0

ছোটগল্প : ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ছোটগল্প


টিকি-টিকটিকি
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


প্রথমজন দ্বিতীয়কে লিখিল — ‘‘টিকিটি কি কাটিয়া ফেলাইয়াছ? বহুদিন তাহার কোনও সন্ধান মিলিতেছে না। যদি কাটিয়া না ফেলাও, তবে শীঘ্র তাহার সন্ধান দিবে। আর যদি টিকিটি কাহারও নিকট বাঁধা রাখিয়াছ,তবে গোল প্রচণ্ড রকমের। ইহজীবনে তাহা ফিরিয়া পাইবার সম্ভাবনা কম জানিবে। এক্ষণে টিকিটির সন্ধান পাইলে বাঁচি...।’’

দ্বিতীয়জন উত্তর করিল— ‘‘টিকিটি সযতনে কাটিয়া সুগন্ধি রুমালে মুড়িয়া চন্দনের কৌটায় ভরিয়া রাখিয়াছি। কখনও যে টিকি ছিল এবং তাহা যে কাহারও নিকট বাঁধা পড়ে নাই ইহাতে পরম সন্তোষে আছি’’...এই পর্য্যন্ত পড়িয়াই অংশু লাফাইয়া উঠিল— ‘‘চমৎকার! একবার পড়ে দ্যাখ বিনু। আহা, কি সুন্দর!’’ সামান্য কিছু হাস্যকর কিংবা আনন্দদায়ক কিছু দেখিলেই সে লাফাইয়া থাকে। বিনু ওরফে বিনোদ তাহার শিশুবয়সের বন্ধু, প্রাথমিক অবস্থা হইতে কালেজ পর্যন্ত একসঙ্গে গিয়াছে।মধ্যে কিছুদিন ছাড়াছাড়ি হইয়াছিল... কিন্তু সে অন্য কথা।

অংশুর হাত হইতে একবার খাতাটির লেখার অংশে চক্ষু বুলাইয়া অংশুকে তাহা পুনরায় ফিরাইয়া দিল বিনোদ। কি এমন হাস্যকর কথা ইহাতে আছে, সে বুঝিল না। মুখ বাঁকাইয়া বলিল— ‘‘তোর সবেতেই বাড়াবাড়ি! আমি তো কিছুই বুঝলাম না।’

অংশু বিস্ময় প্রকাশ করিল— ‘‘বুঝলি না? আরে, একটা মানুষকে বোঝাতে টিকিই যথেষ্ট। যেমন ধর, তোকে বললাম—টিকি দেখা যাচ্ছে না কেন? তার মানে কি বলতো? তোকে দেখতে পাচ্ছিনা কেন, তাই তো? এর জন্য অনেক কিছু বলার দরকার পড়ল না। কম শব্দেই বোঝা গেল!’’

বিনু মুচকি হাসিয়া কহিল— ‘‘তার মানে তুইও টিকি, রমেশ কাকাও টিকি, কাকিমাও টিকি এমন কি সুনুদিও... কি করে বোঝাবি, কে কোন জন?’’ হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল বিনু।

‘‘কেন, তোকে যদি বলি, বড় টিকি এখন বাইরে, তুই বুঝবি না আমি কার কথা বলছি! এ তো সিম্পলি বাবার কথা হচ্ছে...’’অংশু ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল। 

বিনু আবার হাসিয়া বলিয়া উঠিল— ‘‘তুই সবেতেই লাফিয়ে উঠিস। যেখানে বাবা কিংবা মা বললেই চুকে যায়, অত বলবি কেন? আরও কম শব্দেও অনেক সময় বলা যায়।’’

অংশু কিছু যেন পিছু হটিয়া বলিল— ‘‘কিন্তু মজা তো আছে!’’

‘‘সে তো সবেতেই মজা আছে। যেমন ধর টিকটিকি। যদি বলি, টিকটিকি টিক্‌টিক্‌ করছে। এটারও তো একটা মানে হয়, হয় না? কেউ একজন বেশী কথা বলছে, কেউ একজন অনর্থক পিছনে লাগছে...গোয়েন্দাও হতে পারে। টিকটিকি মানে গোয়েন্দা কে না জানে!’’ বিনুর কথা শেষ না হইতেই অংশু বলিয়া উঠিল— ‘‘বাঃ, টিকটিকির কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে ভাল করলি। সেদিন মন্টিদা দিদিকে নিয়ে সিনেমা যাবার কথাটা বলতেই দিদি বলে উঠল, তুমি গিয়ে টিকিটটা কাটো, আমি টিকটিকির লেজটা বেঁধেই রওনা হচ্ছি। দ্যাখ্, এখানে কিন্তু টিকটিকি মানে চুল।’’

বিনু গম্ভীর হইয়া বলিল— ‘‘সে তো মেয়েরা অনেকসময় চুলকে টিকটিকি বলেই থাকে। এই তো, গতকাল ছোড়দি চুল বাঁধতে বসে মা’কে বলল, মা, কিরকম টিকটিকির লেজ হয়ে যাচ্ছে দেখেছ!আসলে, বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ কিছু বোঝাতে আমরা এইরকম কিছু শব্দ ব্যবহার করি, আর কিছুই না। চল ওঠ তো, ক্লাবে যাই।’’

তখনকার মত ব্যাপারটা চাপা রহিল। দুই বন্ধুতে তর্ক ভুলিয়া ক্লাবঘরে গেল। আজ ক্লাবঘরে দারুণ উত্তেজনা ছড়াইয়াছে। অমুক ক্লাবের সহিত খেলা আছে, প্রতিযোগিতামূলক খেলা। প্রাণপণে লড়িতে হইবে, তাহা অপেক্ষাও আরো বেশি চিৎকার করিতে হইবে। এমন চিৎকার যাহাতে বিপক্ষকে কাবু করা যায়।

ক্লাবঘরে একটি অল্পবয়সী খেলোয়াড় বসিয়া আছে। নাম গৌর, বর্ণও গৌর। পুরা নাম বুঝি বা গৌরাঙ্গ সাউ। চুল ছোট করিয়া ছাঁটা, খুব ছোট্ট একটি টিকি রহিয়াছে মাথার পিছনে। হঠাৎ বুঝিতে পারা যায় না, কিন্তু ভাল করিয়া ঠাহর করিলে বোঝা যায়। পূর্বে অংশুর মনে এই সকল চিন্তা মাথায় আসে নাই। কিন্তু আজ সে ভাল করিয়া দেখিল, তাহার পর বিনুকে ডাকিয়া বলিল—‘‘আজ গোল না দিলে গৌরের টিকি কাটা যাবে।’’

বিনু চমকাইয়া‘‘যাঃ’’বলিয়া হাসিয়া ফেলিল।


(২)

সন্ধ্যায় অংশু গৃহে ফিরিতে সিনেমার কমল মিত্রের ন্যায় গম্ভীর স্বরে পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘‘সারাদিন কোথায় টো টো করে ঘুরে বেড়াও, টিকি দেখা যায় না। কি কর কি, সারাদিন?’’ 

অংশু ঘাবড়াইয়া বলিয়া উঠিল— ‘‘না, মানে টিকি তো বাঁধা আছে।’’

পিতা ঠাকুর বিস্মিত হইলেন। পুত্রের দিকে গম্ভীর দৃষ্টিপাত করিয়া ততোধিক গম্ভীর স্বরে বলিলেন— ‘‘বটে! টিকি বাঁধা পর্য্যন্ত পড়েছে। তা কোথায়, শুনি?’’

অংশু আমতা আমতা করিয়া যাহা বলিল, তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিল না। পিতা দরজার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বজ্রস্বরে বলিলেন— ‘‘ডেঁপো ছেলে, পড়তে বসো গে। বাড়ির বাইরে কি করে যাও, আমি দেখছি।’’

এ যাত্রা অংশু বাঁচিল বটে, কিন্তু তাহার টিকিটি বাঁধা কি খোলা তাহা কিছুতেই বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। গল্পটি আর একবার পড়িয়া টিকির মাহাত্ম্য বুঝিবার চেষ্টায় টেবিলে পড়ার বইয়ের সাথে খাতাটি খুলিয়া বসিল। 

তাহার পর কি হইল আমাদিগের আর জানিয়া কাজ নাই। অংশুর টিকিটি সত্যই বাঁধা পড়িয়াছিল, নাকি কোনও টিকটিকি আসিয়া পিতাকে সংবাদ দিবার কালে পিতা ঠাকুর অংশুর টিকি ধরিয়া টেবিল হইতে তুলিয়া দিয়াছিলেন তাহা জানিতে পারি নাই। জানিলেও বলা উচিত নহে। তবে, বিনুর টিকি বহুদিন হইল দেখা যাইতেছে না। তাহা অংশুর পিতাঠাকুরের ভয়ে কিনা বলা যাইতেছে না । 

অংশু তাহার সন্ধানের জন্য সম্প্রতি টিকটিকি লাগাইয়াছে।

0 comments: