0

বিশেষ নিবন্ধ : পল্লববরন পাল

Posted in


বিশেষ নিবন্ধ


আজ বসন্ত
পল্লববরন পাল



‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’

সুভাষদা আমাকে খুব ভালোবাসতেন, আমার কবিতাও। আমাকে নিয়ে ওনার বিখ্যাত অনেক কবিতা আছে, যেমন – ‘কলকাতার বাঁড়ুজ্জে’ – মুশকিল হলো, আমার বিরোধীদের তো একটাই কাজ – মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে পাউডার-টাউডার মেখে বসে শুধু আমার কুৎসা করা, এছাড়া তো অন্য কাজকম্মো নেই, তাই ওরা বলে, ওটা নাকি সুভাষদার নিজের লেখা নয় – অনুবাদ - আসল কবিতাটা নাকি লিখেছিলো একজন তুরস্কের লোক – ইয়ে, কী যেন নাম, কী যেন নাম – জাজিম হিম্মত না নাজিম কী একটা – আমি অনেকবার বলেছি, এই বিরোধী ব্যাটাদের আসল পবলেম হলো, ওদের মাথার মধ্যে একটুও বেন নেই – ওই হিম্মতদা তো নাকি তুরস্কের কবি, তো বলুন তো, একজন তুরস্কের লোক জানবে কী করে যে আমরা বাঙালিরা ব্যানার্জীকে বাঁড়ুজ্জে বলি? হুঁ হুঁ, আসলে আসল হিম্মত একমাত্র আমার আছে, হ্যাঁ, আমারই আছে, তাই আমিই জানি যে হিম্মত কথাটাও আদপে বাংলা – আমাকে সুভাষদা নিজে বলেছিলেন যে, এটা ওনার নিজের লেখা আর আমাকে নিয়েই লেখা, ওসব হিম্মত-টিম্মত সব বুজরুকি – বিরোধীদের চক্কান্ত - আমি বিদেশ থেকে ডিগ্রি পাওয়ার পরে আশিব্বাদস্বরূপ সুভাষদা এটা লিখে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। না না, ১৯৫২ সালে নয়। যাহা বাহান্ন তাহাই বিরানব্বই। যারা বলছে বাহান্ন, দুষ্টুমি করে বলছে।

যাগ্‌গে, এই আমি ঘোষণা করে দিলাম আমার পিয় সুভাষদার কথায় – আজ বসন্ত। ফুল ফুটলো কি ফুটলোনা, সে নিয়ে অযথা মাথা ঘামাবেননা। ব্যাস! আর অন্য কোনো কথা হবেনা, চোখ বন্ধ করে এবারে যান, সবাই ধেই ধেই করে নাচুন, কোমর দুলিয়ে গান করুন, আনন্দ করুন, নিজেরাই ফুল ফোটান - কারণ আজ বসন্ত। বসন্ত মানে শীত শেষ – দুঃখের দিন শেষ - পাতাঝরা শেষ - এবার পোরিবত্তন – নতুন পাতা, নতুন ফুল, নতুন আনন্দ – পোরিবত্তন মানেই আমি – আমি মানেই বসন্ত -বসন্ত মানেই উৎসব। উৎসব মানেই তেলেভাজায় বিশ্বদশ্যোন। বসন্ত মানেই সরস্বতীপুজো – ‘বিশ্বরূপা বিশালাক্ষী’ - ভালোবাসার দিন – ভালোবাসুন - ঘরে ঘরে ঢুকে মানুষকে ভালোবাসুন – বেশি বেশি ভালোবাসুন - দেখবেন, চীৎকার না করে সবাই যেন ওই ‘বিশ্বরূপা বিশালাক্ষী’, মানে বড়ো বড়ো চোখে আপনাদের বিশ্বরূপ দশ্যোন করে, অর্থাৎ আপনাদের ভালোবাসার উৎসব উপভোগ করে – বেশি পোতিরোধ বা ট্যাঁফো করলে বুঝবেন নিশ্চয়ই বিরোধী পার্টি, মানে ভালোবাসার বিরোধী আর কি - তখন ঘাড় মটকে উপভোগে বাধ্য করাবেন, বুঝলেন? বিরোধীদের কোনো চক্কান্ত আমি বরদাস্ত করবো না।বন্ধুরা, আগেও ওদের আমলে বসন্তোৎসব হতো, কিন্তু সেটা হতো রক্ত নিয়ে হোলি খেলা – ওরা রক্ত নিয়ে উৎসব করতো - মানুষের রক্তে। কিন্তু বসন্তোৎসব আসলে ভালোবাসার উৎসব, সুতরাং ভালোবাসতেই হবে সবাইকে – ইট্‌স মাই অর্ডার, লাভ ইজ মাস্ট, নো কম্পোমাইজ - বসন্তোৎসব আবার রঙেরও উৎসব, ‘রঙ যেন মোর কর্মে লাগে’ - কাজেই আপনারা সবাই রঙিন হয়ে রঙবাজী করলে আমি একটুও বকা দেবো না। যান। বেরিয়ে পড়ুন। দুগ্‌গা দুগ্‌গা। 

বসন্তোৎসব মানেই শান্তিনিকেতন। রবিদা আমার কথাতেই তো বোলপুরে এই উৎসব শুরু করেছিলেন –দোলের দিন – উনি তো বাহ্মণঠাকুর নয়, বাহ্ম ঠাকুর ছিলেন – বাহ্ম আর বাহ্মণে তফাৎ আছে, একটা মুর্ধণ্য ‘ণ’য়ের – বাহ্মরা পুজো-টুজোয় বিশ্বাসী ছিলোনা, তাই রবিদাও সরস্বতীপুজো করতেন না, কিন্তু ওই আমার মতো উৎসব খুব ভালোবাসতেন, তাই দোলের দিনটাকেই উনি বেছে নিয়েছিলেন – গান লিখেছিলেন ‘দোলে দোদুল দোলে দুলনা’ – কবিতা লিখেছিলেন ‘দোল দোল দুলুনি রাঙ্গা মাথায় চিরুনি’ – দোল নিয়ে ওনার অনেক লেখা আছে, আমাকে পড়িয়েছিলেন – আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ঐ ‘ঝুলন’ কবিতাটা – ওটা পড়েই তো আমি সেই পোকাশ্যে গলায় কাপড় জড়িয়ে ঝুলনের একটিং করেছিলাম - ‘আমি পরাণের সাথে খেলিবো আজিকে মরণখেলা’ – না না, পরাণবাবুর সাথে আমার কোনো শত্তুতা নেই, মতপার্থক্য থাকতে পারে, উই আর ডেমোক্র্যাটিক কান্টি, আর আই বিলিভ ইন ডেমোক্র্যাসি অনলি – তো, ওই কবিতাটার মধ্যে বারকয়েক আছে – ‘দে দোল দোল, দে দোল দোল’ –ঘুরে ঘুরে আসছে ‘দে দোল দোল, দে দোল দোল’ - ওফ্‌, একদম শ্লোগানের মতো, শিরায় শিরায় যেন কাতুকুতু দেয় – অনেকটা আমার ওই ‘এপাং ওপাং ঝপাং/ পড়ে গিয়ে পটাং/ বাঁচাও বলে ঝপাং/ মুচকি হাসে এপাং’ কবিতাটার মতো – রবিদা আক্ষেপ করে একবার বলেছিলেন – ‘তোমার মতো যদি এরকম স্যাটাস্যট আমিও লিখতে পারতাম…’ বন্ধুরা, উনি এটা কবে বলেছিলেন জানেন? ওই যে, গান্ধীজীকে শরবৎ খাইয়ে অনশন ভাঙিয়ে ফেরার পথে – অতো সাল-তারিখ মনে থাকেনা আমার – মনে রাখিনা।

বাঙালি উৎসব পিয়। আমিই পোথম, যে বাঙালির এই উৎসবপিয়তাকে মর্যাদা দিয়েছি, বাঙলায় সত্যিকার উৎসবের মেজাজ পোতিষ্ঠা করেছি। কী বন্ধু, তাই তো? একটু জোরে ‘হ্যাঁ’ বলুন, সবাই শুনুক।শিল্প না হোক, শিল্প নিয়ে আমি পোত্যেক বছর উৎসব করি। সারদা থেকে টেট, ত্রিফলা থেকে ডেলো -কেলেঙ্কারির উৎসব। কামদুনি থেকে কাটোয়া – ধষ্যণ উৎসব। সিণ্ডিকেট থেকে মাটি, সাইকেল থেকে ক্লাব – সোনার বাংলা জুড়ে এখন শুধুই উৎসব। আমি জানি, সামান্য কিছু ইতিহাস বা পুরাণবাগীশ বিরোধীকণ্ঠ এখনও আমার এই বাঙলায় লুকিয়ে-চুরিয়ে ঘাপটি মেরে আছে, যারা আপনাদের বিভ্ভান্ত করার চেষ্টা করবে, অবশ্য সবাই যে খারাপ তা নয়, বলবে – এই দোল উৎসব নাকি হিন্দুদের অতি প্রাচীন উৎসব – আমার মুসলিম ভাইবোনেদের বঞ্চনা করে মিথ্যে পুরাণের দোহাই দিয়ে সাম্পদায়িক সম্পীতি নষ্ট করার চেষ্টা করবে - রাজা হিরণ্যকশিপু আর তাঁর দুষ্টু বোন হোলিকার দুষ্টুমির গপ্পো শোনাবে – হোলিকাদহন-এর সাতকাহন – বিষ্ণুভক্ত পোহ্লাদকে জব্দ করতে, আগুনে পুড়িয়ে মারতে নিজের পোষাকেই আগুন ধরে গিয়ে পুড়ে ছাই হবে হোলিকা, পরদিন সকালে সবাই যখন দেখবে হোলিকা ইজ অনলি এ বার্ন্ট ডেডবডি – নো হাড় নো মাংস, অনলি ছাই, তখন আনন্দে সবাই হইহই করে সেই ডেডবডির ছাই নিজেরাই নিজেদের মাথায়-মুখে মাখাবে – এই নাকি হোলিখেলার শুরু!যত্তোসব আজগুবি। মুখে ছাই মেখে কোনোদিন উৎসব হয়? গা পিত্তি জ্বলে যায় শুনে। বন্ধুরা, একবার গিয়ে ওই বেনলেস পুরাণবাগীশদের মাথায় আর মুখে আলকাতরা বা ছাই যাহোক একটা লাগিয়ে জিগেস করুন তো - হিরণ্যকশিপু কোথাকার রাজা ছিলেন? – মুলতানের। এবার আমি আপনাদের জিগেস করি, বলুন, মুলতান কোথায়? – পাঞ্জাবে। পাঞ্জাবে কারা থাকে? পাঞ্জাবীরা, যেমন বাঙলায় থাকে বাঙালিরা, বিহারে বিহারিরা। তো বন্ধু, পাঞ্জাবীদের ধর্মগুরু কে? বিষ্ণু নাকি গুরু নানক? একটু জোরে নানকের নামটা বলুন ভাই… পেসের ক্যামেরার মাধ্যমে ওই মিথ্যেবাদীরাও টিভিতে দেখুক, শুনুক -বিরোধীদের এই ধাপ্পাবাজিতে আপনারা যেন কেউ চমকাবেন না। পবলেম হলে সত্যিটা আমার থেকে জেনে নেবেন। না না ভাই, আমি আর সত্যের পোতীক-টোতীক হতে চাইনা, ওসব ব্যাকডেটেড, বরং মানুষ চাইছে সত্য এখন আমাকে পোতীক বানাক – মানুষের ডিম্যাণ্ড – কাজেই আমি মাথা পেতে আপনাদের সম্মান গোহণ করছি।

এই, কী বললি তুই? কী? চন্দগুপ্তর আমলে কালিদাসের লেখায় হোলির কথা আছে? কে কালিদাস? কোন পার্টির লোক? এই এই, যে বললো কথাটা, ওকে ধরো তো, ধরে নিয়ে এসো – ওই কীচন্দ গুপ্ত না কি একটা নাম বললো, পুরো নামটা বলারও সাহস নেই – ব্যাটা ওই গুপ্তরই গুপ্তচর নিশ্চয়ই, ওর পকেট-টকেট তল্লাসি করো, বোম-টোম থাকতে পারে – বন্ধুরা দেখুন, বলতে বলতে একটা পুরাণবাগীশ মিথ্যেবাদীকে ধরে ফেললাম – হুঁহ্‌, আমাকে চমকাতে এসেছে! আমাকে চেনেনা! আমি গোটা আণ্ডারওয়াল্ড কন্টোল করি, তোদের খতম করতে আমার এক মিনিট লাগবে রে শালা! স্যরি। এই, ওকে জেলে পুরে দাও, ওখানে ঘানিউৎসব করুক বাছাধন।

সে যাগ্‌গে-যাগ, বন্ধুরা, শান্ত হোন, বসে পড়ুন, ডিসিপ্লিন মেন্টেন করুন। এখন হোলি নিয়ে একটা গল্প বলবো আপনাদের – ভালোবাসার গল্প। এটা গল্প নাকি সত্যি, সেটা আপনারাই বলবেন – আগে গল্পটা শুনুন। আপনারা পুতনা রাক্ষসীর কথা জানেন - যে নিজের বুকের দুধে বিষ মিশিয়ে খাইয়েছিলো কিষ্ণকে – মারবে বলে, কিন্তু কিষ্ণ কি তাতে মরেছে? না বন্ধু, মরেনি – ওসব পাতি বিষ-টিষে কিষ্ণ কেন, আমাদের কেষ্টরও কিস্যু হয়না - তো সেই বিষ খেয়ে বাচ্চা কিষ্ণর গায়ের রঙ হয়ে গেলো কালো।সেই কারণেই কিষ্ণর আর এক নাম কালা। আমিও ছোটোবেলা খুব ফর্সা ছিলাম জানেন? আমাদের কেষ্টর মতো – ও অবশ্য ফর্সাই, তবে ওই যা এতো বিষ খায় যে ওর মাথায় একটু অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে গেছে আর কি। আমার বিরোধীরা আমাকে এতোবার এতো প্যাঁদান পেঁদিয়েছে, স্যরি, মানে পিটিয়ে পিটিয়ে সারা গায়ে কালসিটে ফেলে দিয়েছিলো, সেই থেকে আমারও গায়ের রঙ কালো। কিন্তু বন্ধুরা,পুতনার পার্টি যেমন পারেনি কিষ্ণকে মেরে ফেলতে, তেমনি আমার বিরোধী পার্টিও পারেনি আমাকে মেরে ফেলতে। কিষ্ণ বা আমার লাশ ফেলে দেওয়া এতো সহজ নয়। আমরা মানুষের সঙ্গে ছিলাম আছি থাকবো। আমরা অমর, চলমান অশরীরী। কিষ্ণর ছিলো নারায়ণী সেনা, চলমান অশরীরীর ছিলো ব্যাণ্ডরসেনা, আমারও আছে বান্দরসেনা। সে যাই হোক, যে কথা বলছিলাম - তো কিষ্ণ যখন একটু বড়ো হলো, ওর মনেও একটু ইন্টুবিন্টুর ইচ্ছে হলো - তো ওর মনে হলো, ও তো এতো কালো, রাধা বা তার সখিরা ওকে কি ভালোবাসবে? মায়ের কাছে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকলো। বিরক্ত হয়ে ওর মা বললো – যা, রাধাকে গিয়ে বল, তার ইচ্ছেমতো রঙ যেন তোর মুখে মাখিয়ে দেয় – সেই থেকে হোলি –ইন্টুবিন্টু - রঙ মাখামাখি। সেই থেকে কিষ্ণ আর রাধা আমাদের সবচেয়ে পপুলার হিরো-হিরোইন।উত্তম-সুচিত্রা। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো, ওনারা বেঁচে থাকলে এমপি করে দিতাম, দুজনকেই একসাথে –লোকসভায় বাঙলা একের পর এক সুপারডুপারহিট স্টোরি দিতো। বাঙলা আবার ভারতসভায় সেষ্ঠ আসন নিতো। ইস্‌! হলোনা। নো পবলেম। আমি নতুন মহানায়ক মহানায়িকা তৈরি করেছি। তাদেরকে লোকসভায় পাঠিয়েছি। উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে আপনারা ভালোবাসেন। কিষ্ণকেও ভালোবাসেন।আমাকেও। জানি। কিষ্ণর মতো আমাকেও আপনারা শুধু ভালোই বাসেন না, পুজোও করেন, আমার ফটোতে রঙ মাখান – সেটাও আমি জানি।

বন্ধুরা, আপনাদের আর দেরি করাবোনা। ছুকছুক করছেন সবাই, বুঝতে পারছি। শুধু একটা কথা - এই দোল উৎসবে আপনারা যারা ভালোবাসতে যাচ্ছেন, রবিদার ওই ‘ঝুলন’ কবিতাটা মাথায় রেখে ভালোবাসবেন – যেখানে উনি বলছেন –

          ‘আয় রে ঝঞ্ঝা, পরানবধূর
           আবরণরাশি করিয়া দে দূর,
           করি লুন্ঠন অবগুন্ঠন-বসন খোল।
                                    দে দোল দোল।’

আমি চাইনা, রবিদার কোনো অসম্মান হোক। আমি চাই, তাঁর কথা যেন আপনারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তারপর ডেলোর মতো কোনো কেলো-টেলো হলে আমি দেখে নেবো। নির্ভয়ে যান বন্ধুরা।উৎসবে মেতে উঠুন। আর শেষ করার আগে আমার সেই প্রিয় সুভাষদার কবিতাটার মতো করে বলতে চাই –

  ফুল ফুটুক না ফুটুক     আজ বসন্ত
ভাত জুটুক না জুটুক      আজ বসন্ত
শিল্প আসুক না আসুক      আজ বসন্ত
কাজ মিলুক না মিলুক       আজ বসন্ত
ইজ্জত থাকুক না থাকুক       আজ বসন্ত

বসন্ত আসুক না আসুক     আজ উৎসব

                তাই
                         এপাং ওপাং ঝপাং

0 comments: