প্রাচীন কথা : কৃষ্ণ দেবরায়
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
বিন্দুতে সিন্ধু-দর্শন (অন্তিম পর্ব )
কৃষ্ণ দেবরায়
প্রত্নতাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টে আর্যদের কোনও উপস্থিতি হরপ্পা সভ্যতায় খুঁজে পাওয়া না গেলেও হাল ছাড়লেন না হিন্দু মৌলবাদীরা। তাঁদেরই অনুগত কিছু প্রত্নতাত্বিক ভারতবর্ষকে আর্যদের আদি বাসভূমি বলে প্রচার করা শুরু করেন। ভারতে আর্যদের আদি বাসস্থান বলে তাঁরা নির্দেশ করেন সরস্বতী অববাহিকা। এস পি গুপ্তর মতানুসারে, ‘‘সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা পূর্ণবিকশিত বৈদিক সভ্যতারই এক গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতিনিধিত্ব করে।’’ তিনি আরো বলেছেন যে হরপ্পা সংস্কৃতি ছিল উভয় নদীরই দান এবং “সম্ভবত শেষোক্ত(সরস্বতী) নদীর দানই বেশি।” তিনি সিন্ধ বনাম সরস্বতী এবং ভারত বনাম পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটি চিন্তা করেছিলেন। তাঁর মতে সরস্বতী এবং তার শাখা নদীগুলির পাড়ে সাতশোরও বেশি হরপ্পা ক্ষেত্র পাওয়া গেছে, আর সিন্ধ নদীর এবং তার শাখানদী গুলির তীরে একশোটি ক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হয়নি। এর থেকেই সরস্বতীর গুরুত্ব বোঝা যায়।
কিন্তু আমরা সিন্ধু এবং সরস্বতীর তুলনার সময় অন্যান্য তুল্য বিষয়গুলি কমিয়ে দেখতে পারিনা। গোড়াতেই বলা দরকার,সরস্বতী নদীকে ঘগ্গর বা হাকরা নদীর সঙ্গে চিহ্নিত করে দেখা হয়েছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানে নদীটিকে ঘগ্গর নামে অভিহিত করা হয় আর সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানে তাকে ডাকা হয় হাকরা নামে। এটা পরিস্কার বোঝা দরকার যে হাকরা-ঘগ্গর হলো সিন্ধুর একটি শাখা নদী। উপরন্তু, হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো এবং ঢোলবিয়া সমেত হরপ্পার প্রধান ক্ষেত্রগুলির একটিও হাকরা বা ঘগ্গর এর তীরে অবস্থিত নয়। কেবলমাত্র কালিবঙ্গান ঘগ্গর এর কাছাকাছি। ঘগ্গর যেখানে গুরুত্বপূর্ণ নদী সেই আম্বালা কিংবা সিরসা জেলায় কোনও হরপ্পা বসতির হদিস পাওয়া যায়নি।
মৌলবাদীরা সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় সিন্ধুর চেয়ে সরস্বতীর দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে চান অতিরিক্ত মাত্রায়। হরপ্পা প্রসঙ্গে তাঁরা মনে করেন যে ভারত বিভাগের পর সিন্ধু মুসলমানদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কেবলমাত্র সরস্বতীই হিন্দুদের সাথে রয়ে গেছে! ঋক্ বেদে সরস্বতীর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে, অনেক সূক্ত রচিত হয়েছে তাকে উপলক্ষ্য করে; সুতরাং তাঁরা তাঁদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যেই এই নদীটিকে ব্যবহার করতে চান। কিন্তু লক্ষণীয় যে সরস্বতী নামে অনেক নদী আছে এবং এদের মধ্যে প্রাচীনতমটিকে হাকরা অথবা ঘগ্গর এর সঙ্গে চিহ্নিত করা যায়না। ঋক্ বেদে সরস্বতীকে বলা হয়েছে নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।এটিএকটি বৃহৎ নদী। বারোমাসই যার জল থাকে, এমন নদী। হাকরা বা ঘগ্গর এর সাথে তার চরিত্র মেলেনা। প্রাচীনতম সরস্বতীকে আফগানিস্তানের হেলমাণ্ড এর সঙ্গে এক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা আবেস্তায় হরখাওয়াতি নামে উল্লিখিত। যাই হোক, ভাষাতাত্ত্বিক এবং স্থান-কালের আগে-পরে বিচারে দৃষ্টিকোণ থেকে ঋকবেদের সঙ্গে আবেস্তার তুলনা করলে কোনও সন্দেহই থাকেনা যে আদি বৈদিক সরস্বতী আর হরখাওয়াতি বা হেলম্যাণ্ড একই নদী। বৈদিক জনগণ যত অগ্রসর হয়েছে তারা এই সরস্বতী নামটি পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, গাড়োয়াল, প্রয়াগ এবং রাজগীর পর্যন্ত নিয়ে গেছে। হিন্দু মৌলবাদীরা যতই চেষ্টা করুক ইতিহাস কে বিকৃত করে নিজেদের কার্য সিদ্ধি করতে, তাদের আগে এইসব প্রমাণগুলিকে খণ্ডন করতে হবে। আর সেগুলি যতদিন না হচ্ছে ততদিন দুটো কথা অবশ্যই আমাদের মেনে নিতে হবে। প্রথমটা হল যে বৈদিক সভ্যতার অনেক আগে থেকেই অবিভক্ত ভারতে এক উন্নত সভ্যতা ছিল এবং দ্বিতীয়ত, হরপ্পা সভ্যতা আর্যদের এদেশে আসার অনেক আগের সভ্যতা। ( শেষ )
0 comments: