0

ধারাবাহিক : নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জল রেখা ৫
নন্দিনী সেনগুপ্ত



--‘দুখিনী নারীর নয়নের নীর— সুখীজনে যেন দেখিতে না পায়’... এষা রান্নাঘরে গুণগুণ করে গাইছিলেন। নীরদা এসে জড়িয়ে ধরে পিছন থেকে দুহাতে। ‘ঠাম্মা , তোমার কিসের দুঃখ?’... বলে ওঠে সে।

--‘দূর বোকা, দুঃখ কিসের? আমার কোনও দুঃখ নেই। আমি ত বসন্তের গান গাইছি।’ 

--‘এটা আমাকে শিখিয়ে দিও প্লিজ।’ 

--‘বিকেলে বসিস একটু হারমোনিয়াম নিয়ে। আলসেমি করিস না যেন। এত মিষ্টি গলা তোর। ঈশ্বর দিয়েছেন। সবাইকে কি সব দেন? তোকে দিয়েছেন। মূল্যবান উপহার, নষ্ট করিস না।’ একটু ভারি গলায় বলেন এষা।

---‘আচ্ছা ঠাম্মা...’ কি যেন বলতে গিয়ে চুপ করে যায় নীরদা। 

---‘কি বলবি বল... এখনও একগাদা কাজ বাকি রে। তাড়াতাড়ি বল’... একটু তাড়া দেন এষা।

---‘থাক, পরে বলব, বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে বলব। এখন আসি। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস আসবে।’

---‘হ্যাঁ, সেই ভাল। এই নে... টিফিনবাক্স নিতে ভুলে যাস না যেন’... বলতে বলতে এষা একদম নীরদার পিঠের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন টিফিনবাক্স। 

---‘আসি-ই-ইই’... বলতে বলতে দৌড় লাগায় নীরদা। নীরদার চলে যাওয়া মূর্তির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ উদাস হয়ে পড়েন এষা। মনে পড়ে যায় নিজের শৈশব, কিশোরীবেলার দিনগুলি। শহরে আজন্ম থাকলেও সেভাবে একটানা ইস্কুলে পড়বার ভাগ্য হয়নি তাঁর। রক্ষণশীল পরিবারে যা হয়। মনে আছে, একেবারে ক্লাস সিক্সে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পাড়ায় লী মেমোরিয়াল স্কুলে। তার আগে বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের কাছে দাদাদের সঙ্গে একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন। পড়াশোনায় ভালোই ছিলেন এষা। প্রিয় বিষয় ছিল ইতিহাস। ম্যাট্রিকের পর পড়বার ইচ্ছে ছিল আরও। ভর্তিও হয়েছিলেন কলেজে। কিন্তু কপালের লিখন কি খণ্ডানো যায়? একমাসের মধ্যে কথাবার্তা পাকা হয়ে বিয়ে হয়ে যায় সুনন্দর সঙ্গে। সুনন্দ তখন কলেজে পড়াতে ঢুকেছেন সবে। কোনও আত্মীয়ের মারফত একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে বাবার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। বাবা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন সেই ঝকঝকে মেধাবী যুবক সুনন্দকিশোরকে দেখে। এষা নিজেও কি একটু একটু হননি? বাবা তো আর জোর করে বিয়ের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি! শুধু বলেছিলেন... ‘শীগগির রিটায়ার করব রে মা। ছেলেটা ভাল, বাড়ির অবস্থাও খারাপ নয়। বাঙাল মানেই কি হাভাতে? এরা অবস্থাপন্ন। তুই সুখে থাকবি!’ একটু একটু অভিমান হয়েছিল এষার বাবার উপর। বাবা এত তাড়াতাড়ি পর করে দিতে চাইছে! সুনন্দ নিজেই এসেছিল এক বন্ধু আর ছোট ভাই রবিকে সঙ্গে নিয়ে পাকা কথা বলতে। দূর থেকে একঝলক দেখে খারাপ লাগেনি এষার।

অভিভাবকহীন সুনন্দ। অনেক কথা উঠেছিল আত্মীয়মহলে এ নিয়ে। বাবা সব সংশয় উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘আমি সব খোঁজ নিয়েছি। হুগলীতে ওর দাদামশায়ের বাড়ির একটা অংশ ওর মায়ের নামে। কলকাতায় বাড়ি আছে। হোকনা ছোট বাড়ি, কিন্তু নিজেদের মাথা গোঁজার জায়গা। ওর বাবা বছরদুয়েক আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করতে, সেখানে দাঙ্গায় খুন হয়ে যান। এই খবর কলকাতার কাগজেও বেরিয়েছিল, কারণ ওর বাবা ছিলেন ঢাকা শহরের সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। এই ঘটনার পর থেকে ওর মা পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। অতএব ছেলেটির উপরেই এখন সংসারের সব ভার।’

বিয়ের দিন ভালই জাঁকজমক হয়েছিল, যেহেতু এষা একমাত্র মেয়ে। কিন্তু বউভাত একেবারেই অনাড়ম্বর। এত বছর সুনন্দর সঙ্গে থাকার পর বুঝতে পেরেছেন এষা, সাদামাটা অনুষ্ঠান যে অর্থাভাব বা লোকবলের অভাবের কারণে হয়েছিল, ঠিক তা নয়। সুনন্দ এরকমই। চিরকাল একইরকম সাদামাটা জীবনযাপন করতে ভালবাসেন। জীবনধারণের জন্য যেটুকু না হলেই নয়, শুধু সেটুকু পেয়ে যে মানুষ অসীম আনন্দে থাকতে পারে, সুনন্দকে না দেখলে হয়তো এর আগে এষা ভাবতেও পারতেন না। মাঝে মধ্যে ক্ষোভের মুখে বলেওছেন সে কথা সুনন্দকে। যে মানুষের হিমালয়ে বসে তপস্যা করলে ভালো মানাত, সেই মানুষ সংসার করলে যা যা সমস্যা হয়, সে সমস্ত আঁচ সামলাতে হয়েছিল এষাকে একার হাতে। বিয়ে হয়ে এসে দেখেছিলেন, দোতলায় ছাদের উপর একখানা টিনের চাল দেওয়া চিলেকোঠার ঘর, সেটাই সুনন্দর ঘর। একতলায় দুটি ঘর, একটিতে শাশুড়ি মা, অন্যটিতে দুই দেওর। রান্নাঘর, কলঘর, সবই একতলায়। মেজদেওর কমলের তখনও বিয়ে হয়নি। অসুস্থ শাশুড়ির সেবা, সংসার সামলানো, সবকিছুর ভার নিজের হাতে ধীরে ধীরে তুলে নিয়েছিলেন এষা। 

তবে হ্যাঁ, বউঠানের সেনাপতি ছিল বটে একখানা! ছোটদেওর রবি। রবিকিশোর পায়ে পায়ে ঘুরত; যা কিছু ফরমায়েশ বউঠানের, মুখের থেকে খসতে দেরী আছে, কিন্তু তামিল করতে দেরী নেই তার। ‘ও রবি, সিনেমার টিকিট কেটে দে না ম্যাটিনি শোয়ের’, ‘ও রবি, কচুবাটা হবে, নারকোল নেই তো, একটিবার যা না বাজারে’, ‘ও রবি, একটু দোতলায় তোর দাদাকে চায়ের কাপটা দিয়ে আয় না’... এরকম কত হাজাররকমের ফরমায়েশ। সব রবি হাসিমুখে তামিল করত। পরিবর্তে বায়নাক্কা করত কালেভদ্রে। সে আর কতটুকু? শীতকালের সকালে কড়াইশুঁটির কচুরি খাবার বায়না বা কলেজের প্র্যাকটিকাল কপিতে যে ছবিটা আঁকতে সমস্যা হচ্ছে সেইটা বউঠানকে এঁকে দিতে হবে, এইটুকুই যা। শাশুড়িমা মৃত্যুর আগে হাতে ধরে বলে গিয়েছিলেন রবিকে দেখে রাখার কথা। ছোটছেলে বলে হয়তো বিশেষ একটু স্নেহ ছিল তাঁর। কিন্তু সে কথাও বা এষা রাখতে পারলেন কই? রবি একটু একটু করে বেরিয়ে গেল বউঠানের আঙিনা থেকে দূরে। অনেক দূরে। কলেজে থাকতেই যে রবি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, সে কথা বুঝতে পেরেছিলেন এষা। সুনন্দর কানেও তুলেছিলেন তার আশঙ্কার কথা। কিন্তু ঐ যে, সন্ন্যাসীর মত চিরকালীন নির্লিপ্তি! ব্যস... রবি দূরে চলে গেল। বাড়িতে থাকত কম সময়, শুধু রাত্রে ঘুমাবার সময়। কেমন গুম মেরে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। এষা জানতে চাইলে বলত, ‘বলব বউঠান, সব বলব। তোমাকে বলব না তো, কাকে বলব?’ তারপর একদিন এসে বলল একটা কাজে কলকাতার বাইরে যাবে। অল্প কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। সেই কি শেষ দেখা? 

না... তার পরেও তো এসেছিল রবি। নিরূপের জন্মের পরেও এসেছিল। নিরূপের অন্নপ্রাশনেও রবি ছিল। তারপর আস্তে আস্তে সুতোটা কেটে যায়। মাঝেমধ্যে এক আধটা পোস্টকার্ড আসত, ‘শ্রীচরণেষু বউঠান, আমি ভাল আছি। তোমরা কেমন আছ? আমার জন্য চিন্তা করিও না। দাদারে আমার প্রণাম দিও। বাচ্চারা কেমন আছে? উহাদের কথা খুবই মনে হয়। ইতি- রবি’। ব্যস... একই বয়ান। কখনও ভূপাল, কখনও নাগপুর, কখনও বা নাসিক থেকে। ঐ চিঠির বয়ানের সঙ্গে মাঝে মধ্যে যোগ হত, ‘এখানকার কাজে বিশেষ সাফল্য পাইতেছি’ বা ‘গতকাল সকালে মন্দিরে গিয়াছিলাম। তোমাদিগের সকলের মঙ্গলকামনায় পূজা দিয়াছি।’ ‘কাজ’ মানে যে শ্রমিক আন্দোলন, সেটা এষা জানতেন। কিন্তু তার সঙ্গে মন্দিরে গিয়ে পূজা দেওয়া, এই দুটোকে মেলানো যেত না। হয়তো রবি ঐভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যেত নিজের লোকজনকে মনে রাখার । পূজা দিয়ে, প্রসাদ বিলিয়ে দিত স্থানীয় গরিব মানুষজনের মধ্যে। তারপর... ধীরে ধীরে কমতে লাগল পোস্টকার্ড। বন্ধুবান্ধব যারা ছিল রবির, তাদের মাধ্যমে কিছু কিছু খবর পেতেন। রবি কি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল সবার কাছ থেকে? কিসের অভিমান ছিল ওর? নাকি ওর রক্তে ছিল বাউণ্ডুলেপনা; হয়ত সেই কারণেই শাশুড়িমা একটু দেখে রাখতে বলেছিলেন রবিকে। এষা তখন নিজের সন্তানদের নিয়ে, সংসার সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে একটু একটু করে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। হয়তো দেখে রাখতে পারছিলেন না রবিকে। অনেক ভেবেছেন এ নিয়ে এষা। শেষ খবর যা পেয়েছেন রবির, তাও প্রায় বছর চারেক আগে এক বন্ধুর মারফত। রবি নাকি পুরুলিয়া না বীরভূমে কোন গ্রামের কাছে আদিবাসী বাচ্চাদের নিয়ে একটা অনাথ-আশ্রম না স্কুল এরকম সব কর্মকাণ্ড নিয়ে মেতে আছে। 

রবির কথা ভেবে এষা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সুনন্দ বহুবার বুঝিয়েছেন যেন রবিকে নিয়ে এষা কোনও অপরাধবোধে না ভোগেন, কিন্তু তবুও...। এষা শুধু একটা মানুষের দূরে চলে যাওয়া নয়, একটা সম্পর্কের মৃত্যু ঘটলে কষ্ট পান। হয়তো তাই নীরদাকে আঁকড়ে ধরে শেখাতে চান প্রতিটি সম্পর্কের মানে, সেই সমস্ত গ্রন্থি যা জুড়ে রাখতে পারে সম্পর্ক, আর দিতে পারে অপরিসীম আনন্দ। ছোট ছোট প্রতিদিনের ঘটনার মধ্য দিয়ে এই শিশুটিকে গড়ে তুলতে চান তিনি; পারবেন কি না এই আশঙ্কায় সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকেন, কিন্তু হাল ছেড়ে দেন না কখনও। 



0 comments: