0

ব্যক্তিগত গদ্য : শৌনক দত্ত

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


বেডরুম, মধ্যরাত, বসন্ত...
শৌনক দত্ত 


বসন্ত যে এসে গেছে কেউ তা বলেনি। জানালার মরচেপড়া গ্রিল ধরে বাইরে তাকাই। রঙীন একটা শূন্যতা,বাতাসে বসন্ত গন্ধ।আমার মন ভালো নেই, এ বছর মা নেই। কোকিল ডাকছে। মা ছাড়া এর আগে আমি অনেক বসন্ত কাটিয়েছি, শিমূল গাছটি অবাক তাকায় আর বিস্ময়ে জানতে চায় প্রেমিকার কথা।আমার যে প্রেম নেই সে বসন্ত জানে। কিন্তু মা যে নেই তা বসন্ত জানে না।পলাশের রঙ মেখে চোখে যে দিকে তাকাই, মনে হয় আমার আকাশটা ছোট হয়ে যাচ্ছে রোজ। মা যে আকাশ, সে আমায় বসন্ত শিখিয়ে দিয়েছিলো। তখন বুঝিনি। আজ বুঝতে পারছি সে কথা! 

আমি সেবার গোটা মাস জুড়ে শান্তিনিকেতন। শীতের তীব্র ঠান্ডার পর হঠাৎ মৃদু শান্ত আর মিষ্টি একটি বাতাস গায়ে এসে লাগছে। টের পাই, এই বুঝি বসন্ত এসে গেছে। সেই প্রথম কোপাইয়ের ধারে বসে মনে হয়ছিলো লিখে রাখি কিছু!কি সব লিখেছিলাম আজ আর কিছুতেই তা মনে করতে পারিনা। অথচ মনে মনে লিখে ফেলতে ইচ্ছে করে বসন্তের 36 এপিটাফ। খুব ইচ্ছে করে নৈঃশব্দের আপন সুর বিরহ পাড়ার দেয়ালে রেখে লিখে দিই আনন্দ বসন্ত সমাগমে মেয়েমাছের হাসি। ইচ্ছে, তোমার ভেতর যাই। সেই বার কি এইসবই লিখেছিলাম... পোকাদের নীরব অথচ চঞ্চল মরণপ্রয়াসী আনন্দের মত কোন আদি কবির চোখে প্রথম ফুটে উঠেছিল বসন্ত রূপ, প্রথম ধরা দিয়েছিল ফাল্গুন, সে আখ্যান আমার লেখা সেইসব দিনের মতোই অজানাই রয়ে গেছে। 

সেবার শান্তিনিকেতনে থেকে মনে হয়েছিলো বাল্মীকি, ব্যাস, কালিদাস, জয়দেব কারও মধ্যেই তো বসন্তের রূপ খুব প্রকটভাবে চোখে পড়ে না। কোপাইয়ের ধারে বসে চুরি যাওয়া আলোয় সেবার কি গান গেয়ে উঠেছিলাম ভাবতে ভাবতে নিঃশব্দ কোমল হাহাকার ছুঁয়ে গেলো। আপন মনেই গেয়ে উঠলাম– আমার প্রাণের পরে চলে গেলো কে... বসন্তের বাতাসটুকুর মতো। খুব প্রিয় গানটিই কি সেইদিন গেয়েছিলাম? নাকি মা হারানো শীতকালের হাওয়া বসন্তের বাতাসে শূন্যতা ছুঁয়ে দিয়েছে? কাদম্বরীর মৃত্যুর পর লেখা এই গানে বসন্ত বাতাস কি তবে সুন্দরের ফিরে যাওয়া? তবে কি রবীন্দ্রনাথই বসন্তের প্রথম কবি? কিংবা অন্তত শ্রেষ্ঠ কবি? তাঁর মাঝে যেভাবে বসন্ত জাগ্রত হয়েছে, উন্মোচিত হয়েছে ফাল্গুন, তা পৃথিবীর অন্য কবিদের মধ্যে সেভাবে কোথায়?

মা বলতো আমার বসন্ত পূর্ণিমা আছে, আবীর-রাঙা ফাগুয়ার উৎসব আছে।পাহাড়ে পাহাড়ে রঙীন চেলি পরা সুন্দরীদের নাচ আছে। আমি বিমোহিত হয়ে যাই আর ভাবি বসন্ত ঈশ্বরের কী অপরূপ সৃষ্টি, কী অমর কবিতা। মা আজ নেই যেই ভাবি, তক্ষুনি মনে হয় তবে কি গ্যেটে শীতের অরণ্যে ফুল ফুটতে দেখেই বলে উঠেছিলেন-'আনন্দের মৃত্যু নেই'। সেই কি তবে গ্যেটের চোখে দেখা প্রথম বসন্ত, অনাবিষ্কৃত ফাল্গুনের রূপ আবিষ্কার? কিন্তু এলিয়ট তো এই এপ্রিলকেই বলেছিলেন- 'এপ্রিল ইউ দ্য ক্রুয়েলেষ্ট মান্থ! 'এপ্রিলও তো বসন্তই, এই বাংলার অতুলনীয়া, অসামান্যা বসন্ত।আমার মায়ের ভাবনার অমর কবিতা। 

আমাদের সময় ভালোবাসা দিবস বলতে কিছু ছিলো না। ছিলো সরস্বতী পূজা। সেও ফাল্গুনে। আজ অতীত হাতড়ে মনে হয়, সেইসব দিনে যে আপনি স্কুলে কলেজে ঘুর ঘুর করেছেন, বছর বিশ ত্রিশ পিছনে ফিরে গিয়ে সেই আপনি ও শিহরিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, ফাল্গুন মানেই ভালোবাসা। ভালো লাগার অনুভূতি। প্রেমিক প্রেমিকার চুম্বনের প্রথম পলাশ ফুল। মনে পড়ে যাচ্ছে কি বসন্তের সাথে জড়িয়ে থাকা কান্নাভেজা চোখ, না পাওয়া প্রেম, পাবার আনন্দ? ভালবাসায় ছুঁয়ে দেওয়া হাত? প্রথম শিহরণ, কত অকথিত কাহিনী, অকথিত প্রেম,অকথিত বিরহ! মনটা কি হু হু করে উঠলো বহুদিন দেখা না হওয়া প্রিয় বন্ধুটি কিংবা বান্ধবীটির কথা মনে পড়ায়? মনে পড়ে গেলো কি লুকিয়ে প্রথম সিনেমা দেখা দুজনের? 

বসন্ত এত মোহময়, এত সুরভিত, এত আর্দ্র, এত উন্মাতাল... কিন্তু পবিত্র, সমস্ত সুঘ্রাণ, সমস্ত সৌন্দর্য, সমস্ত রূপের মিলিত অবয়ব বসন্ত।

আকাশ ছোট হয়ে আসছে রোজ।মা নেই কোত্থাও। তবু মনে হয় এই বসন্তেই মা আমার ভিতর বাহির, মেঘমহলের সন্ধ্যাপ্রদীপ আমার সুখ দুঃখ শব্দ নৈঃশব্দ। তাই এই বসন্তে একচিলতে আকাশ দেখতে দেখতে শান্তিনিকেতন ভাবতে ভাবতে মা-হীনতাতেও মনে হয়, বসন্ত আছে বলেই হয়ত জীবন আজও বসন্তের মতো সত্য।

0 comments: