0

বিশেষ রচনা : পলাশ কুমার পাল

Posted in


বিশেষ রচনা


আমি নারী
পলাশ কুমার পাল




আমি নারী। এই জন্যই হয়তো আমার বিশেষত্ব। সাম্যতা আনার চেষ্টায় পুরুষ দিবসের না-অস্তিত্ত্বে নারীদিবস পালিত হয়। উৎসব! অনুষ্ঠানমুখর পরিবেশে কথার বেলুন সেজে ওঠে... বাতাসের অস্তিত্ত্ব ফুরালে সে বেলুন আর বেলুন নয়।

আসলে দোকানে দেখানদারি পুতুলের মতো এই 'নারী' শব্দের চমকে প্রত্যেকে স্বচ্ছ হয়ে উঠতে চায়। সেখানে নারী নিজেও বাদ যায় না। যেমন ধরুন আমি। নিজের জন্মের মুখরতা কতটা বর্ণময় বা বনেদী ছিল জানি না। তবে জন্মের পরবর্তী ক্ষেত্রে বড়ো হয়ে ওঠার মাপনীতে বয়সের বৃদ্ধির পাশাপাশি কিছু দাগ ক্রমশ সহযাত্রী হয়ে ওঠে আমার নির্বাক শিরদাঁড়ায়, যে দাগই নির্দেশ করে 'আমি নারী ওরা পুরুষ'।

আমি বিবাহের মঞ্চে চন্দনে-ফুলে সেজে বসে পড়ি সাতপাকের গভীর জলে... সুবাসিত রজনীগন্ধা ও অলংকারের মুখোশী আলাপে স্বপ্নগুলো যেন প্রজাপতি হয়ে ওঠে; যার কোনও শিরদাঁড়া নেই, নেই শিকড়! কেবল এক ফুল থেকে অন্য ফুলে উড়ে বেড়াবার বৈশিষ্ট্যগুণে নিজেদের মানিয়ে নিই। দেশ শিক্ষিত হয় বর্ণমালায়, যুক্তিতে শাণ লাগে, বিবাহিত জীবনে শৈশবের অঙ্কিত পদবী কুষ্ঠিকে জীবন কুষ্ঠি রূপে সচল রাখি; আর বলি, "এই দেখো, আমরা নারী নিজেদের পরিচিতিকে নিজের মতো করেই রেখেছি। আমরা এখন স্বাধীন পাখি!"

কিন্তু সাতপাকের পরের সময়ে? পুরুষদের শিকড় আর আমাদের না-শিকড় দুই উদ্ভিদের পার্থক্যকে বাড়িয়ে দেয়। না-শিকড় মানে জড় বলছি না! শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত বেড়ে ওঠা বাগানের পরিবেশকে বিদায় জানিয়ে পাকাপাকিভাবে অন্য বাগানে বাসা বোনার মধ্যে যতটা তোমরা নতুন স্বপ্নের কথা বলো, তার থেকে বেশি ব্যর্থতা আমি বা আমাদের নারীদের দুর্বল করে। করণ শৈশব থেকে যে পরিবেশে নিজের শিকড় তৈরি হয়, তা সাতপাকের চক্রাবর্তে বিনষ্ট হয়ে যায়। নতুন সংসার, নতুন দেয়াল, নতুন মানুষজনের পরিবেশে শৈশবের মতো নতুনভাবে নিজেকে আবারও শিকড় তৈরি করতে হয়। ব্যতিক্রম হয়তো কিছুজন থাকে। তবে সময়-কাল-সভ্যতার অভিনবত্বের মাঝে নিজেরা যখন স্বাধীনতার রঙীন বেলুন ওড়াই আধুনিকতার আকাশে, ঠিক তখনই অ-বিবর্তিত এই লাটাই আর সুতো বলে দেয় ভূমির অস্তিত্ত্বের কথা।

সভ্যতা সৃষ্টির আদিমতা যে ভূমিতে জন্ম, সে বিবাহ। বিবর্তিত সভ্যতার মাঝে নারী-পুরুষের এই মিলন মানবসভ্যতার মূল বীজ। কিন্তু দুই পরিবেশের দুই মানুষের মিলিত সভ্যতা কোন পরিবেশে লালিত হবে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হয়তো আদিকালে নিজেদের জন্মভূমিকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু শিক্ষিত আত্ম জাগরিত নারীরা? এই প্রশ্ন খুব একটা শুনিনা। আমরা নারীরা বা আমি নানা নারীবাদী প্রশ্নের বুদবুদে ফেণিত হলেও শ্যাম্পেন হয়ে রয়ে যাই বোতলে বা সভ্যতার ঠোঁট বেয়ে সভ্যতার মজ্জায়...

অনেকটা টবের গাছের মতন। আলোর সন্ধান চাই! চাই মাটিও! অথচ সজ্জিত থাকি বাড়ির ছাদে বা বারান্দায় বা উঠানে বেড়ে ওঠা পুরুষের আলংকারিক হয়ে। গাছ হয়ে না-ওঠার ব্যর্থতায় শুধু নীল আকাশ দেখা, নিজেদের জন্মভূমির আটচালাকে বিদায় জানিয়ে নতুন মাটির সন্ধানে শিকড়ের 'বিবাহ উপকথা'। নারীবাদের স্রোতে ভাসতে ভাসতে এক সমুদ্র নারী ঢেউয়ের নোনতায় সভ্যতার সমুদ্র সৈকতে ভেঙে পড়া...

আমি সেই সমুদ্র বা সামুদ্রিক ঢেউয়ের নারীদের অস্তিত্ত্ব! তোমরা পর্যটনের সুখ উপভোগ করো, শরীরে মাখো ঢেউ... স্ফূর্তিতে! আমি নারী বা আমরা নারীরা টবের সীমাবদ্ধতায় অট্টালিকার ব্যর্থতা! নারীদিবস আসে-যায় অতিথির মতো সাদা ধবধবে লালপাড় শাড়িতে। আসলে ধবধবে শুভ্রতার নারীবাদে লালপাড় হল এই ব্যর্থতার রক্তলেখা।

0 comments: