2

প্রবন্ধ : সুতপা পাত্র

Posted in


প্রবন্ধ


নারী দিবস, ধর্ষণ ও আমাদের সমাজ
সুতপা পাত্র



সদ্য সদ্য মহা আড়ম্বরে উদযাপিত হল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ফেসবুকে অসংখ্য স্টেটাস পড়ল, কোথাও স্কুলে কেক কাটা হল, কোথাওবা পদযাত্রা আয়োজিত হল আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কর্তৃক, কোথাও আবার ভাবগম্ভীর সভা আয়োজিত হল গুরুগম্ভীর বক্তৃতার মাধ্যমে। কিন্তু আসল ব্যাপারটি হল কই? অর্থাৎ যে মানসিক জাগরণ দরকার তার উত্তরণ না হলে এসব সভা-সমিতি, আয়োজন-প্রয়োজন সবই বৃথা। এখনও আমরা মেয়েরা পিরিয়ডের প্যাড কিনে আনি কাগজে মুড়ে, অসাবধানে জামার পেছনে দাগ লেগে গেলে সঙ্কুচিত হই। কিন্তু আজকের দিনে এই সংকোচটুকু আমাদের উচিত নির্দ্বিধায় বর্জন করা। নারী মুক্তি, নারী-স্বাধীনতার কথা বাতুলতা বই কিছু নয়, বিশেষত সেই দেশে, যে দেশের জনগণের স্বাধীন মত প্রকাশের মর্যাদা দেওয়া হয় না। মর্যাদা দেবার প্রশ্ন এই অর্থে এল যে মতামত আমরা দিই ঠিকই, কিন্তু তার মর্যাদা কতটুকু দেওয়া হয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর আড়ালে? প্রশ্নটা থেকেই যায়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই আমরা গণতন্ত্রের কাষ্ঠপুতুল। অবশ্যই আমি এক্ষেত্রে সাধারন মানুষের কথা বলছি, ক্ষমতার শীর্ষে যাঁরা আছেন, তাঁদের না হয় বাদই দিলাম। নারী কী করে স্বাধীন হবে যেখানে গণতন্ত্র থেকে শুরু করে প্রশাসনতন্ত্র অবধি প্রতিটি স্তর পাঁকে পরিপূর্ণ?

ওই যখন থেকে নারী-পুরুষ সৃষ্টি হল তখন থেকেই তো ভগবান মেরে রেখেছেন নারীকে। শারীরিক‘ডিসঅ্যাডভান্টেজ’ই তো তার ওপর পুরুষের আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করেছে; তাকে বারবার ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। শুধু ধর্ষণ নয়, কামনা চরিতার্থ হলে নৃশংস ভাবে মেরে ফেলাও হয় নারীরূপিনী দুর্বল শিকারকে। এরকম নারকীয় ঘটনার জাজ্বল্যমান প্রমাণ তো আছেই; সাম্প্রতিক কালের দিল্লীতে জ্যোতি সিংয়ের মৃত্যু বা পশ্চিমবঙ্গের কামদুনি হত্যা কান্ড। আমি আপাতত আমার এই লেখায় মেয়েদের ওপর ধর্ষণ কী হারে বেড়ে গেছে, ধর্ষকদের মেন্টালিটি কী, ধর্ষণের কী শাস্তি হওয়া উচিত, এসব বিষয়ে যাচ্ছিনা। আমি এটা বলতে চাইছি যে শারীরিক ভাবে না হলেও মানসিকভাবে আমরা প্রতিনিয়ত ‘ধর্ষিত’ হচ্ছি। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পারা, ক্ষমতা যখন প্রশাসন ও গণতন্ত্রের রূপকে মুখে কুলুপ আঁটতে বাধ্য করে, তখন কী একটা গোটা সমাজ ধর্ষিত হয় না ? এ প্রসঙ্গে আক্কাই পদমশালীর উক্তিটি মনে পড়ে গেল, “That’s patriarchy. It doesn’t attack women alone, it attacks anyone and anything that is feminine. Even other men.”

একটা ছোট্ট ঘটনা বলি: রবিবার সন্ধে ৭টা, ধোবিঘাট ব্যারাকপুর। ব্যারাকপুরের এই ঘাট অনেক পুরনো। সম্প্রতি আগে যেখানে পাড় ছিল তার নীচের দিকে বেশ কিছুটা কর্দমাক্ত জমি শুকিয়ে ডাঙায় পরিণত হয়েছে। বর্ষাকাল নয়, তাই কাদার ভয় নেই; তার উপর নরম সবুজ ঘাসের আস্তরণ পড়ে বেশ মনোরম বসার জায়গা হয়েছে, তবে জায়গাটা বেশ উঁচু-নীচু। রবিবার, ছুটির দিন বলে লোকসমাগম কিছু বেশি ছিল, জোড়ায় জোড়ায় অনেক ছেলেমেয়ে ছিল, কেউ ঘাসের উপর বসে গল্প করছিল, কেউ বা হাত ধরে হাঁটছিল। ওই নীচু জায়গাটায় যে আলো থাকে না, একটু অন্ধকার। তবে গঙ্গার মনোরম শান্ত বাতাসে বসে থাকতে বেশ আরাম লাগে। ওখানে যে শুধু কাপলরাই বসে ছিল তা নয়, ছেলে পুলেরাও ছিল, ফ্যামিলিও ছিল একটা-দুটো। কিন্তু কোথাও যে কোনো বিশৃঙ্খলতা ছিল বা অশ্লীলতা ছিল, তাও নয়। যদি মুক্ত প্রাঙ্গণে নদীর ধারে পাশাপাশি ছেলে-মেয়ে বসে থাকা বা চুমু খাওয়া আদৌ অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়ে! অন্তত আমার চোখে তো নয়ই। হঠাৎ দেখি তিন চার জন মহিলা পুলিশ সিভিল ড্রেসে এসে ওই কাপলদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হয় মেয়েগুলি পুলিশের অস্থায়ী কর্মী,যাদের বয়স ২৫-২৬ বছরের মত, আজ্ঞা পালন করছে মাত্র। ওদের সাথে ছিল হেড কনস্টেবল এক মহিলা। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, ওদের সবাইকে ব্যারাকপুর উইমেন পুলিশ অফিসে যেতে হবে গাড়ি করে। সমস্বরে সবাই প্রতিবাদ করে বলে ওঠে তারা কী অপরাধ করেছে যে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কিন্তু পুলিশের বক্তব্য এখানে নাকি প্রায়ই রেড হয়, সন্ধ্যের পর আজেবাজে লোকজন আসে, মদ খায়। ভালোমন্দ একটা কিছু ঘটে গেলে কী হবে? সেদিন যাদের ধরা হয়েছিল তাদের মুখ যেটুকু দেখতে পেয়েছিলাম, তাতে এটুকু বুঝেছিলাম যে তারা প্রত্যেকে শিক্ষিত উচ্চ মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে মেয়ে,এমনকি কেউ কেউ যে খুব ভালো চাকরি করে সেটা তাদের আত্মপ্রত্যয় দেখেই বোঝা যায়। প্রতিবাদের একটা কন্ঠ শোনা যাচ্ছিল- ‘‘সন্ধ্যের পর আজেবাজে লোকজন আসে, তো তাদের ধরে না নিয়ে গিয়ে আমাদের কেন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? তাছাড়া এ জায়গাটা তো কোন পার্ক নয়, সন্ধ্যে অবধি থাকা যাবে না এমন কোন বিধিনিষেধও নেই….তাহলে?’’

…নাহ্ এই তাহলের কোনও পরিষ্কার উত্তর পাওয়া গেল না। এতে নেতৃস্থানীয়া মহিলা হেড কনস্টেবল বলেন- ‘‘এসব আমাকে বলে লাভ হবে না। আমার ওপর অর্ডার আছে, তোমাদের নিয়ে না গেলে আমার চাকরি যাবে।’’ কেই বা আর পুলিশের গাড়িতে উঠতে চায় বলুন? তাই প্রতিবাদের কন্ঠ ‘‘এবারের মত ছেড়ে দিন’’ বলে করুণ কন্ঠে উপনীত হলে; সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয় তোমাদের নাম-ধাম সই করেই ছেড়ে দেওয়া হবে। তবুও কে আর গাড়ি করে পুলিশ স্টেশন যেতে চায়! তাই সবাই নারাজ হলে আইনের রক্ষকেরা স্বমূর্তি ধারন করে। পুলিশ ফোর্সের ভয় দেখান হয়। ইতিমধ্যে দুজন পুলিশ বাইকে করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়; গাড়ির চালক অসভ্যের মত বলতে থাকে, ‘‘ওঠ, ওঠ শালা! গাড়িতে ওঠ।’’তার এমনি ব্যবহার দেখে মনে হয় এরা যেন কত বড় বড় সব খুন-ডাকাতি করেছে। সত্যি! খুন-ডাকাতি করলে তাও মানা যেত, এ তো তার থেকেও বড় অপরাধ কিনা, যুগ্মভাবে গঙ্গার ঘাটে একটু নিরিবিলিতে বিচরণ করা! ঘাটের পেছন দিকের যে পথ দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে রাস্তার দু-দিকে বাঁধানো বেদীতে আমরা যারা বসেছিলাম সবাই দেখেছিলাম, কিন্তু কেউ কোনও প্রতিবাদ করিনি। আর করবেই বা কে? কথায় বলে না বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা! পরে একটি বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানতে পারি তাদের প্রত্যেকের নামে একটি করে পেটি কেস দেওয়া হয় এবং তাদের নিয়ে আসা হয় ব্যারাকপুর উইমেন পুলিশ অফিসে; সেখানের অফিসার-ইন-চা্র্জ সব নিয়ম-কনুন বলে জামিনের জন্য উকিলের ব্যবস্হা করে দেয় এবং প্রত্যেক কাপল ১০০০ টাকা করে দিয়ে ছাড়া পায়।

গোটা এই ঘটনাটা থেকে কী প্রমাণিত হয়? প্রশাসন দুষ্কৃতীদের না ধরে নিরপরাধ ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের অপরাধ কী না, তারা অন্ধকারে যুগ্মভাবে গঙ্গার ঘাটে বসেছিল! সত্যি যাতে কোনও অপরাধ না ঘটে তার জন্য দায়িত্ব তো প্রশাসনের নেওয়া উচিত। উল্টে ব-কলমে যেন দুষ্কৃতীদের এটাই বলা হচ্ছে যাদের জন্য তোমাদের কাজের অসুবিধে হয় দেখো তাদের তুলে নিয়ে গেলাম, তোমরা মনের খুশিতে অন্ধকারে মদ খাও, যা খুশি কর! তাহলে যা দেখা যাচ্ছে আজ একটা মেয়ে তার বয়-ফ্রেন্ডের সাথেই হোক বা একলাই হোক, সূর্যাস্তের পর শান্ত নিরালা জায়গায় দাঁড়িয়ে আকাশের তারা, নদীতীরের শীতল হাওয়া, কিছুই উপভোগ করতে পারবে না; এতে তাকে হয় দুষ্কৃতীরা ছিঁড়ে খাবে না হয় পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যাবে।

এই পা আমার, শরীর আমার, তবু শুধুমাত্র নারী হওয়ার অপরাধে যথা ইচ্ছে তথা যাবার কোনও স্বাধীনতা নেই! কোনও নিরালা জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সঙ্গে দু-দণ্ড আলাপ করতে পারবো না। এটা আমার নিজের চোখে দেখা একটা ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনা কী প্রমাণ করে না নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক্ষেত্রে ধর্ষিত হল ক্ষমতার হাতে? ধর্ষণ তো কেবল দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার নয়, ক্ষমতার প্রদর্শন, আস্ফালনও বটে। প্রশাসন যখন কামুক পুরুষের মত নিজেদের অর্থকামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে অবিবাহিত প্রেমিক-প্রেমিকাদের যুগ্মভাবে অবস্থান করার অপরাধে আইনের অপপ্রয়োগ ঘটায়, তাতে ব্যক্তিবিশেষের যত না অপমান হয় তার থেকে বেশি অপমান হয় গোটা একটা সমাজের; প্রশাসনের ক্লীবত্ব ফুটে ওঠে মাত্র।

2 comments:

  1. সুখপাঠ্য এই প্রতিবেদনে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন তুলেছেন লেখিকা। যদিও এর উপশম কিভাবে হবে, জানা নেই। কবে ঘটবে দৃষ্টিভঙ্গির বদল, কে জানে?

    ReplyDelete
  2. কী বলুন তো? আমরে পুরো ব্যাপারটা মুখ বুজে হজম করি..যেসব ছেলে-মেয়েরা এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়, তারা বাড়ির কথা ভেবে প্রতিবাদ করতেই পারে না..কারণ, আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের বাবা-মা' রা তাদের ছেলে-মেয়েদের সমর্থন করার বদলে উল্টে তাদেরই বকা-ঝাকা দেবে, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখাবে কী করে এই চিন্তা করে, আর, এই ছিদ্রের জোরেই আইনের তথাকথিত রক্ষকেরা এই জুলুম করতে পারে...তাই, আমাদের উচিত কোনটা ন্যায় , কোনটা অন্যায় তার উপযুক্ত বিচার করে পাশে দাঁড়ানো....

    ReplyDelete