অণুগল্প : লিপিকা ঘোষ
Posted in অণুগল্প
অণুগল্প
ক্ষেত
লিপিকা ঘোষ
‘‘তুমার বিবি পলাইলছে রহিম মিঞা, সোহরাব চাচার মাইজ্যা পোলা মাহাতাবের সহিত।’’ হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলে আজিজ,পড়শী।
ক্ষেতে নিড়ান দিতে দিতে আগাছা তুলে সাফ করছিল রহিম। মুখ না তুলে আকাশ পানে চায় – ‘‘মাহাতাব! ইবলিশ।’’
‘‘থানা পুলিশ করবা না?’’ জিগায় আজিজ।
‘‘নাহ।’’
‘‘কেমুন কথা বুইলছো ? বিবিডারে নিইয়ে পলাইছে।’’
‘‘আমি বেঁইধে আনার কে?’’
‘‘তুমি যেন কেমনতর মিঞা!’’ আজিজ বিরক্ত হয়ে বলে।
‘‘এই যি বেগুন ক্ষেত দেইখছ, ইয়াতে আমরা বিষ দেই কি না?’’
‘‘দিতে তো হইলবেকই মিঞা,তয় কি ?’’
‘‘বিষ দিইলে পুকা ধইরবে না ডাগর বেগুন গুলান খদ্দের ধুম কইর্যে কিইনবে।’’
‘‘তয়?’’
‘‘তবু কিছু বেগুনে পুকা লাগে। ফোঁপরা হয়। ঐ গুলানে বিষ ঢুকে নাই।’’ হা হা করে হাসে রহিম মিঞা।
‘‘বোঝলাম। বিবিরে বড় ভালোবাসো মিঞা। যা বোঝো তা কর।’’ আজিজ চলে যায়।
খুরপি হাতে নিড়েন দেয় রহিম। ভরন্ত শরীর জরিনার। ওর বিবি। টলটলে মুখ। বড় বড় চোখের ফাঁদ। হাসলে গতর উপচে পদ্মার পানির ঢেউ ওঠে। অমন বিবি কি এই বেগুন ক্ষেতের মালিকের ঘরে টিকে থাকে ? ‘‘উ যি পলাইবে,জানতুক।’’ মনে মনে বলে রহিম।‘‘মাহাতাবডা ধোধ লিল।’’
মাহাতাব ঐ গ্রামের রইসের পোলা।মুর্শিদাবাদের আখেরিগঞ্জের ছাড়-পদ্মার ধারে ছোট গ্রাম মানিকচরা। ইদানীং মার্বেল পাথরের কাজে বিদেশ খাটতে যায় মাহাতাব। গ্রামের অনেকেই যায়। কিন্তু সবার থেকে বেশি টাকা কামিয়ে ফেলেছে ক’দিনেই। মাহাতাবের বহিনের সঙ্গে রহিমের আশনাই হয়েছিল। মাহাতাব সহ্য করতে পারেনি। শহরে রইস ঘরে জোর করে বিয়ে দেয় বহিনের। রাতারাতি খবরটুক পায়নি রহিম। বহিন আশনাই করল রহিমের মতো চাষার ব্যাটা চাষার সাথে? রইসের ঘরে বহিনের বিয়ে দিয়েও জ্বালা ভোলেনি মাহাতাব। নিজের বিবি পোলা ফেলে জরিনাকে নিয়ে পালিয়েছে।‘‘উ তো পলাতুকই’’ – আবার বিড়বিড় করে রহিম।
বেলা পড়ে আসছে। নিড়েন শেষ করে ঘরে ফেরে রহিম। গাঁয়ের মানুষের ভিড়,জমায়েত রহিমের বাড়ির সম্মুখে। রহিমকে আসতে দেখে মাহাতাবের বাপ সোহরাব চাচা এগিয়ে আসে।‘‘বৃদ্ধ হইলছে বুড়াডা। কি তেজ ছিল,বাপরে।’’ মনে ভাবে রহিম।
‘‘রহিম,বাপ আমার, থানা পুলিশ কইরিস না পোলা। তু আবার বিহা কর। আমি ভাল মেইয়্যে দেইখ্যে দিব।’’ কাতরে বলে সোহরাব।
‘‘তুমি ছাড়ান দিবা সোহরাব মিঞা? যদি তুমার ডাগর ছোট বিটিকে নিইয়ে পলাই? তুমার বিটি এখুনো ভুলে নাই আমাকে।’’
‘‘মুখে সামাল দে রহিম’’, গর্জে ওঠে বৃদ্ধ সোহরাব।‘‘আমার বিটি তর মাগের মতো ছিনাল না।’’
হা হা করে হাসে রহিম।‘‘ঘর যাও সব। আমি হাত মুখ ধুই। থানা পুলিশ কইর্যে কি হইলবে? পুকায় কাটা বেগুন,বিষ ঢুকে নাই।’’
লোকজনের জমায়েত ধীরে ধীরে ভেঙে যায়। সকলে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটে।
‘‘মাথা ডা এক্কেবারে গেইলছে তুমার। হালার মাহাতাবইয়া কে এইবার জেলে ঢুকাইতা।’’ গজগজ করতে করতে চলে যায় আজিজ।
সন্ধে নেমে আসে গাঁ জুড়ে,রহিমের দাওয়া জুড়ে। শূন্য ঘর। এক চিলতে বেগুন ক্ষেতের চাষা ও।‘‘জরিনার মতুন বিবি টিইকব্যে কিসের জইন্যে?’’ভাবে বসে।‘‘কাল সকালে উঠ্যে ক্ষেতে বিষ দিইতে হইলবে। হালার পুকা গুলোন যেন ক্ষেত উজাড় না কইর্যে। নধর বেগুন গুলোন কিইনবে সব খদ্দের হুমড়ি খেইয়্যে। পুকায় কাটা বেগুন কেনে কয়জনা? কেনে দু-এক জনা। উয়ারা জানে পোকায় কাটা বেগুনে বিষ ঢুকে নাই...’’
0 comments: