0

রম্যরচনা : পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in


রম্যরচনা


ঘুরন্ত মাথা
পিনাকী চক্রবর্তী



সেই আমলে, মানে সত্তরের দশকে, এখনকার মত প্রফেসরের ছড়াছড়ি দেখা যেত না ডিপার্টমেন্টে ডিপার্টমেন্টে। একজন, বা কদাচিৎ দুজন প্রফেসর থাকতেন, বাকিরা রীডার, লেকচারার আর ডেমন্সট্রেটর। সবার থেকে সিনিয়র হবার সুবাদে প্রফেসর হতেন বিভাগীয় প্রধান। আর এই দায়িত্বটুকু তাঁকে তাঁর অবশিষ্ট কর্মজীবন ধরে বহন করতে হত। বয়সের ভারে বা অন্য কোনও কারণে তিনি এই ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে নিতান্ত অপারগ হলে তাঁকে প্রফেসর এমেরিটাস গোছের কিছু একটা পদে ভূষিত করে পরের জনকে হেড বানানো হত। মোটামুটি এই ছাঁদেই চলতো ডিপার্টমেন্টগুলো।

আর এখন? শুনুন তাহলে, এখন কি হয়...! ক’বছর আগে মে মাসে কলকাতায় গিয়েছিলাম ভাইঝির বিয়েতে। বিয়ে থা মিটে যাওয়ার পরেও, কিছু না কিছু টুকটাক কাজের জন্যে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম রোজই। একদিন দুপুরবেলা বালীগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে এমন বিশ্রী রকম ট্র্যাফিক জ্যামে আটকালাম যে, বিরক্ত হয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম বেলতলার দিকে, প্যাচপ্যাচে গরম মাথায় করে নিয়ে। পথে পুরোনো কলেজ, পুরোনো স্কুল। স্মৃতি বিজড়িত এই রাস্তা, এটার নাম বালীগঞ্জ সার্কুলার রোড না হয়ে মেমরি লেন হলেই ঠিক ছিল। খানিকটা সেই স্মৃতিরই ধাক্কায় বেলতলা যাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়ে গোঁত্তা খেয়ে ঢুকে গেলাম সায়েন্স কলেজের ভেতরে।

কলেজের ভেতরে ঢুকতেই একটা বহু পরিচিত স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা ভাব শরীর মন সব জুড়িয়ে দিলো। এক মিনিটেই ফিরে গেলাম সেই গরমের ছুটির দিনগুলোতে, যখন কলেজের থেকে নিখরচায় আরামদায়ক জায়গা গ্রীষ্মের দুপুরে আর কোথাও ছিলো না। ডিপার্টমেন্টের করিডোর দিয়ে হাঁটছি আর এক একটা ঘর বাইরে থেকে দেখে দেখে পুরানো সেই দিনের কথা মনে পড়ছে, মনের ভাবটা এই বৈশাখী দুপুরেও বেশ হৈমন্তী সন্ধ্যার মতো ধোঁয়াশায় মাখোমাখো হয়ে উঠছে, এমন সময়ে অচেনা এক ভদ্রলোক, যাঁকে দেখে মনে হল তিনি গৌরীদার জায়গায় নতুন এসেছেন, মৈথিলী টানের হিন্দিতে পেছন থেকে হাঁক পেড়ে আমাকে একটু দাঁড়াতে বললেন। তারপর কাছে এসে জানালেন যে হেড আমাকে ডাকছেন। কেন হে বাপু, পুরোনো ডিপার্টমেন্টে ঢোকাটা কি বেআইনি, না কি স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে করিডোরে পায়চারি করাটা অন্যায়? অত শত উনি জানেন না, শুধু জানেন যে স্যার আমাকে ডাকছেন...

উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু ইনি জানলেন কি করে যে হেড আমাকেই ডাকছেন? আমি এঁকে চিনিনা, ইনিও নিশ্চয় আমাকে চেনেন না। অন্তত সেই সম্ভাবনা কম। ইনি নবীন, আমি প্রবীণ। ইনি দ্বারভাঙ্গা কিম্বা মধুবনীর বাসিন্দা, আর আমি মুম্বাই নিবাসী গত প্রায় বিশ বছর যাবত। এই শতাব্দীতে এই আমার প্রথম ডিপার্টমেন্টে পা রাখা। বর্তমানে কে হেড আর কেইবা টেল আমার জানা নেই, কারণ আমার সাথে এখন ডিপার্টমেন্টের সম্পর্কটা খুবই অল্প। আর তা ছাড়া বয়েসটা যেমন তাড়াহুড়ো করে ষাটের দিকে দৌড়োচ্ছে, ডিপার্টমেন্টে আমার চেনাশোনা লোকজনের সংখ্যাও তার সাথে তাল রেখে কমে যাচ্ছে, বর্তমানে গোণাগুণতি জনা দুয়েক হবেন হয়তো, মুস্কিলসে। তাই আমার মনে হল এটা এই মৈথিলী ভদ্রলোকের ভ্রান্তিবিলাস। কিন্তু দেখলাম এনার অগাধ আত্মবিশ্বাস। জানালেন স্যার আমাকে দেখেছেন ল্যাব থেকে নিজের ঘরে ফেরার সময় এবং স্বয়ং আমাকে পেছন থেকে দেখিয়ে দিয়ে বলেছেন আমাকে ডেকে নিয়ে আসতে। কি বিপদ রে বাবা...! একটু যে নিজের মনে স্মৃতিচারণার সাথে পদচারণা করব নিরিবিলিতে, তারও উপায় নেই। তার ওপর স্থানমাহাত্মটা একবার দেখুন, হেড ডাকছেন শুনলে এই বয়েসেও কেমন যেন পেটের মধ্যেটা গুড়গুড় করে ওঠে!

তা ডাকছেন যখন, তখন তো যেতেই হবে! গেলাম গুটিগুটি পায়ে সুবোধ বালকটির মত। ভেতরে ঢুকতে যাব, তো সেই ভদ্রলোক হেঁকে বললেন ওটা না, ওটা না, পাশের ঘরটা। বুঝুন কারবারটা! শুধু হেডই না, এই ক’দিনে হেডের ঘরটাও আমার কাছে সমান অচেনা হয়ে উঠেছে। পাশের ঘরটা তো আমাদের সময় অফিসঘর ছিল, যাকে বলে নৃপেনদার চারণভূমি। অবশ্য, ঘরটা অনেকটা বড় ছিল ঠিকই, হেডের ঘরের থেকেও অনেকটা বড়। কিন্তু তাই বলে এতটাই বদলে যাবে সবকিছু সময়ের সাথে? ঠিক আছে, আমীন, সো বি ইট, তবে তাই হোক, গেলাম পাশের ঘরে। দরজায় টুকটুক করতেই ভেতর থেকে সাদর আহ্বান, এসো এসো পিনাকীদা।

কি রে বাবা, এরকমভাবে তো কোনো হেড জীবনে কখনও অভ্যর্থনা করেন নি? ভেতরে ঢুকে দেখি একমুখ হাসি আর এক গাল কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ নিয়ে বসে আছেন এক চেনা চেনা ভদ্রলোক। ভালো করে তাকিয়ে দেখি আরে দূর, ভদ্রলোক হতে যাবে কেন, ওটাতো সুশীতল, উরফ্ সিতু। আমাদের থেকে পাঁচ ছ’বছর জুনিয়ার, কিন্তু বাঁদরামোতে আমাদের জ্যাঠামশাই। হ্যাঁ, একবার শুনেছিলাম বটে সিতুটা ইউনিভারসিটিতে পড়াচ্ছে আজকাল। “আরে সিতু, তুই এখানে কি করছিস? উঠে আয়, উঠে আয়। তোদের হেড আমাকে ডেকেছে, এক্ষুণি এল বলে। ওই চেয়ারে তোকে দেখলে বাবার নাম ভুলিয়ে দেবে।” দেখলাম সিতু এখন অনেকটাই সুশীতল হয়েছে, মোটেই ঘাবড়ালো না। উলটে আমাকেই প্রবোধ দিল – “কিছু বলবে না, পিনাকীদা, তুমি বসো।”

বসলাম বটে, কিন্তু কেমন যেন একটা সন্দেহ হল। বললাম ‘‘হ্যাঁ রে, তুইই কি এখন হেড নাকি?’’ সিতু মিষ্টি করে হাসলো। আমি অবিশ্বাসভরে বললাম, “তোর থেকে ঢের ঢের সিনিয়র লোকের নাম দেখলাম ওদিকের দরজাগুলোতে। তাদেরকে ছাপিয়ে তুই হেড? কেন, তুই কি ভিসির নাতজামাই? তোকে হেড বলে মানে ওরা? চালাস কি করে ডিপার্টমেন্ট?” সিতুটা হেড হোক বা নাই হোক, বেশ জ্ঞানীগুণী হয়ে উঠেছে। চট করে হাসিটা বন্ধ করে কলৌ মলৌ করে কি সব সংস্কৃত শ্লোক আওড়াতে লাগলো। আমি চটে গিয়ে বললাম “তোর লজ্জা করে না, ব্রাহ্মণসন্তানকে ডাকিয়ে আনিয়ে মন্তর পড়ে ঘায়েল করছিস?” সিতু বললো, ‘‘মন্ত্র পড়ে সত্যযুগে ঘায়েল করা যেত, কিন্তু ত্রেতাযুগে তন্ত্রের দরকার হয়ে পড়লো, দ্বাপরে কৌশলো কিরি কাজ হাসিল করা হত আর এখন এই চার পো কলিতে প্রয়োজন হয় টীমওয়ার্কের। এই আপ্তবাক্যটাই বলছিলাম তোমাকে, তা তুমি তো শুনলেই না!’’

আমি বললাম, “হেডেদের বুঝি পাতি বাংলায় কথা বলতে মানা আছে? তুই এখানকার হেড না হয়ে সচ্ছন্দে সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হতে পারতিস। যাই হোক, এখন পরিষ্কার করে খুলে বলতো কেসটা কি?” 

সিতু বললো, ‘‘কেস গুরুচরণ...! আমাদের আজকাল খুব মাথা ঘোরে।’’

“সে কি রে? মাথা ঘোরে মানে? সকলের একসাথে মাথা কি করে ঘুরবে? ইয়ারকি মারছিস আমার সাথে?”

সিতু বললো,‘‘ইয়ারকি না পিনাকীদা, এটা একটা খুব খারাপ ধরণের সংক্রামক রোগ। সকলেরই হয়, এর নাম রোটেশনাল হেড, গোদা বাংলায় ঘুরন্ত মাথা। মানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবারই হেড হবার সুযোগ পাওয়া। যদি তুমি আজ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হয়ে ঢোকো, তবে আট দশ বছরের মধ্যে তুমিও বিভাগীয় প্রধান হতে পারবে, তবে কিনা মাত্র দু’বছরের জন্যে। দুই বছর পরে আবার পুনর্মূষিকোভব। এই গণতান্ত্রিক মাথা ঘোরা রোগটা মহামারীর মত দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।’’

“দুই বছর পরে আবার পুনর্মূষিকোভব, মানে? হেড থেকে একেবারে আবার টেইল? প্রেস্টিজে একেবারে গ্যামাক্সিন, যাকে বলে...! কিন্তু তারপর?” সিতু মাথা নেড়ে সায় দিলো হেড থেকে টেইলের কথাটায়, আর দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে সাধুবাবাদের মত আবার শুরু করলো, “পুনরপি জননম, পুনরপি মরণম, পুনরপি জননী জঠরে শয়নম ...” আচ্ছা, রোটেশনাল হেড সিস্টেমটা চালু হবার পর থেকে কি জিওলজির ক্লাসগুলো সংস্কৃতে নেওয়া হচ্ছে? 

“থাম তুই,” আমি ওকে জোরসে দাবড়ানি দিয়ে থামালাম। “আজ সকালে দাড়ি কামাস নি কেন? ভারিক্কে দেখানোর জন্যে ? তা দাড়িই রাখ আর যাই কর, তোকে তো সবাই হাড়ে হাড়ে চেনে। দু’দিনের হেড হয়ে বসা তোর মত একটা বাচ্চা রীডারের কথা এক একজন প্রবীণ প্রফেসর মানেন?” 

সিতু বললো, ‘‘এতে মানামানির কি আছে? এই ভাবে ভাবো না - আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে!’’

সবাই রাজা হলে তো রাজায় রাজায় যুদ্ধ বেধে যাবে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা কল্পদৃশ্য – সেনেট হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ছাতা দিয়ে একে অপরকে ঠ্যাঙ্গাচ্ছেন আর পোর্টফোলিও ব্যাগগুলো হ্যাভারস্যাকের মত ঝুলিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচাচ্ছেন। সিতুর কথামত ভাবতে গিয়ে আমি শিউরে উঠলাম। ‘‘নাঃ, এর থেকে আমাদের সময় ঢের ঢের ভালো ছিলো, বুঝলি সিতু!’’

সিতু কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললো, ‘‘স্মৃতি বিগতকালের আলোকে সততই সুন্দর লাগে, আবার আগামীকাল জাগায় অনেক অপূরণীয় আশার স্বপ্ন, জ্ঞানীজন তাই শুধুমাত্র আজকের দিনটিকেই অবলোকন করেন।’’

হেড হয়ে সিতুর মাথাটা সত্যি করেই ঘুরে গেছে! ওর কথামতো দু’বছর পরে যদি ওর মাথা ঘোরা সেরেও যায়, ততদিনে ওর ছাত্রদের যে কি গতি হবে এই দুশ্চিন্তা নিয়ে আমি সেদিন কলেজ ছেড়েছিলাম!

0 comments: