয়ে কোনও স্থির বিন্দুতে অবস্থান করতে পারেনা। চেতনায় ও চিন্তায় আন্তর্জাতিক মেলবন্ধনের গভীর ও অভিপ্রেত প্রেরণায় নিজেকে সম্পন্ন করে নিজের অনেকখানি জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের অত্যাবশ্যক উপাদান আত্মীকরন করে। হার্বাট স্পেনসার সংস্কৃতি প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন তা আরও একবার মনে করা যাক - “সংস্কৃতির মধ্যে সবসময় আহরণপ্রয়াসী পরিশীলিত জীবন সম্ভাবনা আছে, যা কোনও কালেই আত্মপরিপুষ্ট এবং আত্মসর্বস্ব নয়, বরং নিত্য বিচরণশীল ও নবায়ণের সম্ভাবনাঋদ্ধ।” কিন্তু সময় এগিয়ে গেলেও পুরুলিয়া তার অন্তরে প্রতিপালন করে চলে মানভূমের সেই বহমান ধারাটিই। গ্রাম বা শহর সর্বত্রই এই লোকজীবনের গভীরতর বার্তা। সংস্কৃতি শব্দটির মধ্যে যে সবুজতা এবং প্রাণের সমারোহ আছে, প্রত্যেকটি জাতির অভিব্যক্তির মধ্যে এই শ্যামলিমা ও স্পৃহণীয় মৌলিকতাই তাকে আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচায়। পুরুলিয়ার মানুষের ঋজু মেরুদণ্ড, মাটির সাথে সংলগ্ন থাকার দৃঢ়তা তাকে সাবেকী সাংস্কৃতিক ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেয়নি।



অবিভক্ত মানভূমে ঝুমুর লেখার রেওয়াজ ছিল। জেলার অধিকাংশ ঝুমুরকবি, যেমন গদাধর চৌধুরী, দীনা তাঁতি, পরেশ কামার, বরজুরাম, দ্বিজ টিমা, উদয় কামার মানভূমের ভাষাতেই তাঁদের গানের সুললিত ছন্দে মনের ভাব প্রকাশ করে গেছেন। যাঁরা আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখেছেন বা আজ যারা আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখছেন, এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ঝুমুর কবিদের প্রভাবকে তাঁরা অস্বীকার করতে পারবেন না। যদিও কবিরা ঝুমুরের ধারা থেকে নয়, পুরুলিয়ার জল মাটি এবং নিজেদের অন্তরের আকুতি থেকেই লিখতে এসেছেন মাটির কবিতা।



ঝুমুরকবি গদাধর চৌধুরী যখন লেখেন ‘‘খালভরা হামকে সাথাছে / লদিভরায় হামকে সাথাছে / ঘরে আইসে খাছ্যে দাছ্যে মকমকাছে / কুলি কুলি কি মহিমা পাছে গো’’, বা দীনা তাঁতি যখন উচ্চারণ করেন ‘‘চাটি চুটি দিঞে মোরে / সাম করাল্য ডিপু ঘরে / লেখাইল আমার সাত পুরুষের নাম / লম্পট্যা শ্যাম ফাঁকি দিঞে চালালি আসাম’’, তা কবিতা হয়ে উঠুক বা না উঠুক, পুরুলিয়ার নিরাবরণ নিরাভরণ প্রান্তরের ছবিই উন্মুক্ত করে, যা শুধু আমাদের চোখের উপরিস্তরে নয়, অন্তরের গভীরেও দাগ রেখে দেয়।



মাটি ও মানুষের সংস্কৃতির এই ধারা থেকে পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক কবিতার ধারাটির উন্মেষ ঘটে। আঞ্চলিক কবিতা রূপে প্রসার ও পরিচিতি লাভ করে সাতের দশকে। এ ক্ষেত্রে পুরুলিয়ার ছত্রাক পত্রিকার সবিশেষ ভুমিকাও আছে। আমি শুধু সেই সমস্ত কবিদের কবিতা নিয়েই আলোচনা করব যাঁরা পুরুলিয়ার কবিতাকে পরিশীলিত রুপ দিয়ে কবিতাভাবনায় সমকালীন ফর্ম ও কনটেন্ট এনে সারা বাংলার মধ্যে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। যদিও কখনওই মাটিকে অস্বীকার করে নয় বরং মৃত্তিকার গভীর তলদেশে শিকড় প্রসারিত করে।জেলার অগ্রনী কবিদের মধ্যে বেনু দেবী, সুবোধ বসু রায়, মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, অমিয়কুমার সেনগুপ্ত এবং সুকুমার চৌধুরীর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। মূলত এঁরাই পুরুলিয়ার ভাষায় লিখিত কবিতাকে সারা বাংলার প্রবাহের মধ্যে মিশিয়ে দিতে পেরেছেন। বুদ্ধিজীবি মহলের চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পেরেছেন।

আঞ্চলিক কবিতা যেহেতু একটি নির্দিষ্ট ভূমিখণ্ডের মানুষের কথ্যভাষায় লিখিত কবিতা, তাই খুব সঙ্গত কারণেই অন্য এলাকার মানুষের পক্ষে এই কবিতা পাঠ করা বা এর রসাস্বাদন করে আত্মস্থ করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। ফলে এই ধরনের কবিতার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে এই ভাষারীতি ও উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরী। অনার্য-দ্রাবিড়–অস্ট্রিক (মুণ্ডারি, ওঁরাও, হো, সাঁওতালি) এবং আর্য গোষ্ঠীর (কুড়মালি, ভোজপুরি, মৈথিলী, হিন্দি, ওড়িয়া, সাদানি, খড়িবেলি) ভাষার আংশিক প্রভাব পড়েছে এই জেলার ভাষার মধ্যে।কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা ভাষার পেলবতা অতিক্রম করে পুরুলিয়া বা পশ্চিম সীমান্ত বাংলার ভাষা হয়ে উঠেছে অনেক সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও তেজী। ‘‘বাজে বকিস না’’ এই নরম কথাটি পুরুলিয়ার ভাষায় যখন হয়ে ওঠে ‘‘আনখাই বিকলাইস না’’ বা যখন তাড়া কর কথাটি ‘‘ইঁড়কাই দ্যা’’তে পর্যবসিত হয়, তখন ভাষার শক্তিমত্ততা নিয়ে, তার তেজ ও গরিমা নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ থাকেনা। অপিনিহিতি, স্বরাঘাতের প্রাবল্যজনিত হ আগম, স্বতোনাসিক্যভবন এবং অন্তে অ উচ্চারণ এই উপভাষার মধ্যে পুরো মাত্রায় উপস্থিত।



পুরুলিয়া জেলার আঞ্চলিক কবিতার গ্রহণীয়তা ও জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, প্রতিযোগিতায় আবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হচ্ছে এই সব কবিতা। ক্যাসেটবন্দী হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।

বেনু দেবী(১৯২১ – ১৯৯৪)ই জেলার আঞ্চলিক ভাষার কবিদের মধ্যে প্রবীনতমা। যদিও তাঁর আঞ্চলিক কবিতার বই ‘পুরহুইলার বারহমাসি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। সামাজিক বৈষম্য, নারীর অবস্থান এবং মেয়েদের উপর অত্যচার, এইসব বিষয় তাঁর কবিতায় সহজেই জায়গা করে নিয়েছে। পণ ও প্রতিবাদ কবিতায় তিনি সেই প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত মেয়েটিকে তুলে আনেন... ‘‘জমি বিচে পইসা বাপ কেনে দিবি পরকে / ল্যাখাপড়া হামায় শিখা, ঘুরাই দিব ঘরকে।’’



সত্য গুপ্ত একজন শক্তিমান কবি। তাঁর ‘সাঁজী’ যদিও পুরোপুরি ভাবে আঞ্চলিক কবিতার বই নয়, তবু তাতে বেশ কিছু আঞ্চলিক কবিতা পড়ার সুযোগ হয়। যা কবিকে চিনিয়ে দেয়।‘ঝান্ডি উঠা পরব’ কবিতায় তিনি লেখেন... ‘‘ভিখারি যদি ভিখ মাঙ্গাই রহে গেল ত শুখা ঝান্ডি ট উঠাই কি শুধু ফট তুলা হবেক?’’



কবি অরুণ চট্টোপাধ্যায় রাঢ়ের এক শক্তিমান ও বলিষ্ঠ কবি। তাঁর ‘সাঁঝবিহান’ আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম। কর্মসূত্রে তিনি পুরুলিয়ার সাঁওতালডিতে ছিলেন দীর্ঘদিন। পুরুলিয়ার মাটি ও মানুষের আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। ‘ভুজুং মাঝির দেয়ালে পোস্টার’ কবিতায় তাই তিনি অনায়াসে লিখতে পারেন নিয়ত পদপিষ্ট হতে থাকা মানুষের যন্ত্রনার ছাপ... ‘‘বড় বাহার লাইগছে আইজ্ঞা দিয়ালে / লাল কালা রঙ দাইগলেন দমে / তা আইজ্ঞা উ গুলান কি বটে ... ছবি ত লয় ... লিখা বটে / ত কি লিখলেন বাবু / ই গাঁয়ের বিত্তান্ত কিছু লিখলেন ন কি / ইখেনে একটাও কুয়া নাই জোড়ের জল শুঁকাই গেইছে / একবেলা টুকচেক পান্তা খাইয়ে পাথর ভাঙ্গা মিশিনে খাইটছে ঘরের বিটি ছিলা / আমি বিনা লাঙ্গলের চাষি / ঠিকাদারের নাম কাটা মজুর / চদুর পারা ভালছি আংরাপুড়া আকাশ / মরা কাড়ার চামের পারা শুখা মাটি...’’

অধ্যাপক সুবোধ বসু রায় সম্পাদিত মানভূমী কবিতার দুটি সংকলনের মধ্যে প্রথমটি ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়, পরেরটি ১৯৮৭ সালে। মানভূমী কবিতা সংকলন(১৯৮২ )-এর ‘ই সময়টয়’ কবিতায় বসন্তে পুরুলিয়ার অনুপম সৌন্দর্যের চিত্র তুলে ধরেন কবি... ‘‘মুকুলের বাসে মহ মহ কইত্তে থাকে চাইরদিক... / ই বোঙ্গাবুরুর দেশে / হলিতলি হয় আইজ্ঞা ই সময়টয় / টুকচা ঝুম্যর লাচ হয় / শারহুল ফুল গুইঞ্জে লিয়ে ডুংরি ধারে মাঝিঘরের বহু বিটিরা লাইচতে থাকে / এই রূপ ও জ্যোৎস্নায় তখন – বুকের ভিতরটা গুরগুরায়।’’



মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় জেলার আরেকজন শক্তিমান ও জনপ্রিয় কবি। প্রান্তিক উপভাষায় লেখা তাঁর অগণিত কবিতা পৌঁছে গেছে মানুষের ঘরে ঘরে। আকাশবাণী কলকাতা ও রাঁচি কেন্দ্রে অসংখ্য বার আমন্ত্রিত হয়ে মূল বাঙলা কবিতার সাথে পুরুলিয়ার আঞ্চলিক কবিতাও পাঠ করেছেন। ‘মাড় ভাতের লড়াই’ (১৯৮৫), ‘চাঁদে এককাঠা জমি’ (১৯৯৫), ‘মাঠ খসড়া’(১৯৯৯), তিনটি মানভূমী কাব্যগ্রন্থই পুরুলিয়ার আঞ্চলিক কবিতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তবু বলব, ‘মাড় ভাতের লড়াই’ একটি মাইলস্টোন। লফরা মাহাতর ‘জবানবন্দী’ কবিতায় নিজের অধিকারকে বলবৎ করার জন্য মজুরী বৃদ্ধির আন্দোলনে সামিল হয়েছিল লফরা। এই অপরাধে তার পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। জেল থেকে ফিরে এসে সে দেখে শূন্য ঘর,স্ত্রী সন্তান অনাহারে মারা গেছে। তখন আরও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে সে। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় অধিকার অর্জনের দূর্বার শপথ... ‘‘ই মাটি সবার ই আকাশ সবার / সবার লাইগ্যে সব কিছু সমান না হল্যে / কাল্লায় কাল্লায় শোধ লিবঅ আইজ্ঞা / ই কনহ অন্যায় লয়, কনহ অন্যায় লয়।’’



গ্রাভিল হিকসের মতে – একজন প্রগতিশীল লেখক তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে প্রলেতারীয় পাঠককে শ্রেণীসংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ও অংশগ্রহণ সম্পর্কে অবহিত করেন, তাই যে অঙ্গীকারের মধ্যে লফরা মাহাতর জবানবন্দী কবিতার সমাপ্তি, সেই অধিকারই একদিন বাস্তব রূপ পায় ‘ইস্ট্রাইক’ কবিতায়। এই কবিতায় ডমরু বাগদি মরদের বেটা মরদ। “পুরুল্যার গাঁ গঞ্জের মড়ল গুল্যানের বড় দেমাক / দশ দিনের ইস্ট্রাইকে চুপসাই গেছে বুক / চারদিকের লে সামাল সামাল ডাক উইঠছে / দাবি দাওয়া মান্যে লিয়েছে সব – নীচু গলায় রা কাইড়ছে ইখন /... হ মরদের বেটা মরদ বটে ডমরু / বাবুদের পাঁজরা গুল্যান হিল্যাই দিলেক।’’



আশির শক্তিমান কবি সুকুমার চৌধুরী নিজস্ব প্রকরণে ও আঙ্গিকে অনন্য মাত্রা যোগ করেছেন জেলার আঞ্চলিক সাহিত্যে। ‘লাল লীল হইলদা তিন দিকে ঝাইলদা’ তাঁর জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ শুধু নয়, শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থের স্বীকৃতিও পেয়েছে ‘দূরের খেয়া’, ‘নাগপুর থেকে’। মহারাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসিত এই কবির সাথে তাঁর জন্মভূমি পুরুলিয়ার মাটির সংযোগ যে কত নিবিড়, তা বোঝা যায় তাঁর কবিতাভাবনা অনুধাবন করলে। তাঁর কাব্যভাষা মাড় গালা ভাতের মতই ঝরঝরে নির্মল। গ্রামীণ যাত্রাপালা, লৌকিক দেবদেবী থেকে আরম্ভ করে ইঁজর পিঁজর ঝান্ডি খেল পর্যন্ত উদ্ভাসিত হয় তাঁর নির্মাণে। ভাভরার গন্ধে ম ম করে তাঁর কবিতার প্রতিটি অনুচ্ছেদ। লাম্বু সাউ, লুকা মাস্টার, ফাটা গনেশ, মাখনা, কন্ডাকটর লন্দী, মুতড়ু, সনুয়া পেড়কা, এইসব প্রান্তিক মানুষজনের আখ্যান বিম্বিত হয় তাঁর দ্যুতিময় কবিতায়... ‘‘মাথা গরম হয়ে গেল আরুনির। / ইড়কা বাছুরের পারহা / একগাড়ি বিলাতির চড়হে / খেপা ষাঁড়ের মত লাইচতে লাইচতে বল্য.../ দু নয়া ... যা শালহা ... নাই বিকব / ... ফকটেই লিয়ে যা বকাচদা তর বিজনিশের মুহে মুতি। / হাট ভরতি মায়া মরদ উয়াকেই দেখে, মুহে কাপড় দেয় / বিলাতি কুড়ায়। / ছেলাপুল্যারা হাততালি দেয় আর গেদলা বিলাতি তুলে / উয়াকেই ছুড়ে ছুড়ে মারছে।’’



গ্রামজ এক স্বাভাবিক ঘটনা তাঁর নিপুণ কলমে অসামান্য দীপ্তি পায়। আর বিলাতি ছোঁড়ার দৃশ্যটি অমরত্বের মহিমা অর্জন করে নেয় অনায়াসে।

গ্রাম্য জীবনের উপর একাগ্র ও নিবিড় হয়ে ওঠে সুকুমারের চোখ যখন ভোজনরসিক ঘাঘু ঠাকুরের কথা লেখেন তিনি। পরিচিত চিত্র ও চরিত্র কি অসামান্য মহিমায় উঠে আসে গ্রামবাংলার আকাঁড়া শব্দের নির্যাসে... ‘‘ঘাঘু ঠাকুরের মুখ চইলতেই থাকে / কনহ থকান নাই শুধু লাজাই গেলহে / মাঝে মাঝে মিটমিটাই হাসে আর / বকা খাওয়াসের ছুটু ছেলা পেন্টুল সামলাতে সামলাতে গুনহে / একশহ তিন ... একশহ চার ...’’

দেবাশিস সরখেল আঞ্চলিক ভাষাকে ছন্দের রূপ দিয়েছেন নিজস্ব ধারায়। তিনি যখন লেখেন... ‘‘তোর ক্ষেত ভইরেছে বড়হান ধানের শীসে / তুই কমতি ছিলি কিসে? যেমনি টাঁড় তেমনি মুগুর / বউটি খুব ডাগর ডুগর মাচান ভরা পুঁই / তবু কিসের দুখে ঝুইলে পড়লি তুই?’’, কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের আট বছর আগের একদিন কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়।



মানভূমী কবিতার আর এক সার্থক কবি দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ‘আঁধার বাইদ বহাল’ জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থগুলির অন্যতম। কবির ‘হারান্যা’ কবিতাটি বিভিন্ন মঞ্চে শোনা যায়। চাসনালার কয়লাখাদানে জল ঢুকে কত শ্রমিকের যে মৃত্যু হয়েছিল সেদিন তার কোনও পরিসংখ্যান নেই। পুত্রশোকে পিতার মর্মান্তিক কান্নায় ভরে উঠেছিল আকাশ বাতাশ। কত স্বামীহারা অনাথিনীর কান্না, মায়ের চোখের জল। অনেকেরই ঘরে ফেরা হয়নি। ছেলের মৃত্যুতে কাকা চাকরি পেলে ঘরে প্রাচুর্য আসে, অভাব দূর হয়। কিন্তু হারান্যার জন্য একবুক অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকে তার বাবা... ‘‘আইজ শুনলি ক্যলেন আইসছে / সেই হারান্যা নদীটাই ঘুইরে আইসছে বাবু / লদীর সঙ্গে হামার বড় ছেল্যা ট নাই আইসবেক বাবু?’’

কবি অমিয়কুমার সেনগুপ্ত শুধু কবি নন, পুরুলিয়ার লৌকিক সংস্কৃতির প্রাণপুরুষও। এই জেলার কাব্য আন্দোলনে একটি উজ্জ্বল নাম। পাষাণময় যে দেশ, মানভূমের বিংশ শতাব্দীর কবিতার পাশাপাশি তিনি পুরুলিয়ার আঞ্চলিক কবিতার সংকলনও করেছেন। নতুন এক সুর সংযোজন করেছেন আঞ্চলিক কবিতায়... ‘‘এই দুনিয়া হামদের লয়, উরাই থাকুক সুকে/ কষ্ট লিয়ে চোলে যাবঅ রোইবে দাগা বুকে / অ বাবু লাও পেনাম হামার ... লখনা টুডু বলে / জীবন যাছ্যে পারল্যে বাচাও অ্যাতটুকু মাড়জলে।’’ বা ‘‘হা ভাল দিন ডুব্যে গ্যালঅ কাছাই গ্যালঅ রাত/ রাতকানা এই বুড়ার ইবার ধর নুনা ডাইনহাত।’’



কবি গোপাল কুম্ভকার সার্বিক অর্থেই একজন সাবঅল্টার্ন মানুষ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কবিতায় উঠে আসে ‘দুখবুড়া আঠুড়্যা মানুষের পেটে গামছা বাইন্ধে’ দিন গুজরানোর কাহিনী... ‘‘হামরা ত শিকড় ছিঁড়া হে / হামরা চইখ থাইক্ত্যে কানা / হামদের কি রকত আছে? তেজ আছে? পুইড়্যে পুইড়্যে ন জুমড়া কাঠ হয়্যে গেলি।’’



তারাশঙ্কর দরিপার ‘কপাট খুলঅ’ কাব্যগ্রন্থে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে স্থানীয় মানুষের কথা। কানাইলাল খাঁর ‘পরিযায়ী পাখিদের কথা’ (২০০৪) কাব্যগ্রন্থেও কয়েকটি আঞ্চলিক কবিতা রয়েছে। শঙ্কর চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপাতা’ (১৯৯৮), পার্থসারথী মহাপাত্রের ‘বড় মুকরুর ছা’ (১৯৯৮) সেভাবে রেখাপাত না করলেও আঞ্চলিক কবিতার ধারাটিকে পুষ্ট করেছে। জলধর কর্মকারের ‘হামরা মানভুঞা’ বটি বা মুজিবর আনসারীর ‘টাঁড় টিকর’ (২০০০) বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। কবি অসিতকুমার মাজির অতি সফল ও জনপ্রিয় আঞ্চলিক কবিতার বই ‘পরব টাড়ের পাঁচালী’। কবি সনাতন মাজির ‘মানভুম কেইসন সুন্দর’। হরেন্দ্রনাথ ওঝার ‘রুখা মাটি কাব্য’-এর কবিতা আজও ভাবিয়ে তোলে। ‘অড়’ পত্রিকার সম্পাদক রমানাথ দাসের ‘ঢেউ’ এবং ‘আয় পুরুল্যা যায় পুরুল্যা’ উল্লেখযোগ্য মানভূমী বইগুলির মধ্যে অন্যতম।



মানভূমী কবিতার বিকাশ ও সৃজনে যেসব পত্রিকা সংগ্রামী ভূমিকা নিয়েছিল, তাদের মধ্যে ছত্রাক, রাঢ়ভূম, অনৃজু, সাহিত্য মন্দির এবং অড় পত্রিকার নাম উল্লেখযোগ্য। কবি ও লোক সংস্কৃতি গবেষক ডঃ সুভাষ রায় চেলিয়ামায় মানভূম লোকসংস্কৃতি পরিষদ গঠন করে জেলার আঞ্চলিক সাহিত্যকে উৎসাহিত করে চলেছেন। এই পরিষদ প্রতি বছর জেলার শিল্পীদের পুরস্কৃত সম্বর্ধিত করে।



উপরে উল্লিখিত কবিরা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে যাঁরা এই ধরনের কবিতা লিখেছেন বা লিখে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে মহাবীর নন্দী, হাজারী প্রসাদ রাজোয়াড়, কানাইলাল দরিপা, অনিল পাত্র, সিরাজুল হক, দুঃখহরণ মুখোপাধ্যায়, নির্মল আচার্য, তারাশঙ্কর দরিপা, চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত, সৃষ্টিধর মাহাত, সুনীল মাহাত, ব্রজদুলাল চক্রবর্তী, শীলা সরকার, ছত্রমোহন মাহাত, ঝগড়ু মাহাত, নিত্যানন্দ মাহাত, সনাতন মাজি, অনিল মাহাত, অমল ত্রিবেদী, উদয়ন হাজরা, শঙ্কর চৌধুরী, প্রিয়ব্রত দাস, অশোক কুমার চৌধুরী, খগেন্দ্রনাথ মাহাত, পাগল বাউরী,কানাইলাল খান, নিত্যানন্দ রায়, বিজয় পণ্ডা, তপন ঘোষ, অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়, চঞ্চল দুবে, ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভরত মাহাত, নির্মল পট্টনায়ক, চারিয়ান মাহাত, বিদ্যুৎ পরামানিক, সিদ্ধিনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ বাউরী, দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার মাজি, পার্থ সারথি মহাপাত্র, সুভাষ রায়, সুনীতি গাতাইত, অপর্ণা দেওঘরিয়া, বিশ্বজিৎ লায়েক, অভিমন্যু মাহাত, জলধর কর্মকার, দীনবন্ধু চট্টরাজ, রমানাথ দাস, মুজিবর আনসারী, তরুণ কুমার সরখেল, রোহিত চন্দ্র মণ্ডল, তরুণ বাউরি, সন্দীপ সরকার অরূপ শান্তিকারী এবং এই নিবন্ধকার থেকে শুরু করে এখন তো প্রায় সবাইই আঞ্চলিক কবিতা লিখছেন। ফলে এই প্রান্তিক উপভাষায় কবিতা লেখার ধারাটিও পরিপুষ্ট হচ্ছে।



১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অখণ্ড মানভূম ভূখণ্ডে যে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, তা বাংলা দেশের ভাষা আন্দোলন বা আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দলনের চেয়ে কোন অংশে কম গরিমাদীপ্ত নয়। ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর দিনটির গুরুত্ব তাই ২১শে ফেব্রুয়ারী বা ১৯শে মে-র মতই সমান তাৎপর্যপূর্ণ। মানুষের অশিক্ষার কারণে এবং প্রচারের অভাবে তা আড়ালেই থেকে গেছে। এই আন্দোলন শুধু ভারতবর্ষের এক ব্যতিক্রমী ঘটনাই নয়, এক রক্তলাঞ্ছিত অধ্যায়ের ঐতিহাসিক দলিলও একে বলা যেতে পারে। মূলত এই ভাষাধিকার অর্জনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পুরুলিয়া জেলার মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞাকঠিন শপথ ও অঙ্গীকার। রুখা শুখা মানুষের টান টান শিরদাঁড়ায় তারই বজ্রনির্ঘোষ। শুধু ভাষার স্বাধিকার অর্জনই নয়, আঞ্চলিক কবিতার বিকাশে এবং তার গৌরবময় প্রসারে যে সমস্ত কবি, সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীগণ এগিয়ে এসেছেন এবং সারা বাংলার দরবারে পুরুলিয়ার এই উপভাষাকে গ্রহণীয় করে তুলেছেন, সাহিত্যের মূলস্রোতে তাঁদেরও অবদান কম নয়। এর ফলে মূল বাংলা ভাষাও সমৃদ্ধ হচ্ছে, গতিশীল হচ্ছে। বাবু বাঙলার কাছে আজ আর আঞ্চলিক উপভাষা উপেক্ষিত নয়। বরং প্রসারিত হচ্ছে সার্বিক বাঙলা ভাষার রূপরেখা। প্রতিদিন নতুন নতুন আকাঁড়া শব্দে ভরে যাচ্ছে বাংলার শব্দকোষ।



ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ



তথ্যসুত্র

১। নির্বাচিত আঞ্চলিক কবিতা (কবিতা পাক্ষিক) – সম্পাদনা – মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়

২। পুরুলিয়ার আঞ্চলিক কবিতা সংকলন (সঞ্চয়ন) – সম্পাদনা - অমিয়কুমার সেনগুপ্ত

৩। নির্বাচিত মানভূমী কবিতা (ক্রিয়েটিভ এ্যসোসিয়েটস) - সম্পাদনা - শ্রমিক সেন



৪। মানভূমের কবিতা সংকলন (অনৃজু) – সম্পাদনা - ডঃ সুভাষ রায়

2 comments:

  1. অনুরুদ্ধ এই নিবন্ধটি তো খনন বর্ষ ২৯ সংকলন ৩৫~ ৩৬ ১ম এবং ২য় সংস্করণে ইতিমধ্যে দুবার প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে সেপ্টেম্বর ২০১৪ এবং অক্টোবর ২০১৫ সালে । তৃতীয় বার রচনাটির প্রকাশের কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না । অন্তত: সম্পাদক মহাশয় সৌজন্যতাবোধে 'খনন থেকে পূন:মুদ্রিত' এটুকু লিখতেই পারতেন । ~ সুকুমার চৌধুরী, সম্পাদক: খনন ২১.০৩.২০১৬

    ReplyDelete
  2. ঋতবাকের ব্লগে সাধারণত পূর্বপ্রকাশিত লেখা নেওয়া হয় না। লেখক-লেখিকাদেরও সেই মর্মেই সূচনা দেওয়া আছে। এই লেখাটি যে খনন পত্রিকায় ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তেমন কোনও তথ্য লেখক ঋতবাককে জানাননি। আমরা ক্ষমাপ্রার্থী, কিন্তু এই বিভ্রান্তির দায় লেখকের, ঋতবাকের নয়।

    ReplyDelete