12

প্রাচীন কথা : অমিতাভ প্রামাণিক

Posted in


প্রাচীন কথা


সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে
অমিতাভ প্রামাণিক



এক


খাচ্ছিলো তাঁতী তাঁত বুনে।

তাই তো খায়, এতে আর নতুনত্ব কী আছে? আর এ তাঁতী তেমন অবিমৃশ্যকারীও নয় যে এঁড়ে গরু কিনতে যাবে। সুতরাং সে পথে তার কাল হয়নি। এর বাড়িতে ব্যাঙের বাসাও নেই। নিজের যে ছা, সে কোলা ব্যাঙের ছায়ের মত খায় দায় গান গায় তাইরে নাইরে না করে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় না।

একটা ছা নাকি? গোটা পাঁচেক। কিন্তু বাকিদের কথা থাক। সবচেয়ে বড়ো যে, যার নাম বিল, তার কথাই বলি।

নর্দাম্পটনশায়ারে শ’ আটেক মাত্র জনবসতির এক অজ গ্রামে বাড়ি। বাচ্চা বিল ইস্কুলে যায়, পড়াশুনা করে। আর পাঁচটা বাচ্চা যেমন, বিলের শেখার ইচ্ছে তাদের থেকে বেশি বই কম না। গাছপালার বিষয়ে জানতে সে উৎসুক, ভাষাশিক্ষায় চৌকস। নিজে নিজেই চেষ্টা করে ল্যাটিনের পাঠ শিখে নেয় সে। বইতে কলম্বাসের ভ্রমণকাহিনি পড়েছে, বন্ধুদের বলে সে কলম্বাসের মত দেশ বিদেশ ঘুরতে চায়, বন্ধুরা তাকে বিল্লু কলম্বাস বলে খ্যাপায়। কাকা পিটার কানাডায় যোদ্ধা, সে বিলকে শুনিয়েছে জাহাজ আর সমুদ্রের গল্প। বিলের মন সর্বদা নতুন জগৎ দেখার আশায় বুঁদ হয়ে থাকে।

বাবা এডমন্ড পেশায় তাঁতী, কিন্তু তাঁত বুনে সংসার চলে না বলে তার পাশাপাশি গ্রামের চার্চে প্যারিশ ক্লার্কগিরি করেন, যাজকদের ইউনিফর্ম কেচে দেন, আর সেখানকার স্কুলে সবচেয়ে নীচু ক্লাসে শিক্ষকতাও করেন। বিলের বয়স যখন মাত্র সাত বছর, তার সারা শরীরে এক বিচিত্র অ্যালার্জি দেখা দিলো। রোদে গেলেই চামড়ায় চাকা চাকা দাগ, চুলকে ঘা। মোটে রোদ সহ্য করতে পারে না তার চামড়া, ফলে বাড়ির বাইরে কাজকর্ম করা তার পক্ষে মুশকিল হয়ে উঠলো। বয়স চোদ্দ পুরতেই তাই তাকে ধরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো পাশের গ্রাম প্যাডিংটনের এক মুচি ক্লার্ক নিকোলাসের কাছে। ক্লার্কও এডমন্ডের মতই জুতো সেলাইয়ের অবসরে চার্চেও কাজ করে। তার দোকানে ছিল একটা ওল্ড টেস্টামেন্টের কপি, তার কিছু অংশ আবার গ্রীক ভাষায় লেখা। ক্লার্কের কাছে চামড়ার কাজ শেখার মধ্যেই গ্রামের এক প্রতিবেশী কলেজ পড়ুয়া ছেলের কাছে গ্রীক গ্রামার বই চেয়ে নিয়ে নিজে নিজেই গ্রীক ভাষা শিখে নিলো বিল।

ক্লার্ক নিকোলাসের চামড়ার দোকানে আর এক শিক্ষানবিশ ছিল, তার নাম জন, সে আবার প্রতিবাদী ধরণের। এরা যে চার্চে যেত, চার্চ অফ ইংল্যান্ড, সে তার মতে বিশ্বাসী নয়। বিলকে ফুসলে জন নিয়ে গেল পাশের গ্রাম হ্যাকলটনে, সেখানে আরো কিছু সমমনস্কদের সহায়তায় খুলে বসলো এক কংগ্রিগেশনাল চার্চ।

বিলের বয়স যখন আঠারো, ক্লার্ক নিকোলাস মারা যায়। বিল গেলো তার পাশের গ্রাম হ্যাকলটনের মুচি টমাস ওল্ডের কাছে কাজ শিখতে। দু বছর যেতে না যেতেই বিল টমাসের শালী ডরোথিকে বিয়ে করে ফেললো, তখনো তার বয়স কুড়িও পোরেনি।

ডরোথির ডাক নাম ডলি, সে বয়সে বিলের চেয়ে ছ’ বছরের বড়, তার ওপর নিরক্ষর। কিন্তু বিল অতশত গ্রাহ্য করলো না। বিয়ের রেজিস্টারে ডরোথি সই করলো মস্ত একটা ক্রস মেরে, নামটা ঠিকঠাক সই করতেও শেখেনি সে। বছর ঘুরতেই তার পেটে বাচ্চা, জন্ম হলো মেয়ে অ্যানের। একে তো আয় নেই তেমন, তার ওপরে আবার এই সংসারের চাপ, অথৈ জলে পড়ে গেল বিল।

অ্যান অবশ্য বেশিদিন জ্বালায়নি বিলদের। এক বছর পূর্তির আগেই তার কী এক জ্বর হলো, তাতেই মারা গেলো সে। সেই জ্বর হলো বিলেরও, সেও প্রায় মারাই পড়ছিল, কিন্তু কোনোমতে সেরে উঠলো আরও ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে। তার মাথার সব চুল পড়ে গেল, সে আর গজালো না কোনোদিন। বিলের এই দুর্দিনে তার মা গ্রাম থেকে এলেন ছেলেকে দেখতে। ছেলের আর্থিক অবস্থা যা দেখলেন, তা তিনিও সহ্য করতে পারলেন না।

টমাস ওল্ড মারা যেতে তার জুতোর দোকান বিলের হয়ে গেলো বটে, কিন্তু ওল্ডের বিধবা বৌ আর বাচ্চাদের দেখাশুনার ভারও বিলকেই নিতে হলো। বিল তখন সবে বাইশ বছরের। ব্যবসাপত্র তার দ্বারা মোটেই হয় না। লোকজন ধারে মাল নিয়ে টাকা দেয়না, বিল তাগাদা দিয়ে আদায় করতে পারে না।

উপায় না পেয়ে সন্ধ্যেবেলা একটা স্কুল খুলে ফেললো সে। কিন্তু ছাত্র হিসাবে সে যতটা মনোযোগী, শিক্ষক হিসাবে ততটাই ব্যর্থ। সংসারের খরচ বেড়েই চললো, পাওনাদারদের উৎপাত শুরু হলো, বিল কিছুতেই দারিদ্র্য থেকে বেরোতে পারে না। পড়াশুনা অবশ্য চলতেই থাকলো ইংরাজী, ল্যাটিন, গ্রীক ভাষায়। ধর্মগ্রন্থ পড়ে, ঈশ্বরের মহিমা কত অপার তা অনুধাবন করে, তার ওপর যে কেন তাঁর করুণা বর্ষিত হয় না, তা অবশ্য বুঝতে পারে না।

ছোটবেলায় পড়া ছিল কলম্বাসের কথা। এখন সে পড়লো অ্যান্টার্কটিকায় ক্যাপ্টেন কুকের অভিযানের কাহিনি। তারও মনে জেগে উঠলো দূরদেশে ভ্রমণের ইচ্ছা।

বছর দুই পরে বিল মল্টন নামে এক ছোট্ট গ্রামের নগণ্য এক ব্যাপ্টিস্ট চার্চে যাজকগিরির কাজ পেলো। ততদিনে ক্লার্কের বিধবা আর তার ছেলেপুলে তার ঘাড় থেকে নেমে গেছে, কিন্তু নিজের সংসারের দায়িত্ব গেছে অনেক বেড়ে। ডলি এক এক করে তিন বাচ্চার জন্ম দিয়েছে – ফেলিক্স, উইলিয়াম আর পিটারের। তার দুর্দশা আর ঘুচছেই না। মল্টনেও সে ছাত্র পড়িয়ে সংসারে উপার্জন বাড়ানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। তার ছাত্ররা তাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় পড়তে চলে যায়, ফলে তাকে আবার মুচিগিরি ধরতে হলো। বিল ভাবলো, সে প্রভু যিশুর বাণী প্রচার করবে, কিন্তু তার সহযোগীরা বলে, ধুর, তোমার দ্বারা হবে না। চার্চে জন সাটক্লিফ, জন রায়ল্যান্ড আর অ্যান্ড্রু ফুলার নামে তিনজন যজমানি করে, তারা বিলকে ভালবাসে, কিন্তু জনগণ বিলকে চায় না।

বিল পড়াশুনা নিয়ে থাকে। যে জুতোর দোকানে সে মুচিগিরি করে, সেখানে সে চামড়া কেটে কেটে পৃথিবীর ম্যাপ বানিয়ে দেওয়ালে ঝুলিয়ে কোন জায়গায় কত লোক, তাদের কী ধর্ম, কী করে তারা যাবতীয় তথ্য লিখে রাখলো। দোকানের মালিক বোঝে বিল জ্ঞানী লোক, পার্ট টাইম কাজ করলেও সে পুরো পয়সা দিয়ে দেয়, কিন্তু তাতেও বিলের চলে না তেমন। ল্যাটিন গ্রীকের পাশাপাশি সে ততদিনে হিব্রু, ফ্রেঞ্চ আর ড্যানিশ ভাষাও শিখে ফেলেছে।

বিল খবরাখবর পড়ে আর ভাবে সাধারণ মানুষের যে এত দুঃখ দুর্দশা, তা কেবল প্রভু যিশুর মাহাত্ম্য না অনুধাবন করার জন্যেই। যত বেশি বইটই পড়ে, ততই তার এই ধারণা দৃঢ় হয়। সে এর ওপরে বইও লিখে ফেললো আর অন্যান্য যাজকদের তার মতে উৎসাহিত করতে লাগলো। একত্রিশ বছর বয়সে জনা বারো যাজক মিলে একটা সোসাইটিও বানিয়ে ফেললো সে।

বিলের যখন জন্ম হয়, তার মাত্র চার বছর আগে তার স্বদেশী রবার্ট ক্লাইভ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে ভারতে বাণিজ্য করতে এসে সেখানে এক শক্তিশালী নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার বিশাল সেনাবাহিনীকে কৌশলে যুদ্ধে পরাস্ত করে এক ব্যাপক এলাকায় শুধু বাণিজ্য নয়, প্রভুত্ব করার অধিকার পেয়ে গেছে। তার বছর সাতেক পরে বক্সারের যুদ্ধে জিতে তারা সমগ্র বাংলায় আধিপত্য কায়েম করে ফেলেছে। ক্লাইভের পরে ওয়ারেন হেস্টিংস ও তারও পরে কর্ণওয়ালিস বাংলা শাসন করছে। যুদ্ধ চলছে দক্ষিণে টিপু সুলতানের সঙ্গে, পশ্চিমে মারাঠাদের সঙ্গে। এই যুদ্ধে জয় হলে পুরো ভারতবর্ষই চলে আসবে ইংরেজদের অধীনে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে কাজ করতে প্রচুর ইংরেজ ভারতে আসে, কিছুদিন থাকে, লুঠতরাজ ফুর্তি করে আর জাহাজ ভর্তি লুঠের মাল নিয়ে ফিরে যায় দেশে। জন টমাস নামে এক সার্জন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে কাজে এসে কিছুদিন থেকে গেছে বাংলায় আর সেখানকার চার্চে কিছু কাজ করে গেছে। জন দেখে গেছে বাংলার অবস্থা, সে আবার ফিরে গিয়ে সেখানে ধর্মের কাজ করতে চায়, যদি সঙ্গে একজন সহযোগী পাওয়া যায়, আর তাদের খরচ যদি সোসাইটি বহন করতে রাজি হয়।

করছিলো জুতো সেলাই, হঠাৎ চণ্ডীপাঠেও উৎসাহী হয়ে পড়লো বিল। সোসাইটির এক মিটিঙে জন টমাসের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতেই বিল বলে উঠলো, সে জনের সঙ্গে ভারতে যেতে ইচ্ছুক।

কিন্তু বিলের চার্চ বিলকে ছাড়তে রাজি নয়। বিলের বাবা তো শুনেই বললেন, বিল কি পাগল হয়ে গেল? পাঁচ মাসের অন্তঃস্বত্তা ডলি তো একেবারেই গররাজি। সে পরিষ্কার বলে দিলো, আমি এর মধ্যেই নেই। সোসাইটি বললো, আমরা তোমাদের যাওয়ার ব্যাপারে রাজি, কিন্তু পয়সা চেয়ে লজ্জা দিও না, আমাদের কাছে নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চুক্তিতেও ধর্মপ্রচারকদের বাংলায় নিয়ে গিয়ে হাজির করা বে-আইনী।

তবু তাদের যাওয়া কেউ আটকাতে পারলো না।

ঝামেলা অবশ্য কম হয়নি। ডলি রাজি না হওয়ায় বিল একটু ঝুলোঝুলি করে শেষে বললো, ঠিক আছে, তাহলে আমি ফেলিক্সকে নিয়ে যাই, তুমি থাকো অন্য বাচ্চাদের নিয়ে। অন্তঃস্বত্তা বৌ আর দুটো বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে বড় ছেলেকে নিয়ে জাহাজে উঠলো বিল জন আর ওর বৌ-বাচ্চার সঙ্গে। কিন্তু জাহাজ ভোঁ বাজতেই খবর পাওয়া গেল জন পাওনাদারদের টাকা শোধ না করে পালাচ্ছে, তাই ওদের দুই ফ্যামিলিকে নামিয়ে দিয়ে জাহাজ চলে গেল।

আর কোনো জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই ওদের যাওয়া পেছিয়ে গেল। এই অবসরে ডলি বাচ্চার জন্ম দিয়েছে ভালভাবেই। বিল তাকে বললো, দেখো ডলি, জনের বৌও তো যেতে চাইছিল না, বরের কথা ভেবেই যাচ্ছে। তুমিও প্লিজ চলো। জন বিলের বাড়ি এসে ডলিকে ভয় দেখালো, ভেবে দেখো, আমরা চলে গেলে তোমার কী করে চলবে। গিয়েই তো আর আমরা টাকা পাঠাতে পারবো না, কাজ জুটলে তবেই না। তোমাদের যদি আর কোনোদিন দেখা না হয় –

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডলি রাজি হয় বিলের সঙ্গে যেতে। তবে তার আগে শর্ত দেয় যে তার বোন কিটিকে সঙ্গে নিতে হবে, সে নবজাত বাচ্চার দেখভাল করবে।

পাঁচ মাস ড্যানিশ জাহাজে ভেসে সমুদ্রঝড় সহ্য করে বত্রিশ বছর বয়সে এক নভেম্বরের শীতের সন্ধ্যায় কলকাতা এসে হাজির হলো জন আর বিল। সঙ্গে ছেলেপুলে কোলে ডলি, ডলির বোন কিটি, জনের বৌ আর মেয়ে। ওরা ভাবতেই পারেনি কলকাতায় থাকতে কেমন খরচাপাতি হবে। সঙ্গে যা টাকাপয়সা এনেছিলো, দ্রুত ফুরিয়ে যেতে লাগলো। কলকাতার কাছে কিছুদিন থেকে টাকার অভাবে তাদের চলে যেতে হলো এক জলা বাদাবনে। সেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, চোর-ছ্যাঁচড়ের উৎপাত। স্থানীয় এক মহাজনের এক পরিত্যক্ত বাড়িতে স্থান হলো, সেখানে ভাড়ার ব্যাপার নেই। টমাসের এসব পোষালো না, সে বিলকে টা টা করে কেটে পড়লো নিজের ধান্দায় ফের সার্জনগিরি করতে।

ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া জোটেনা, বাড়িটাও পোড়ো আর ড্যাম্প ধরা, বিল ডলি আর ওদের বড়ছেলে ফেলিক্সের আমাশা ধরে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ফেলিক্স তো মরেই যাচ্ছিলো। ডলির বোন কিটির অবস্থাও তথৈবচ। বিল কাজ খুঁজতে লাগলো, কিন্তু এই বিদেশ বিভুঁইতে ম্লেচ্ছ বিদেশীকে কাজ দেবে কে? বিল জনকে খবর পাঠালো, চল্লিশ মাইল পূবদিকে গেলে একটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার জায়গায় থাকা যায়, তুমি আমার ভাগের টাকাটা পাঠাও। জন উত্তর দিলো, সে টাকা কি আর আছে? সার্জারির যন্ত্র কিনতে খরচ হয়ে গেছে।

চোখে অন্ধকার দেখলো বিল। ডলি নিত্য গঞ্জনা দেয়, এ তুমি কোথায় এনে ফেললে!

উপায়হীন বিল স্থানীয় লোকের কাছে সাহায্য নিয়ে বাংলা শিখতে লাগলো। এখানে লোক অধিকাংশই অশিক্ষিত, এদের কাছে ধর্মকথা প্রচার করতে গেলে স্থানীয় ভাষাতেই করতে হবে, সেটা শেখা দরকার। একজন পণ্ডিতকে সামান্য পয়সা দিয়ে নিযুক্ত করলো ভাষাশিক্ষার জন্যে। কিছুদিন যেতেই লোকজন জোগাড় করে শুরু করে দিলো বাইবেলের বাংলা অনুবাদ।

কিছুদিন বাদে টমাসের দয়ায় কিছু টাকা ধার পেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লো সংসার উঠিয়ে বৌ, শালী, তিনটে বাচ্চা আর একটা সদ্যোজাত শিশু নিয়ে। নদীর ধার দিয়ে বনের পথ দিয়ে চললো তাদের যাত্রা। নদীর ধারে রোদ পোহায় কুমির, বনের পথে বিষধর সাপ আর মানুষখেকো বাঘের আনাগোনা, রাত্রে কোথায় থাকবে তার ঠিক নেই – চলছে বিলের অন্বেষণ। শেষমেষ একটা পছন্দের জায়গা মিললো তো তাও স্থায়ী হলো না। জন টমাসের এক বন্ধু জন বিলকে এক গ্রামে নীল বানানোর কারখানায় ম্যানেজারের চাকরির খবর দিয়েছে। বিল ঠিক করলো সেখানেই আস্তানা গাড়বে। চাকরি পেলে তার থাকাটা অন্তত আইনানুগ হয়।

সেই গ্রামে পৌছাবার সঙ্গে সঙ্গেই ডলি রক্ত-আমাশায় আক্রান্ত হলো, বিলের হলো ম্যালেরিয়া। দিনরাত বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে সে। ওদিকে ডলির বোন কিটিকে পটিয়ে নিয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক ছোকরা সেনা, তার সঙ্গে সে ভেগে গেছে। পাঁচ বছরের ছেলে পিটার কয়েক দিনের মধ্যে পেটের রোগ সহ্য করতে না পেরে মারা গেলো। তার মৃতদেহ কবরস্থ করার লোকও পাওয়া গেল না, কেননা বিদেশীর মড়া ছুঁলে ভারতীয় ডোমেরও জাত যাবে।

ইংল্যান্ডের অজ পাড়াগাঁ থেকে বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ে এসে তারা যা দেখেছে, তাতে মাথা ঠিক রাখা কঠিন। এখানে রাস্তার ধারে মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকে, রাস্তার কুকুরে খায়, কেউ গ্রাহ্য করে না। ভায়ে ভায়ে খুনোখুনি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বিচারে কারো হয়ত প্রাণদণ্ড হয়েছে, খোলা মাঠে প্রকাশ্যে তার ফাঁসি হয়, সেই ফাঁসি দেখতে অনেকে আসে। ফাঁসির পরে মৃতদেহ সেই ফাঁসের দড়ি থেকে ঝুলে থাকে দিনের পর দিন, পচে দুর্গন্ধ বের হয় তা থেকে, সরিয়ে নেওয়ার কেউ নেই। কয়েকদিনের জন্যে তারা মালদা বেড়াতে গেছিলো। সেখানে প্রচুর আমগাছ। একটা আমগাছের ডালে একটা ঝুড়ি বাঁধা দেখে ডলি জানতে চেয়েছিলো, ওখানে অত উঁচুতে ঝুড়ি কেন। তাতে সে যা জানলো, তা শিউরে ওঠার মত ঘটনা। গত বছর আমের ফলন ভালো না হওয়ায় বাগানের মালিক নিজের সদ্যোজাত শিশুকে ঝুড়িতে বেঁধে গাছে টাঙিয়ে দিয়েছে। সেখানে সে রোদে পুড়ে, জল ও খাদ্যাভাবে মারা গেছে, তার মৃতদেহ পিঁপড়ে খাচ্ছে, মাথার ছোট্ট খুলি বেরিয়ে আছে ঝুড়ি থেকে। এ নাকি ভগবানকে খুশি করার জন্যে, যাতে আমের ফলন ভাল হয়। ভয়ে বিতৃষ্ণায় আঁতকে উঠেছিলো ডলি, এ রকম কিছু তার নিজের দেশে ভাবাই যায় না।

বিল অবশ্য এ দেশে এসে এর চেয়েও ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখেছে। জীবন্ত সদ্য-বিধবাকে প্রচুর পরিমাণে ভাঙ খাইয়ে ঢাকের বাজনার তালে তালে এক সময় চিতায় তুলে দেওয়া হয়। স্থানীয় লোকেরা বলে – সতী। অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে গঙ্গার ধারে ফেলে রেখে আত্মীয়রা বাড়ি চলে গেছে, তার সেই নিঃসঙ্গ মৃত্যু কী করুণ! শেয়াল-শকুন অপেক্ষায় থাকে কখন ছিঁড়ে খাবে তাকে। কুষ্ঠরোগীকে জলে ডুবিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে জোর করে মেরে ফেলা হয়, নিজের ছেলে-মেয়েকে বাবা-মারাই মেরে ফেলে। ডরোথিকে সে জানায় নি এই ব্যাপার। জানলে সে তো তুলকালাম করবে। 

নিজের দেশে প্রথম সন্তান অ্যানকে হারিয়েছে ডলি। প্রবাসে ছেলে পিটারের এই অসহায় মৃত্যু। ভয়ঙ্কর দারিদ্র্য, অপরিচিত পরিবেশ, নিত্য অসুখ-বিসুখে বিধ্বস্ত, সহায়-সম্বলহীনা, লেখাপড়া না-জানা গ্রাম্য বিদেশিনী ডলি এরপর একেবারে পাগল হয়ে গেলো। তার চিকিৎসা করার মত সঙ্গতি বিলের ছিলো না। সে তখন ভাষা শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। একে একে ভারতীয় ভাষা শিখছে সে – বাংলা, সংস্কৃত, মারাঠি, ওড়িয়া, হিন্দী, অসমিয়া। ডলি চুপচাপ থাকে, এমনি দেখলে কিছু বোঝা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ রেগে গিয়ে চ্যাঁচাতে থাকে, লোকজনের মধ্যেই বিলকে গালাগালি দেয় বেশ্যাসক্ত বলে, ছুরি হাতে তেড়ে আসে।বিলের চুলের মুঠি ধরে বলে, এখুনি তোর গলা কেটে দু-ফাঁক করে দেবো। তার ধারণা বিল অন্য মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে, বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে শোয়, পতিতাপল্লী যায়। কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে যখন চ্যাঁচাতে থাকে, তখন তাকে ঠেকানো যায় না। জনের বৌ একদিন ওকে শান্ত করতে এসেছিল, তাকে উদ্দেশ্য করেই প্রকাশ্যে চেঁচিয়ে উঠলো, বিলের সঙ্গে লটঘট করতে তোর লজ্জা করে না! এর পর বিলের কাছে আসলে তোর মাথাও ফাটিয়ে দেবো হারামজাদি।

বাচ্চা তিনটেকে দেখার কেউ নেই, তারা বাপ-মা মরা অনাথের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ডলির মাথা খারাপের লক্ষণ খুব বেড়ে গেলে তাকে বাড়িতে একটা ঘরের মধ্যে তালাবন্ধ রেখে বিল অন্য ঘরে বসে একমনে নিজের বাংলা ব্যাকরণ শিক্ষা চালিয়ে যায় আর নীলের কারখানায় শ’খানেক কর্মীর কাজের দেখভাল করে।

এরমধ্যে জন টমাস আবার তাকে ছেড়ে চলে গেছে, এবার রামের ব্যবসা করতে। জনের পাওনাদাররাও এসে বিলকে ছেঁকে ধরে। মানসিকভাবে অসুস্থ ডলি জনাথন নামে আর এক পুত্রের জন্ম দিয়েছে ততদিনে। চারখানা বাচ্চা মুরগীর মতো এখানে ওখানে চরে, তাদের পোশাকের ছিরি নেই, কার সঙ্গে কেমনভাবে কথা বলতে হয় কিচ্ছু জানে না, পড়াশুনা তো দূরের কথা। এই অবস্থায় নীল কারখানার মালিক কারখানা বন্ধ করে দিলো। বিল সেই নীলকুঠির বাস উঠিয়ে চললো আবার ভাগ্যান্বেষণে, এবার খিদিরপুরে।

আরও ন’বছর ধরে নিজে প্রবল মানসিক অশান্তি ভোগ করে ও বিলের ওপর প্রবল মানসিক অত্যাচার চালিয়ে একান্ন বছর বয়সে ডরোথি এক পক্ষকাল জ্বরে ভুগে একদিন চিরশান্তির দেশে চলে গেলো।ততদিনে তাকে কবরস্থ করার মত স্বদেশী সঙ্গীসাথী জুটেছে বিলের। পাঠিয়েছে দেশের সোসাইটি।

দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইতে কখনো তেমন ক্লান্ত হয়নি বিল, কিন্তু এতদিনের বিবাহিত জীবনে, বিশেষ করে বাংলায় আসার পর চোদ্দ বছর ডরোথি ছিলো যেন এক মূর্তিমতী অভিশাপ। তবুও এতদিনের সাথীকে হারিয়ে একটুর জন্যে মুহ্যমান হয়ে পড়লো বিল। কবরখানার রেজিস্টারে নিজের নাম সই করতে গিয়ে তার ওপর ঝরে পড়লো দুফোঁটা চোখের জল। হাতের তালু দিয়ে মুছে তার ওপর পুরো নাম সই করলো সে – উইলিয়াম কেরি। 

(ক্রমশ)

12 comments:

  1. অসাধারণ উপস্থাপনা... উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করবো পরবর্তী সংখ্যার জন্য।

    ReplyDelete
  2. ভাল লেগেছে। উইলিয়াম কেরির জীবনের অনেক অজানা তথ্যের উন্মোচন এর অপেক্ষায় রইলাম।সবচেয়ে ভাল লাগল আপনার লেখনশৈৈলী।

    ReplyDelete
  3. ভালো লাগলো। বাকি পড়্রবার অপেক্ষায় রইলেম।

    ReplyDelete
  4. ভালো লাগলো। বাকি পড়্রবার অপেক্ষায় রইলেম।

    ReplyDelete
  5. অসাধারণ! পরের কিস্তির অপেক্ষা করছি।

    ReplyDelete
  6. চমৎকার রচনা।

    ReplyDelete
  7. खूब भालो दादा।

    ReplyDelete
  8. খুব ভালো লাগলো! কেরি সাহেবের গল্প আরো শোনার আশায় থাকলাম!

    ReplyDelete
  9. অমিতাভদা....পুরো পেডেস্টাল ফ্যান হয় গেলাম তো!!

    ReplyDelete
  10. Last line ta tee mind blown... Osadharon

    ReplyDelete
  11. সেই চৌরঙ্গী উপন্যাসে পড়েছিলাম রবি আর জেন এডামসের করুণ জীবনগাথা আর তারপরে এই উইলিয়াম কেরি। দেখা যাচ্ছে ভাগ্য সহায় না হলে বিদেশী ইংরেজরা শুধু কষ্ট দেয় নি, একসময় অনেক কষ্ট করেছেও এদেশে এসে। এতদিনে অমিতাভের প্রতিভারও যথাযোগ্য প্রস্ফুরণ হচ্ছে।

    ReplyDelete